ধর্ম আর রাজনীতির ককটেলে মোক্ষ নয় ‘মৃত্যুফাঁদ' মোদির ভারত!

Maha Kumbh 2025: কুম্ভমেলার পদপিষ্টের ঘটনায় সে রাজ্যের ভিআইপি কালচারের দিকে আঙুল উঠছে। প্রতিপক্ষ অভিযোগ করছে, ভিআইপিদের জায়গা করে দিতেই নাকি সাধারণ মানুষের জীবন বাজি রাখল যোগী সরকার।

সাংবাদিকতার পেশায় মাঝেমধ্যে নানা রেস্তোরাঁয় যেতে হয়। আপ্যায়ন করার সময় মাঝেমধ্যেই নিজেদের বারে তৈরি বিশেষ ককটেল অফার করেন কর্তৃপক্ষ। নানারকম উপাদানে তৈরি সেই ককটেলের স্বাদ অতীব চমৎকার। তার থেকেও চমৎকার হলো, সেই ককটেল তৈরির পদ্ধতি। প্রতিটি উপাদানের সঠিক মিশ্রণ না হলে ককটেল তৈরি হয় না।

আজকের ভারতবর্ষের জনতাও সম্ভবত, অজান্তেই এক দুর্ধর্ষ ককটেলের নেশায় ডুবে যাচ্ছে। ধর্ম আর অর্থনীতি দু'হাতে যারা মিশিয়ে দিচ্ছেন, তাঁরা অবশ্য পেশায় মিক্সোলজিস্ট নন। বরং রাজনীতিবিদ। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, ভারতীয় জনতা পার্টির রাজনীতিবিদরা। আর ধর্মটি এক্ষেত্রে অবশ্যই ‘সনাতন’ হিন্দু ধর্ম।

একটু খোলসা করে বলা যাক। ভারতবর্ষে চাকরি নেই। কাতারে কাতারে মানুষ দেশ ছাড়ছেন। বাজেটের আগে বেশ অনেকগুলো সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, কীভাবে মানুষের খরচ করার মতো টাকা আস্তে আস্তে কমে আসছে। বাজেটে করছাড়ও সেই কারণে। উপভোক্তা যাতে বাজারে সামান্য কিছু হলেও খরচ করতে পারেন। হাতে টাকা না থাকার কারণ কী? আগেই বলেছি, পর্যাপ্ত চাকরির সুযোগ না তৈরি করতে পারা।

আরও পড়ুন- বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরিতে নয়, কুম্ভ আয়োজনে বেশি টাকা দেওয়াই বিজেপির লক্ষ্য

অথচ, সেই সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা অত্যন্ত সামান্য। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ধর্ম। বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে, উৎসব। ২০২৪ সালের ২২ জানুয়ারি আলোচনার উৎসমুখ ছিল রামমন্দির। আর এই বছরে কুম্ভমেলা। দু'টির মধ্যেই কয়েকটি সাযুজ্য রয়েছে। দু'টিই উত্তরপ্রদেশে এবং দুটোতেই সুনিপুণভাবে মিশে গিয়েছে অর্থনীতির প্রশ্নটি।

রামমন্দির স্রেফ হিন্দু ধর্মের তীর্থক্ষেত্রে আটকে থাকেনি। বিশ্বায়নের দাবি মেনে তার সঙ্গে মিশেছে অর্থনীতির প্রশ্নটি। রামমন্দির হবে পর্যটনক্ষেত্র। মন্দির-ট্যুরিজমের চমৎকার ‘ককটেলে’ হোটেলের পর হোটেল তৈরি হয় অযোধ্যায়। সারা বিশ্ব থেকে পর্যটকেরা আসবেন, থাকবেন, তাঁদের জনসমাগমে অযোধ্যা হয়ে উঠবে হিন্দুদের ‘ভ্যাটিকান।’

চলতি বছরেও কুম্ভমেলা নিয়ে ঠিক একই উত্তেজনা। ১৪৪ বছরে নাকি প্রথম মহাকুম্ভ। মিডিয়ায় হাইপ তৈরি করতে কোনওরকম খুঁত রাখেনি যোগী সরকার। ৬,৯০০ কোটি টাকার অফিসিয়াল বাজেটে তৈরি এই কুম্ভমেলায় হাজার হাজার কোটির টেন্ডার দেওয়া হয় বিভিন্ন কোম্পানিকে। যেমন, ব্রিজেশ এবং অশ্বিন থাক্করের RR Hospitality Private Limited। কুম্ভমেলা উপলক্ষ্যে এই কোম্পানি প্রায় ১৩ কোটি টাকা খরচ করে প্রাঙ্গণজুড়ে খাবারের স্টল দিতে। প্রায় ১.২৩ কোটি টাকা খরচ করে নিলামে স্টলের টেন্ডার জিতে নিয়েছিল ওই সংস্থা। খোদ উত্তরপ্রদেশ সরকারের তরফ থেকে আশা করা হয়েছিল, কুম্ভমেলা প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার রেভিনিউ প্রদান করবে।

