যুগে যুগে দেশের শত্রু নির্ভীক সাংবাদিকতাই?
Freedom Of Speech in India: ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট থেকে শুরু করে এমারজেন্সি হয়ে আজকের সাংবাদিকতা! ভারতের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে?
সোহিনী দাস ও মধুরিমা দত্ত: একসময় গুহার দেওয়ালে আঁকিবুঁকি কেটে নিজেদের ইতিহাস, প্রথা, যাপনের চিহ্নগুলোকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বাঁচিয়ে রাখতে শিখেছিল মানুষ। ক্রমে তাকে পেয়ে বসল আবিষ্কারের নেশা। একদিন সে তৈরি করল নিজস্ব লিপি, অক্ষরমালা। পাথরে খোদাই করে কিংবা ধাতু কেটে কেটে লিখে রাখতে শুরু করল সেই সব লিপি। কখনও গাছের ছাল, কখনও বা গাছের পাতা, সে সব দিয়ে তৈরি হতে লাগল বিভিন্ন নথি-পুথি। তখনও কাগজের বালাই ছিল না। প্রাচীন রোমে রাজার আদেশ বা ঘোষণাগুলি ধাতু বা পাথরে খোদাই করে রাজ্যের এমন স্থানগুলিতে টাঙিয়ে দেওয়া হত, যেখানে মানুষের যাতায়াত বা ভিড় বেশি। প্রাচীন রোমে তাকে বলা হত 'অ্যাক্টা দিউরমা'। সংবাদপত্রের আদিতম রূপ বললে তাকে ভুল হয় না। চিনেও নাকি অষ্টম শতাব্দীতে 'কাইয়ুয়ান ঝা বাও' নামে এক দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ হত বলে শোনা যায়। তবে তা-ও ছিল রাজদরবারের খবরাখবর বিষয়ক। সিল্কের উপর হাতে লিখে তৈরি হত সেই পত্রিকা।
কিন্তু এসব তো রোম, চিন— অন্য মহাদেশের গল্প। ভারতীয় উপ-মহাদেশে প্রথম সাংবাদিকতা পেশাটির শুরু কিন্তু মুঘল আমলে। সে সময় সাংবাদিকদের বলা হত 'ওয়াকিয়া নবিশ'। ‘ওয়াকিয়া’ শব্দের অর্থ ঘটনা এবং ‘নবিশ’ শব্দটি ব্যবহার হত লেখককে বোঝাতে। মুঘল সম্রাট আকবরের আমল থেকেই শুরু হয় এই পেশার চল। প্রদেশের বিভিন্ন প্রশাসনিক অংশগুলিতে কেন্দ্র থেকে ওয়াকিয়া নবিশ নিয়োগের প্রথা ছিল। যাঁরা এলাকার প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে সমস্ত খবরাখবর রাজার কানে পৌঁছে দিতেন। মুঘল আমলের প্রায় শেষ অবধি এই প্রথা চালু ছিল। সরকারের সংবাদ লেখক এবং রাজদরবারের লেখক হিসেবেও কাজ করতেন এই ওয়াকিয়া নবিশরা। ক্রমে মুঘল জমানায় গুরুত্ব বাড়তে থাকে সাংবাদিকদের। তৈরি হয় সম্পূর্ণ আলাদা একটি দফতরও। লিখিত এবং মৌখিক— দু'ভাবেই খবর পরিবেশনের চল ছিল। জানা গিয়েছে, সেই সময়ে তিন ধরনের লিখিত বা মৌখিক সংবাদদাতা থাকতেন। প্রথম, ওয়াকিয়া নবিশ বা ওয়াকিয়া নিগার, যারা ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে তা নিয়ে লিখবেন। দ্বিতীয়, সাওয়ানিহ নবিশ বা সাওয়ানিহ নিগার, তাঁরা ঘটনার ধারাবিবরণী লিখতেন। আর তৃতীয়, খুফিয়া নবিশ বা গোপন লেখক। এই সময়কার সমস্ত ওয়াকিয়া নবিশের পদই ছিল রাজদরবারের থেকে বেতনপ্রাপ্ত। ফলে তাঁরা যে রাজার নিয়ন্ত্রণেই থাকবেন, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। সম্রাট আকবরের সময়ে আবুল ফজল রচিত 'আইন-ই-আকবরি' বইতে এই ওয়াকিয়া নবিশদের কাজের পরিধি নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনাও রয়েছে। সাংবাদিকের স্বাধীনতার সীমারেখাও ধার্য করা রয়েছে সেখানে। জানা যায়, ওয়াকিয়া নবিশ তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ছিলেন স্বাধীন। তবে সরকারি কোনও বিবরণ সুবাদারের কাছে প্রকাশ করার ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল তাদের উপরে। তবে সম্রাট ছাড়া রাষ্ট্রের আর কোনও কর্মকর্তার উপরে নির্ভরশীল ছিলেন না তাঁরা। শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় কাজেই নয়, সামরিক কাজেও যুক্ত করা হত সেসময় নবিশদের। সাংবাদিক এবং লিখিত সংবাদের প্রচলন থাকলেও মুদ্রিত সংবাদপত্রের জায়গা কিন্তু তখনও তেমন ছিল না। সম্রাট আকবরের সময় গর্ভনমেন্ট গেজেটের মতো রাজকীয় সমাচারপত্র প্রচলিত ছিল বটে তবে মুদ্রিত আকারে তেমন ভাবে জনগণের সংবাদপত্র তখনও তৈরি হয়নি। শোনা যায়, সম্রাট আরঙ্গজেবের অসুস্থতার কথা নাকি সেসময় 'পয়গম-এ-হিন্দ্' নামক একটি ফারসি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল।
আরও পড়ুন: সাংবাদিকদের উপর রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলার বিকল্প সংবাদমাধ্যমের সমস্বর
এরই মধ্যে ভারতে উপনিবেশ গড়ে ফেলল ব্রিটিশ শক্তি। ক্রমে কমতে থাকল নবাবী আমলের প্রতাপ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের আগে তেমন ভাবে এই উপমহাদেশে কোনও মুদ্রিত সংবাদপত্রের প্রমাণ ইতিহাসে মেলে না। ১৭৮০ সাল নাগাদ ভারতে প্রকাশ পায় এ দেশের প্রথম দৈনিক 'বেঙ্গল গেজেট' বা 'ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভার্টাইজার' নামে দুই পাতার একটি সাপ্তাহিক। যার নেপথ্যে ছিলেন জেমস অগাস্টাস হিকি নামে এক ইংরেজ সাহেব। স্থানীয় ইংরেজদের জন্য বানানো সংবাদপত্র, ফলে তা গোটাটাই ছিল ইংরেজি ভাষাতে। আর সেই ইংরেজ পত্রিকাতেই ওয়ারেন হেস্টিংস, তাঁর স্ত্রী ও ইংরেজ বিচারকদের সম্পর্কে সমালোচনামূলক লেখাপত্র ছেপে ফেললেন হিকি সাহেব। আর সে কারণে ইংরেজদের রোষের মুখেও পড়লেন তিনি। দ্রুত বাজেয়াপ্ত করা হল ভারতের প্রথম সংবাদপত্র 'বেঙ্গল গেজেট'-কে। প্রকাশের পরেই খর্ব হল ভারতবর্ষের প্রথম দৈনিকের বাকস্বাধীনতা। তবে এ অবশ্য প্রথম নয়। ব্রিটিশ ভারতে সংবাদপত্রের প্রথম সফল সূচনা ১৭৮০ সালে হলেও তার ঠিক এক যুগ প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল আগেই। সেটা ১৫৫০ সালে কথা। পোর্তুগিজরা গোয়ায় আসার সময় সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল একটি প্রেস মেশিন। সেই মুদ্রনযন্ত্রের মাধ্যমেই ১৫৫৭ সালে পোর্তুগিজ রাজা তথা গোয়ার জেসুইটের উদ্যোগে ছাপা হল প্রথম বই। তারপর অবশ্য ১৬৮৪ সাল থেকে কোম্পানির আওতায় থাকা ভারতের কোনও অঞ্চলেই আর কোনও সংবাদপত্র প্রকাশের চেষ্টা হয়নি। এরপর ১৭৬৮ সালে উইলিয়াম বোল্টস নামে জনৈক ওলন্দাজ ভারতবর্ষে প্রথম ছাপাখানা তৈরির করার পরিকল্পনা করলেন। কিন্তু বোল্টস ছিলেন কোম্পানির কর্মচারী। ছাপাখানা তৈরি করে উপরি কামাই করবেন একজন সাধারণ কর্মচারী, তা কেনই বা মেনে নেবে ব্রিটিশ সরকার। প্রাতিষ্ঠানিক আয়ের বাইরে গিয়ে উপরি রোজগারের রাস্তা বন্ধ করতে তাই রাতারাতি বরখাস্ত করা হল বোল্টসকে। চাকরি খুইয়ে বোল্টস তখন আরও স্বাধীন। ছাপাখানা খোলার পথে আর কোনও বাধা নেই তাঁর। তখন তাঁর মাথায় কিলবিল করছে ছাপাখানা খুলে একখানা পত্রিকা বের করার পোকা। কলকাতার কাউন্সিল হলে এ নিয়ে একটা বিজ্ঞাপনও সেঁটে বসলেন তিনি। স্বাভাবিক ভাবেই ব্যাপারখানা মেনে নিল না কোম্পানি। কোনও রকম ঝুঁকি না নিয়ে কোম্পানি তাঁকে ডেকে পাঠাল মাদ্রাজে, এবং সেখান থেকে তাঁকে সটান তুলে দেওয়া হল বিলেতের জাহাজে। ভারতের প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশের প্রচেষ্টা নষ্ট হল অঙ্কুরেই। সংবাদপত্রের জন্মই হল যেন শাসকের রক্তচক্ষু শাপখানা গায়ে মেখে।
