মৃত্যুর পরেও যেন হেঁটে যেতে পারি...

Buddhadeb Bhattacharjee: আসলে নিজস্ব আদর্শ, নিজস্ব জীবনধর্মে আজীবন অটল ছিলেন বুদ্ধবাবু। সেখান থেকে নড়ানো গেল না তাঁকে আজও।

ক্ষমতা মানুষকে ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্য, বিলাসবহুল যাপনের দিকে ঠেলে দেয়। সুবিধা নিতে শেখায়। অন্তত আজকের দিনের রাজনীতিকদের ক্ষেত্রে এমনটা তো আখছারই ঘটে। ক্ষমতাসীন শাসকদলের মন্ত্রীর বিলাসবহুল ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয় কোটি কোটি টাকা। সামান্য ক্ষমতা স্থানীয় নেতাকে ভাবতে শেখায় সর্বেসর্বা, প্রভাব খাটিয়ে এলাকার জমিজমা লুঠ থেকে নারীদের অমর্যাদা, সবটাই করে চলে সেই 'সামান্য' ক্ষমতার দাপটে। এ সমস্ত দেখতে দেখতে চোখ ঝলসে যাওয়া সমাজ যখন পিছনে ফিরে তাকায়, চোখ যায় পাম অ্যাভিনিউয়ের একরত্তি ফ্ল্যাটে সারাটা জীবন কাটিয়ে যাওয়া এক নেতার দিকে। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি, সাদামাটা পোশাক, সাদামাটা জীবন তাঁকে ছেড়ে যায়নি এমনকী মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেও।

পাম অ্যাভিনিউয়ের সেই বাড়ির চারপাশে ভিড়। বৃহস্পতিবার সকালে প্রয়াত হয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও বামপন্থী নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। মার্ক্সিও দর্শন শিখিয়েছিল সাম্যবাদের মন্ত্র, দেখিয়েছিল যৌথ খামারের স্বপ্ন। আর সেই স্বপ্নে নিজে লুটেপুটে নেওয়ার, নিজের জন্য সঞ্চয়ের ধারণাটাই নেই। ফলে মৃত্যুর পরেও যা কিছু একান্ত ভাবে নিজের, তা-ও অন্যের জন্য দান করে গেলেন তিনি। বৃহস্পতিবার সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম জানিয়েছেন, মরনোত্তর দেহদান করে গিয়েছেন বুদ্ধদেব। দান করে গিয়েছেন নিজের চোখদু'টিও। যে চোখ দু'টি দেখেছে বিস্তর দুনিয়াদারি। ক্ষমতা দেখেছে, ক্ষমতাচ্যুত হওয়া দেখেছে, সাফল্য দেখেছে, ব্যর্থতাও দেখেছে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ঘটনার পর যে দাগ তাঁর সাদা ধুতিতে লেগেছিল, সেই ব্যর্থতা, অভিমান বুকে নিয়ে একদিন রাজনীতি ছেড়েছিলেন বুদ্ধবাবু। পরে সময়ের কষ্টিপাথরে প্রমাণ হয়ে গিয়েছে, সেদিনও ভুল ছিলেন না বুদ্ধবাবু। রাজনীতিক হিসেবে, দেশের প্রশাসক হিসেবে তাঁর কর্মপদ্ধতি বা সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকতেই পারে, তবে মানুষ হিসেবে যে খুঁত ছিল না তাঁর, তা বরাবার নিজের জীবনধর্মে প্রমাণ করে দিয়েছেন তিনি।

আরও পড়ুন: নিঃশব্দে যে যায় লাল পতাকা মুড়ে… বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যা শিখিয়ে গেলেন বাংলাকে

বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা বেজে ২০ মিনিটে তাঁর পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতেই প্রয়াত হন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সেই খবর পাওয়ার পরেই সেখানে পৌঁছন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সেলিম। তিনি জানিয়েছেন, ‘‘সাড়ে ১২টা পর্যন্ত বাড়িতেই রাখা থাকবে ওঁর দেহ। দেশের নানা প্রান্ত থেকে অনেকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতে আসবেন। তাই আজ শেষযাত্রা করা সম্ভব হবে না। দিল্লি এবং উত্তরবঙ্গ থেকে যাঁরা আসবেন তাঁরা রাতেই সফর করে পৌঁছবেন। তাঁদের জন্য সংরক্ষণ করা হবে ওঁর দেহ। কাল (শুক্রবার) সকালে আলিমুদ্দিনে নিয়ে যাওয়া হবে।’’ বুদ্ধদেবের চক্ষুদান প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরে তাঁর দেহ নিয়ে যাওয়া হবে পিস ওয়ার্ল্ডে। সংরক্ষণের জন্য। শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ৩১, আলিমুদ্দিন স্ট্রিট, সিপিআই(এম) রাজ্য দফতর মুজফফর আহমদ ভবনে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য শায়িত থাকবে তাঁর মরদেহ। এর পর সেখান থেকেই বিকেল ৪টে নাগাদ বুদ্ধদেবের মরদেহ নিয়ে শোকমিছিল করা হবে। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে মরণোত্তর দেহদান করা হবে।

প্রেসিডেন্সি কলেজে সাহিত্য নিয়ে পড়ার সময় থেকেই সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বাড়িতে একটা রাজনৈতিক পরিমণ্ডল তো ছিলই। কাকা সুকান্ত ভট্টাচার্যের যোগ্য় উত্তরসুরি বুদ্ধদেব বরাবরই ভালো লিখতেন। সারা জীবনে অসংখ্য কবিতা লিখেছেন, লিখেছেন নাটক। অনুবাদেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ১৯৬৬ সালে সিপিএমের প্রাথমিক সদস্যপদ পান বুদ্ধবাবু। ১৯৯৭ সাল নাগাদ কাশিপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে প্রথম নির্বাচন লড়া। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ক্রমে রাজ্যের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী থেকে জ্যোতি বসুর মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের ভার। সেখান থেকে রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী। জ্যোতি বসুর হাত থেকে পতাকা গেল ক্রমে তাঁর হাতে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন বুদ্ধবাবু।

দলের সঙ্গে মতপার্থক্য, কর্মপদ্ধতি সংক্রান্ত মনোমালিন্য, সব কিছুর পরেও বাংলার ইতিহাসের এক ব্যতিক্রমী নেতা হয়েই রয়ে গেলেন বুদ্ধদেববাবু। সংস্কৃতিমনষ্কতার জন্যেও একসময় বিদ্ধ হতে হয়েছে তাঁকে, এমনকী শিল্প আনতে গিয়েও গায়ে লেগেছে কলঙ্কের ছিটে। নিভৃতে গিয়েছেন, কিন্তু নিজস্ব আদর্শ, জীবনধর্ম থেকে সরে আসতে দেখা যায়নি কখনও তাঁকে। রাজনীতি থেকে সরে আসার পরেও আলিমুদ্দিনে গিয়ে বইপত্তরে ডুবে থাকতেন তিনি। শেষবার তাঁকে দেখা গিয়েছিল ব্রিগেডের অনুষ্ঠানে। তখন অশক্ত শরীর, ধুলোর মধ্যে নামতেও পারলেন না তিনি। গাড়িতে বসেই সঙ্গী হয়েছিলেন ব্রিগেডের। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো বটেই, পরবর্তী সরকারের নেতানেত্রীদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক ছিল তাঁর। বুদ্ধবাবু অসুস্থ হতে বারবার তাঁকে দেখতে ছুটে গিয়েছেন মমতা। ২০২২ সালে পদ্মভূষণের সম্মান এসেছিল দরজায়, ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। আসলে নিজস্ব আদর্শ, নিজস্ব জীবনধর্মে আজীবন অটল ছিলেন বুদ্ধবাবু। সেখান থেকে নড়ানো গেল না তাঁকে মৃত্যুর পরেও।

আরও পড়ুন:বাংলার রাজনীতির শেষ ‘ভদ্রলোক’! প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য

রাজনীতির মঞ্চ ছেড়েছেন অনেক দিন। এক শ্রাবণ সকালে জীবনের নাটমঞ্চ ছাড়লেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সোশ্যাল মিডিয়া যখন তাঁকে নিয়ে নানা আলোচনা, স্মৃতিচারণে ব্যস্ত, তখন যেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সেই লাইনটিই মনে করিয়ে দিয়ে গেলেন তিনি —

"দক্ষিণদুয়ারে এসে দাঁড়াবে নির্ঘাৎ
চতুর্দোলা নিয়ে যম—
অপমান লাগে ...

মৃত্যুর পরেও যেন হেঁটে যেতে পারি।"

 

More Articles