প্রতি পদে বিভূতিভূষণের স্মৃতি, সস্তার এই স্বর্গই হোক পুজো ডেস্টিনেশন
Ghatshila: ঝর্নার অবিরাম বয়ে চলা আর পাখির ডাকের শব্দে ভোর নামে সেখানে। চন্দ্রালোকিত রাত্তিরে জ্যোৎস্নায় ভাসে রাতমোহানার চর। সেই রূপ নেশা ধরায় উদভ্রান্ত পথিকের মনে, শান্তি আনে নাগরিক ছুটে চলার ভারে ক্লান্ত, অবসন্নের হৃদয়ে...
একটা সময় ছিল যখন শুধুমাত্র ওষুধ বা পথ্যে শরীর সারত না। রাইটিং প্যাড টেনে একগুচ্ছ ওষুধের প্রেসক্রিপশন লেখার সঙ্গে সঙ্গেই খসখস করে ডাক্তার লিখতেন হাওয়াবদলের পরামর্শ। পশ্চিমের জলে নাকি হজম করার মহৌষধী থাকে। একবার পেটে পড়লেই রোগ পালানোর পথ পায় না। তার পর রইল হাওয়া, তার তো যত প্রশংসা করা যায়, ততই কম। অগত্যা বাঙালি সময়ে-অসময়ে ছুটত হাওয়াবদলে। স্বাভাবিক ভাবেই গিরিডি, গালুডি, মধুপুর, শিমুলতলার মতো একাধিক জায়গায় পড়েছিল সেই বাঙালি আধিপত্যের ছাপ। শুধু ঘুরেই কি আর সাধ মেটে, ক্রমে সেখানে বাড়িঘর কেনা শুরু করলেন বাঙালিরা। গড়লেন বাংলো। কাজকর্ম থেকে ছুটিছাটা পেলেই তা হয়ে উঠত অবসরের ঠিকানা। অনেকে আবার থেকেই গেলেন একেবারে। আর সেই সব হাওয়া বদলের জায়গার মধ্যে অন্যতম ছিল ঘাটশিলা।
আরও পড়ুন: নামমাত্র খরচে পাহাড় ভ্রমণ, দুদিনের ছুটিতে ঘুরে আসুন এই অফবিট জায়গা থেকে
বাংলার সীমান্ত ঘেঁষে অল্প এগোলেই ঝাড়খণ্ডের ঘাটশিলা। এক সময় ধলভূমগড়ের সদর দফতর ছিল এই এলাকা। এখানে একটি রেলওয়ে স্টেশন আছে যেটি দক্ষিণ-পূর্ব রেলপথের অন্তর্ভুক্ত। তবে তাকে আলাদা করে ঝাড়খণ্ডের বলে মানতে ভুল হবে। আসলে অবিভক্ত দেশে এত ভাগাভাগি ছিল না, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রামের মতো বাংলার বহু রাজ্যের একেকটা এলাকা ছিল ঝাড়খণ্ডের অংশ। যেমন মানভূম জেলা ভেঙে পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হয়েছিল পুরুলিয়া জেলা। পূর্ণীয়া জেলা থেকে কিছুটা অংশ ঢুকে পড়ল পশ্চিম দিনাজপুরে যা বর্তমানে আবার উত্তর দিনাজপুর হিসেবে পরিচিত। ফলে সংস্কৃতির মিশ্রন হয়েছে, মিশ্রন হয়েছে ভাষারও। ঘাটশিলাতেও সেই ছাপ স্পষ্ট। দোকান থেকে বাজার, গাড়ি থেকে হোটেল, যেখানেই যাবেন বাংলা ভাষার আধিপত্য টের পাবেন ভালো মতোই। স্টেশনে নামতে না নামতেই হাওয়াবদলের সেই ফুরফুরে ভাবখানা শরীরে এসে লাগতে বাধ্য।
