৭০ কিমি ট্রেকিং, ৮ ঘণ্টা এনকাউন্টার! ছত্তিশগড়ের মাওবাদী নিকেশ অভিযানে যা ঘটেছে
Chhattisgarh’s Anti-Maoist Operations 2025: প্রশ্ন উঠছে, নিরাপত্তাবাহিনী যখন মাওবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তাঁদের নিশানা করছে— তখন শিশুরা কীভাবে আহত হচ্ছে?
অমিত শাহ, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ছত্তিশগড় থেকে মাওবাদীদের তিনি নির্মূল করে দেবেন ২০২৬ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে। ২০২৫ সালের জানুয়ারির শুরু থেকেই লাগাতার অভিযান চলেছে সেই রাজ্যের মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে। ২০২৫ সালের প্রথম ৪০ দিনেই ৮১ জন মাওবাদীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছে নিরাপত্তবাহিনী। গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ছত্তিশগড়ের রায়পুরে গিয়েছিলেন। সেই সময়ই এই সময়সীমা নির্ধারণ করে দেন শাহ। অমিত শাহ ঘোষণা করেছিলেন যে, নিরাপত্তা বাহিনী ১৪ জন শীর্ষ নেতা সহ ২৮৭ জন মাওবাদীকে নিকেশ করেছে, ১ হাজার জনকে গ্রেফতার করেছে এবং এক বছরে ৮৩৭ জন আত্মসমর্পণ করেছেন। তিনি আরও বলেছিলেন, নিরাপত্তা কর্মীদের হতাহতের সংখ্যা ৭৩% কমে গেছে। সাধারণ মানুষের মাওবাদী হামলায় মৃত্যুও ৭০% হ্রাস পেয়েছে। শাহ এও বলেছিলেন, ২০২৩ সালে ছত্তিশগড়ে কংগ্রেস শাসনের অধীনে মাত্র ২০ জন মাওবাদী নিহত হয়েছিলেন। আর বিজেপি ক্ষমতায় আসতেই এক বছরে ২৮৭ জন মারা গেছে।
মাওবাদীমুক্ত ছত্তিগড়ের লক্ষ্যে গত ৯ ফেব্রুয়ারি সবচেয়ে বড় এনকাউন্টারটি হয়েছে বলে দাবি নিরাপত্তাবাহিনীর। ছত্তিশগড়ের বিজাপুর জেলার ইন্দ্রাবতী জাতীয় উদ্যানের ঘন জঙ্গলে, নিরাপত্তা বাহিনী গত সপ্তাহ থেকে মাওবাদীদের সন্ধানে প্রায় ৭০ কিলোমিটার ট্রেকিং করে। চার দিনের অভিযানে এই এলাকাকে মাওবাদী মুক্ত করতে চেয়েছিল ডিস্ট্রিক্ট রিজার্ভ গার্ড (ডিআরজি), স্পেশাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)। এর মধ্যে একটি এনকাউন্টারে ৩১ জন মাওবাদী এবং দুইজন নিরাপত্তা কর্মী নিহত হন। নিরাপত্তা কর্মীরা তাদের বেস ক্যাম্প থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ইন্দ্রাবতী জাতীয় উদ্যানের গভীরে মাওবাদীদের আস্তানা ঘেরাও করে। আট ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলে এনকাউন্টার। ঘটনাস্থল থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ও গ্রেনেড লঞ্চার উদ্ধার করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
আরও পড়ুন- মাথার দাম ৪০ লক্ষ! মাওবাদী কমান্ডার হিডমার নাগাল পেতে কেন মরিয়া নিরাপত্তাবাহিনী?
