বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী: শেখ মুজিব থেকে শেখ হাসিনা
Bangladesh Politics: বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপ্রধান যারা ছিলেন তাঁদের মধ্যে কেউ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান উপদেষ্টা আবার কেউ সামরিক প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন করেছেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে প্রায় ৫২ বছর। একক দল হিসেবে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লিগ। এবং শেখ হাসিনা আওয়ামী লিগের সভানেত্রী তথা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। চলতি বছর জানুয়ারিতে চতুর্থবারের জন্য সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লিগ। বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপ্রধান যারা ছিলেন তাঁদের মধ্যে কেউ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান উপদেষ্টা আবার কেউ সামরিক প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন করেছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সংসদীয় পদ্ধতির সরকার করে প্রথম রাষ্ট্রপতি থেকে প্রধানমন্ত্রী হন। স্বাধীনতার পর থেকে কারা বাংলাদেশে মন্ত্রী হলেন এবং কী ভাবে ক্ষমতা হারালেন, আজ দেখে নেওয়া জরুরি।
শেখ মুজিবুর রহমান
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতির সূচনা হয়েছিল মুসলিম লিগ রাজনীতির হাত ধরে। ধীরে ধীরে বঙ্গবন্ধুই হয়ে ওঠেন অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবোধ এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির প্রবক্তা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও রাষ্ট্রপতি দেশে ফেরেন। এরপর ১২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে, বাকশাল গঠনের পর আবার রাষ্ট্রপতি হন। ওই বছরেই ১৫ অগস্ট একদল সামরিক কর্মকর্তা শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। শেখ মুজিবুর রহমান ১৪ বছর জেলবন্দি ছিলেন। রাজনীতির তাঁর আদর্শ অটুট ছিল। তাই হয়তো গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন এবং প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বাংলাদেশের।
খন্দকার মোশতাকে আহমেদ
শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার কয়েক ঘণ্টা পর বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তে আওয়ামী লিগের সিনিয়র নেতা তথা শেখ মুজিবুর মন্ত্রিসভার বাণিজ্য মন্ত্রী খন্দকার মোশতাকে আহমেদ রাষ্ট্রপতি হন। 'বিবিসি'- র একটি প্রতিবেদনে এই ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে লেখা হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমানের রক্তের দাগ শুকোনোর আগেই খন্দকার মোশতাকে আহমেদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন। একই সঙ্গে এই দিন তিনি দেশে সামরিক আইনও জারি করেন। এবং নিজেই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নেন। ৩ নভেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি, একজন প্রাক্তন উপ-রাষ্ট্রপতি ও দু'জন প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রী সহ আওয়ামী লিগের প্রধান চারজন নেতাকে হত্যা করার নির্দেশ দেন সামরিক অভ্যুত্থানের নেতা বিগ্রেডিয়ার খালেদা মোশাররফ। এই দিনটি রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকে আহমেদর কাল হয়ে যায়। সামরিক অভ্যুত্থানের তিন দিন পর, ক্ষমতাচ্যুত হন আহমেদ। ৬ নভেম্বরে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি শুধুমাত্র ৮১ দিন রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতায় ছিলেন। জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হওয়ার পরই আবার মুক্তিও পান খন্দকার মোশতাকে আহমেদ।
'বিবিসি'-র প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, 'শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের তিনি (খন্দকার মোশতাকে আহমেদ) জাতির সূর্য সন্তান বলে আখ্যা দেন।' গবেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ-এর কথায়, আসলে 'খুনিচক্র' তাঁকে ক্ষমতায় বসিয়ে ছিল। তিনি আরও বলেন, '১৫ আগস্ট আগ পর্যন্ত বকশাল ব্যবস্থা ছিল। একটি অর্ডিন্যান্স জরি করে বকশালের একদলীয় ব্যবস্থা রদ করেন। দ্বিতীয়ত, অনেকগুলো পত্রিকা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেগুলো খোলা শুরু করেন। তৃতীয়ত, ব্যক্তি পুঁজির একটি সিলিং (ঊর্ধ্বসীমা) ছিল ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত, সেটা তিনি ১০ কোটি টাকা করেন এবং প্রাইভেটাইজেশনে একটা গতি আনার চেষ্টা করেন।'