এসময়ে 'ক্যালকাটা গেজেট' (১৭৮৪), 'বেঙ্গল জার্নাল' (১৭৮৫), কলকাতার 'ওরিয়েন্টাল ম্যাগাজিন' (১৭৮৫) , 'দ্য ক্যালকাটা ক্রনিকল' (১৭৮৬), 'মাদ্রাজ কুরিয়ার' (১৭৮৮), 'বোম্বে হেরাল্ড' (১৭৮৯)-র মতো বেশ কিছু ইংরেজি ভাষার পত্রিকা ও সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছে। তবে তার মধ্যে বেশিরভাগ কাগজই 'বেঙ্গল গেজেট'-এর পথে হেঁটে ইংরেজদের চটায়নি। তা সত্ত্বেও ১৭৯৯ সালে দেশে 'সেন্সরশিপ অফ প্রেস অ্যাক্ট' জারি করলেন লর্ড ওয়েলেসলি। ব্রিটিশদের ক্ষতি করতে পারে এমন কিছু যাতে ফরাসিরা প্রকাশ করতে না পারে, সেটাই ছিল আসল উদ্দেশ্য। এই আইনটি কার্যকর ররা আগে সমস্ত সংবাদপত্রকে সরকারি তদন্তের আওতায় নিয়ে আসা হয়। ১৮০৭ সালে পর্যন্ত কার্যকর ছিল আইন। সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, বইয়ের পাশাপাশি এই আইনের আওতায় পড়ত ছাপানো প্যামফলেটও। পরে লর্ড হেস্টিংসের আমলে সেই নিয়ম খানিকটা শিথিল হয় ।
১৮১৮ সালের গোড়ার দিকে রাজা রামমোহন রায়ের সহায়তায় শিক্ষক ও সংস্কারক গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক 'বাঙ্গাল গেজেট' প্রকাশ করলেন। এটিই ছিল বাংলা ভাষায় ও বাঙালি সম্পাদক-প্রকাশকদের পরিচালনায় প্রথম সংবাদপত্র। শুধু তাই নয়, এটিই ছিল সম্ভবত ভারতীয়দের সম্পাদনা-প্রকাশনা-পরিচালনায় প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র। ওই বছরেরই এপ্রিল মাসে ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিদের উদ্যোগে শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত হল বাংলা মাসিক পত্রিকা 'দিগদর্শন'। ওই বছর মে মাসেই প্রকাশিত হয় 'সমাচার দর্পণ'। যার সম্পাদক ছিলেন জন ক্লার্ক মার্শম্যান। কিন্তু তিনি ছিলেন নামমাত্র সম্পাদক। বাঙালি পণ্ডিতরাই আসলে 'সমাচার দর্পণ' সম্পাদনা করতেন। তবে এই পত্রিকাটির বিরুদ্ধে সামান্য খ্রিস্টান মতবাদ-ঘেঁষা হওয়ার অভিযোগ ছিল। শুধু 'বাঙ্গাল গেজেটে'ই থেমে না থেকে রামমোহন রায় একের পর এক 'বাংলা সমবাদ কৌমুদী', 'ইংরেজি ব্রাহ্মিনিক্যাল ম্যাগাজিন' ও ফার্সিতে 'মিরাত-উল-আকবর' প্রকাশ করতে লাগলেন। রামমোহন রায়ের প্রথম প্রকাশিত পত্রিকা ছিল ১৮০৩ সালে 'তাহাফত -উল-হুয়াহহিদ্দিন' বা 'একেশ্বরবাদীদের জন্য প্রদত্ত উপহার'। সাপ্তাহিক 'সমবাদ কৌমুদী' ছিল রামমোহন রায়ের দ্বিতীয় পত্রিকা। ১৮২১ সালের ৪ ডিসেম্বর প্রথম প্রকাশিত হয় এই সাপ্তাহিক। রামমোহন রায়ের বাকি ২টি পত্রিকা ছিল 'জান-ই-জাহাপনামা ও 'বেঙ্গল হেরাল্ড'। 'জান-ই-জাহাপনামা' প্রকাশিত হতো উর্দু ও ফার্সি ভাষায়। আর 'বেঙ্গল হেরাল্ড' প্রকাশিত হত মোট ৪টি ভাষায়। টানা ১৩ বছর প্রকাশিত হওয়ার পর ব্রিটিশ সরকার সংবাদপত্রের ওপর সেন্সরশিফ আরোপ করলে রামমোহন রায় এক পর্যায়ে পত্রিকা বন্ধ করে দেন। এ দেশে তিনিই প্রথম, যিনি সরব হয়েছিলেন সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে। ১৮২৩ সালে অস্থায়ী গভর্নর জন অ্যাডাম কঠোর প্রেস অর্ডিনেন্স জারি করলেন ভারতবর্ষ জুড়ে। হরণ করা হল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। তবে চুপ করে থাকলেন না রামমোহনেরা। এর প্রতিবাদে রামমোহন, দ্বারকানাথ ঠাকুর ও আরও কয়েকজন মিলে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করলেন। বিচারপতি সে আবেদন খারিজ করে দিলে তাঁরা ইংল্যান্ডের রাজার কাছে একটি আপিল পাঠান। পঞ্চান্ন পাতার দীর্ঘ সেই আবেদনে রামমোহন সবিস্তার জানান, মুদ্রনযন্ত্রের স্বাধীনতা কীভাবে অপহরণ করা হল। পাশাপাশি এই দমনমূলক আইন শাসক ও শাসিতের মধ্যে কতটা দূরত্ব তৈরি করবে তা-ও যুক্তি-সহকারে লিখে পাঠালেন রাজার দরবারে। রামমোহনের এই প্রচেষ্টা সাড়া ফেলল ইংল্যান্ডেও। তবে সেখানেও বাতিল হয়ে গেল এই আবেদন। তবে বিফলে গেল না তাঁর লড়াই। ১৮৩৮ সালে গভর্নর জেনারেল হয়ে আসার পর সংবাদপত্রের উপর নিয়ন্ত্রণ বিধি বাতিল করে দিলেন চার্লস মেটকাফে। ততদিনে অবশ্য রামমোহন আর বেঁচে নেই।
কিন্তু সংবাদপত্রের সঙ্গে শাসকের এই সংগ্রাম, এই রেষারেষি বেঁচে রইল আজীবন। ১৮৫৭ সালে শুরু হল সিপাহী বিদ্রোহ। সংবাদপত্রগুলোতে স্বভাবতই এ নিয়ে খবর প্রকাশিত হতে শুরু করল। লর্ড ক্যানিং খেয়াল করলেন, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান খবরের কাগজগুলো যেমন বিদ্রোহের একটি অংশকে সমর্থন করছে, তেমনভাবেই দেশীয় সংবাদপত্রগুলোও তাদের পছন্দমতো বিদ্রোহীদের সমর্থন জানাচ্ছে। আর তা রুখতেই দেশ জুড়ে বলবৎ করা হল 'দ্য লাইসেন্সিং অ্যাক্ট'। খর্ব করা হল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। কিন্তু ততদিনে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদের সলতে পাকানো হয়ে গিয়েছে অনেকটাই। ১৮৭৮ সাল নাগাদ ব্রিটিশ সরকার ভারতে জারি করল 'ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট'। ভারতীয় ভাষার সংবাদপত্র অর্থাৎ অ-ইংরেজি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করাই ছিল যার উদ্দেশ্য। ১৮৭৮ সালে লেগে গেল ইঙ্গো-আফগান যুদ্ধ। সে সময় ব্রিটিশ-বিরোধিতার জোয়ার উঠতে দেখা যায় দেশ জুড়ে। আর তাকে প্রতিহত করতেই অ-ইংরেজি সংবাদপত্রের উপর আরোপ করা হল বিধিনিষেধ। কারণ কে না জানে, 'এরা যত বেশি পড়ে, যত বেশি জানে, তত কম মানে।' তাই জানার রাস্তা বন্ধ করার সবচেয়ে বড় এবং সহজ রাস্তা সংবাদমাধ্যমের মুখ বন্ধ করা। আজও আমরা দেখি, গাজায় বেছে বেছে বোমা ফেলা হয় সমস্ত টেলিকম, ইন্টারনেট পরিষেবা সরবরাহকারী ভবনগুলির উপরে। যাতে গোড়াতেই ছিন্ন করে ফেলা যায় সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা। যাতে ভিতরের খবর বাইরে না পৌঁছতে পারে। মণিপুর বা জম্মু-কাশ্মীরেও কি আমরা সেই ছবিই বারবার দেখি না! ১৮৮১ সালে ভাইসরয় লর্ড রিপন ক্ষমতায় এসে এই আইন তুলে নেন। ততদিনে অবশ্য ইঙ্গো-আফগান যুদ্ধ শেষ। তবে এই 'ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট' প্রয়োগ কার্যত ছিল সেই দেশলাইয়ে কাঠিটির মতো, যার স্ফুলিঙ্গ ভারতবাসীকে সামান্য হলেও ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। পরবর্তীকালে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম অনুঘটকও হয়ে উঠেছিল এই ঘটনা।
