দ্রৌপদী থেকে নির্ভয়া, ‘সবক’ শেখাতেই ধর্ষণ আজও

Nirbhaya case: সে রাতে ফাঁকা বাসে নির্ভয়া আর তার পুরুষ বন্ধুটি ছিলেন দুর্বলের সারিতে। রাতের শহরে একা মেয়ের এক পুরুষবন্ধুর সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর সবক শেখানো গিয়েছিল সেদিন নির্ভয়াকে।

দৃশ্য ১: ভরা দ্যূতসভায় তাঁকে চুল ধরে টানতে টানতে সভার মাঝখানে নিয়ে এসেছিল দুঃশাসন। সামনে শত কৌরব, অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র, আমাত্যবর্গ, পাশাদক্ষ শকুনি আর তাঁর সামনে হেরে ভূত হয়ে যাওয়া পঞ্চপাণ্ডব, দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামী। যাদের কূপমন্ডূক গোঁড়ামি আর জাত্যাভিমানের দাপটের দাম দিতে হয়েছিল সেদিন পাঞ্চালীকে।
দৃশ্য ২: দিল্লির শীতের রাত। আর কয়েক দিন বাদেই বড়দিন। রবিবারের রাতে বন্ধুর সঙ্গে 'লাইফ অব পাই' সিনেমাটি দেখে বাড়ি ফিরছিল মেয়েটি। সমুদ্রের বুকে একটি নৌকোতে আস্ত একটা বাঘ আর এক যুবক। তাঁদের টিকে যাওয়ার গল্প। এই সব কথা ভাবতে ভাবতেই কি বন্ধুর সঙ্গে বাসে উঠে বসেছিল সে। নির্জন রাতে ওই বাসেই যে ঘাপটি মেরে রয়েছে কয়েকটি নরখাদক বাঘ, তা কি দুঃস্বপ্নেও ভেবেছিল সেদিন মেয়েটি?

মুহূর্তে শরীর ফালা ফালা করে দিল তারা। পুরুষ বন্ধুটি বাঁচানোর চেষ্টা করায় তাঁর কপালে জুটল বেধড়ক মার। শরীরের শিরা-ধমনী ফাটিয়ে দেয় যেন একেকটা লোহার রডের বাড়ি। তার পর চলন্ত বাসে এক নারকীয় কাণ্ড চলতে লাগল প্রায় অনেকক্ষণ। একে একে মেয়েটির ধর্ষণে মাতে মানুষের মুখোশ পরা কয়েকটি 'জল্লাদ'। না, ভয়ঙ্কর লালসায় বারংবার ধর্ষণ করেও আশ মেটেনি তাদের। শেষমেশ মেয়েটির যোনীপথে ঢুকিয়ে দেয় তারা লোহার রড। শরীরের ভিতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ উপড়ে ফেলতে চায় তারা। তারপর নারকীয় খিদে মিটে গেলে চলন্ত বাসের দরজা খুলে তাঁদের ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সেই দরজা খোলা যায়নি। শেষমেশ সামনের দরজায় হিঁচড়ে নিয়ে এসে উড়ালপুলের কাছে ৮ নম্বর জাতীয় সড়কের উপরে ছুড়ে দেওয়া হয় রক্তাক্ত দেহদু'টি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা তাঁদের উদ্ধার করে নিয়ে গিয়েছিল দিল্লির সফদরজং হাসপাতালে। সেদিন হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও মেয়েটি বলার চেষ্টা করেছিল, সে মরবে না। সে বেঁচে থাকবেই। তাকে হারানো যাবে না কিছুতেই। কিন্তু না! দিল্লির এইমস হাসপাতাল থেকে সিঙ্গাপুরের সেন্ট মেরি হাসপাতাল। তেরো দিনের লড়াই শেষে মারা যায় মেয়েটি। দেশ তাঁকে চিনল নির্ভয়া নামে। নির্ভয়ার জন্য প্রতিবাদে নামল গোটা দেশ। জ্বলল মোমবাতি। দিকে দিকে অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে কাঁপল আকাশ। খানিক বদল এল আইনেও।

