ফেডারেশনের দাদাগিরি আর মানবেন না পরিচালকেরা, কী ভবিষ্যৎ বাংলা সিনেমার?
Rahool-Fedaration Row: রবিবার রাতে রেক্টরস গিল্ডের তরফে সদস্যদের ফোনে পৌঁছে গিয়েছে বিজ্ঞপ্তি। অনির্দিষ্ট কালের জন্য কর্মবিরতির ডাক দিয়েছেন বাংলা ছবির পরিচালকেরা।
পুজোর ছবির একটা আলাদা অপেক্ষা সবসময়েই থেকেছে বাংলা সিনেমার দুনিয়ায়। তবে ২০২৪ সালে দুর্গাপুজোয় তেমনটা হবে কিনা বলা কঠিন। গত শুক্রবার থেকেই অচলাবস্থা জারি টলিপাড়ায়। কার্যত পরিচালকদের ক্ষোভে অনিশ্চয়তার মধ্যে বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ। সোমবার থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য কর্মবিরতির পথে বাংলা ছবির অধিকাংশ পরিচালকেরা। রবিবার রাতেই ডিরেক্টরস গিল্ডের তরফে বিবৃতি এই ঘোষণা জানানো হয়েছে।
সমস্যার শুরুটা অবশ্য হয়েছে দিন কয়েক আগেই। বেশ কিছু দিন ধরেই টলিপাড়ায় চর্চায় পরিচালক রাহুল মুখোপাধ্যায়। রাহুল মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে আপত্তি ফেডারেশনের। সে নিয়ে শনিবার দিনভর চাপানউতোর চলে। সোমবার শুটিং ফ্লোরে পরিচালক, প্রযোজক এবং অভিনেতারা এলেও আসেননি অন্য টেকনিশিয়ানরা। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আন্দোলনে নামেন টলিউডের পরিচালকেরা। ছিলেন কৌশিক গাঙ্গুলী, সৃজিৎ মুখোপাধ্যায়, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, সুদেষ্ণা রায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, রাজ চক্রবর্তীর মতো প্রথম সারির পরিচালক থেকে শুরু ইন্ডাস্ট্রির ছোটবড় বহু পরিচালকই। শনিবার রাতেই পরিচালকদের তরফে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়েছিল, সমাধানসূত্র না বেরোলে সোমবার থেকে কাজে না-ও যেতে পারেন তাঁরা।
বাংলাদেশি স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম 'লহু'র শ্যুটিং কলকাতায় শুরু করেছিলেন পরিচালক রাহুল মুখোপাধ্যায়। চারদিন কাজ হওয়ার পর শ্যুটিং বন্ধ হয়। ফেডারেশনের নিয়মের সঙ্গে মতের মিল হয়নি প্রযোজকদের। এরপর ফেডারেশনকে কিছু না জানিয়ে শুধুমাত্র ডিওপি নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশে ছবির বাকি কাজ শেষ করেন রাহুল। সেই নিয়েই ঝামেলার সূত্রেপাত। সেই ইউনিটের সঙ্গে প্রায় ৪০-৪৫ জনের রুজিরুটি জড়িয়ে। কারওর কথা ভাবেননি রাহুল, এমনই অভিযোগ করা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এ নিয়ে গিল্ডের তরফে রাহুলকে চিঠি ধরানো হলে পরবর্তীতে ক্ষমা চেয়ে নেন তিনি। রাহুলের উপর তিনমাসের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল ফেডারেশন অফ সিনে টেকনিশিয়ান ওয়ার্কার্স অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়া অর্থাৎ FCTWEI। আর এই নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়েছিল ২০ জুলাই থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত। এদিকে এরই মাঝে SVF-এর প্রযোজনায় প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ও অনির্বাণ ভট্টাাচার্যকে নিয়ে তাঁদের পুজোয় মুক্তি পাওয়া ছবির দায়িত্বে ছিলেন রাহুল মুখোপাধ্যায়। এদিকে রাহুলকে পরিচালকের আসনে বসানোয় সংগঠনের তরফ থেকে আপত্তি ওঠে, আর তাতেই শোরগোল পড়ে যায়। রাহুলকে সরিয়ে প্রযোজনা সংস্থার তরফে কার্যনির্বাহী প্রযোজকের আসনে বসানো হয়। তবে তাতেও আপত্তি ওঠে। অনেকেই এর প্রতিবাদ জানান।