রামমোহন যে লড়াই শুরু করেছিলেন, তা আসলে শেষ হওয়ার নয়। রামমোহনদের দেখানো পথ ধরে এরপর ব্রিটিশ ভারতে আত্মপ্রকাশ করেছিল অসংখ্য ছোটবড় সাপ্তাহিক ও দৈনিক সংবাদপত্র। 'সংবাদ প্রভাকর', 'সোমপ্রকাশ', 'তত্ত্ববোধনী', 'প্রবাসী', 'বন্দে মাতরম', 'নিউ ইন্ডিয়া', 'ধূমকেতু', 'লাঙল', 'অমৃতবাজার', 'যুগান্তর', 'বসুমতী'-র মতো বহু পত্রিকায় ক্রমে প্রবল হতে শুরু করল ইংরেজ বিরোধিতার ভাষা। সংবাদপত্র যত সরব হয়, ততই তার কণ্ঠরোধের চেষ্টায় উঠেপড়ে লাগে ব্রিটিশ সরকার। বারবার একের পর এক সংবাদপত্রের মালিককে গ্রেফতার করে আনে ইংরেজরা। চলে স্বাধীনতা হরণের প্রাণপন চেষ্টা। এরই মধ্যে ভাইসরয় লর্ড কার্জনের নির্দেশে ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর বাংলা ভাগ করার কাজ সম্পন্ন হল। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে পথে নামলেন দেশের সমস্ত বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ। বাংলার রাজপথ ভাসল জনস্রোতে। 'সঞ্জীবনী'র সম্পাদক কৃষ্ণকুমার মিত্রের মতো সাংবাদিকেরা ব্রিটিশ জিনিসপত্র বর্জন, শোক পালন ও সরকারি অঙ্গ-সংগঠনগুলির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য জনগণকে উদ্দীপ্ত করা শুরু করলেন। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বাংলায় যে আন্দোলনের নতুন জোয়ারের উঠেছিল, তা পাঞ্জাব, মধ্যপ্রদেশ, পুনে, মাদ্রাজ, বোম্বে ও অন্যান্য শহরগুলিতেও ছড়িয়ে পড়ে।
১৯০৬ সালের মার্চ মাসে সন্ধ্যার পর বৈপ্লবিক দলের জাতীয়বাদী মুখপত্র 'যুগান্তর' প্রকাশিত হয়। বারীন্দ্রনাথ ঘোষ, ভুপেন্দ্রনাথ দত্ত, দেবব্রত বসু অবিনাশ ভট্টাচার্য প্রমুখরাই ছিলেন তার প্রধান উদ্যোক্তা। ভূপেন্দ্রনাথ ছিল 'যুগান্তরে'র প্রধান কর্মী। সশস্ত্র বিপ্লব বা হিংসাত্মক সংঘর্ষের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা লাভের স্বপ্ন বুকে নিয়ে জন্ম তার। প্রথম তিন সপ্তাহ 'যুগান্তর' পার্টি মেম্বার প্রেসে ছাপা হত পত্রিকাটি। পরে ছাপা শুরু হয় নিজস্ব প্রেস থেকেই। জন্মের অল্প দিনের মধ্যেই জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় 'যুগান্তর'। এরই মাঝে ১৯০৭ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হল ব্রিটিশ সরকারের দেশীয় সংবাদপত্র দমন অভিযান। ২ জুনে প্রকাশিত কয়েকটি প্রবন্ধের জন্য সম্পাদককে চিঠি দেওয়া হল। ৩ জুলাই কার্যালয়ে চলল খানাতল্লাশি। ৫ জুলাই ভূপেন্দ্রনাথ নিজে পুলিশের কাছে গিয়ে ধরা দিলেন। 'যুগান্তরে'র আর্থিক দায়িত্ব বহন করতেন অবিনাশ ও লেখার দায়িত্ব ছিল ভুপেন্দ্রনাথের কাঁধে। কিন্তু সম্পাদক হিসাবে কেউ ছিলেন না। ভুপেন্দ্রনাথ নিজেকে সম্পাদক বলে দাবি করে যাবতীয় দায়দায়িত্ব নিজের উপরে নিলেন। ২২ জুলাই শুরু হল 'যুগান্তরে'র বিরুদ্ধে মামলা। ২৪ জুলাই বিচারপতি মামলার রায় দেন। রাজদ্রোহের অপরাধে ভূপেন্দ্রনাথের এক বছরের সশ্রম কারাদন্ড হল। কিন্তু 'যুগান্তরে'র যাত্রা থামল না। ফের নতুন প্রাণশক্তি নিয়ে প্রকাশিত হতে শুরু করল পত্রিকাটি। ওই বছরের অগষ্ট মাসে দ্বিতীয় বার খানাতল্লাশি চলল 'যুগান্তরে'র কার্যালয়ে। আসলে 'যুগান্তরে'র এই বৈপ্লবিক প্রচারে ভয় পেয়েছিল ইংরেজ সরকার। ওই বছরের শেষের দিকে ফের মামলা করা হল পত্রিকাটির বিরুদ্ধে। ফের চলল খানাতল্লাশি। বারবার পুলিশি আক্রমণের মাধ্যমে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্ঠা করা হল পত্রিকার ভিত। শুধু 'যুগান্তর' নয়, 'বন্দেমাতরম', 'সন্ধ্যা'-র মতো বহু পত্রপত্রিকা হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মুখ। 'যুগান্তরে'র মতো নানা ধরনের পুলিশি অত্যাচারের শিকার হয়েছে এইসব পত্রিকাও। চলেছে কণ্ঠরোধের চেষ্টা।
ভারতীয় মালিকানায় পরিচালিত সবচেয়ে পুরোনো ইংরেজি দৈনিক ছিল 'অমৃতবাজার পত্রিকা'। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি যশোর জেলার (অধুনা বাংলাদেশ) অমৃত বাজার গ্রামে এক বাংলা সাপ্তাহিক পত্ররূপে 'অমৃতবাজার পত্রিকা ' আত্মপ্রকাশ করেছিল। নীলকর সাহেবরা যে সকল কৃষককে শোষণ করত তাদের পক্ষে লড়াইয়ের জন্য ঘোষ ভাইয়েরা এই পত্রিকা শুরু করেছিলেন। এর প্রথম সম্পাদক ছিলেন শিশির কুমার ঘোষ। প্লেগ রোগের প্রকোপ দেখা দেওয়ার কারণে ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের ২১ শে ডিসেম্বর 'অমৃতবাজার পত্রিকা ' কলকাতার বৌবাজারে উঠে আসে। ইংরেজি এবং বাংলা দুই ভাষাতেই সংবাদ ও মতামত প্রকাশ করে এখানে এই পত্রিকা একটা দ্বিভাষিক সাপ্তাহিক হিসেবে চালু হয়। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মার্চ পর্যন্ত বৌবাজার থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। এর পর বাগবাজারে স্থানান্তরিত হয়। ক্রমে সরকার-বিরোধী মতামত এবং জনগণের মধ্যে বিপুল প্রভাবের ফলে সরকারের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াল এই 'অমৃতবাজার '। ভারতের ভাইসরয় লর্ড লিটন প্রধানত এবিপি-র বিরুদ্ধেই ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে ১৪ মার্চ 'ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট' প্রবর্তন করেছিলেন। কিন্তু শিশিরকুমার ঘোষ এই বাংলা পত্রিকাকে পরবর্তী ২১ মার্চ ইংরাজী সাপ্তাহিক পত্রিকায় পরিবর্তিত করেন। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ ফেব্রুয়ারি পত্রিকা একটা দৈনিক সংবাদপত্রে পরিণত হয়। ভারতীয় মালিকানার দৈনিক সংবাদপত্রের মধ্যে এটাই প্রথম অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা চালু করে। জানা যায়, লর্ড ল্যান্সডাউনের শাসনকালে এক পত্রিকা সাংবাদিক ভাইসরয়ের কার্যালয়ের পরিত্যক্ত কাগজের ঝুড়ি থেকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে একটা ছেঁড়া চিঠির অংশগুলো যোগ করেন, যাতে ভাইসরয়ের কাশ্মীর সংযুক্তির পরিকল্পনা ছিল। এবিপি চিঠিটা প্রথম পাতায় প্রকাশ করছিল, যেখানে কাশ্মীরের মহারাজা এটা পড়েছিলেন এবং সত্বর লন্ডনে গিয়ে তার স্বাধীনতার জন্যে তদ্বির করেছিলেন। শিশির কুমার ঘোষও সীমাবদ্ধ নাগরিক স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে প্রচণ্ডভাবে প্রচারে নেমেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন প্রশাসনে ভারতীয়দের গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হোক। তিনি এবং তার ভাই মতিলাল, বাল গঙ্গাধর তিলকের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে তিলক যখন রাষ্ট্রদ্রোহের কারণে অভিযুক্ত হন, তার পক্ষে দাঁড়ানোর জন্যে তারা কলকাতায় তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন। যে বিচারক তিলকের ৬ বছর কারাবাসের সাজা শুনিয়েছিলেন, তার বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করে সম্পাদকীয়ও প্রকাশ করা হয়েছিল কাগজে। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ চাপিয়ে দেওয়ার পরে অন্যান্য কাগজগুলির মতোই সরব হয়েছিল অমৃতবাজারও। ছাপা হতে থাকে একের পর এক আগুন জ্বালানো সম্পাদকীয়।
এরই মধ্যে ১৯০৮ সাল নাগাদ ভারতীয় সংবাদপত্রের উপর চাপল সংবাদপত্র (অপরাধের প্ররোচনা) আইন। যার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপের বিরুদ্ধ হত্যায় প্ররোচনার মতো অভিযোগ এনে যে কোনও প্রকাশনা সংস্থা বা সংবাদপত্র বাজেয়াপ্ত করতে পারত সরকার। সেই সুযোগে যুগান্তরের ছাপাখানা একেবারে নষ্ট করে দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। ১৯০৮ সনের ৬ জুলাই 'যুগান্তরে 'র সর্বশেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর ১৯১০ সাল নাগাদ ভারতের প্রায় সব ধরনের প্রকাশনার উপর জারি করা হল কঠোর সেন্সরশিপ। ভারতীয় স্থানীয় ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষার উপরেও উগ্র ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রভাব কমানোর জন্য কার্যকর করা হল এই ব্যবস্থা। এতই কঠোর ছিল সেই আইন, যে কেউ কোনও সংবাদপত্রে যদি কোনওরকম উগ্র জাতীয়তাবাদী নিবন্ধ লেখে, তাকে জেলের সাজা, এমনকী মৃত্যুদণ্ড দেওয়ারও সুযোগ ছিল ব্রিটিশদের হাতে। ১৯০৮-এর সংবাদপত্র আইন বলে বাংলার চারটি, পঞ্জাবের দু'টি ও বোম্বাইয়ের একটি ছাপাখানার মৃত্যু হয়েছিল। ১৯১০ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে বহু সংবাদপত্র ও ছাপাখানার কাছ থেকে চড়া হারে 'সিকিওরিটি' অর্থ দাবি করা হয়। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী সম্পাদকীয় ছাপার কারণে এবিপির কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা দাবি করা হয়েছিল। মতিলাল ঘোষের বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছিল। লবণ সত্যাগ্রহ চলাকালে এর থেকে ১০,০০০ টাকার উচ্চ জামানত দাবি করা হয়েছিল। এমনকী তৎকালীন সম্পাদক তথা শিশির ঘোষর পুত্র তুষার কান্তি ঘোষকে কারাদণ্ডও দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। ১৯১০ থেকে ১৯১৯-এর মধ্যে ৩৫০টি মুদ্রনযন্ত্র, ৩০০টি সংবাদপত্র ও ৫০০ বই বাজেয়াপ্ত করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তেজ বাহাদুর সাপ্রুর নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সুপারিশে ওঠে সেই ভয়ঙ্কর আইন।
এর মাঝখানেও সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের একাধিক চেষ্টা হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় সীমারেখা টানতে তৈরি হয়ে ভারতের প্রতীরক্ষা আইন ১৯১৫। ততদিন গান্ধিজি আফ্রিকা থেকে ফিরে এসেছেন ভারতে। ১৯১৭ সালে বিহারের চম্পারণে তাঁর নেতৃত্বে শুরু হল সত্যাগ্রহ আন্দোলন। অত্যাচারিত নীলচাষীদের পাশে দাঁড়িয়ে নীলকর সাহেবের বিরুদ্ধে শুরু হল বিপ্লব। পুলিশের কথা অমান্য করে গ্রেফতার হলেন গান্ধি। সেখান থেকে ক্রমশ গুজরাটে পৌঁছে গেল সত্যাগ্রহের আগুন। ইতিমধ্যে আবার ভারতীয়দের হিংসাত্মক আন্দোলন থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে রক্ষা করতে বিচারপতি রাউলাটের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের ‘সিডিশন কমিশন’বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেন। সেই সুপারিশ সমূহের ওপর ভিত্তি করে ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ মার্চ ব্রিটিশ সরকার এক সন্ত্রাসবাদ বিরোধী এবং দমনমূলক আইন প্রণয়ন করেন, যা ইতিহাসে 'কুখ্যাত' রাওলাট আইন হিসেবে পরিচিত। এই আইনে জনগণের স্বাধীনতা ও অধিকার হরণ করা হয় । সরকার বিরোধী যে-কোনো প্রচারকার্যকে দন্ডনীয় অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হয় এবং কোনো রকম সাক্ষ প্রমাণ ছাড়াই যে-কোনো সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে বিনা পরোয়ানায় ও বিনাবিচারে গ্রেফতার ও যতদিন খুশি আটক রাখার অবাধ ক্ষমতা ও ঘরবাড়ি তল্লাসির অধিকার সরকারকে দেওয়া হয়। এমনকী এই আইনের মাধ্যমে ভারতীয়দের ন্যায়বিচার লাভের অধিকার সম্পূর্ণভাবে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। স্বাভাবিক ভাবেই এই ভয়াবহ আইনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল দেশের সাংবাদিক থেকে শুরু করে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সব মানুষই। শুরু হয় প্রবল বিরোধিতা। সেই আইনের প্রতিবাদে , ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসরের জালিয়ান ওয়ালাবাগ উদ্যানে সমবেত হয়েছিলেন দশ হাজার মানুষ। কার্যত মৃত্যুকূপ বানিয়ে সেখানে গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিল জেনারেল ডায়ার। অসংখ্য সাধারণ মানুষকে নির্বিকার ভাবে হত্যা করা হয়েছিল সেদিন। ভারতীয়দের জাতীয় স্বার্থবিরোধী এই আইনের বিরুদ্ধে চারিদিকে তীব্র প্রতিবাদ গড়ে ওঠে । কেন্দ্রীয় আইন সভার সমস্ত ভারতীয় সদস্য প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন। মহাত্মা গান্ধি সর্বভারতীয় আন্দোলনের ডাক দেন । ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে ৩০ মার্চ এবং ৬ এপ্রিল গান্ধিজির ডাকে দেশব্যাপী বিক্ষোভ হরতাল পালিত হয় ও জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯২০ থেকেই গান্ধিজির নেতৃত্বে দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে সত্যাগ্রহ ও অসহোযোগ আন্দোলন।