আরও পড়ুন: পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বাকে গণধর্ষণ, বিলকিস বানো মামলার নেপথ্যে যে ভয়াবহ ইতিহাস

প্যারা-মেডিক্যাল ছাত্রী নির্ভয়ার আসল নাম জানাতে দ্বিধা করেননি তাঁর মা। সত্যিই তো, তাঁর কীসের লজ্জা! লজ্জা এ সমাজের। যে সমাজের দোষীদের ধরে ফাঁসিতে ঝোলাতে ঝোলাতে সময় লেগে যায় সাত-সাতটি বছর। হাল ছাড়েননি নির্ভয়ার মা-বাবা। বছর তেইশের কন্যা জ্যোতির জন্য লাগাতার আইনের দরজায় দরজায় ঘুরেছেন তাঁরা। ২০২০ সালের মার্চ মাসের এক ভোরে শেষমেশ ফাঁসি হল নির্ভয়া কাণ্ডের চার অপরাধীর। সেদিন বাসে যাঁরা নির্মম ভাবে মেয়েটির শরীর কাটাছেঁড়া করেছিল, উপড়ে এনেছিল নাড়ি-পৌষ্টিক তন্ত্র, সেই ৬ জনের মধ্যে একজন ছিল নাবালক। জানা যায়, তার হাতেই ভয়ঙ্করতম অত্যাচারের শিকার হয়েছিল নির্ভয়া। আর এক অভিযুক্ত জেলের মধ্যেই আত্মহত্যা করে। বাকিদের ফাঁসি দেয় ভারতের আইন।

From Draupadi to Nirbhaya, the lessons which patriarchy wants to impart through rape

নির্ভয়া ঘটনার পরে যে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের ছবি দেখেছিল গোটা দেশ, তা দেখতে দেখতে একজনও কি ভাবেননি, যে এই ঘটনা অনেকদিন মনে রাখবে দেশ। নির্ভয়ার অপরাধীদের ফাঁসির সাজা, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবার ভয় ধরাবে ধর্ষকদের অন্দরে? নিশ্চিত ভাবেই ভেবেছিলেন। কিন্তু, তেমন কিছুই ঘটেনি। তার পরেও একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেই গিয়েছে দেশ জুড়ে। কার্যত ঘটে চলেছে। যে লজ্জার ইতিহাস একদিন দ্রৌপদীকে দিয়ে শুরু হয়েছিল, সেই লজ্জার পুনরাবৃত্তি ঘটেই গিয়েছে দেশের প্রতিটি প্রান্তে। মণিপুর থেকে দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ থেকে গুজরাত, কাশ্মীর থেকে বাংলা— একের পর এক ধর্ষিতা, গণধর্ষিতার আর্তচিৎকারে ফেটে পড়েছে আকাশ। তাতে রয়েছে আট বছরের কাঠুয়া কন্যা আসিফা বানুর কান্না, বিলকিস বানোর মতো অন্তঃসত্ত্বা মায়ের চিৎকার কিংবা বছর তেইশের নির্ভয়ার সেই যন্ত্রণা। এমনকী সত্তর বছরের বৃদ্ধাকেও ছাড়ে না যে সমাজ। নারী শরীর দেখলেই ঠুকরে খেতে চায় শকুনের দল।

From Draupadi to Nirbhaya, the lessons which patriarchy wants to impart through rape

