কোন চালে মাত জার্মানি থেকে আর্জেন্টিনা? আশার আলো দেখাচ্ছে এশীয় ফুটবল
FIFA World Cup 2022: জাপানের ও সৌদি আরবের জয় যে মোটেই ফ্লুক নয়, তা বিশেষজ্ঞরাই স্বীকার করছেন।
পরপর দু'দিন আর্জেন্টিনা আর জার্মানিকে হারাল দুই এশীয় দেশ, যথাক্রমে সৌদি আরব ও জাপান। একই ফলাফলে, ২-১-এ। আর্জেন্টিনা মেসির করা পেনাল্টি গোলে এগিয়ে গেলেও সৌদি পরপর দু'গোল দিয়ে জয় ছিনিয়ে নেয়। প্রথম গোলটি করে আল সেহরি, দ্বিতীয় গোলটি করে আল দৌসরি। জার্মানি পেনাল্টি গোলে এগিয়ে গেলেও জাপান দ্বিতীয়ার্ধে প্রচণ্ডভাবে খেলায় ফিরে আসে। দুই পরিবর্ত খেলোয়াড় ডুয়ান ও আসানো চমৎকার গোল করে ফলাফল জাপানের অনুকূলে নিয়ে আসে।
এতদিন উত্তর কোরিয়া-র পুসকাসের ইতালির বিরুদ্ধে ১-০ গোলে জয়লাভকেই এশীয় টিমের সেরা সাফল্য বলে ধরা হত। তার পাশাপাশি এই দু'টি জয়কেও এবার থেকে রাখতে হবে। যদিও জাপান, কোরিয়া, বড় দলের বিরুদ্ধে আগেও জয় হাসিল করেছে।
সৌদি আরব ও জাপান একদিনে সাফল্যের মুখ দেখেনি। জে লিগে জিকোর খেলা দিয়ে জাপানের ফুটবলের নবযুগের সূচনা হয়। অনেক বিদেশি খেলোয়াড় জে লিগে আসতে শুরু করে। ফুটবলের বিশ্বায়ন ঘটছে তখন। জাপানের ও সৌদি আরবের জয় যে মোটেই ফ্লুক নয়, তা বিশেষজ্ঞরাই স্বীকার করছেন।
আরও পড়ুন: আবারও কি অঘটন? ‘খুদে’ সার্বিয়ার সঙ্গে টক্কর দিতে কতটা তৈরি ব্রাজিল
এবারের বিশ্বকাপে 'অফসাইড' ট্র্যাপ' বিরাট ভূমিকা নিয়েছে। আর্জেন্টিনা এই অফসাইড ট্র্যাপকে গুরুত্ব না দিয়ে বিরাট মাশুল দিয়েছে। তিনটি গোল নাকচ হয় সৌদি আরবের পাতা অফসাইড ট্র্যাপে। সৌদির রক্ষণের সব প্লেয়ার সমান্তরাল থাকার ফলে আর্জেন্টিনার ফরওয়ার্ডরা অফসাইড ট্র্যাপের কবলে পড়ে বারবার। স্বয়ং মেসিও সেটা স্বীকার করেছেন। ডি মারিয়ার মতো পোড় খাওয়া খেলোয়াড়ও এটা উপেক্ষা করেছে। ফলে তিন-তিনটি গোল নাকচ হলো।
আবার জার্মানির বিরুদ্ধে জাপানিরা দেখিয়ে দিয়েছে অফসাইড ট্র্যাপকে এড়িয়ে কী করে গোল করতে হয়। সবচেয়ে আশ্চর্য হতে হয়, ম্যানুয়াল নয়্যারের মতো বিশ্বখ্যাত গোলকিপার বলকে ফিস্ট করে বিপন্মুক্ত করতে পারছেন না দেখে। প্রথম গোলের সময় তো ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর একহাতে ফিস্ট করা বল জাপানি প্লেয়ারের পায়ে গিয়ে জমল। অতীতে বিশ্বকাপের আসরে জার্মান গোলকিপার অলিভার কানের ফিস্ট করা বল ব্রাজিলের ফরোয়ার্ড রোনাল্ডোর পায়ে পড়ে গোল খেতে হয়েছিল বিশ্বকাপ ফাইনালে। শুমাখারের মতো দক্ষ জার্মান গোলকিপারও ফিস্ট করতে ভুল করতেন।
