কেন ভারতকে কোণঠাসা করল ফিফা? আতসকাচের নিচে প্রফুল্ল পটেল
প্রফুল্ল পটেল নাকি ফিফার কর্তা হিসেবে নিজের প্রভাব খাটিয়ে এই ব্যান সুনিশ্চিত করেছেন, এমনটাই জল্পনা।
ভারত যখন ঔপনিবেশিক শাসনের জাঁতাকলে বন্দি, তখন স্বাধীনতাকামী তরুণ সমাজের একাংশ জাতীয় চরিত্র-গঠনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরূপে দৈহিক কসরত এবং খেলাধুলোর প্রতি উৎসাহী হয়ে উঠেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে ভারতে গড়ে ওঠে একাধিক ফুটবল ক্লাব। ১৯১১ সালে গোরা সেপাইদের ক্লাবের বিরুদ্ধে বুট ছাড়া আইএফএ শিল্ড ফাইনালে মোহনবাগানের ঐতিহাসিক জয়ের প্রায় দুই দশক আগেই শোভাবাজার ক্লাব ১৮৯২ সালে জিতেছিল ট্রেডস ক্লাব। এফএ কাপ এবং স্কটিশ কাপের পরেই, অর্থাৎ ব্রিটেনের বাইরে, দুনিয়ার সবচেয়ে পুরনো ফুটবল টুর্নামেন্ট ডুরান্ড কাপ শুরু হয়েছিল ভারতেই। ক্রিকেটের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার পাশে যতই ফিকে দেখাক ভারতের ফুটবল-ক্রেজ, ঐতিহ্যের বিচারে ভারতের স্থান ফুটবলের ইতিহাসে যথেষ্টই গুরুত্বপূর্ণ।
১৮৯৩ সালে গঠিত আইএফএ বা ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন ছিল প্রধানত সাহেব-অধ্যুষিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর দু'বছর আগে ভারতের জাতীয় ফুটবল বডি অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন বা এআইএফএফ তার যাত্রা শুরু করে। পঁচাশি বছরের দীর্ঘ জীবনে এই প্রথমবার ফিফার ব্যানের মুখোমুখি হতে হলো ভারতের ফুটবল ফেডারেশনকে।
ফিফা তার নাতিদীর্ঘ বিবৃতির মাধ্যমে পরিষ্কার জানিয়েছে যে, তারা তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের কারণেই এআইএফএফকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। সঙ্গে যোগ করেছে যে এআইএফএফ-এর একজিকিউটিভ কমিটির যাবতীয় ক্ষমতা যে 'কমিটি অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটরস' বা সিওএ গ্রহণ করতে চলেছে, সেই সিওএ-কে গঠন করার আদেশটা রদ করে, এআইএফএফ-এর প্রশাসকদের রোজকার কাজের দায়িত্বে ফের বহাল করলেই ফিফা তুলে দেবে তাদের সাসপেনশন। বিবৃতিতে এও লেখা আছে যে, অক্টোবর মাসে ভারতে অনুষ্ঠিত হতে চলা মহিলাদের অনূর্ধ্ব ১৭ বিশ্বকাপ, অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। ভারতের ক্রীড়া মন্ত্রকের সঙ্গে নাকি ফিফা-র গঠনমূলক সম্পর্ক বজায় রয়েছে, এবং ফিফা আশাবাদী যে, ঘটনাটা ঠিকঠাক দিকেই গড়াবে।
আরও পড়ুন: ভারতীয় ফুটবলকে কতটা ধাক্কা দিতে চলেছে ফিফার নিষেধাজ্ঞা?