মনে রাখতে হবে, গান্ধিজি কিন্তু শুধু একজন নেতা বা একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন না। দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকালীনই তাঁর হাতেখড়ি হয়েছিল সাংবাদিকতায়। ১৯০৩-০৪ সালে তিনি যোগ দেন 'ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন' নামক একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকায়। গান্ধিজি বুঝেছিলেন, আন্দোলন করতে হলে সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এগোতে হবে। আর মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের সহজ মাধ্যম সংবাদপত্র। তিনি তাঁর লেখনীর মধ্যমে তাঁর চিন্তা-ভাবনা, মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, জনগণের আবেগ প্রতিবাদ প্রকাশ করতেন। অনেকেই মনে করেন, গান্ধীজি তাঁর সত্যাগ্রহ আন্দোলন সফল করতে সক্ষম হয়েছিলেন সাংবাদিকতার জন্য। ১৯১৯ সাল নাগাদ মুম্বইয়ের 'ইয়ং ইন্ডিয়া' পত্রিকার সম্পাদক হন গান্ধি। এই সময়ে তিনি 'নাজীবন' নামক একটি গুজরাতি মাসিক পত্রিকার সম্পাদকেরও দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই পত্রিকাটি ১৯৩২ সাল অবধি চলেছিল। মোট ছ'টি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। 'ইয়ং ইন্ডিয়া' এবং 'নবজীবন' পত্রিকা দু'টি তিনি ব্যবহার করেছিলেন তাঁর মতামতকে ছড়িয়ে দেওয়া ও জনসাধারণকে সত্যাগ্রহ সম্পর্কে শিক্ষিত করার কাজে। ১৯৩৩ সালে গান্ধি ইংরেজি, গুজরাটি এবং হিন্দিতে যথাক্রমে 'হরিজন', 'হরিজনবন্ধু', 'হরিজনসেবক' নামে তিনটি সংবাদপত্র শুরু করেন। এই সংবাদপত্রগুলি ছিল গ্রামীণ এলাকায় অস্পৃশ্যতা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে তাঁর যুদ্ধের আয়ুধ। কোনও বিজ্ঞাপন না নিয়েই এই সংবাদপত্রগুলি চালিয়েছেন গান্ধি।
ততদিনে দেশ জুড়ে ব্রিটিশ বিরোধিতার ঝড় আরও প্রবল। গান্ধির নেতৃত্বে ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেল আইন অমান্য আন্দোলন। লবণ-কর বাতিল-সহ মোট এগারোটি দাবি ব্রিটিশ সরকারের কাছে পেশ করেছিলেন গান্ধি। তবে তা প্রত্যাখ্যান করে ইংরেজ সরকার। গভর্নর-জেনারেল লর্ড আরউইন কার্যত উপেক্ষাই করেছিলেন সেই আবেদন। এরপর ১৯৩০ সালের সবরমতি থেকে ডান্ডিমার্চ শুরু করেন গান্ধিজি। ১২ মার্চ যাত্রা শুরু করে ৬ এপ্রিল ডান্ডিতে পৌঁছয় যাত্রা। ক্রমে বড় আকার নিল সেই আন্দোলন। প্রমাদ গুনল ব্রিটিশ সরকার। গান্ধির সাংবাদিক সত্তার সঙ্গে ততদিনে তারা পরিচিত। কীভাবে সংবাদমাধ্যমকে মশাল করে এক এক করে বিদ্রোহের আগুন দেশ জুড়ে ছড়িয়ে চলেছেন গান্ধি, তা তারা দেখেছে সচক্ষে। ১৯৩১ সাল নাগাদ সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর ফের নামল আঘাত। এবার দেশ জুড়ে ইন্ডিয়ান প্রেস ইমার্জেন্সি অ্যাক্ট আরোপ করল ব্রিটিশ সরকার। আরও কড়া আইন। আরও সজোরে কষে চেপে ধরা হল সংবাদমাধ্যমের টুঁটি। বাড়ল সাজার পরিমাণ। গান্ধিজির আইন অমান্য আন্দোলন চলেছিল মোটামুটি ১৯৩৪ পর্যন্ত। তবে এই আইন জারি রইল দেশ জুড়ে প্রায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় পর্যন্ত। সরকারবিরোধী সংবাদপত্রগুলিকে দমাতে কোনও রকম চেষ্টার ত্রুটি করেনি সেসময়ের ব্রিটিশ সরকার।
সেটা ১৯২২ সালের কথা। ধূমকেতু পত্রিকার পূজো সংখ্যায় 'আনন্দময়ীর আগমনে' নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন কাজি নজরুল ইসলাম। আর সেই কবিতাকে ব্রিটিশ বিরোধী আখ্যা দিয়ে নজরুলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনে তৎকালীন সরকার। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর নজরুলকে প্রেসিডেন্সি জেল থেকে হুগলি জেলে স্থানান্তর করা হয়। সরকার তাকে এক বছরের কারাদণ্ড দেয়। কারাগারে থাকাকালীন, নজরুল এবং তার সহবন্দিরা বেঙ্গল পুলিশ প্রশাসনের অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে অনির্দিষ্টকালের অনশন শুরু করেন যা প্রায় ৩৯ দিন চলেছিল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কবিকে চিঠি দিয়ে অনশন প্রত্যাহারের অনুমতি জানান। বিরুদ্ধস্বর দেখলেই তাঁকে পিষে দেওয়ার যে প্রবণতা, তা দেড়শো বছরেও কি আদৌ বদলেছে? ভয়াবহ এক পরিণাম দিয়ে শেষ হয়েছে বিশ্বযুদ্ধ। দু'শো বছরের ব্রিটিশ পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীন হয়েছে দেশও। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সংবাদমাধ্যমকে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। দেশের গণতন্ত্র রক্ষায় ও সংবিধানমাফিক আইনের শাসন বজায় রাখতে প্রেস ও মিডিয়ার গুরুত্বকে তুলে ধরেছিলেন তিনি। দেশের সংবিধানের কারিগর ড. বি আর অম্বেদকরও কিন্তু সংবাদমাধ্যমের বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করেছেন সংবিধানে। ভারতীয় সংবিধানের ১৯ (১) (এ) অনুচ্ছেদে ভারতে সংবাদমাধ্য়মের স্বাধীনতাকে মৌলিক স্বাধীনতা হিসেবে বর্ণনা করেছে। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর ভারত কি সত্যিই সেই সংবিধানের সমস্ত কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনেছে। নাকি সেই ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কি আদৌ প্রতিষ্ঠা হয়েছে আজও?