যা হোক, বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে এশিয়ার জয়জয়কার দেখে এখনই উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। '৭৮ আর '৮৬-র আর্জেন্টিনাকে তখনকার এশীয় কোনও দেশ হারাতে পারে এটা কল্পনাতেই আনা যেত না। '৭৮-এর বিশ্বকাপ ফাইনাল বউবাজারের মেডিক্যাল কলেজ স্টুডেন্টস মেইন হোস্টেলের টিভিতে দেখেছিলাম। লুকে, কেম্পেস, বার্তোনির ত্রিফলা আক্রমণ সামলাতে পারেনি হল্যান্ডের রক্ষণভাগ। হল্যান্ডের নিসকেনস, আরি হান, রুড ক্রল, রব রেনসেনব্রিঙ্কের আক্রমণও যথেষ্ট ঝাঁঝালো ছিল। বস্তুত একস্ট্রা টাইমে ম্যাচটি যাওয়ার ঠিক আগে আগে রব রেনসেনব্রিঙ্কের গোলমুখী শট পোস্টে লেগে বাইরে না গেলে হল্যান্ডই চ্যাম্পিয়ন হতো সেবার। আর্জেন্টিনার গোলে উবাল্ডো ফিলোল, ডিফেন্সে ডানিয়েল পাসারেলা তখন দুনিয়া-কাঁপানো নাম। হল্যান্ডের নিসকেনস গোল করে দলকে এগিয়ে দিলেও মারিও কেম্পেসের জোড়াগোলের ফলে ৩-১ গোলে জেতে আর্জেন্টিনা। বউবাজার, ইডেন হসপিটল রোডে বেরিয়ে পড়ে আর্জেন্টিনার ডাক্তারিপড়ুয়া ভক্তরা। অতরাতেও দেখি কলকাতায় আর্জেন্টিনার ভক্তরা নেমে পড়েছে দলে দলে। ১৯৮৩-তে ভারতের ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়ের দিনেও দেখেছিলাম একই চিত্র। বাংলার খেলাপাগল জনতার মাতামাতি।
'৮৬-র বিশ্বকাপ দেখেছিলাম বাড়ির টিভিতে। তার আগে চুরাশিতে ফুলবাগানে নারকেলডাঙা মেন রোডের ডা. বি সি রায় মেমোরিয়্যাল পেডিয়াট্রিক হসপিটালে হাউসস্টাফশিপ করার সময় সল্টলেকের যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে '৮৬-র চ্যাম্পিয়ন টিমের অর্ধেক প্লেয়ারকে খেলতে দেখেছি নেহরু কাপে। ব্রাউন, বাতিস্তুতা, বুরুচাগা, ক্যানিজিয়ারা খেলে গেছে। আরও দুয়েকজনের নাম মনে পড়ছে না এই মৃহূর্তে। তাই মারাদোনা, ভালদানো, বুরুচাগা, ব্রাউন, বাতিস্তুতা, নেরি পম্পিদুদের '৮৬-তে বিশ্বকাপ জিততে দেখে মনে হয়েছিল যেন ঘরের টিমই বিশ্বকাপ জয় করল। পরবর্তীকালে বাংলায় যে আর্জেন্টিনা-অনুরাগ তৈরি হল, তার পিছনে '৮৪-র নেহরু গোল্ড কাপে আর্জেন্টিনার '৮৬-র বিশ্বজয়ী দলের হাফটিমকে খেলতে দেখার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা কাজ করেছে।
