শেখ শাহজাহান, জেসিবি, জয়ন্ত: পাড়ায় পাড়ায় বাহুবলী এটাই তৃণমূলের সংস্কৃতি?
Sheikh Shahjahan, JCB, Jayant Singh: সরকার পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা যদি তৈরি না হতো কেউ কি কোনওদিনও শেখ শাহজাহানের দাপটের আঁচ পেত?
সন্দেশখালি থেকে চোপড়া হয়ে আড়িয়াদহ। পশ্চিমবঙ্গে গত কয়েক মাস ধরে শাসকের ছায়াতে বেড়ে ওঠা স্থানীয় গুন্ডা কাম নেতাদের বাড়বাড়ন্ত চোখে পড়ার মতো। শাসকের ছায়াতে দুষ্কৃতীর বৃদ্ধি, স্থানীয় স্তরে ক্ষমতা ধরে রাখতে উঠতি মস্তানদের মাথায় রাজনীতির হাত রাখা নয়া ঘটনা নয়। বামেদের জমানাতেও 'গুন্ডা' পোষার অভিযোগ ছিল, গুন্ডা পুষতেন কংগ্রেসিরাও, পোষেন তৃণমূল-বিজেপির নেতারাও। কিন্তু আগে কখনই স্থানীয় গুন্ডাদের অগাধ শক্তি পেতে দিতেন না নেতারা। বুঝিয়ে দেওয়া হতো ক্ষমতার দরবারে 'বাবা' কে। এখন, বেশ কিছুকাল ধরেই, পাড়ায় পাড়ায় 'দাদা' তৈরির পরিমাণ বাড়ছে, আর ক্ষমতায় ঘ্রাণ এমন যে অজান্তেই নিয়ন্ত্রণ বেরিয়ে যাচ্ছে শাসকের হাত থেকেও। বাংলার রাজনীতিতে শাসকের মদতপুষ্ট গুন্ডাদের অপরাধের কি নিজস্ব জগত তৈরি হয়ে যাচ্ছে তবে?
সন্দেশখালির বেতাজ বাদশা হয়ে উঠেছিলেন শেখ শাহজাহান শেখ। দাপট এমনই বাড়ে যে লোকসভা নির্বাচনের আগে সন্দেশখালিতে মহিলাদের উপর অত্যাচার ও স্থানীয়দের নিগ্রহ জাতীয় রাজনীতির ইস্যু হয়ে ওঠে। চোপড়ায় তাজিমুল ইসলাম ওরফে জেসিবির বাড়বাড়ন্ত এমনই যে স্থানীয় তৃণমূল নেতারা সব জানলেও গণপিটুনির ঘটনা নিয়ে রাজ্যস্তরে কোনও জলঘোলা হয় না। জয়ন্ত সিংয়ের মতো দুষ্কৃতী আড়িয়াদহ ব্যারাকপুরের বাহুবলী হয়ে ওঠেন। ছেলে ও মাকে রাস্তায় ফেলে মারধর করার ঘটনা সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে। তার বহু আগের বহু বহু ভিডিও রয়েছে যা দেখে শিউরে উঠতে হয়। বাংলার রাজনীতি এমন উত্তরপ্রদেশের ছাঁচে ঢালা হলো কীভাবে?
