লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বা লড়কি বহিন! কেন মহিলাদের অনুদান দিলেই ভোটে জেতা সহজ?

Maharashtra Ladki Bahin Scheme: শুধু বিজেপিই নয়, প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলই আসন্ন সমস্ত নির্বাচনে মহিলাদের জন্য এই ধরনের পরিকল্পনার দিকে ঝুঁকবে বলেই আশা করা হচ্ছে।

মহিলাদের মন জিতলে ভোট জেতা যায়? নানা রাজ্যে ক্রমেই এই প্রশ্নের উত্তর 'হ্যাঁ' হয়েই দেখা দিচ্ছে। মহিলাদের ক্ষমতায়নের নামে (যদিও ভাতা ভিত্তিক অনুদান আর ক্ষমতায়ন এক কিনা প্রশ্ন থাকছেই) যে যে প্রকল্প বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন সরকার নিচ্ছে, দেখা যাচ্ছে সেই দলগুলিকে মহিলারা সমর্থন করছেন। এখানে অবশ্যই উল্লেখ্য, ক্ষমতায়ন মানে নগদ টাকা অ্যাকাউন্টে তুলে দেওয়া। সম্প্রতি মহারাষ্ট্রে বিজেপি-নেতৃত্বাধীন মহাযুতি সরকারের সাফল্যের নেপথ্যে 'লডকি বহিন যোজনা'-কে কৃতিত্ব দিচ্ছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এই জোট ২৮৮টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ২৩৪টি আসন জিতেছে।

'লড়লি বহিন যোজনা'-তে মহারাষ্ট্রের পরিবারের প্রধান মহিলাদের সরাসরি নগদ ১,৫০০ টাকা দেওয়া হচ্ছে। বলা হয়েছিল, নির্বাচনে বিজেপির জোট জিতলে এই টাকা বাড়িয়ে ২,১০০ টাকা করা হবে। অর্থাৎ মহিলারা নগদ টাকা পাচ্ছেন হাতে। সেই টাকা তাঁদের নিজস্ব অর্জন বলে মনে করছেন তাঁরা।

তৃণমূল কংগ্রেস দাবি করেছে, প্রথম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রকল্পটি চালু করেছিলেন। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাতেনাতে ফলও পেয়েছেন। এবার এই মডেলটিই ভারতের অনেক রাজ্য নিজের নিজের মতো নামে প্রয়োগ করছে। হ্যাঁ, এই প্রকল্পের জন্য পশ্চিমবঙ্গ এবং কর্ণাটক সহ অনেক রাজ্যের কোষাগারেরই অবস্থা করুণ, তবু ক্ষমতা ধরে রাখার মোক্ষম দাওয়াই এটি।

শুধু বিজেপিই নয়, প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলই আসন্ন সমস্ত নির্বাচনে মহিলাদের জন্য এই ধরনের পরিকল্পনার দিকে ঝুঁকবে বলেই আশা করা হচ্ছে। এই মুহূর্তে দেশের অনেক রাজ্যই মহিলাদের নগদ টাকা পাইয়ে দিয়ে, লাভের গুড় ঘরে তুলছে।

আরও পড়ুন- নির্বাচনে জেতা আসলে ৩৬৫ দিনের কাজ! যেভাবে প্রমাণ করল মহারাষ্ট্র

মহারাষ্ট্রের 'লড়কি বহিন স্কিম'

এই বছর রাখীবন্ধনের দিনে চালু করা হয় এই প্রকল্প। এই প্রকল্পে মহারাষ্ট্রের ১ কোটিরও বেশি মহিলাকে প্রতি মাসে ১,৫০০ টাকা করে দেওয়া হয়। মহারাষ্ট্র সরকার আসলে বিজেপি শাসিত আরেকটি রাজ্য মধ্যপ্রদেশের প্রকল্পটিকেই এই রাজ্যে নিয়ে আসে। মহারাষ্ট্রে নির্বাচনের আগে দুর্নীতি এড়াতে সরকার সতর্ক ছিল। তাই, সরকার ‘নারী শক্তি ধুত’ অ্যাপ চালু করে যার মাধ্যমে যোগ্য মহিলারা অনলাইনেই আবেদন করতে পারবেন।