অথচ এত খরচের পরেও ভাঁড়ার শূন্য। কুম্ভমেলা এবং রামমন্দির দু'টিই তার প্রাথমিক জৌলুস হারিয়েছে। মন্দিরের ছাদ ফুটো হয়ে জল পড়ছে। আর, কুম্ভমেলায় যা হয়েছে, তা নারকীয়। পদপিষ্ট হয়ে মারা গিয়েছেন প্রায় ৪০-এর কাছাকাছি মানুষ। মেলা ফেরত অজস্র মানুষের বয়ানে উঠে আসছে, কীভাবে লাশের পাহাড় গোনা হয়েছে। প্রিয়জনকে হারিয়ে সরকারের দফতরে দফতরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন মানুষ, সামান্য ক্ষতিপূরণের আশায়।

আরও পড়ুন- পদপিষ্ট গরিবরাই! উচ্চবিত্তদের জন্য মহাকুম্ভে কী আয়োজন? চমকে দেবে বিলাসের বহর

কুম্ভমেলার পদপিষ্টের ঘটনায়, নানা ন্যারেটিভ সামনে আসছে। সবথেকে বেশি করে যা সামনে আসছে তা হলো, রাজ্যের ভিআইপি কালচার। প্রতিপক্ষ অভিযোগ করছে, ভিআইপিদের জায়গা করে দিতেই নাকি সাধারণ মানুষের জীবন বাজি রাখল যোগী সরকার। অস্বীকার করা যায় না। রামমন্দিরের সাফল্যের জন্যে গোটা দেশের VIP, VVIP-দের নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই, যেখানে বড় সংখ্যায় সেলিব্রিটিরা আসছেন, সেখানে সাধারণ মানুষের স্বার্থ বিঘ্নিত হবেই। অথচ নতুন ভারতে কেন্দ্র এবং বিভিন্ন রাজ্য, যেখানে বিজেপির সরকার রয়েছে তাদের লক্ষ্য এটাই। এক কর্পোরেট হিন্দুরাষ্ট্র তৈরি, যেখানে পুঁজির সহায়তায় কোটি কোটি টাকা খরচ করে গ্লোবাল হিন্দু ন্যারেটিভ তৈরি করা হবে। সেই ন্যারেটিভকে ভারতীয়ত্বের নামে তুলে ধরা হবে সারা পৃথিবীর কাছে। সারা পৃথিবীর মানুষ আসবেন, দেখবেন, অথচ তাঁদের মনে গেঁথে যাবে না এদেশের আর্তপীড়িতের চিৎকার।

কিন্তু কেন গেঁথে যাবে না? তার কারণ, গেঁথে দেওয়ার দায়িত্ব যাদের, তাঁরা কর্তব্য থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন বহুদিন আগেই। আজকের ভারতবর্ষের টেলিভিশন চ্যানেলে চাকরি সংক্রান্ত কোনও আলোচনা হয় না। যে টেলিভিশন চ্যানেল কংগ্রেস জমানার শেষদিকে একের পর এক প্রশ্নবানে বিদ্ধ করত তৎকালীন মনমোহন সিংয়ের সরকারকে, তারা আজ এক্কেবারে চুপ। যোগী আদিত্যনাথের যে কোনও পুরনো ইন্টারভিউ দেখলে শোনা যায়, তিনি বারংবার বলছেন উত্তরপ্রদেশকে তিনি কেরল বা পশ্চিমবঙ্গ হয়ে উঠতে দিতে চান না। অথচ, কথাটা বলার সময়ে সঞ্চালক বা সঞ্চালিকা একবারও পালটা প্রশ্ন করেন না, ‘কেরল বা পশ্চিমবঙ্গ হয়ে উঠলে ক্ষতি কী? সামাজিক সূচকে তো দুই রাজ্যই অনেকটা এগিয়ে।’

আসলে ২০১৪ পরবর্তী সময়ে ভারতীয় রাজনীতির অগ্রাধিকার ব্যাপক বদলে গিয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অধিকারের প্রশ্নগুলোর জায়গায়, মিডিয়ার দায়িত্ব সরে গিয়েছে ধর্মের গুণগান করার দিকে। হাজার হাজার পডকাস্ট স্পিরিচুয়ালিটির নাম করে বিজ্ঞানবিরোধী কথাবার্তা বলে চলেছে। ফলত, মোক্ষ নয়, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ২০১৪ পরবর্তী ভারতবর্ষ হয়ে উঠেছে একটি মৃত্যুফাঁদ। সেই ফাঁদ রচনা করছে রাজনৈতিক ও কর্পোরেট শিল্পপতিদের একাংশ।

More Articles