আরও পড়ুন: বাংলা সিনেমায় ‘দলিত’ স্বর! যে অভাব পূরণ করল অর্ণ-অনির্বাণ-সোহিনীর অথৈ
বৃহস্পতিবার ডিরেক্টরস গিলডের তরফে বৈঠক ডাকা হয়। তারপরই শেষে পর্যন্ত রাহুল মুখোপাধ্যায়ের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। শুক্রবার পরিচালক সংগঠনের তরফে বৈঠকের পর দীর্ঘ বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছিল পরিচালকের আসনে ফিরতে পারবেন রাহুল। ডিরেক্টরস গিল্ড-এর তরফে এ কথা জানান সংগঠনের সম্পাদক খোদ সুদেষ্ণা রায়। কিন্তু তারপরেও বাধ সাধে ফেডারেশন অফ সিনে টেকনিশিয়ান ওয়ার্কার্স অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়া। ফেডারেশন অবশ্য ডিরেক্টরস গিল্ডের বৈঠকে হওয়া সিদ্ধান্তকে মান্য়তা দেয়নি। এরপর ওইদিনই সন্ধ্যায় বৈঠক ডাকেন ফেডারেশনের সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাস। তিনি জানান, পরিচালক হিসাবে নয়, কার্যনির্বাহী প্রযোজক হিসাবে তিনি SVF-এর পুজোর ছবির কাজে যুক্ত থাকবেন। স্বরূপ বিশ্বাস জানান, শনিবারই রাহুলের বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগ নিয়ে ফের সাংবাদিক বৈঠক করবেন তাঁরা। তাঁদের সাফ কথা, রাহুল অনৈতিক কাজ করেছেন বলেই শাস্তি হিসাবে তাঁর উপর ৩ মাসের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এরপর শনিবার কাউকে কিছু না জানিয়েই কর্মবিরতির ডাক দেন টেকনিশিয়ানরা। শনিবার পরিচালক, প্রযোজক এবং অভিনেতারা শুটিং ফ্লোরে হাজির থাকা সত্ত্বেও কাজ হল না একফোঁটাও। সারাদিন কাজে এলেন না অন্যান্য কলাকুশলীরা। সেই নিয়েই সমস্যা বাড়তে থাকে।
ফেডারেশনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেন রাজ চক্রবর্তী, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়রা। তাঁরা এই ঘটনায় ‘অপমানিত’ বলে দাবি করে পরিচালকেরা জানিয়ে দিয়েছিলেন, রাহুল মুখোপাধ্যায়ের উপর থেকে বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পরেও টেকনিশিয়ানরা ফ্লোরে পৌঁছাননি। ফেডারেশনের ‘দাদাগিরি’ নিয়ে নিজেদের বক্তব্য রাখেন তাঁরা। বিকাল গড়াতেই মুখ খুললেন ফেডারেশন সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাস। মন্ত্রী, অরূপ বিশ্বাসের ভাই এদিন জানান, ‘বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে’। রাহুল পরিচালকের আসনে থাকলে টেকনিশিয়ানরা শ্যুটিং করবেন? এই প্রশ্নের জবাবে স্বরূপ বিশ্বাস জানান, তাঁদের কাছে যে নথি আছে, সেখানে এসভিএফের ছবির পরিচালক সৌমিক হালদার, রাহুল মুখোপাধ্যায় নন। অর্থাৎ রাহুলকে বয়কটের সিদ্ধান্ত থেকে সরল না ফেডারেশন।
নিজেদের রুজিরুটির প্রশ্ন তুলে পালটা জবাব দেন ফেডারেশনের আওতায় থাকা ২৬টি ইউনিয়নের প্রতিনিধিরাও। দৈনিক ৭ থেকে ৮ হাজার কলাকুশলী ‘দিন আনি দিন খাই’ পরিস্থিতিতে টলিপাড়ায় কাজ করেন, কাজ বন্ধ হোক এটা কেউ চান না। বরং টেকনিশিয়নারা জানান, রাহুলের জন্য নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তাঁরা! ফেডারেশনকে না জানিয়ে কাজ করলে অসহযোগিতার অধিকার রয়েছে টেকনিশিয়ানদের। আইন মেনে প্রযোজনা সংস্থা শ্যুটিং করলে টেকনিশিয়ানরা কাজে যোগ দেবে। তাঁদের আরও প্রশ্ন, 'রাহুল অন্যায় না করলে অপরাধ স্বীকার করলেন কী করে?