আসলে বারংবার ধর্ষণ ঠিক যতটা না লালসার, তার চেয়েও অনেক বেশি প্রতিহিংসা, ক্ষমতার আস্ফালনের। কার্যত দুর্বলকে 'সবক' শেখানোর এ যেন এক ভয়ঙ্কর ব্যধি। সে রাতে ফাঁকা বাসে নির্ভয়া আর তার পুরুষ বন্ধুটি ছিলেন দুর্বলের সারিতে। হাতে লোহার রড নিয়ে ক্ষমতার চেয়ারে বসেছিল সেদিন ওই ৬ ধর্ষক। রাতের শহরে একা মেয়ের এক পুরুষবন্ধুর সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর 'সবক' শেখানো গিয়েছিল সেদিন নির্ভয়াকে। জাতিহিংসায় উত্তাল মণিপুরে নগ্ন করে হাঁটানো হয় মেয়েদের, ধর্ষণ করে ফেলে রাখা হয় ক্ষেতের ধারে। তাতে পূরণ হয় প্রতিহিংসা। কুরুসভায় দাঁড়িয়ে সেদিন যুধিষ্ঠিরের চোখ চোখ রেখে প্রশ্ন তুলেছিলেন দ্রৌপদী। জিজ্ঞেস করেছিলেন, যুধিষ্ঠির প্রথমে নিজেকে হেরেছেন নাকি তাঁকে। কারণ যুধিষ্ঠির যদি প্রথমে নিজের স্বাধীনতাই হারিয়ে ফেলে থাকেন, তবে দ্রৌপদীকে পণ রাখেন কোন সত্ত্বে? মেয়েমানুষের এমন ধৃষ্টতা সমাজ কবেই বা সহ্য করেছে! যেমন সহ্য করেনি শীতের দিল্লির সেই রাতে পুরুষবন্ধুর সঙ্গে সিনেমা দেখে ফেরা মেয়েটির দুঃসাহস। 'সবক' শিখিয়েছে পুরুষতন্ত্র। কেননা নিরাপত্তা দেওয়ার থেকে ঢের সহজ পায়ের বেড়ি কিংবা চাবুক। কারণ পিতৃতন্ত্রকে উপড়ে ফেলার থেকে ঢের সহজ আইন করে সমাজকে সত্তর বছর পিছিয়ে দেওয়া। 

আরও পড়ুন: যৌন হেনস্থা রুখতে কড়া আইন, আদৌ ভারতকে শিশুর বাসযোগ্য করতে পারল পকসো?

আরজি কর কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক মেয়েটিকে কোন 'সবক' শেখাতে চেয়েছিল সেদিন ধর্ষক? কলেজের অধ্যক্ষ কী অবলীলায় বলে দিলেন, অত রাতে সেমিনার রুমে একা কী করছিলেন তিনি? এ দেশ বহু খেটে মেয়েদের শিক্ষার অধিকার দিয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে চাকরি-উপার্জনেরও, তাই বলে পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাত শাসন করবেন মেয়েরাও! এ বড় কঠিন কথা বৈকি। এ শহরের রাত পুরুষের, এ শহরের রাত ধর্ষকের, মেয়েদের নয়। তাই শরীর ক্ষতবিক্ষত করো, ভেঙে দাও শরীরের হাড়, হত্যা করে শেখাও 'সবক'। তার পর কয়েকদিন মোমবাতি মিছিল, বিক্ষোভ, কর্মক্ষেত্রে-রাস্তায় নিরাপত্তার দাবি, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদের ঝড়। তার পর 'একদিন ঝড় থেমে যাবে।' ফেসবুকে ফিরে আসবে মনোরঞ্জনী রিলস, পুজোর বাজারে জমে উঠবে ভিড়, শ্রীলেদার্সের সিঁড়িতে পা রাখার জায়গা থাকবে না। নির্ভয়া, বিলকিস বানো, আসিফার পাশে লেখা হবে আরও কয়েকটা নাম।

নির্ভয়া মামলায় চরম শাস্তি পেয়েছে ধর্ষকেরা। কোনওদিন আবার দেশের 'অমৃত মহোৎসব' পালন করার আনন্দে মুক্তির স্বাদ ছুঁয়ে দেখবে বিলকিস বানোর ধর্ষক। আরজি কর কাণ্ডের দোষীদেরও হয়তো বিচার হবে। দুঃশাসনের বুক চিরে দেবে ভীম। কিন্তু সমাজ থেকে ধর্ষকামকে উপড়ে ফেলা কি এতই সহজ হবে? এক-আধ দিনে রাতের শহরে দখলদারিত্ব কি মুছে দিতে পারবে মেয়েদের জন্য সমাজের টেনে দেওয়া গণ্ডি? বদলাতে পারবে সমাজের ভিতরে বসে থাকা 'সবক' শেখানোর এই আদিম মানসিকতা? প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা...

More Articles