সাল ১৯৭৫, ২৬ জুন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলি আহমেদ 'অভ্যন্তরীণ গোলযোগ'-এর ফলে জাতীয় নিরাপত্তার বিপন্নতার দোহাই দিয়ে ভারতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে দিলেন। অল ইন্ডিয়া রেডিওতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির গলা শুনছে গোটা দেশ, “রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন। এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।” আতঙ্ক যে কী, শিকল যে কী, স্বাধীন দেশে পরাধীন হওয়া যে কী মর্মে মর্মে টের পেয়েছিল মানুষ। মত প্রকাশের স্বাধীনতা যে আসলে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ইন্দিরা গান্ধির সরকারকে দেখে বুঝেছিল মানুষ। তাঁর শাসনে সাংবাদিক, বিরোধীদলীয় নেতা এবং কর্মীদের তখন জেলের অন্ধকারই ভবিতব্য। ছাপাখানায় তখন পুলিশি অভিযান চলছে, কাগজ ছাপা বন্ধ।
ইন্দিরার সরকার সারা দেশে সাংবাদিকদের জন্য কিছু মৌলিক নিয়ম বেঁধে দেয়। সাংবাদিকদের সরকারি নির্দেশিকা মেনে চলতে বলা হয়। অনেক নিয়মের মধ্যে, একটিতে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়, “যেক্ষেত্রে কোনও সংবাদ স্পষ্টতই বিপজ্জনক মনে হবে, সেখানে সংবাদপত্রগুলি নিজেরাই সেটিকে চেপে গিয়ে চিফ প্রেস অ্যাডভাইজরিকে সাহয্য করবে। যেখানে কোনওরকম দ্বন্দ্ব মনে হবে প্রেস অ্যাডভাইজরিকে তা জানাতে হবে।” দেশের সব সংবাদপত্রকেই কোনও লেখা প্রকাশ করার আগে চিফ প্রেস অ্যাডভাইজরি অনুমতি নিতে বলা হয়েছিল। মূলধারার অধিকাংশ সংবাদপত্র ও পত্রিকাই জরুরি অবস্থার এই বিপজ্জনক পরাধীনতার কবলে পড়ে। কারও কারও চাকরি যায়, কেউ কেউ জেলে যান। জেলা পর্যায়ের ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান-বিরোধী সংবাদপত্রগুলিও বন্ধ করে দিয়েছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা। বদলে প্রকাশিত হতো সরকারি গেজেট। অধিকাংশ সংবাদপত্রেরই প্রতিবাদের সাহস থাকে না। তখনও অধিকাংশের ছিল না, এখনও নেই। জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে অনেকেই কিছুই বলতে পারেনি কারণ বেশিরভাগেরই মালিকের টিকি বাঁধা সরকারি আনুকূল্যে।
যে কয়েকটি সংবাদপত্র প্রতিরোধ করেছিল, তার মধ্যে অন্যতম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, মালিক ছিলেন আর এন গোয়েঙ্কা আর দ্য স্টেটসম্যান, তখন এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন সিআর ইরানি এবং বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন বিখ্যাত আইনজীবী এনএ পালখিওয়ালা। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এবং দ্য স্টেটসম্যান প্রথম প্রতিবাদ করেছিল। প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এবং স্টেটসম্যান তাদের সম্পাদকীয় পাতা খালি রেখেছিল। আরও অনেক পত্রিকাই পরে এই পদক্ষেপ অনুসরণ করে। স্টেটসম্যানের সরকারি বিজ্ঞাপন স্থগিত করে দেওয়া হয়। নির্বাচনের পরে অবশ্য এই নিষেধাজ্ঞা সরানো হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তথ্য বলছে, ১৯৭৬ সালের মে মাসে প্রায় ৭,০০০ সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। বিরোধীদলীয় নেতারাও জেলে দিন কাটিয়েছিলেন একই কারণে। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন ভারতীয় জনতা পার্টির প্রবীণ মুখ, তৎকালীন জনতা পার্টির নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী। জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়ার পর আডবাণী দেশের গণমাধ্যমকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন: "আপনাদের কেবল ঝুঁকতে বলা হয়েছিল, কিন্তু আপনারা হামাগুড়ি দিয়ে ফেললেন।"
আরও পড়ুন- জরুরিতর অবস্থা
ইন্দিরার জরুরি অবস্থা পরবর্তী ভারতে সংবাদমাধ্যমে বিবিধ লগ্নি আসতে থাকে। সংবাদ আর শুধু কাগজে আটকে থাকে না। দেশে অডিও-ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে সংবাদ প্রতিটি মানুষের বসার ঘরে ঢুকে পড়ে। আরও কয়েক দশক পর, সংবাদ এখন মুঠোয়। সংবাদ এখন মোবাইলে মোবাইলে। ডিজিটাল মাধ্যম এসে সাংবাদিকতার ভাষা পাল্টে দেয় তুমুল। শাসকের হয়ে কথা বলার চল নতুন নয়। তবে তাঁকে কীভাবে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে হয় তা সাম্প্রতিক দশকে দেখেছে দেশ। সারা ভারতে প্রধানমন্ত্রীর কোলে বসা সংবাদমাধ্যম 'গোদি মিডিয়া' নামে এক পৃথক ঘরানা তৈরি করে ফেলে। সংবাদ দায়বদ্ধতার স্থান থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে হয়ে ওঠে নিছকই অন্য চাকরি। আদর্শ, নিরপেক্ষতা শব্দগুলি সাংবাদিকের অভিধান থেকে বাদ পড়ে যায় কারণ শাসকের দেওয়া মাস মাইনেতে জীবন চালাতে গেলে এর অতিরিক্ত বিদ্রোহের কোনও ঠাঁই হওয়ার কথাও না। ফলে এই দেশে মূলধারার সাংবাদিকতা বিকৃত ও বিক্রিত আর স্বাধীন সাংবাদিকদের ভবিতব্য হয় জেলের অন্ধকার কুঠুরি বা মৃত্যু!
ভারতের অন্যতম প্রবীণ টিভি নিউজ চ্যানেল এনডিটিভিতে সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের অভিযানের প্রতিবাদে সাংবাদিকরা জড়ো হয়েছিলেন। সাংবাদিক প্রণয় রায় নয়াদিল্লির প্রেস ক্লাব অফ ইন্ডিয়াতে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, "তারা আমাদের বলার চেষ্টা করছে, আপনারা কোনও ভুল না করলেও আমরা আপনাকে দমন করতে পারি। স্পষ্ট করে বলতে গেলে, এটি ভারতের সমগ্র স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের জন্য এক অশনি সংকেত।" সংকেত কতখানি বিপজ্জনক ছিল তা আদানি গোষ্ঠী এনডিটিভি অধিগ্রহণ পর্বেই বোঝা গিয়েছে। এনডিটিভিকে ভারতের অন্যতম বিজেপি বিরোধী স্বাধীন নিউজ নেটওয়ার্ক হিসেবেই দেখা হতো। এনডিটিভির কর্মীরা উচ্চকিত জাতীয়তাবাদ ওরফে হিন্দুত্ববাদের থেকে তফাতে থেকে সত্যের অনুসন্ধান করত। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং রয়টার্স ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ জার্নালিজমের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছিল, ৭৬% মানুষ এনডিটিভির তথ্য বিশ্বাস করে। এনডিটিভি আদানির হস্তগত হওয়া ভারতে সত্য সাংবাদিকতার মৃত্যুর দিকে ১০০ ধাপ এগনো।
একসময় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বলেই দিয়েছিলেন, দেশের সার্বভৌমত্ব অটুট রাখার জন্য মত প্রকাশের স্বাধীনতা অধীনে থাকা উচিত। এই 'উচিত’-কে বাস্তব করার বিবিধ প্রয়াস বিজেপি করেছে, করে চলেছে। ২০১৭ সালের ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে, ভারত তিন ধাপ নেমে ১৩৬ নম্বর স্থানে চলে যায়। ২০২৩ সালে প্রেস ফ্রিডম ইনিডেক্সে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১৬১! ২০২২ সালে ভারতের ঠাঁই ছিল ১৫০ নম্বরে। তথ্য বলছে, নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের এপ্রিল অবধি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ৫৪টি হামলা, টেলিভিশন নিউজ চ্যানেল নিষিদ্ধ করার অন্তত ৩টি মামলা, ৪৫টি ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ এবং ৪৫ জন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়েছে।