স্থানীয় প্রশাসনিক আধিকারিকরা, যেমন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী এবং গ্রাম সেবকরা এই প্রকল্পে মহিলাদের নাম নথিভুক্তকরণে সহায়তা করেছিলেন বিনামূল্যে৷ সরকার আবেদনকারীদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে আধার লিঙ্ক করার ব্যবস্থাও নেয়। এই স্কিমটি শুধু সামাজিক নয়, রাজনৈতিক সাফল্য হিসেবেও প্রমাণিত হয়ে যায়৷

নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরে, শরদ পাওয়ার বলেছিলেন, "আমরা জনগণ এবং দলীয় কর্মীদের কাছ থেকে যা তথ্য পেয়েছি, তাতে আমি মনে করি 'লড়কি বহিন যোজনা' আমাদের হারের পিছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। মহিলা ভোটারদের কিছু টাকা দেওয়া হয় এবং তারপর ক্ষমতাসীন দলের নেতারা তা নিয়ে প্রচার চালান। তারা ভোটারদের বলেছেন যে তারা মহিলাদের অ্যাকাউন্টে দুই থেকে তিন মাসের টাকা একসঙ্গে দিচ্ছেন। কারণ মহাযুতি ক্ষমতা হারালে, এই স্কিমটি বন্ধ হয়ে যাবে। এতে মহিলারা চিন্তায় পড়ে যান এবং তারা আমাদের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন।"

ঝাড়খণ্ডের 'মাইয়া সম্মান স্কিম'

ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার (জেএমএম) নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার সমীক্ষা করে গত অগাস্ট মাসে 'মাইয়া সম্মান স্কিম' চালু করে। এই প্রকল্পে ২১ থেকে ৫০ বছর বয়সি মহিলাদের ১,০০০ টাকা করে প্রতি মাসে দেওয়া হয়। মোটামুটি ঝাড়খণ্ড রাজ্যজুড়ে ৫ মিলিয়ন মহিলা এতে উপকৃত হন। ঝাড়খণ্ড বিধানসভা নির্বাচনে দেখা যায় মহিলা ভোটাররা পুরুষদের চেয়ে বেশি ভোট দিচ্ছেন। ৮১টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ৬৮টিতে মহিলা ভোটার বেশি। নির্বাচন কমিশনের মতে, মহিলা ভোটারের সংখ্যা ছিল ৯১.১৬ লাখ। পুরুষ ভোটারদের তুলনায় ৫.৫২ লাখ ভোট বেশি দিয়েছেন মহিলারা।

নির্বাচনে জয়ের পর এই ১০০০ টাকা বাড়িয়ে ২,৫০০ করা হবে পরের বছর থেকে, প্রতিশ্রুতি এমনই। মহিলাদের হাতে প্রতি মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে এই ১০০০ টাকা আসা তাঁদের আবারও এক নিজস্ব টাকা অর্জনের অনুভূতি দেয়, যা ভোটবাক্সে সরাসরি প্রভাব ফেলে। বিজেপি এবার মরিয়া চেষ্টা করেও ঝাড়খণ্ড দখল করতে পারেনি। জেএমএম ঝাড়খণ্ডে ক্ষমতায় ফিরেছে। তবে একা মাইয়া সম্মান স্কিম নয়, এর নেপথ্যে আরও অনেকগুলি কারণ থাকতে পারে। বিজেপির তরফে উপজাতীয় মুখ্যমন্ত্রীর মুখ ঘোষণা না করা, হেমন্ত সোরেনের গ্রেফতারির পর বাড়তে থাকা উপজাতি সহানুভূতি, মহিলাদের আর্থিক সহায়তা - সব মিলেই নির্বাচনে জেএমএম শক্তি ধরে রেখেছে।

আরও পড়ুন- ফের লক্ষ্মীর ভাণ্ডারেই আস্থা! কেন মমতাকে সবচেয়ে বেশি ভোট দেন মহিলারা?