এর আগে, ৩১ জানুয়ারি বিজাপুর জেলায় সেনার সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে আট মাওবাদী নিহত হন। গত ২৩ জানুয়ারি সেই রাজ্যের গারিবন্দ জেলায় কমপক্ষে ১৬ জন মাওবাদী নিহত হন বলে দাবি। এদের মধ্যে ১২ জনের মাথার দাম সরকার আগেই ঘোষণা করেছিল।
ছত্তিশগড়ের প্রতি কর্পোরেট আগ্রহ যত বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে সরকারের অভিযান। সরকার বলছে, মাওবাদীদের থেকে সাধারণ মানুষদের রক্ষা করা হবে। এই বছরের শুরু থেকেই ছত্তিশগড় তোলপাড় করা মাওবাদী বিরোধী অভিযানগুলি সত্যিই কি নীতি মেনে হয়েছে? জানুয়ারিতেই, দক্ষিণ ছত্তিশগড়ের বাস্তার অঞ্চলের বিজাপুর জেলার ঘন জঙ্গলে নিরাপত্তা বাহিনী এবং মাওবাদী বিদ্রোহীদের মধ্যে গোলাগুলি চলাকালীন ছয় মাসের এক শিশুকন্যা মারা যায় এবং তার মা আহত হন।
কেবল ডিসেম্বরেই, আবুজহমাদে মাওবাদী বিরোধী অভিযান চলাকালীন অন্তত চারজন শিশু আহত হয়েছে। সরকার বলছে নিরাপত্তা বাহিনী ওই এলাকায় সাতজন মাওবাদীকে হত্যা করেছে। যদিও ছত্তিশগড় প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভাপতি দীপক বাইজ সহ স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, নিহত সাতজনের মধ্যে পাঁচজনই নিরীহ গ্রামবাসী। আহত শিশুদের মধ্যে একজন, রামলি ওক্সামের কশেরুকায় একটি বুলেট গেঁথে আছে। আরেকজন আহত শিশু সোনু ওয়াম। একটি গুলি তার মাথা ছুঁয়ে যায়, মারাত্মক আঘাত থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পায় সে। তবে ভয়ানক আহত হয়। এই শিশু নিজের চোখে দেখেছে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে তার বাবা।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, নিরাপত্তাবাহিনী যখন মাওবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তাঁদের নিশানা করছে— তখন শিশুরা কীভাবে আহত হচ্ছে? সত্যিই কি এনকাউন্টার হচ্ছে জঙ্গলে, না কি নিরীহ মানুষদের হত্যা চলছে নির্বিচারে? উল্লেখ্য, বিজেপি সরকারের আমলে ভুয়ো এনকাউন্টারের ঘটনা অসংখ্য। পুলিশ বলছে মাওবাদীরা শিশুদের মানব ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেছে বলেই এই ঘটনা ঘটেছে। আর স্থানীয় গ্রামবাসীরা বলছেন, যখন গুলি চালাচ্ছিল নিরাপত্তাবাহিনী তখন সাধারণ এই মানুষরা ফসল কাটছিল।
আরও পড়ুন-এনকাউন্টারে নিহত, মাথার দাম ১ কোটি! কে ছিলেন এই প্রবীণ মাওবাদী নেতা?
ভারত সরকার আর মাওবাদীদের লড়াইয়ের শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী সেই ১৯৬৭ সাল থেকে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। মাওবাদীরাও দেশের দরিদ্র আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ, আরও চাকরি, জমি এবং সম্পদের দাবিতে লড়াই জারি রেখেছে। এই ঘন জঙ্গলের বাসিন্দা মাওবাদীদের, স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, বছরের পর বছর কেন্দ্রের অবহেলাই পেয়ে এসেছে এই অঞ্চল। স্থানীয় আদিবাসীদের জন্য না আছে ভালো চাকরি, না আছে স্কুল, না আছে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা। অথচ এই রাজ্য খনিজ পদার্থে ঠাসা, তাও ভারতের অন্যতম দরিদ্র রাজ্যও এটিই। অভিযোগ, সরকার আদিবাসীদের বঞ্চিত করে এই বিপুল প্রাকৃতিক সম্পর কর্পোরেট পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেবে। আদিবাসীদের উন্নয়ন কোনওকালেই হবে না।
জঙ্গল, জমি ও জনজাতিকে বাঁচাতে তাই মাওবাদী যোদ্ধারা পুলিশের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়েছে, সরকারি অফিস ধ্বংস করেছে, সরকারি কর্মকর্তাদের অপহরণ করেছে। রেললাইন উড়িয়ে দিয়েছে, কমরেডদের মুক্তি চেয়ে জেলে হামলা করেছে, পুলিশ ও আধাসামরিকদের অস্ত্র চুরি করেই নিজেদের রণসাজে সাজিয়েছে। আর পাল্লা দিয়ে লাগাতার মৃত্যু ঘটেছে এই জংলা রাজ্যে। মাওবাদীদের শেষ করতে গিয়ে নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে সাধারণ মানুষের প্রাণ গেছে যা স্বাভাবিকভাবেই ধামাচাপাও পড়ে গেছে। সরকার দাবি করছে বিপুল সংখ্যক মাওবাদী নিধন চলছে ছত্তিশগড়ে, চলবেও। তবে মাওবাদীদের শীর্ষ নেতাদের ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি প্রশাসন। সূত্রের খবর, তেলেঙ্গানার প্রায় ৯০ জন মাওবাদী ছত্তিশগড়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যাঁদের বেশিরভাগেরই বয়স ৬০ বছরের বেশি। তবে নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে এঁদের মাত্র কয়েকজনের বিষয়েই সাম্প্রতিক তথ্য রয়েছে। অনেক নেতারই সাম্প্রতিক ছবিও নেই। ফলে পুলিশ আধিকারিকরা এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে পুরনো ছবির উপর ভিত্তি করে মাওবাদী নেতাদের বর্তমান বয়সের ছবি তৈরির কাজ করছেন৷ বর্তমানে এই শীর্ষ নেতারা কেমন দেখতে তা সম্পর্কে ধারণা পেলে মাওবাদী অভিযান আরও কড়া হবে তা সহজেই অনুমেয়। অমিত শাহ বলেছেন, ২০২৬ সালের মার্চ অবধি সময়সীমা। হাতে আছে ১ বছরের কিঞ্চিৎ বেশি সময়।