আনোয়ার উল আলম তাঁর 'রক্ষাবাহিনীর সত্য-মিথ্যা' বইতে লিখেছেন, 'খন্দকার মোশতাক আহমেদ ক্ষমতা গ্রহণ এবং মন্ত্রীসভা গঠন করেই আওয়ামী লিগের নেতা-কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রেফতার করতে থাকেন। ২৩ আগস্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাসাউদ্দিন আহমেদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, এম মনসুর আলী, আবদুস সামাদ আজাদসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে যারা তাকে সমর্থন করতে এবং তার মন্ত্রীসভায় যোগ দিতে অস্বীকার করেন, তাঁদের বন্দি করেন।'
আবু সাদাত মহম্মদ সায়েম
সামরিক অভ্যুত্থানে সেনা প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান পদচ্যুত হন। অভ্যুত্থানে নেতা খালেদা মোশাররফ নিজেকে সেনা প্রধান ঘোষণা করেন এবং তখনকার বিচারপতি আবু সাদাত মহম্মদ সায়েম-কে রাষ্ট্রপতি করা হয়। পরদিন থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতি বদলে যায়।
অভ্যুত্থানের নায়ক খালেদা মোশাররফ সিপাহী বিদ্রোহে নিহত হন। ফের সেনা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ পান জেনারেল জিয়াউর রহমান। চলতি বছরে ২১ এপ্রিল, বাংলাদেশের 'প্রথম আলো' পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, 'বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবু সাদাত মহম্মদ সায়েমকে তাঁরই উত্তরসূরি আরেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করেছিলেন।' আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম 'এএফপি' বিষয়টির ফ্যাক্ট চেক করে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটিতে ওই তথ্যটি ভুল বলে লেখা হয়।
সাবেক প্রেসিডেন্ট আবু সাদাত মহম্মদ সায়েম - 'বঙ্গভঙ্গের শেষ দিনগুলি' গ্রন্থের ৩৪ নং পাতায় লিখেছেন, 'প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার সপ্তাহ খানিক আগে আমার ব্যক্তিগত চিকিৎসা ডা. মুহম্মদ মনিরুজ্জামান আমাকে পরীক্ষা করে বললেন, আমার প্রোস্টেট অপারেশন করতে হবে। তাঁরা বললেন, ওষুধ কিছু চলবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত অপারেশন করতেই হবে। কিছু ট্যাবলেট দেওয়া হল, কিছুটা আরাম পাওয়া গেল। পরিস্থিতি ছিল এ রকম। আমি সরকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ দ্রুত হারাচ্ছিলাম। তখন আমি প্রেসিডেন্ট পদ ত্যাগ করি।'
জিয়াউর রহমান
শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনীতি ও সেনাবাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন জিয়াউর রহমান। রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মহম্মদ সায়েম তাঁকে চিফ অব আর্মি স্টাফ এবং উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দেন। ১৯৭৭ সালে ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। ১৯৭৮-এ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আয়োজন করে, তিনিই রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এই বছরেই সেপ্টেম্বরে নিজস্ব রাজনৈতিক দল গঠন করেন। দলটির নাম রাখা হয় - জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি। ১৯৮১ সালের ৩০ মে, সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তখন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সেনা প্রধান ছিলেন। বিবিসি-র একটি প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, 'বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭২ সালে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছিল, কিন্তু জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় রাজনীতিতে ফিরে আসার নীতি কারণে ধর্মভিত্তিক দলগুলো সুযোগ পায়। এর ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীতাকারী জামায়েত ইসলামীও রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পায়।'
আব্দুস সাত্তার ও আবুল মহম্মদ আহসান উদ্দিন চৌধুরী