রবিবার সকাল থেকেই ডিরেক্টর্স গিল্ডের সদস্যরা বিষয়টি নিয়ে দফায় দফায় আলোচনায় বসেন। জানা যায়, সেই আলোচনায় অগ্রজ পরিচালকদের সঙ্গে আলোচনা করে স্থির হয়, কলাকুশলীরা রাহুলকে নির্দিষ্ট ছবির পরিচালক হিসেবে মেনে না নিলে, তাঁর সঙ্গে শুটিং করতে রাজি না হলে পরিচালকেরা ২৯ জুলাই অর্থাৎ সোমবার থেকে অসহযোগিতায় যেতে বাধ্য হচ্ছেন। মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত এই অবস্থান থেকে তাঁরা নড়বেন না। পরিচালক গিল্ডের দাবি, “ফেডারেশন একটি ইন্ডাস্ট্রির একচ্ছত্র নিয়ামক সংস্থা হতে পারে না। ভুলভ্রান্তি, সমস্যা যাই হয়ে থাক, তার সমাধান না করে কাউকে জোর করে কর্মবিরতি নিতে বাধ্য করা অসাংবিধানিক। বিশেষত, ভুল বোঝাবুঝি থেকে আমাদের ডিরেক্টর্স গিল্ড রাহুল মুখোপাধ্যায়ের উপর আরোপিত কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে নেওয়ার পরেও যে ভাবে বাকি গিল্ডের কলাকুশলীরা অসহযোগিতার পথে হেঁটেছেন তা শুধু রাহুলের জন্য নয়, আমাদের প্রত্যেক পরিচালকের জন্য অপমানজনক এবং ক্ষতিকারক। আমাদের এই সিদ্ধান্তের ফলস্বরূপ আগামীতে যদি মাধ্যম নির্বিশেষে কোনও পরিচালক কোনও রকম সমস্যার মুখে পড়েন, তার পাশে সমস্ত পরিচালকরা দাঁড়াবেন, সেই অঙ্গীকারও আমরা করছি।” রবিবার রাতে রেক্টরস গিল্ডের তরফে সদস্যদের ফোনে পৌঁছে গিয়েছে বিজ্ঞপ্তি। সেখানে স্পষ্ট বাংলায় লেখা রয়েছে, ‘অধিকাংশ পরিচালক সদস্যের আবেগ ও মতামতকে গুরুত্ব এবং মান্যতা দিয়ে সংগঠনের কার্যকরি সমিতি আগামিকাল থেকে (২৯/১২/২০২৪) থেকে যতদিন না পর্যন্ত পরিচালকদের সমস্যার সুষ্ঠ সমাধান হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত বাংলা ভাষার সমস্ত শ্য়ুটিং ফ্লোরে সদস্যদের অনুপস্থিত থাকতে অনুরোধ জানাচ্ছে’। বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য ভাষার শ্যুটিংয়ে অবশ্য এই অনুরোধ কার্যকর হচ্ছে না।
ইতিমধ্যেই এই বার্তার প্রেক্ষিতে পরিচালকদের সই সংগ্রহ করা হয়েছে। সম্মতি জানিয়ে সই করেছেন, রাজ চক্রবর্তী, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, অনীক দত্ত, অতনু ঘোষ, দেবালয় ভট্টচার্য, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের মতো বহু পরিচালকই। এ দিকে টলিপাড়ায় হঠাৎ আসা এই সমস্যার