ছত্তিশগড় রাজ্যে ভারতের কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে কাজে লাগিয়ে সাংবাদিকদের গ্রেফতার, মৃত্যুর হুমকি দেওয়া এবং সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী এবং আইনজীবীদের উপর নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। নকশাল-মাওবাদী বিদ্রোহের কেন্দ্রস্থল হওয়াতে নিরাপত্তা বাহিনীর হিংসা এখানে বাড়াবাড়ি। ছত্তিশগড় স্পেশাল পাবলিক সিকিউরিটি অ্যাক্টের অধীনে যথেচ্ছ ধরপাকড় চলে এখানে।
গোদি মিডিয়ার বাড়বাড়ন্ত দেশে ভুয়ো খবরের আধিপত্যকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছে সেখান থেকে দেখলে সত্য শব্দটিকে বিন্দুও মনে হয় না। দেশ জুড়ে বিজেপির আনুকূল্যে বেড়ে ওঠা কিছু বিশিষ্ট মিডিয়া কোম্পানির আক্রমণাত্মক 'হাইপার-ন্যাশনালিস্ট' অবস্থান সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকতার পেশাকে নিছক খিল্লিতে রূপান্তরিত করেছে। পাকিস্তান, জেএনইউকে তুলোধনা আর গেরুয়াবন্দনের বাইরে জগৎ আঁধার! মিথ্যা ফুটেজ, অশ্লীল উপস্থাপন, ভুল তথ্যের রমরমায় এই গোদি মিডিয়া তাই বিজেপির অন্যতম বড় অস্ত্র। আর এই সংস্থাগুলিও রেটিং-ব্যবসায় পাল্লা দিতে শাসকের পদলেহনে কোনও কসুরই করে না। সত্যি সাংবাদিকতা তাহলে নিধিরাম সর্দার? গেরুয়াবাহিনী কীভাবে সত্য সাংবাদিকতাকে পিষে মারে দেখা যাক।
২৫,০০০ টাকা মাইনে, দিনে ১২ ঘণ্টা, সপ্তাহে ৬ দিন কাজ করতে হবে। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে কখনও কখনও, দিনে ১৪ ঘণ্টা এবং রবিবারেও কাজ। কী কাজ? বিভিন্ন সংবাদপত্র পড়তে হবে, টিভির বিতর্ক দেখতে হবে এবং সাংবাদিকদের টুইটার হ্যান্ডেলে ঈগলের মতো চোখ রাখতে হবে। অফিস ভারতীয় জনতা পার্টির কোনও অফিস। নির্বাচনের আগে যা 'ওয়ার রুম' হয়ে ওঠে। কর্মীরা বেশিরভাগই সাংবাদিক, আইনজীবী এবং আইআইটি এবং আইআইএম-এর স্নাতক। কেন এত নিরবিচ্ছিন্নভাবে সাংবাদিকদের টুইটার দেখতে হবে, সোশ্যাল মিডিয়া দেখতে হবে? কেন টিভির বিতর্ক পুঙ্খানুপুঙ্খ শুনতে হবে? এখানে চাকরি করতে এলে এত কারণ জানা চলে না। কারণ বলাও হয় না। ১২ ঘণ্টার কাজ। প্রথম চার ঘণ্টা সংবাদপত্র পড়া, তারপর পরের চার ঘণ্টা টিভির বিতর্ক দেখা। বাকি সময়ে সাংবাদিকদের সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেল দেখা। সন্ধ্যা নাগাদ সারাদিনের কাজের খতিয়ান দেওয়া। কোন সাংবাদিক বেশি বিজেপি-বিরোধী এবং মোদি-বিরোধী পোস্ট করেছেন তা নজরে রাখাটাই কাজ। সেই সাংবাদিকরা 'প্রাইম লিস্টে' চলে যান, তাঁদের উপর সবচেয়ে বেশি নজর রাখা হয়। রাজ্যওয়াড়ি তালিকা রয়েছে সকলের। এই পুরো কাজটা হয় বিজেপির একাধিক 'ওয়ার রুম'-এ বসে। এবং সারা দেশে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে এই কাজে বিজেপির উদ্যোগে নিয়োজিত। এই বিশাল কর্মকাণ্ডের পাশে নিধিরামের কী করণীয়? সে ভাতেও মরে, কাজেও মরে।
অথচ ২০১৪ সালে দায়িত্ব নেওয়ার এক মাস পরে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, "আমরা যদি বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে না পারি তাহলে ভারতের গণতন্ত্র টিকবে না"। দশবছরে গণতন্ত্রের শ্রাদ্ধ যে সমাধা হয়েছে তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে জনতা। সত্যি বললেই সহজ অস্ত্র ইউএপিএ। তারপর বাকিটা জেল-পুলিশ নিংড়ে নেবে। স্বাধীন সাংবাদিক খুব বিপজ্জনক হয়ে উঠতে থাকলে প্রথমে ইডি-সিবিআই, তাতেই না দমলে সোজা খুন! ঔপনিবেশিক যুগের রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের ব্যাপক ব্যবহার করেছে বিজেপি ভিন্নমতকে দমন করার জন্য। গত এক দশকে রাজনীতিবিদ এবং সরকারের সমালোচনা করার জন্য ৪০৫ জন ভারতীয়দের বিরুদ্ধে দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহের মামলাগুলির সিংহভাগই ২০১৪ সালের পরে নথিভুক্ত করা হয়েছিল, অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পরে। বিরোধী রাজনীতিবিদ, ছাত্র, সাংবাদিক, লেখক ও শিক্ষাবিদরা এই দমনমূলক আইনের খেসারত দিচ্ছেন।
ফ্রি স্পিচ কালেকটিভের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ২০২০ সালে ৬৭ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, প্রায় ২০০ জনকে শারীরিক আক্রমণ করা হয়েছিল। বিশেষ করে সরকারের সমালোচক মহিলা সাংবাদিকরা ভয়ঙ্কর অনলাইন ট্রোলিং এবং ধর্ষণ ও হত্যার প্রকাশ্য হুমকির মুখে পড়েছেন এই সময়কালে৷ গত এক দশকে সাংবাদিকদের জেল ও হত্যার সংখ্যা বাড়ছে। ১৯৯২ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে ভারতে ১৭ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছিল এবং দু'জনকে জেলবন্দি করা হয়েছিল। ২০১১ সাল অবধি চার জনকে গ্রেফতার এবং ১৬জন সাংবাদিককে হত্যার ঘটনা ঘটে। ২০১২ সাল থেকে প্রায় ৩০ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে এবং ৩৩ জনকে জেলে পাঠানো হয়েছে। ২০২১ এবং ২০২২ সালেই শুধু ৭ জন সাংবাদিককে জেল বন্দি করা হয়, যা তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।
ভারতে, সাতজন সাংবাদিক জেলে। আসিফ সুলতান, সিদ্দিক কাপ্পান, গৌতম নাভলাখা, মানান দার, সাজাদ গুল, ফাহাদ শাহ এবং রূপেশ কুমার সিংকে সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খোলার মাসুল গুনতে হচ্ছে। জম্মু ও কাশ্মীর জননিরাপত্তা আইন (পিএসএ) ব্যবহার করে কাশ্মীরি সাংবাদিক আসিফ সুলতান, ফাহাদ শাহ এবং সাজাদ গুলকে জেলে বন্দি করে রাখা হয়। কারাগারে আটক সাত সাংবাদিকের মধ্যে ছয়জনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইন বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনের (ইউএপিএ) অধীনে তদন্ত করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন- নতুন ভারতে ‘গোলি মারো…’ বলার বাকস্বাধীনতা আছে, প্রশ্ন তোলার নেই
আসিফ সুলতান জম্মু ও কাশ্মীরের কাশ্মীর ন্যারেটরের একজন সাংবাদিক। ২০১৮ সালের ২৭ অগাস্ট তাঁকে জেলবন্দি করা হয়। প্রাথমিকভাবে একটি ইউএপিএ মামলায় গ্রেফতার হয়েছিলেন কিন্তু এই মামলায় জামিন পাওয়ার পর ফের পিএসএ-র অধীনে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সিদ্দিক কাপ্পান, একজন মালয়ালম সাংবাদিক। ২০২০ সালের ৫ অক্টোবর তাঁকে উত্তরপ্রদেশে গ্রেফতার হয়েছিল। হাথরাসের ধর্ষণের খবর সন্ধানে গিয়ে সরকারের কোপে পড়েন তিনি। সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে জামিন দিলেও, অর্থ তছরুপে মামলা দিয়ে দেওয়া হয় ফের। গৌতম নাভলাখাকে ২০২০ সালের ১৪ এপ্রিল পুনে পুলিশ এলগার পরিষদের মামলায় গ্রেফতাআর করে। সাংবাদিক মানান দার, জম্মু ও কাশ্মীরে ২০২১ সালের ১০ অক্টোবর গ্রেফতার হন জঙ্গি ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে।
কাশ্মীর ওয়ালার সাজাদ গুলকে একটি প্রতিবাদের ভিডিও টুইট করার জন্য গ্রেফতার করা হয়। মামলায় জামিন পাওয়ার পর তাঁকে পিএসএ-এর আওতায় ফের আটক করা হয়। কাশ্মীর ওয়ালার ফাহাদ শাহকেও সেনাবাহিনী ভুয়ো খবর ছড়ানোর অভিযোগে গ্রেফতার করে। ঝাড়খণ্ডের সাংবাদিক রূপেশ কুমার সিংকে ২০২২ সালের জুলাই মাসে ইউএপিএ-র অধীনে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরে তাঁর বিরুদ্ধে আরও দুটি মামলা হয়।