জিয়াউরের পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। পরে তিনিই স্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৯২ সালের ২৪ মার্চ তৎকালীন সেনা প্রধান এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারান সাত্তার। এরপর বিচারপতি আবুল মহম্মদ আহসান উদ্দিন চৌধুরী রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৮২ সালের ২৭ মার্চ রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতা ছেড়ে দেন তিনি।
হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ, বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে সরিয়ে নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা করেন বাংলাদেশের সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতায় আসেন তিনি। জিয়াউর-এর হত্যার ৯ মাস পর সামরিক শাসন জারি করেন এরশাদ। সাত্তারের মন্ত্রীসভার বেশির ভাগ সদস্যই আড়ালে জেনারেল এরশাদের সাথে সম্পর্ক রাখতেন। ক্ষমতা দখল করতে সরকারের ভেতরেই অস্থিরতা তৈরির কৌশল করেছিলেন তিনি। সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যেও মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধার বিভেদ তৈরি করেছিলেন। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর, গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছেড়েছিলেন বাংলাদেশের সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৯৯০- এ জরুরি অবস্থা এবং কারফিউয়ের মত কঠোর পদক্ষেপের পরও এরশাদ বিরোধী আন্দোলন দমানো যায়নি। শেষমেষ, ৪ ডিসেম্বর সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ মেজর আব্দুস সালাম প্রেসিডেন্ট এরশাদকে পদত্যাগ করা উচিত বলে জানিয়ে দেন।
১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের গণআন্দোলন তিনি নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছিলেন। সে সময় সাংবাদিক, মানবধিকার কর্মী, রাজনীতিবিদ, বিক্ষোভকারী সকলকে ধরে ধরে জেলবন্দি করা হচ্ছিল। ক্ষমতা ধরে রাখতে ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্মও ঘোষণা করেছিলেন। বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান তাঁর হাত ধরেই পরিবর্তন হয়। দুর্নীতি বিরোধী সরকারের কথা বলে ক্ষমতা দখল করলেও, তিনিই বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান, যাকে দুর্নীতির অভিযোগে কারাগারে যেতে হয়েছিল।
সাহাবুদ্দিন আহমেদকে
আওয়ামী লিগ এবং বিএনপি একই সাথে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে মাঠে নেমেছিল। প্রেসিডেন্ট এরশাদের পদত্যাগের পর, আন্দোলনকারী দলগুলি তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদকে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য বেছে নেয়। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন একটি 'নিরপেক্ষ নির্দলীয় কেয়ারটেকার' সরকার গঠন করেন। নতুন সরকারের একমাত্র দায়িত্ব ছিল, তিন মাসের মধ্যে নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা। ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে, পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। এবং প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়া
খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। জিয়াউর রহমানের হত্যার পর তৎকালীন বিএনপি-র সিনিওর কিছু নেতার পরামর্শে এবং অনুরোধে রাজনীতিতে আসেন খালেদা জিয়া। তাঁর শাসনের শেষ দিকে বিরোধী দলগুলো আবার জোরদার আন্দোলন শুরু করে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অধিকাংশ বিরোধী দল নির্বাচন বয়কট করে। ওই নির্বাচন তিনিই জিতেছিলেন। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য বেশিদিন ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেননি তিনি। ফলত ৩০ মার্চ ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয় খালেদা জিয়াকে। ২০০১ সালে, ফের রাষ্ট্রক্ষমতা ফিরে পান খালেদা জিয়া। সে বারও সংবিধানের সংশোধনী ঘিরে আবার বিরোধীদের আন্দোলন তীব্র হয়। শেষে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন খালেদা জিয়া।