মধ্যপ্রদেশের 'মুখ্যমন্ত্রী লাডলি বেহনা যোজনা'

প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানকে মধ্যপ্রদেশের মহিলাদের ‘ভাই’ বলে মনে করা হয়। তাঁর পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ার পরে এই মহিলাদের মধ্যে অনেকেই কেঁদেও ফেলেছিলেন। ২০২৩ সালে 'মুখ্যমন্ত্রী লাডলি বেহনা যোজনা' চালু হয়। মধ্যপ্রদেশে বিজেপি তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার নেপথ্যে এই স্কিমটিকে একটি বড় কারণ হিসাবে দেখা হয়।

এই প্রকল্পের অধীনে, মধ্যপ্রদেশের ২৩ বছরের বেশি এবং ৬০ বছরের কম বয়সি প্রতি মহিলা সরকার থেকে প্রতি মাসে ১,০০০ টাকা পান। যাদের বার্ষিক আয় ২.৫ লক্ষ টাকা বা তার বেশি সেই মহিলাদের এই প্রকল্পের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে৷

গত বছর শিবরাজ সিং চৌহান এক সমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়েছিলেন। স্পষ্ট দেখা যায়, সেই ভিড়ে পুরুষদের চেয়ে মহিলারাই সংখ্যায় বেশি। নির্বাচনের ফলাফলেও বিজেপি মহিলাদের ভোটই পায় বেশি।

কর্ণাটকের 'গৃহ লক্ষ্মী স্কিম'

কংগ্রেস শাসিত কর্ণাটক প্রান্তিক মহিলাদের জন্য ‘গৃহ লক্ষ্মী স্কিম’ নিয়ে আসে। ২০২৩ সালে চালু হওয়া এই প্রকল্পের অধীনে রাজ্যের প্রায় ১.১ কোটি মহিলাকে মাসে ২,০০০ টাকা আর্থিক সহায়তা করা হয়। এই প্রকল্পে সেই মহিলারাই টাকা পাবেন যারা অবশ্যই অন্ত্যোদয়, বিপিএল বা এপিএল রেশন কার্ডে পরিবারের প্রধান হিসাবে তালিকাভুক্ত আছেন। রাজ্যসভার বিরোধীদলীয় নেতা মল্লিকার্জুন খাড়্গে এবং কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধি এই প্রকল্প চালু করেন।

মহারাষ্ট্রে বিজেপি কংগ্রেসকে ধূলিস্যাৎ করে দিলেও কর্ণাটকের উপ-নির্বাচনে তিনটি আসন জিতে কংগ্রেস বড় ধাক্কা সামলাতে পেরেছিল। কংগ্রেস দক্ষিণ কর্ণাটকের চান্নাপাটনা আসনটি ২৫,৪১৩ ভোটের ব্যবধানে, মধ্য কর্ণাটকের শিগগাঁও আসনটি ১৩,৪৪৮ ভোটে এবং উত্তর কর্ণাটকের সান্দুর ৯,৬৪৯ ভোটে জিতে যায়।

আরও পড়ুন- আরজি কর ধর্ষণ-হত্যার প্রতিবাদ কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মহিলা ভোট কমিয়ে দেবে?

পশ্চিমবঙ্গের ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্প’

পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ২৫ থেকে ৬০ বছর বয়সের মহিলাদের মাসিক আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ শুরু করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মহিলাদের ৫০০ টাকা করে দেওয়া হতো, সেই টাকার পরিমাণ এই বছর বেড়েছে। লোকসভা নির্বাচন ঘোষণার কয়েক সপ্তাহ আগে, রাজ্য বাজেটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সাধারণ শ্রেণির জন্য প্রতি মাসে নগদ ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১,০০০ টাকা করে এবং তপশিলি জাতি এবং উপজাতির মহিলাদের জন্য ১,০০০ টাকা অনুদান বাড়িয়ে ১,২০০ টাকা করে। বিজেপি আগে এই প্রকল্পটিকে 'ভিক্ষা' বলে উপহাস করলেও এর রাজনৈতিক মূল্য হাড়েহাড়ে টের পেয়েছে৷

মহিলাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক না হোক, চাকরির নিশ্চয়তা থাকুক না থাকুক অনুদানের গ্যারান্টি আছে। ক্ষমতা বদলে হলেও যে কোনও সরকার এলেই এই জাতীয় স্কিম আর বন্ধ করার পথে তো হাঁটতে পারবেই না, উল্টে অনুদানের পরিমাণ বাড়িয়ে তাঁদের ভোট কিনতে হবে এবার।

More Articles