চাঁদ-জয় থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দাপট! যা খেল দেখাল ২০২৩
2023 Science and Technology: সদ্য করোনার ক্ষত ভোলা বছরটায় কী কী হল বিজ্ঞানের জগতে? কোন কোন আবিষ্কার মানুষের মাথা করল আরও একটু উঁচু।
কালের গর্ভে চলে যাচ্ছে আরও একটা বছর। বিশ্ব রাজনীতি, যুদ্ধবিগ্রহের দিক থেকে ২০২৩ সালটা ছিল আক্ষরিক অর্থেই রোলার কোস্টার। কিন্তু কোনও দেশের উন্নতির মাপকাঠি রাখা তাঁর বিজ্ঞানগত প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে। সদ্য করোনার ক্ষত ভোলা বছরটায় কী কী হল বিজ্ঞানের জগতে? কোন কোন আবিষ্কার মানুষের মাথা করল আরও একটু উঁচু। বিজ্ঞানের জগতে এমন কী-ই বা হল, যা দেখে বুঝে জেনে বিজ্ঞানীমহল হলেন যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। কোন কোন আবিষ্কার ২০২৪ সালটাকে করে তুলতে চলেছে অন্যরকম। কোন কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয় গ্রাস করল বছরটাকে। আসুন দেখে নেওয়া যাক, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির দুনিয়ায় ঠিক কেমন গেল ২০২৩ সালটা? প্রকৃতিতেই বা ঘটল কী কী বদল?
চাঁদে পা
আজ থেকে নয়, দীর্ঘদিন ধরেই দেশের উন্নতির চাবিকাঠি রাখা ছিল তার মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে। যে দেশ মহাকাশ দখলের লড়াইয়ে যত এগিয়ে, সে দেশ তত এগিয়ে। এ নিয়ে রেষারেষিও কম হয়নি প্রথম বিশ্বের দেশগুলির মধ্যে। বিশেষত আমেরিকা ও রাশিয়া ছিল এই লড়াইয়ের প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী। পিছিয়ে ছিল না চিনও। তবে তৃতীয় বিশ্বের দেশ হওয়া সত্ত্বেও বরাবর মহাকাশ গবেষণায় উল্লেখযোগ্য জায়গা বজায় রেখেছিল ভারত। আর এবার সেই সাফল্যের ঝুলিতে ঢুকে পড়ে চাঁদ-জয়ের সাফল্যও। তিন বারের চেষ্টার পর শেষপর্যন্ত সফল হয়েছে ইসরোর চন্দ্রযান-৩ মিশন। এর আগে চাঁদের মাটিতে পা রেখে ফেলেছে আমেরিকা, রাশিয়া এবং চিন। সেই হিসেবে ভারত চাঁদে পা রাখা চতুর্থ দেশ। তবে ভারতের অতিরিক্ত সাফল্য হল যে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পা রাখা প্রথম দেশ তাঁরাই। চলতি বছরের জুলাই মাসে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটা থেকে চাঁদের উদ্দেশ্য রওনা হয়েছিল চন্দ্রযান ৩। অবশেষে গত ২৩ অগস্ট চাঁদের মাটিতে অবতরণ করে চন্দ্রযান ৩। মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে যায় দিনটি। ২০২৩ সালের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দুনিয়ায় সাফল্যের কথা বলতে গেলে এই চাঁদ-জয় গাথার উল্লেখ কিন্তু না করলেই নয়।
আরও পড়ুন: ২০২৩ সালে কোন শব্দটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছেন আপনি? চমকে যাবেন এই উত্তরে
AI-র রমরমা