আরও পড়ুন- আড়িয়াদহে মা-ছেলেকে পিটুনি! মদন মিত্রের ছায়ায় যেভাবে বেড়ে উঠল গুন্ডা জয়ন্ত সিং
এই স্থানীয় গুন্ডাদের বাড়বাড়ন্ত যে হঠাৎ করে হয়নি তা বলাই বাহুল্য। এদের অনেকের শিকড় লুকিয়ে বাম যুগেই। উত্তর ২৪ পরগণার শাসনের মজিদ মাস্টার, তপন, মেদিনীপুরের সুকুর – সবাই বামপন্থী নেতাদের ছায়াতে বেড়ে উঠেছিলেন, হয়ে উঠেছিলেন এলাকার মাথা। রাজ্যে সিপিআইএমের ৩৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটে ২০১১ সালে। তখন বামেদের 'পোষা' গুন্ডারাও 'বাবা' বদলে নেন। কেউ কেউ জেলে যান, কেউ কেউ দল পাল্টে নিয়ে বেঁচে যান। শাহজাহান শেখ তো তেমনই একজন। স্থানীয়রা বলছেন, চোপড়ার জেসিবিও আগে বামেদের হয়েই কাজ করত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক নেতাদের হাতের মুঠোয় থাকা এই বাহুবলীরা তৃণমূল কংগ্রেসের যুগে আরও বড় নেতা হয়ে যান। মুশকিল হলো, বামেদের বেলায় যদিও বা সামান্য নিয়ন্ত্রণ ছিল ঘাসফুলের গালিচায় সেসব হারিয়ে গেল। কতটা করতে হবে, কোথায় থামতে হবে নিয়ন্ত্রণ রইল না। ফলে অবস্থা এমন দাঁড়াল, মন্ত্রীদের থেকেও কোনও কোনও বাহুবলীর প্রতিপত্তি, সম্পত্তি আকাশ ছুঁতে শুরু করল।
গুন্ডাদের কথা হলে অবশ্যই আরাবুল ইসলামের নাম আসে। ভাঙর এলাকার 'ত্রাস'। এই তালিকার শীর্ষে রইবেন অনুব্রত মণ্ডল। জেলে শুকিয়ে গেছেন ঠিকই। কিন্তু বীরভূম জেলার তৃণমূলের সভাপতি এলাকার জনপ্রিয় নেতা এবং মস্তান ছিলেন একইসঙ্গে। বীরভূমের নির্বাচন সামলে দিতেন ঘরে বসেই। তবে অনুব্রত, আরাবুল, শাহজানরা শুধু 'গুন্ডা' ছিলেন না। এদের নামের সঙ্গে তৃণমূলের দলীয় পদও ছিল। জেসিবি এবং জয়ন্ত সিংরা দলীয় পদাশিকারী নন। তবে তারা ছায়া। কাদের? হামিদুল এবং মদন মিত্রের মতো শক্তিশালী স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের।
আরও পড়ুন- অপহরণ থেকে শুরু করে সিপিএম নেতা খুন! পুলিশের খাতায় ‘অপরাধে’র লম্বা তালিকা চোপড়ার জেসিবি-র
চোপড়া এবং সন্দেশখালির সাধারণ মানুষরা বলছেন, জেসিবি, শাহজাহানের মতো লোকেরা নির্বাচনের সময় মানুষকে ভয় দেখিয়েছে। দিনের পর দিন এমনভাবে কাজ করেছে, এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে যাতে শাসকদল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয় এবং এই স্থানীয় নেতাদের ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পায়। চোপড়ার জেসিবির বিরুদ্ধে কমপক্ষে ১২টি মামলা রয়েছে। আড়িয়াদহের জয়ন্ত সিংয়ের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার মামলা রয়েছে। কিছুদিন জেল খেটের জামিন পেয়ে যান তিনি। অনাদিকাল থেকেই এমনটা ঘটে। রাজনৈতিক দলের হাত মাথায় থাকলে জেল খাটাবে সাধ্য কার! শাস্তি হবে না এ বলাই বাহুল্য।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় 'গুন্ডাগিরি'-র বিরুদ্ধে কথা বলেন। শাহজাহানকে গ্রেফতার করাতে তৎপরতা না দেখালে সরকার পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা যদি তৈরি না হতো কেউ কি কোনওদিনও শেখ শাহজাহানের দাপটের আঁচ পেত? শেখ শাহজাহান একইভাবে সন্দেশখালিতে কাজ চালিয়ে যেতেন। আড়িয়াদহের গণপিটুনির ঘটনার আগে ক্লাবের মধ্যে অস্ত্র প্রশিক্ষণ, কিশোরের যৌনাঙ্গ সাঁড়াশি দিয়ে টানার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে। কেই বা সে সবের খবর রেখেছে! এখন জয়ন্ত সিংকে গ্রেফতার করা হয়েছে, আগেও হয়েছে। খবরের আঁচ কমে যেতেই তারা মুক্তিও পেয়েছে। আসলে তৃণমূল হোক বা যে কোনও শাসক, এলাকায় ভয়ের রাজনীতিই যে ভোটবাক্স ভরায় এই কৌশল সকলের জানা। তাই শাসকের হাত মাথায় নিজে, জেসিবি বা জয়ন্ত সিংদের বাড়বাড়ন্ত চলবেই। প্রশ্ন একটাই, এই বাড়বাড়ন্ত শাসকের ছায়ার থেকেও বড় হয়ে যাবে না তো?