নতুন প্রজন্ম আর সিপিএমে আকৃষ্ট নয়! কী বলছেন শতরূপ, মীনাক্ষীরা?
CPIM West Bengal: ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৩ বছরে ডিওয়াইএফআই-এর সদস্য সংখ্যা বেড়েছে ২ লক্ষ ৩০ হাজারেরও বেশি। কিন্তু সদস্যসংখ্যা বাড়লেও ভোটবাক্সে তার কোনও প্রতিফলন পড়ছে না। কেন?
বামপন্থার প্রতি ঝোঁক কমছে তরুণ প্রজন্মের? তাহলে পুরনো প্রজন্ম শেষের সঙ্গে সঙ্গেই বামপন্থাও মৃত? নতুন প্রজন্মের যুবক-যুবতীরা আর সাম্যের প্রশ্নে ভাবিত নন? এত প্রশ্ন উঠছে প্রকাশ কারাটের একটি মন্তব্য ঘিরে। জানা গিয়েছে, সিপিএমের রাজ্য সম্মেলনে পার্টির পলিটব্যুরোর সমন্বয়ক প্রকাশ কারাট সংশয় প্রকাশ করে বলেছেন, তরুণ-তরুণীরা আন্দোলনে অংশ নিলেও দলের সদস্য হচ্ছেন না। তাহলে, সিপিএম নতুন প্রজন্মের সঙ্গে নিজেকে মেশাতে পারছে না? না কি নতুন প্রজন্মকে বেশি আকর্ষণ করছে অন্য রাজনৈতিক আদর্শ?
সিপিএমের তরুণ নেতা শতরূপ ঘোষ অবশ্য বলছেন তরুণরা পার্টির সদস্য হচ্ছে না একথা রাজ্য সম্মেলনে প্রকাশ কারাট বলেননি। ইনস্ক্রিপ্টকে শতরূপ বলেছেন, আরও বেশি সংখ্যক তরুণ সদস্যদের সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত করতে চেষ্টা করতে হবে বলেই জোর দিয়েছেন প্রকাশ কারাট। শতরূপের বক্তব্য, পার্টির সম্মেলন এই কারণেই করা হয়, যাতে আগামীদিনে পার্টিকে আরও শক্তিশালী করা যায়।
শতরূপ তো তরুণ তুর্কি! সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয়। নতুন প্রজন্মের সঙ্গে যোগাযোগও আছে তাঁর। সত্যিই কি বামপন্থার প্রতি ঝোঁক কমছে তরুণ প্রজন্মের? শতরূপ ঘোষের বক্তব্য, “বামপন্থার প্রতি ঝোঁক কমছে না বাড়ছে বলতে পারব না। তবে এটা তো শুধু সিপিএমের ক্ষেত্রে নয়, গোটা পৃথিবীতেই বিভিন্ন পরিস্থিতি রয়েছে। যেমন কোথাও কোথাও ফ্যাসিবাদের উত্থান হচ্ছে, আবার শ্রীলঙ্কার মতো দেশে নতুন করে বামপন্থীদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এক এক জায়গায় এক এক রকম পরিস্থিতি। পশ্চিমবঙ্গে বামেদের গণভিত্তি কমেছে এটা ঠিক। তবে সেটা বয়স্ক, যুব, মহিলা, পুরুষ সবার মধ্যেই কমেছে”।
আরও পড়ুন- মীনাক্ষীকে ঘিরে বাম যুবদের উৎসাহের সীমা নেই, তবু অতীতই ভবিষ্যতের অন্তরায়
পশ্চিমবঙ্গে ২০১১ সালের পর থেকে যে আঘাত ও আক্রমণের শিকার হয়েছে বামেরা, সেই সব বাধা পেরিয়ে গত আড়াই-তিন বছরে নাকি তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বামপন্থীদের জনপ্রিয়তা বেড়েছে বলেই মত শতরূপ ঘোষের। এই প্রসঙ্গে কোভিডের সময় রেড ভলেন্টিয়ারদের কার্যকলাপ ও ইনসাফ যাত্রায় তরুণদের এগিয়ে আসার কথাও উল্লেখ করেছেন যুব বামনেতা। শতরূপের দাবি, পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম ছাড়া আর কোনও দল নেই যারা যুব সংগঠনের ডাকে ব্রিগেড করতে পারবে। বাংলায় মুখ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর সভাতেও এত জমায়েত হয় না, যা বামেদের রাজ্য সম্মেলন বা ব্রিগেডে হয়।
গত কয়েকবছরে বামেদের ভরসাযোগ্য মুখ হয়ে উঠছেন মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। বামপন্থা ও তরুণ প্রজন্ম নিয়ে মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় খুবই আত্মবিশ্বাসী। বামপন্থার প্রতি তরুণদের ঝোঁক মোটেই কমছে না, বরং বাড়ছে বলেই বক্তব্য বঙ্গ সিপিএমের ক্যাপ্টেন মীনাক্ষীর।
পরিসংখ্যানও অবশ্য তাই বলছে। ডিওয়াইএফআই নেতৃত্ব জানিয়েছে, গত এক বছরে সিপিএমের এই যুব সংগঠনে ৫১ হাজার সদস্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৩ বছরে ডিওয়াইএফআই-এর সদস্য সংখ্যা বেড়েছে ২ লক্ষ ৩০ হাজারেরও বেশি। কিন্তু সদস্যসংখ্যা বাড়লেও ভোটবাক্সে তার কোনও প্রতিফলন পড়ছে না। কেন? অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে বামেদের মিটিং-মিছিলে সামিল হলেও, ভোটের লড়াইয়ে কি লাল ঝান্ডার উপর ভরসা করতে পারছে না মানুষ?