২০২৩ সালটাই আদতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের। যা ছিল এতদিন বিজ্ঞানীমহলের হাতের মধ্যে, তা চলতি বছরে হয়ে উঠেছে আক্ষরিক অর্থেই সর্বজনীন। এআই দাপটে কখনও ভিক্টোরিয়া ঢেকে যাচ্ছে বরফে তো কখনও শাহরুখ খান হয়ে যাচ্ছেন লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও। তবে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথা বলতে গেলে অবশ্যই বলতে হবে ২০২২ সালে আত্মপ্রকাশ করা চ্যাটবট পরিষেবা চ্যাটজিপিটির কথা। ওপেনএআই-এর হাত ধরে ২০২২ সালের শেষে লঞ্চ হয়েছিল এই চ্যাটবট পরিষেবা, যা আদতে ব্যবহার একটি বিশেষ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল, যার আধারই হল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। ২০২৩ সালে ভয়ঙ্কর রকমের ভাইরাল হয়েছে এই চ্যাটজিপিটি। চ্যাটজিপিটিকে পাল্লা দিতে বাজারে নামে গুগলও। রাতারাতি তারাও তাদের চ্যাটবট পরিষেবা বার্ড আনার কথা ঘোষণা করে দেয়। গুগলের বিভিন্ন শাখাতেই আশীর্বাদী হাত রাখতে শুরু করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এমনকী চিকিৎসা বিজ্ঞানেও ঢুকে পড়েছে এআইয়ের ব্যবহার। বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা থেকে শুরু করে অস্ত্রোপচার,এমনকী পক্ষাঘাতগ্রস্ত বা স্ট্রোক হওয়া রোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রেও ব্যবহার হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। শুধু কি তাই, গোটা বিশ্ব জুড়ে মারাত্মক ভাবে বেড়েছে এআই দাপট। ২০২৩ সালের কনজিউমার ইলেকট্রনিক্স শো (CES)-এর মঞ্চে আত্মপ্রকাশ করেছিল একাধিক এআই পাওয়ারড রোবট। এই বছরই ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে প্রথম বার এআই টুলের মাধ্যমে শুনানির লাইভ ট্রান্সস্ক্রিপশন হয়েছে। এতদিন যে কাজটি করা হত ম্যানুয়ালি, কোনও কর্মীর মাধ্যমে। তিনি কাগজ-কলমের মাধ্যমে লিখে রাখতেন গোটা শুনানি প্রক্রিয়াটি। সুপ্রিম কোর্টে এআই ট্রান্সক্রিপশনের ব্যাপারটি কিন্তু যথেষ্ট সফল হয়েছে।
নাসার হাতে গ্রহাণু-খণ্ড
২০২৩ সালে মহাকাশ গবেষণার দুনিয়ায় আরও একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে। ইতিহাসে এই প্রথম বার নাসার হাতে এসেছে গ্রহাণুর অংশ। সেই সুবিশাল অ্যাস্টেরয়েডর নমুনাটির ছবিও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করে নাসা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে উটাহ মরুভূমি থেকে উদ্ধার হয় অ্যাস্টেরয়েড টুকরোটি।মহাকাশ বিশেষজ্ঞদের অনেকেই জানিয়েছেন, মহাকাশ গবেষণার বিশ্বে এ আদতে বিরাট এক মাইলস্টোন। সোলার সিস্টেমের গোড়ার দিনগুলো সম্পর্কে ধারণা পেতে সাহায্য় করবে এই আবিষ্কার। পাশাপাশি প্রাণের উৎস সম্পর্কেও একটি ধারণা দিতে পারবে এই গ্রহাণুর টুকরো।
থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা
থ্যালাসেমিয়া রোগীদের বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র উপায় ঘন ঘন রক্ত ট্রান্সফিউশন। যা যথেষ্ট কষ্টদায়ক এক প্রক্রিয়া। সেই থ্যালাসেমিয়ার দুনিয়ায় যুগান্তকারী এক চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে ২০২৩ সালে। বিটা থ্যালাসেমিয়া ও সিকেল সেল রোগের চিকিৎসার জন্য এই প্রথম বার জিন এডিটিং থেরাপি আবিষ্কার হয়েছে। যা জেনেটিক মিউটেশনের মাধ্যমে হিমোগ্লোবিনের উৎপাদন ও কাজকে প্রভাবিত করবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞেরা।
রেকর্ড গরম
এত সব ভালো সত্ত্বেও এই বছরটা যে পুরোটাই ভালো ছিল, তা কিন্তু নয়। এই বছরে বিশ্ব উষ্ণায়ন ছুঁয়েছে রেকর্ড মাত্রা। দিন কে দিন আরও খারাপ হচ্ছে পরিস্থিতি। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গরম, গলে যাচ্ছে হিমবাহ। সমুদ্রের জল বাড়ছে বহুগুণ। মরে যাচ্ছে সামুদ্রিক প্রাণীরা। ওয়ার্ল্ড মেটেরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন, রাষ্ট্রপুঞ্জ, NOAA-সহ একাধিক সংগঠন জানিয়েছে, এই বছরটা ছিল উষ্ণতম বছর।
দাবানলে পুড়ল কানাডা ও হাওয়াই
২০২৩ সালটা কিন্ত কানাডা ও হাওয়াইয়ের বিস্তীর্ণ এলাকা। ভয়ঙ্কর দাবানলে অক্টোবর থেকে জ্বলছে কানাডাক প্রায় ৪৫ মিলিয়ন এলাকা। ১৯৮৯ সালের দাবানলের থেকে যা ছিল প্রায় তিনগুণ। আকাশ ভরেছিল কালো ধোঁয়ায়। হাওয়ার জেরে আগুন ছড়িয়ে আরও কয়েক গুণ। জুন মাস থেকেই দাবানলেপ প্রভাব পড়েছে আমেরিকা, স্পেন, ব্রিটেন ও নরওয়েতে। অন্যাদিকে হাওয়াইয়ের মাওউই দ্বীপে দাবানল প্রাণ কেড়েছে অন্তত ১০০ জনের। যা আমেরিকার দাবানলের ইতিহাসে কার্যত রেকর্ড।
ইসরো-র সূর্য অভিযান
চাঁদের পর সূর্য। ইতিমধ্যেই সূর্যের উদ্দেশে নতুন একটি মহাকাশযান পাঠিয়েছে ইসরো। ইতিমধ্যেই সূর্যের আশপাশে পৌঁছে গিয়েছে আদিত্য এল ১। আগামী বছরের ৬ জানুয়ারি উদ্দিষ্ট গন্তব্য অর্থাৎ ল্যাগারেঞ্জ পয়েন্টে পৌঁছে যাওয়ার কথা সৌরযানটির। মহাকাশের আবহাওয়া ও পৃথিবী-সহ অন্যান্য গ্রহের উপরে সূর্যের প্রভাব নিয়ে বহু নতুন তথ্য জানা যাবে বলেই আশাবাদী ইসরোর বিজ্ঞানীরা।
আরও পড়ুন:২০২৩: বর্ষশেষে ফিরে দেখা পাঁচটি বাংলা বই
সব মিলিয়ে ২০২৩ সালটা কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতে বেশ সাড়া জাগানো ছিল, তা অস্বীকার করার জায়গা নেই। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের আশীর্বাদী হাত, স্বাস্থ্য থেকে মহাকাশ গবেষণায় দুর্দান্ত অগ্রগতি দেখেছে বছরখানা। বিশ্ব জুড়ে একাধিক বড় যুদ্ধ, প্রাণহানি, মৃত্যুমিছিল থেকে শুরু করে একাধিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে তা একটু হলেও যে বিশ্ববাসীকে আশার কথা শুনিয়েছে। তবে বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির সঙ্গেই আসে তার খারাপ দিকগুলোও। ইতিমধ্যেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার খারাপ দিকগুলোর সঙ্গেও আমরা পরিচিত। আসন্ন বছরে যেন খারাপের মধ্যে থেকে যা কিছু ভালো, কল্যাণকর, তাকেই আমরা বেছে নিতে পারি, সেটুকুই প্রার্থনা।