5G দিয়ে ডাটা চচ্চড়ি, মন্দ নয় সে স্বপ্ন ভালো
গোকর্ণর থেকে কিছুটা দূরে ভেসে যাচ্ছে আমাদের স্পিডবোট। দু'দিকে দেখা যাচ্ছে কিছু ডলফিন। স্পিড বোট থেকে দূরত্ব বজায় রেখে লুকোচুরি খেলছে আমাদের সঙ্গে। আমি মশগুল ডলফিনের কীর্তি দেখতে। হঠাৎ আমাদের নৌকার চালক সন্দীপ খোঁটে আমায় আবদার করলো - "আমার মোবাইল থেকে একটা টাকা ট্রান্সফার করে দিন না "। আমি অবাক। মাঝ সমুদ্রে ওঁর মাথায় এই খেয়াল এল কী করে ?
'এখনই?' আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'পাড়ে গিয়ে করলে হয় না?'
'না, বউ ফোন করেছে, ও হসপিটালের বিল মেটাচ্ছে, এখনই হসপিটালের একজনের অ্যাকাউন্টে কিছু টাকা ট্রান্সফার করতে হবে'।
আমার মনে একটু ধন্দ ছিল নেটওয়ার্ক নিয়ে। হসপিটালের কথাটা বলাতে আর কথা বাড়ালাম না। ওঁর কথা অনুযায়ী দশ হাজার টাকা টাইপ করে গুগল পে-তে এন্টার মারলাম। একটু সময় নিলো। সন্দীপের মুখের দিকে তাকালাম। দেখলাম পুরো প্রসেসটায় আমার থেকে ওঁর ভরসা বেশি , মুখে চোখে কোনও টেনশন, কোনও সন্দেহের কোন চিহ্ন নেই। কিছুক্ষণে পেমেন্ট সাকসেস নোটিফিকেশন ভেসে উঠলো স্ক্রিনে। ফোন ফেরত দিয়ে ওঁকে প্রশ্ন করলাম, 'এই যে টাকাটা ট্রান্সফার করলে আমাকে দিয়ে , তোমার ভয় লাগলো না? টাকাটা যদি ট্রানসাকশানে আটকে যেত ?'
সন্দীপ নির্দ্বিধায় উত্তর দিল, 'কিছু গোলমাল হলে তো টাকাটা ফেরত পেয়ে যেতাম , 4G নেটওয়ার্কে আমার ভয় লাগে না।'
আমি অবাক হয়ে দেখলাম একজন প্রাইমারি স্কুল পাশ করা নৌকাচালক যে কিনা ইংরেজি কমান্ডস বোঝে না, ইংরেজি টাইপ করতে পারে না, দিব্যি ডিজিটাল পেমেন্টকে জীবনের অঙ্গ করে নিয়েছে। ওঁর মনে কোনও শঙ্কা নেই।
একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে ভাবি, দেখতে দেখতে 2G , 3G , 4G কে পেছনে ফেলে ভারতবর্ষকে হাতছানি দিচ্ছে 5G - ফিফ্থ জেনারেশন , মোবাইল ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্কের লং টার্ম ইভোল্যুশন (LTE ) ।
তাহলে, 5G কী? আসুন "G" (জেনারেশন) এর একটি টাইমলাইন বিশ্লেষণ করে নিই-
- 1G তার প্রাথমিক পর্যায়ে মোবাইল ফোন এবং মোবাইল কলে সক্ষম।
- 2G-তে এগিয়ে গিয়ে, আমরা আমাদের বন্ধু এবং পরিবারকে টেক্সট করার ক্ষমতা পেয়েছি।
- 3G আমাদের ইন্টারনেট অ্যাক্সেস করার জন্য আমাদের ফোন ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে। এই পরিবর্তন তখন বিপ্লব মনে হয়েছিল আমাদের। মোটামুটি ধীর গতিতে চলছিল এই উত্তরণ উপভোগ।
- তারপরে এলো 4G, যা সম্ভবত আমাদের বেশিরভাগই সবচেয়ে বেশি পরিচিত। আমরা আমাদের সেলফোনের মাধ্যমে কল করতে, ইন্টারনেট ব্রাউজ করতে, টেক্সট করতে, রেডিও শুনতে, টিভি শো দেখতে এবং আরও অনেক কিছু করতে সক্ষম। কিন্তু আমরা এখন যা দেখছি তা হল, নেটওয়ার্ক ওভারলোড হয়ে গিয়েছে এখানে। এটি যতটা প্রয়োজন তত দ্রুত কাজ করতে পারে না। এবং এটি যতটা কাঠামোগত এবং পরিশীলিত হতে পারত, আখেরে ততটা নয়।
আর এখানেই ফাইভ জি-র আগমনী শোনা যাচ্ছে। বলা হচ্ছে 5G নাকি 4G থেকে কুড়ি গুণ বেশি শক্তিশালী | কী করে? দিব্যি তো ইউটিউব , নেটফ্লিক্স দেখছি, বাচ্চারা দু'বছর ধরে অনলাইন ক্লাস করছে।