কয়েক বছর আগে মধ্যপ্রদেশ পুলিশ এক সাংবাদিককে নগ্ন করে রাখে থানাতে! সাংবাদিক কনিষ্ক তিওয়ারি নীরজ কুন্দর নামে একজন থিয়েটার শিল্পীকে গ্রেফতারের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদের খবর করছিলেন। ভারতীয় জনতা পার্টির বিধায়ক কেদারনাথ শুক্লা এবং তাঁর ছেলে কেদার গুরুদত্ত শরণ শুক্লার একটি নকল ফেসবুক প্রোফাইল ব্যবহার করে অশালীন মন্তব্য করার অভিযোগে কুন্দরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কণিষ্ক তিওয়ারি নিউজ নেশন নিউজ চ্যানেলের একজন স্ট্রিংগার ছিলেন, এমপি সন্দেশ নিউজ ২৪ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলও চালান তিনি। মধ্যপ্রদেশ পুলিশ তাঁকে মারধর করে নগ্ন হতে বাধ্য করে, বলে ওই সাংবাদিক যদি বিধায়ক বা পুলিশের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করেন তাহলে নগ্ন করে ঘোরানো হবে তাঁকে।
এর কয়েক বছর আগে, ২০১৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর নরেন্দ্র মোদি সরকারের প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনার সমালোচনা করে টাইমস অফ ইন্ডিয়ার জয়পুর সংস্করণে একটি খবর বেরোয়। বিজেপির না-পসন্দ হওয়ায় প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সংবাদপত্রের ওয়েবসাইট থেকে তা সরিয়ে নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এর আগে টাইমস অফ ইন্ডিয়ার আহমেদাবাদ সংস্করণে গত পাঁচ বছরে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের সম্পত্তিতে ৩০০% বৃদ্ধি বিষয়ক সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সংবাদপত্রের ওয়েবসাইট থেকে খবর সরিয়ে দেওয়া হয়। সাংসদ তহবিলে স্মৃতি ইরানির বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ ওঠার খবরও সরিয়ে নেওয়া হয়।
জেল, নগ্ন করে রাখা, সংবাদ তুলে নিতে বাধ্য করার পাশাপাশি রাষ্ট্রের সমালোচনার, শান্তির কথা বলার দাম জীবন দিয়ে চুকিয়েছেন অনেকেই। কাশ্মীরের বিখ্যাত সাংবাদিক সুজাত বুখারিকে গুলি করে খুন করে দেওয়া হয়। কাশ্মীরের পার্বত্য, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ও শান্তি আনার কাজ করছিলেন সুজাত। ২০১৮ সালের ১৪ জুন শ্রীনগরে তাঁর অফিস থেকে বেরোতেই একটি মোটরসাইকেলে আরোহী তিনজন হামলাকারী তাঁকে গুলি করে। শ্রীনগর থেকে প্রকাশিত ইংরেজি ভাষার শীর্ষস্থানীয় দৈনিক রাইজিং কাশ্মীরের প্রধান সম্পাদক ছিলেন সুজাত বুখারি। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক সাক্ষাত্কারে, সুজাত বুখারি বলেছিলেন, ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী এবং বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষই বহু কাশ্মীরি যুবককে কঠিন-কঠোর করে তুলেছে।
তার একবছর আগে, ২০১৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর গৌরী লঙ্কেশ পত্রিকের মুখ গৌরী লঙ্কেশকে তাঁর নিজেরই বাড়ির সামনে একটি লোক মোটরসাইকেলে এসে গুলি করে মেরে ফেলে। দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন গৌরী, লড়েছিলেন কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে। কর্ণাটক পুলিশ ও মহারাষ্ট্র পুলিশ একসঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করে গৌরী লঙ্কেশ খুনের ঘটনায় ৬ জনকে গ্রেফতার করে। এই ছয়জনই একটি ডানপন্থী সংস্থার লোক, শ্রী রাম সেনি।
গতবছরই নিউজক্লিক ওয়েব পোর্টালের একাধিক সাংবাদিকের বাড়িতে, সংস্থার অফিসে পুলিশ হানা দেয়। বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনের বিভিন্ন ধারা এবং ষড়যন্ত্র (ধারা ১২০ বি, আইপিসি), ধর্ম, বর্ণের ভিত্তিতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা প্রচার করা এবং সম্প্রীতি নষ্টের জন্য ক্ষতিকর কাজ করার (১৫৩ এ) অভিযোগ তোলা হয় এর সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। পুলিশ জানতে চায় যে কেন দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে কথা লিখেছেন এই সাংবাদিকরা? এই ওয়েব পোর্টালের প্রতিষ্ঠাতা প্রবীর পুরকায়স্থ, পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা, ভাষা সিং, অভিসার শর্মাকে হেনস্থা করে পুলিশ। পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা আদানি গোষ্ঠীর দুর্নীতি নিয়ে নিয়মিত কাজ করে গেছেন। হিন্ডেনবার্গের আদানি বিষয়ক বিস্ফোরক রিপোর্টে উল্লিখিত একমাত্র ভারতীয় সাংবাদিক পরঞ্জয়ই। নিউজক্লিক নিয়মিত নির্বাচনী বন্ডের সমালোচনা করেছে। ফলে ইডি-সিবিআইয়ের নজরে পড়তেই হয়েছে তাদের।
আরও পড়ুন- কেন ‘দেশদ্রোহী’র তকমা পরঞ্জয়, অভিসার, ভাষাদের? আসলে ঠিক কী লিখতেন এই সাংবাদিকরা?
অল্ট নিউজ-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ জ়ুবেরের গ্রেফতারির ঘটনা মানুষ ভুলে যাবে না। ভুয়ো খবরের উল্টোপিঠে দাঁড়িয়ে সত্যি বলার খেসারত দিতে হয়েছে তাঁকে। ভারতের দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি, বিশেষ করে বিজেপি পরিকল্পিত ভাবে সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করছে নিজে প্রোপাগান্ডা ছড়াতে এবং সত্যকে বিকৃতভাবে পরিবেশন করতে। গুজব, ভুল খবর, অর্ধসত্য ছড়িয়ে রয়েছে চারদিকে। এই পাঁকের মধ্যে সত্যের অনুসন্ধান করেছিলেন মহম্মদ জুবেইর। ২০১৭ সালে জ়ুবেইররা অল্ট নিউজ় তৈরি করে ভুয়ো খবরের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন, প্রকৃত সত্য তুলে ধরতে থাকেন। জুবেইরের একটি টুইটে সাধুসন্তদের মানহানি করা হয়েছে বলে উত্তরপ্রদেশের সীতাপুর থানায় এক হিন্দুত্ববাদী অভিযোগ করা মাত্র তাঁর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে জুবেইরকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পুলিশ। সুপ্রিম কোর্ট সেই মামলায় জামিন দিলেও তাঁর সেই পুরনো টুইট নিয়ে একের পর এক অভিযোগের ভিত্তিতে আরও ৬টি মামলার জালে জড়িয়ে যোগী আদিত্যনাথ সরকারের পুলিশ তাঁর মুক্তি আটকে দেয়। পরে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সব ক’টি মামলায় জামিন পান জুবেইর।
কিন্তু এত ক্ষমতাশালী হলো কীভাবে দেশের শাসক? বিজেপি ক্ষমতায় এসে সরকারি বিজ্ঞাপনকে সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করা শুরু করে। কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের তথ্যই বলছে, ২০১৪ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়কালে কেন্দ্রীয় সরকার ইলেকট্রনিক্স সংবাদমাধ্যমকে ১,৬৫৬ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন দিয়েছে। কাগজ বা পত্রিকাগুলিতে দেওয়া হয়েছে মোট ১,৬৯৮ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন। অর্থাৎ প্রায় ৩,৩৫৪ কোটি টাকা সরকার ব্যয় করেছে বিজ্ঞাপনে। অফিস চালাতে, মাইনে দিতে যেখানে সরকারি বিজ্ঞাপনের উপর নির্ভর করতেই হয় সেখানে যদি টাকার বদলে শাসককে সন্তুষ্ট করে নিশ্চিন্তে বেঁচে থাকা যায়, কেন সেই পথ নেবে না অধিকাংশ মানুষ?
উমর খালিদ একবার বলেছিলেন, “বিজেপি সফলভাবে যা করতে পেরেছে, তা হলো তাদের বিরোধীদেরও তাদের ভাষায় কথা বলা।” বিরোধী কণ্ঠ কিনতে কোটি কোটি টাকা ব্যবহার করেছে কেন্দ্র। রাজ্যের শাসক তৃণমূলও বিরুদ্ধ খবর পরিবেশনকারীদের সঙ্গে এই আচরণই করেছে। সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়ে প্রকারান্তরে চাপ সৃষ্টি করে মত প্রকাশকে নিজের মুঠোয় শাসক চিরকালই রাখে। আদর্শ না পেট এই প্রশ্নে এসে যাবতীয় বিপ্লব গোঁত্তা খায়। বিবেককে বিক্রি না করার মতো মেরুদণ্ড যে কতিপয় মানুষের আছে, তাঁরা লড়ে যান তবু। গৌরী লড়ে যান, জুবেইর লড়ে যান। এই দুঃসময়ে পক্ষ একটা নিতেই হয়। সেটা সত্যের না পাঁকের – সেই বিচারই আমাদের প্রকৃত পরিচয়।