২০০৭ সালে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবার নতুন প্রেক্ষাপটের সূচনা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এই সরকারের আমলে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি-র নেতৃত্ব খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা হয়। ২০১৮ সালে, জিয়া অরফ্যানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের জন্য জেলে যান খালেদা জিয়া। কিন্তু দু'বছরের মধ্যেই দুটি শর্তে নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি দেওয়া হয় তাঁকে। অভিযোগ ছিল, এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে পাওয়া ২ কোটি ১০ লক্ষ ৭১ হাজার ৬১৬ টাকা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অপব্যবহার করেন খালেদা জিয়া। তখনকার সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী, সরকার পক্ষ নিজেরাই সেই টাকা আত্মসাৎ করেছিলেন। রায়ে খালেদা জিয়ার পুত্র তথা বিএনপি-র ভারপ্রাপ্ত প্রধান তারেক রহমান কেও ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
২০১৯ সালে 'বিবিসি বাংলা'র আকবর হোসেনকে একটি সাক্ষাৎকারে বিএনপি নিয়ে লেখা একটি গবেষণা ধর্মী বইয়ের লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, 'সেভাবে এটি (বিএনপি) রাজনৈতিক দল ছিল না, যেভাবে রাজনৈতিক দল তৈরি হয় আমাদের দেশে। বিএনপি-র রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে ওঠা এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের সময়, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে। আজকে আমরা যে বিএনপি দেখি, যদিও সেটার আইকন জিয়াউর রহমান, কিন্তু দলটাকে এ পর্যায়ে এনেছেন খালেদা জিয়া।' 'বিবিসি বাংলা'র একটি প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বেই এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়েছিল।
শেখ হাসিনা
১৯৯৬ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শেখ হাসিনা হেরে গেলে ফের ক্ষমতা পান বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া।
ফখরুদ্দীন আহমেদ
২০০৭ সালে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সরকার প্রধানের ক্ষমতা পান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমেদ। প্রায় দু'বছর ক্ষমতায় ছিলেন। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে আবার বিপুল ভোটে জয়ী হন শেখ হাসিনা।
এরপর ২০০৯ থেকে ২০২৪ একটানা এখনও ক্ষমতায় রয়েছেন হাসিনা। ২০০৮ সালের পর থেকে নির্বাচনগুলো হাসিনা সরকারের অধীনেই হয়েছে। ২০১৪ সালে বিএনপি এবং আরও বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বয়কট করে। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধীরা অংশ নেয়। 'বিবিসি'-র তথ্য অনুযায়ী, সে বছর অত্যধিক মাত্রায় ভোট কারচুপি হয়। চলতি বছরের শুরুতে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনকে বিরোধীরা প্রহসন বলেন। অভিযোগ, এবারও নিরপেক্ষ ভোট হয়নি।
সম্প্রতি কোটা সংস্কার নিয়ে উচ্চ আদালতের রায়ের পর থেকে টানা আন্দোলন ও অবরোধের মত কর্মসূচি শুরু করেছে শিক্ষার্থীরা। এই চলমান আন্দোলনকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করছেন শেখ হাসিনা। এখনও আন্দোলনে মৃতের সংখ্যা অন্তত ১৯৭। শিক্ষার্থীরা বলছেন, স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। অন্যদিকে, পড়ুয়াদের সন্ত্রাসবাদী ছকের অংশ বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে।২৭ জুলাই 'মানবজমিন' পত্রিকার প্রথম পাতার একটি প্রতিবেদনে শিরোনাম করা হয়েছে - '৫৫০ মামলা ৬ হাজারের বেশি গ্রেফতার।' প্রতিবেদনটিতে পুলিশের বিভিন্ন সূত্রের বরাতে লেখা হয়েছে, শুক্রবার পর্যন্ত দেশজুড়ে ৫১টি মহানগর ও জেলায় প্রায় ৫৫০টি মামলা করা হয়েছে। ইন্টারনেট পুরোপুরি ফিরে আসেনি, কার্ফিউ পুরোপুরি তুলে দেওয়া হয়নি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখনও বন্ধ রয়েছে। এই আন্দোলন কোটা সংস্কার কেন্দ্র করে সূচনা হলেও, এখন আর সেখানে সীমাবদ্ধ নেই। বেশির ভাগ মামলা করেছে পুলিশ ও ছাত্রলিগ। সবমিলে বর্তমান ছাত্র আন্দোলনে দিশেহারা বাংলাদেশ। আপাতত যত রকম দুঃসহ, নির্মম, ভয়াবহ রূপ হতে পারে, তার সব অভিজ্ঞতাই বাংলাদেশ পেয়ে গেছে। এই ভয়াবহ অবর্ণনীয় নির্যাতনে বারবারই প্রশ্ন জাগছে - এরশাদ, খালিদ জিয়াদের মতোই কি হাসিনার পতন হবে? না কি রাজনীতির প্যাঁচে আবার মানুষকে সব ভুলিয়ে দেওয়া হবে?