জেরে শুধু যে বাংলা ছবি বিপাকে পড়েছে, তা-ই নয়, একই বাংলা সিরিয়ালগুলিও বিপদের মুখে। অচলাবস্থা শুরু হয়েছে সেখানেও। রবিবার অচলাবস্থার ইঙ্গিত পেতেই টলিগঞ্জের একাধিক সিরিয়াল ডবল ইউনিট নিয়ে সকাল থেকে শ্যুটিং শুরু করেছে। কারণ সিরিয়ালের ক্ষেত্রে সেইভাবে এপিসোড ব্যাঙ্কিং থাকে না। আর একদিন শ্যুটিং বন্ধ মানে সিরিয়ালের সম্প্রচার বন্ধের মুখে পড়তে পারে। সেই ঝুঁকি নিতে রাজি নন কেউ। মাসের চতুর্থ রবিবার যেখানে টেলিপাড়ায় ছুটি থাকে, সেখানে ডবল ইউনিট নিয়ে শ্যুট হয়েছে গত রবিবার। বিভিন্ন সিরিয়ালের পরিচালকেরা অবশ্য জানিয়েছেন, তাঁরা ডিরেক্টরস গিল্ডের সিদ্ধান্তে সঙ্গে আছেন।
আরও পড়ুন: বাংলা সিনেমার উচ্চতা থেকে পতন নিয়ে দু’চার কথা
এদিকে এই অশান্তির জেরে অনিশ্চয়তার মুখে রাহুল মুখোপাধ্য়ায়ের পুজোর ছবি। যদিও পরবর্তীতে SVF-এর সেই পুজোর ছবি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় পরিচালক সৌমিক হালদারকে। এরই মধ্যে একটি পক্ষের প্রশ্ন, রাহুলের এই ঘটনার সঙ্গে এসভিএফের মতো একটি প্রথম সারির প্রযোজনা সংস্থা জড়িত। তাই কি আন্দোলনের আকার এত বড়? এর আগেও অনেক ছবি, ধারাবাহিক, সিরিজ়ের শুটিং বন্ধ করে দিয়েছে ফেডারেশন। পরিচালকের কাজ থামিয়ে দিয়েছে। কেন সেসময় ডিরেক্টরস গিল্ডের তরফে সাড়া মেলেনি। যদিও পরিচালক দেবালয় ভট্টাচার্যের যুক্তি, “প্রথম সারির প্রযোজনা সংস্থার নাম জড়ানোর কারণে নয়, দীর্ঘ দিন সহ্য করার পর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে। তাই আন্দোলন ক্রমশ বড় হচ্ছে। এটা হওয়ারই ছিল। অবশেষে যে হচ্ছে, সেটাই আশার কথা।” তাঁর কথায়, “শুধুই তো বড় পর্দা নয়! ছোট পর্দার পরিচালক-প্রযোজকেরাও প্রায় প্রতি দিন ফেডারেশনের তৈরি নানা নিয়মের ফাঁসে আটকে যান। তাই তাঁদের যোগদানও স্বতঃস্ফূর্ত।"
সব মিলিয়ে বড়সড় অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গিয়েছে টলিপাড়া। পুজোর আগে মাথায় উঠতে বসেছে পুজোর ছবি থেকে শুরু করে ওটিটি এবং সিরিয়ালের কাজ। কোন পথে মিলবে সমাধানসূত্র, তা এখনও পরিষ্কার নয়। কয়েকটি সূত্র মনে করছে, এই পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করতে হতে পারে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়কেও।