আসুন একটু বোঝা যাক।
ইন্টারনেট স্পিডের দুটো স্তম্ভ - ব্যান্ডউইডথ আর ল্যাটেন্সি | সহজ ভাষায়, যদি ব্যান্ডউইথ একটি হাইওয়ের প্রস্থ হয় তবে ল্যাটেন্সি হল রাস্তার হাজারো বাধাবিঘ্ন যা বিলম্বের কারণ। 4G-এর তুলনায় 5G-এর লেটেন্সি খুবই কম৷ যদিও 4G 50ms এর লেটেন্সিতে সীমাবদ্ধ ছিল, 5G তাত্ত্বিকভাবে 1ms পর্যন্ত কম হতে পারে |
ভেবে দেখুন - একজন ডাক্তার পৃথিবীর অন্য কোনও প্রান্ত থেকে রোবটিক সার্জারি করছে ভারতবর্ষের কোনও এক রোগীর, কয়েক মিলিসেকেন্ডের ব্যবধানে রয়েছে জীবন-মরণ সিদ্ধান্ত | এই সময় এক মাত্র ভরসা ইন্টারনেট স্পিড যা দিতে পারে শুধু 5G ।
5G হলো এমন প্রযুক্তি যা গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবাগুলি রিমোট কন্ট্রোল দ্বারা সমর্থন করতে সক্ষম করবে ৷ এটি স্বায়ত্তশাসিত ড্রাইভিং, ইন্টারনেট অফ থিংস ( IOT ), ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং ডেটা অ্যাক্সেস, সুরক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যবসার কাজ করার পদ্ধতিকে অগ্রসর করবে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI ) এবং ভার্চুয়াল রিয়ালিটি, অগমেন্টেড রিয়ালিটি (AR,VR ) প্রযুক্তিকে প্রভাবিত করে, মিনিমাম ল্যাটেন্সি এবং হাই স্ট্যান্ডার্ড সফিস্টিকেশনের দ্বারা, সবার জীবনকে ছুঁয়ে যাবে এই 5G।
আরও পড়ুন-প্রিয়জনকে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে উপহার? বিটকয়েন নাকি অন্য কিছু দেবেন?
দ্রুততর ডেটা সংযোগের অর্থ হলো স্মার্ট ডিভাইসগুলি হয়ে উঠবে আরও দ্রুত। একটি বৃহত্তর ব্যান্ডউইথ ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT) ডিভাইসগুলিকে একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সাহায্য করবে, যা শুধুমাত্র স্মার্ট হোম নয় বরং স্মার্ট সিটি গড়ে তুলতে সাহায্য করবে । শহরের রাস্তায় আরও স্ব-চালিত যানবাহন মোতায়েন করা হবে। ল্যাম্পপোস্ট, ট্রাফিক সিগন্যাল এবং ক্যামেরা-সহ সবকিছু একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হবে যা আমাদের শহরকে প্রতিনিয়ত নিরীক্ষণ এবং নিরাপদ করতে সাহায্য করবে। এর মানে হল যে আপনার কাজের পথে, আপনার গাড়ি অন্যান্য যানবাহনের সাথে তথ্য বিনিময় করতে সক্ষম হবে৷ স্ব-চালিত হওয়ায়, এটি সম্ভাব্য দ্রুততম রুট গ্রহণ করবে এবং উপলব্ধ পার্কিং স্লটে নিজেকে পার্ক করবে। গাড়ির মধ্যে এই যোগাযোগ সড়কে যানজটও কমিয়ে দেবে এবং দুর্ঘটনার সংখ্যা কমিয়ে দেবে, বিশেষ করে মানুষের ভুলের কারণে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা।
আশা করা হচ্ছে যে ২০২৭ সালের মধ্যে, ভারত প্রতি মাসে মোবাইল ডেটা ব্যবহারে পৌঁছে যাবে বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানে — যা প্রতি মাসে গড়ে ৫০ GB হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থাকবে নেতৃত্বে, প্রায় 52GB আনুমানিক মাসিক গড় খরচ নিয়ে।
গোকর্ণ থেকে ফিরে এসেছি অনেক দিন হল। যে স্বপ্নবীজ বুকে নিয়ে ফিরেছি তাই ছড়িয়ে দিলাম। অতঃকিম আপনার হৃদয়ে জল-সার পেয়ে মহীরুহ হয়ে উঠুক ফাইভ জি।