'৭৪-এর বিশ্বকাপ ফাইনালে জার্মানির সেপ মেয়ার, জার্ড মুলার, পল ব্রিটনার, ফ্রাঞ্জ বেকেনবাউয়ারদের খেলা দেখে মন তৃপ্তিতে ভরে গিয়েছিল। হল্যান্ডের কোচ রিনাস মিশেলের টোটাল ফুটবল তখন দুনিয়া কাঁপাচ্ছে। জোহান ক্রুয়েফদের দাপটে অন্যদলগুলোর ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। ক্রুয়েফের পেনাল্টি গোলে হল্যান্ড এগিয়ে গেলেও জার্মানির পল ব্রিটনার সমতা ফেরায়। তারপর সুযোগসন্ধানী ফরোয়ার্ড জার্ড মুলার জয়সূচক গোল করে। এই জার্মানি দলকে নিশ্চয় তখনকার জাপান হারাতে পারত না। সেসময়ের ফলাফলও সেকথাই প্রমাণ করে।
মেসি, ডি মারিয়া, নিকোলাস ওতামেন্দি, ক্রিস্টিয়ানো রোমেরো, দে পল, পারেদেস, মার্টিনেজদের এই আর্জেন্টিনা সৌদির কাছে হারায়, একথা প্রমাণ হলো ফুটবলে নামী দেশ ও অনামী দেশের মধ্যে তফাতটা আস্তে আস্তে কমে আসছে। তৃতীয় বিশ্বের অনেক ফুটবলারই এখন উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন ক্লাবে খেলেন। নিজেদের দেশের ফুটবল প্রতিযোগিতাতেও অনেক বিদেশি ফুটবলের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার সুযোগ পায়। পারস্পরিক দক্ষতার ফারাকটা আস্তে আস্তে কমে আসছে বলেই মনে হয়। এর সঙ্গে বিদেশি কোচের ভূমিকাও আছে। বিদেশের বহু ক্লাবে কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা তাঁরা তৃতীয় বিশ্বের দেশে কাজে লাগান। এইভাবে ফুটবলের গ্লোবালাইজেশন তথাকথিত বড়ো ও ছোট দেেশের ফুটবলের সার্বিক মানের তফাতটা ক্রমশ কমিয়ে আনছে। তবে ধারাবাহিকতা দেখাতে না পারলে একটি-দু'টি জয় দিয়ে বাজিমাত করা সম্ভব নয়। আর্জেন্টিনা, জার্মানি বড় দল। তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে হয়তো ঘুরে দাঁড়াবে। শেষ চারেও পৌঁছে যেতে পারে।এই ধারাবাহিকতা অর্জন করাটাই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির কাছে বড় চ্যালেঞ্জ।
সৌদি আরব আর জাপানকে এশিয়ার মুক্তির সূর্য বলে ডাকা সেদিনই সার্থকতা লাভ করবে। ভারতীয় ফুটবল ফ্যানদের এখনও বিদেশি দলের সাফল্যেই গলা ফাটিয়ে যেতে হবে, কেন না বিশ্বস্তরে উঠতে গেলে ভারতকে অনেক রাস্তা পেরতে হবে। চিরিচ মিলোভান ভারতীয় ফুটবলে যে পেরেস্ত্রোইকার খোলা হাওয়া এনেছিলেন, পরবর্তীকালে তা ধরে রাখা যায়নি। তাই একসময়ের এশিয়ান গেমসের সোনাজয়ী দলকে সৌদি আরব ও জাপানের সাফল্যে নাচানাচি করতে হচ্ছে। ইন্ডিয়ান সুপার লিগে (আইএসএল) বিদেশি ফুটবলারদের ভিড়। ঘরোয়া ফুটবলে ভারতীয় নামী দলগুলোতেও তাই। নিজের দেশের ফুটবলারদের উন্নতি ঘটাতে না পারলে শুধু টাকা ছড়িয়ে কী লাভ?