কিন্তু কী এমন ঘটেছে যে, ফিফাকে এত বড় একটা পদক্ষেপ নিতে হলো? আসলে ভারতের ফুটবল ফেডারেশনের এক্কেবারে মগডালে আজ সাড়ে বারো বছর ধরে স্থিত হয়ে রয়েছেন প্রফুল্ল মনোহরভাই পটেল। ২০১৬ সালে শেষবার প্রেসিডেন্ট পদের ভোটে বিরোধী-শূন্য অবস্থায় জেতেন পটেল। তারপর আর ইলেকশন হয়ইনি। ২০২০-র ডিসেম্বরে কথা ছিল ভোট হওয়ার। সেটা না হওয়ায় প্রফুল্ল পটেলই প্রেসিডেন্ট রয়ে গিয়েছেন। ভোট না হওয়ার পিছনে কারণ জানানো হয়েছিল, নতুন সংবিধানের সম্পাদনা অসম্পূর্ণ থাকার কথা। সংবিধান তৈরির পথে রাজনৈতিক লাল ফিতের প্যাঁচ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
অবস্থাটা নজরে আসে সুপ্রিম কোর্টের। সুপ্রিম কোর্ট, ভারতের স্পোর্টস কোড মাথায় রেখে, ১৮ মে ঘোষণা করে যে, তারা তিন সদস্যের একটি কমিটি অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর তৈরি করবে। এআইএফএফ-এর একজিকিউটিভ কমিটিসমেত, প্রফুল্ল পটেলকে পত্রপাঠ সরিয়ে দেওয়া হয়। তিন সদস্যের সিওএতে ছিলেন এককালীন চিফ ইলেকশন কমিশনার এস ওয়াই কুরেশি, সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন জজ অনিল দাভে এবং ভারতীয় ফুটবল দলের একসময়ের অধিনায়ক ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়। সিওএ-র দায়িত্ব ছিল নতুন সংবিধান সম্পাদনা সম্পূর্ণ করার, আর অবশ্যই ইলেকশন আয়োজন করার।
প্রফুল্ল পটেল হাল ছাড়ার লোক নন। তিনিও ফিফা-র একজিকিউটিভ কমিটির সদস্য হিসেবে রাজ্য স্তরের ফুটবল ফেডারেশনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখে চললেন। তাঁর এই নাক গলানোর চেষ্টায় বিরক্ত হয়ে সুপ্রিম কোর্ট রাজ্যস্তরের ফেডারেশনগুলোকেই হুঁশিয়ারি দিয়েছিল যাতে প্রফুল্ল পটেল কলকাঠি কিছুতেই না নাড়তে পারেন।
৩ অগাস্ট সুপ্রিম কোর্টে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, এআইএফএফ-এর যে নতুন একজিকিউটিভ কমিটি তৈরি হবে, তার নির্বাচনের জন্য যে ইলেক্টোরাল কলেজ গঠন করা হবে, তাতে থাকবেন ৩৬টি রাজ্য ফুটবল ফেডারেশনের প্রতিনিধি আর সঙ্গে থাকবেন ৩৬ জন প্রাক্তন ফুটবলার, যাঁরা অন্তত একটি করে ম্যাচ খেলেছেন জাতীয় দলের হয়ে এবং অন্তত দু'বছর আগে অবসর গ্রহণ করেছেন। এই খেলোয়াড়দের মধ্যে ২৪ জন হবেন পুরুষ দলের খেলোয়াড় আর ১২ জন মহিলা দলের।
ইলেক্টোরাল কলেজের এমন কম্পোজিশন ফিফার এবং এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের নীতির বিরোধী। অর্ধেক সদস্যই আদতে স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে যোগদান করুক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায়, এমনটা চায় না তারা। এতে নাকি ফুটবল ফেডারেশনের অসুবিধেই বাড়বে। তবে ফিফা জানায় যে, ইলেক্টোরাল কলেজে পঁচিশ শতাংশ সদস্য প্রাক্তন ফুটবলার হতেই পারেন 'কো-অপটেড মেম্বার' হিসেবে। কিন্তু নিজেদের অবস্থানে অনড় থেকে এআইএফএফ-এর নির্বাচন ২৮ অগাস্ট করার সিদ্ধান্ত নেয় সিওএ। ফিফা ভারতের ফুটবল ফেডারেশনকে ব্যান করে দেয় এরপর।
ব্যানের খবরটা অনেকেই জানতে পেরেছেন ১৬ অগাস্ট সকালবেলা। ১৬ অগাস্ট ভারতের ফুটবলের কালো দিন অনেক আগের থেকেই। ১৯৮০ সালের এই দিনেই ইডেন গার্ডেনসের সেই দুর্ঘটনায় পদপিষ্ট হয়ে ১৬ জন ফুটবল-প্রেমী প্রাণ হারান। তার ঠিক বিয়াল্লিশ বছর বাদেই জানা গেল ভারতের ফুটবল ফেডারেশনের সাসপেন্ড হওয়ার কথা।
ভারত একা নয় অবশ্য। এই তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের কারণে ফিফা ইরাক, নাইজেরিয়া, চাড, কুয়েত, গুয়াতেমালা, পাকিস্তানের মতো নানা দেশের ফেডারেশনকে এর আগে সাসপেন্ড করেছে। এই মুহূর্তে কেনিয়া আর জিম্বাবোয়ের ফুটবল ফেডারেশনও একই কারণে সাসপেন্ডেড।