তৃণমূলের শ্রেয়া পান্ডে বলছেন, “২০১১ থেকে সিপিএম সেই অর্থে নেই। তাই বর্তমানের তরুণ প্রজন্ম সিপিএমকে সেভাবে দেখেনি বললেই চলে। এখন সিপিএম পার্টির কোনও জোর নেই। যে উন্নয়ন করবে, যে বাংলাকে সুরক্ষা দেবে তার সঙ্গেই মানুষ থাকবে। তাই বাংলার মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই বারবার বেছে নিচ্ছেন”। তবে, সিপিএমের কিছু তরুণ নেতৃত্বকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করেন বলেও জানান শ্রেয়া পান্ডে। দু-তিনজন তরুণ বাম নেতৃত্বের কথা, যুক্তি ভালো লাগে সাধন কন্যার। তাঁদের পাশে আছেন বলেও জানান শ্রেয়া। দলীয় প্রতীক বদলালে তাঁরা রাজনীতিতে এগোবেন বলেও একপ্রকার পরামর্শ দিয়েছেন শ্রেয়া পান্ডে।
আরও পড়ুন- নর-নারীর মিলন নিয়ে চিত্তপ্রসাদের স্বাধীন ভাবনা মেনে নেয়নি বামপন্থীরা
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত লোকসভা নির্বাচনে একাধিক তরুণ তুর্কিকে প্রার্থী করেছিল সিপিআইএম। তবে ভোটবাক্সে বিশেষ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। বামেদের ২৩ জন প্রার্থীর মধ্যে ২১ জনেরই জামানত জব্দ হয়েছিল। জামানত রক্ষা করতে পেরেছিলেন শুধু মহম্মদ সেলিম ও সুজন চক্রবর্তী। নতুন মুখেদের অবস্থা ছিল তথৈবচ।
হুগলির ডানকুনিতে সদ্য শেষ হয়েছে সিপিএমের ২৭তম রাজ্য সম্মেলন। ২২ থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি ডানকুনিতে শান্তি মঞ্চে সম্মেলন চলার পরে, শেষ দিনে ডানকুনি স্পোর্টিং ক্লাবে প্রকাশ্য সমাবেশ হয়। তার আগে শান্তি মঞ্চে গঠিত হয় নতুন রাজ্য কমিটি। রাজ্য সম্পাদক হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হয়েছেন মহম্মদ সেলিম। ৮০ জনের কমিটিতে ১৫ জন মহিলা। প্রগতিশীল, সাম্যের কথা বলা, নারী অধিকার, নারী সুরক্ষার কথা বলা পার্টির রাজ্য কমিটিতে মহিলা সদস্য সংখ্যা এত কম কেন? এই নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। যার উত্তরে অবশ্য নব নির্বাচিত রাজ্য সম্পাদক বলছেন, “আগে ১৪ জন মহিলা সদস্য ছিল। এবার সংখ্যাটা ১৫ হল। আরও বাড়াতে হবে। ধাপে ধাপে এগোব আমরা”।
সিপিএমে বৃদ্ধতন্ত্র ও মহিলাদের অবস্থান নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। অবশ্য এসব বিতর্কে কান দিতে নারাজ নেতৃত্ব। রাজ্য সম্মেলনের প্রকাশ্য সমাবেশ থেকে নবীন-প্রবীণ, কৃষক-শ্রমিক, মহিলা-পুরুষ সবাইকে একত্রিত করে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, তৃণমূল ও বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ার বার্তা দিয়েছেন প্রকাশ কারাট থেকে শুরু করে দেবলীনা হেমব্রম, মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় ও মহম্মদ সেলিমরা। কিন্তু বাস্তবের চিত্র থেকে কতদিনই বা মুখ ঘুরিয়ে থাকবেন বামেরা? প্রত্যক্ষ রাজনীতি না করা মানুষও জানেন, ক্রমেই ডানপন্থীদের দিকেই আকৃষ্ট হচ্ছে যুবসমাজ। আর যারা হচ্ছেন না, তারা উদাসীন থেকে যাচ্ছেন সংসদীয় রাজনীতি নিয়ে। ব্রিগেড ভরানোর ছবি, সম্মেলন থিকথিক করা ছবি দিয়ে আসলে ভ্রমে বাঁচছে না কি বামেরা?