অক্টোবরের অনূর্ধ্ব ১৭ মহিলা বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টের নতুন আয়োজকের খোঁজ তো শুরু হয়েছেই, পাশাপাশি ভারতের জাতীয় দল এখন কোনওরকম ফিফা প্রতিযোগিতায় বা ফ্রেন্ডলি ম্যাচে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। এএফসি এশিয়ান কাপের যোগ্যতা অর্জনপর্বে লড়াই করে ভারতের পুরুষ দল ওই প্রতিযোগিতায় নিজেদের জায়গা পাকা করেছিল অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। কিন্তু সেই টুর্নামেন্ট থেকে ভারতকে সরিয়ে দিয়েছে এএফসি। এটিকে মোহনবাগান, এএফসি কাপের ইন্টার-জোনাল সেমিফাইনালে উঠেছিল। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে খেলা ছিল তাদের। তা ঘিরেও রয়েছে একরাশ অনিশ্চয়তা। যেরকম অনিশ্চয়তা রয়েছে গোকুলম এফসি-র মহিলা দলের এএফসি উইমেন্স ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপ কাপে খেলা নিয়ে। গোকুলম প্রথম ভারতীয় ক্লাব হিসেবে এই প্রতিযোগিতায় খেলার সুযোগ অর্জন করেছিল। টুর্নামেন্টটা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। ২৩ অগাস্ট হওয়ার কথা গোকুলমের প্রথম ম্যাচ। সেটা বাতিল করা হয়নি এখনও ঠিকই, কিন্তু হওয়াটা খুব অস্বাভাবিক নয়। সুনীল ছেত্রীর বয়স এখন ৩৮। ফিফার সাসপেনশন খুব শিগগিরই না উঠলে, ভারতের আরেকটা বিশাল ক্ষতি সুনীল ছেত্রীর কেরিয়ারের গোধূলিবেলাটা এভাবে ছারখার হয়ে যাওয়া। সামনের বছরের এশিয়ান কাপটা হতে পারত আন্তর্জাতিক এক মেগামঞ্চে ছেত্রীর বর্ণময় কেরিয়ারের জ্বলজ্বলে সমাপ্তিরেখা। পরের এশিয়ান কাপ আসতে আসতে তাঁর বয়স হবে তেতাল্লিশ।
ভারতের ফুটবল ফেডারেশনই শুধু নয়, পাশাপাশি ভারতের হকি ফেডারেশন, অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন, জুডো আর টেবিল টেনিস ফেডারেশনকেও কোর্টের আদেশে তৈরি হওয়া প্রশাসনিক কমিটির আওতায় আসতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি ইতিমধ্যেই তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ আর ঠিকঠাক নির্বাচনী প্রক্রিয়া মেনে না চলার জন্য ভারতের অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনকে সাসপেন্ড করতে পারে বলে জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক হকি ফেডারেশনও জানিয়েছে যে, হকি ইন্ডিয়া এবং সম্পৃক্ত সিওএ-র সঙ্গে যদি তাদের ১৭ অগাস্টের মিটিং সন্তোষজনক না হয়, তাহলে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে উড়িষ্যায় অনুষ্ঠিত হতে চলা ফিল্ড হকি বিশ্বকাপও ভারতের বাইরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। কমনওয়েলথ পদক তালিকায় যতই চতুর্থ হোক ভারত, খেলার মাঠে নানা আন্তর্জাতিক লজ্জা একযোগে তাড়া করছে ভারতকে। এর দায় কিন্তু নিতে হবে ভারতের রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক মহলের কর্তাব্যক্তিদেরই।
সিওএ অবশ্য এখন দাবি করছে যে, এই ব্যান সুচিন্তিত একটি অন্তর্ঘাতের ফল। প্রফুল্ল পটেল নাকি ফিফার কর্তা হিসেবে নিজের প্রভাব খাটিয়ে এই ব্যান সুনিশ্চিত করেছেন। সুপ্রিম কোর্টে আবার কন্টেম্পট অফ কোর্ট নোটিশও জারি করা হয়েছে প্রফুল্ল পটেলের বিরুদ্ধে। সিওএ সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন জমা দিয়েছে, যাতে নিশ্চিত করা যায় যে, প্রফুল্ল পটেল আর কোনও ফুটবল-সংক্রান্ত পদ, ফিফাতে, এএফসিতে বা ভারতের মধ্যে, অধিকার না করতে পারেন কোনওদিন।
দেখা যাক, এই জল কতদূর গড়ায়। ফিফার সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি একটা সমঝোতায় এসে যদি নির্বাচনী প্রক্রিয়াতে প্রয়োজনীয় বদল আনা যায়, তাহলে হয়তো ক্ষতি খুব বেশি হবে না। যদিও অনূর্ধ্ব ১৭ মহিলা বিশ্বকাপ আয়োজনের সম্মানজনক সুযোগটা খুব নিশ্চিতভাবেই ফসকে গেল ভারতের হাত থেকে। ফুটবল এবং অন্যান্য খেলাগুলোতেও প্রশাসনিক স্তরে এত গোলযোগ নিশ্চয়ই ভারতীয় ক্রীড়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটা সর্বাঙ্গীন ওয়েক-আপ কল। সেই কলে গঠনমূলকভাবে সাড়া দিতে পারলে, আখেরে লাভ ভারতেরই।