জানা যায়, কয়েকশো বছর আগে রাজস্থানের ঢোলপুর থেকে আসা রাজপুক যুবক জগন্নাথ দেব খাতড়ার সুপুর পরগনার রাজা চিন্তামনি ধোপাকে পরাস্ত করেন। জগন্নাথ শাহজাদা ধবলদেব নাম নিয়ে তিনি রাজা হলেন ধবলভূমের। রাজধানী করলেন সুপুরকেই। নাম বদল হল ধবলভূমের। ঘাটশিলা নামে পরিচিত হল সেই রাজধানী। এরও প্রায় বত্রিশ পুরুষ পর রাজপরিবারের বিবাদের মেঘ দেখা গেল। ছোট-বড় দুই পক্ষের বিবাদের জেরে তৎকালীন রাজা টেকচন্দ্র চলে গেবেন খাতড়া। সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন রাজপ্রাসাদের কুলদেবতা কালাচাঁদ জিউকে। সেখানেই তৈরি হল নতুন মন্দির, যেখানে বিরাজ করলেন কুলদেব। অন্যদিকে, খড়্গেশ্বর ধবলদেব অম্বিকানগরে গিয়ে নিজের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করলেন। বিগ্রহশূন্য পড়ে রইল মন্দির। সেই মন্দিরকে নিজের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে গ্রহণ করলেন ঘাটশিলাবাসী। প্রশাসনিক সাহায্য না পেয়ে দু-দুবার সেই মন্দির নিজেরাই সংস্কার করেছিলেন তাঁরা। তবে ক্রমশ ক্ষয়ের মুখে সেই প্রাচীন ঐতিহ্যশালী মন্দির, যা আসলে আজও বলে চলে ঘাটশিলার প্রাচীন কথা।
হাওয়া বদলের ঠিকানা ঘাটশিলাকে বাঙালির সঙ্গে আরও শক্ত করে বেঁধেছেন সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। পুজোর ঠিক কয়েকদিন আগেই নাকি বিভূতিভূষণ চলে যেতেন ঘাটশিলায়। পুজোটা কাটত সেখানেই। ফিরতে ফিরতে তাঁর মাঘের শেষ কিংবা ফাল্গুনের গোড়ায়। ঘাটশিলার প্রতি মুগ্ধতা তাকে এমন জায়গায় নিয়ে যায় সেখানে একটি বাড়িও কিনে ফেলেন মধুসূদন। নাম রাখেন গৌরীকুঞ্জ। প্রথমা স্ত্রী গৌরীদেবীর নামে। বিয়ের এক বছরের মাথায় যাঁকে হারিয়েছিলেন বিভূতিভূষণ। অপর্ণাকে হারানো অপুর মধ্যে কি কোথাও পড়েছিল সেই ছায়া! সেই ছায়া পড়ে রয়েছে ঘাটশিলাতেও।
পুরুলিয়া থেকে দু'পা এগোলেই ছোট জনপদ ঘাটশিলা। পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে সুবর্ণরেখা নদী। জনশ্রুতি, এক সময় নাকি নদীর তটে খুঁজলে মিলত সোনার কণা। সেই থেকেই নাম সুবর্ণরেখা। সেই সুবর্ণরেখাকে ঘিরে রেখেছে অনুচ্চ সব পাহাড়, টিলা আর জঙ্গল। চরিত্রে শান্ত সে। ঝর্নার অবিরাম বয়ে চলা আর পাখির ডাকের শব্দে ভোর নামে সেখানে। চন্দ্রালোকিত রাত্তিরে জ্যোৎস্নায় ভাসে রাতমোহানার চর। সেই রূপ নেশা ধরায় উদভ্রান্ত পথিকের মনে, শান্তি আনে নাগরিক ছুটে চলার ভারে ক্লান্ত, অবসন্ন মানুষটির হৃদয়ে। ঘাটশিলা বিখ্যাত তার তাম্রখনির জন্যেও। এশিয়ার প্রথম তাম্রখনির খোঁজ মিলেছিল এখানেই। পাশাপাশি পৃথিবীর দ্বিতীয় গভীরতম খনিও রয়েছে এখানেই। মোসাবনি-সহ সেখানকার নানা খনি আজও জীবন্ত। যাদুগোড়ায় রয়েছে বিরাট ইউরেনিয়ামের খনি। ফলে এলাকা জুড়ে লেগে থাকে নিরাপত্তার বেষ্টনী। তো হোক, তবু ঘাটশিলা পর্যটকদের আপন করে নিতে জানে। মায়ামাখা এক শীতলতা ছড়িয়ে থাকে সেই আত্মীয়তায়।
সেই শান্ত মায়াবী ঘাটশিলা কিন্তু হতেই পারে নাগরিক ভিড় এড়িয়ে পুজো কাটানোর গন্তব্য, যেমনটা কাটাতেন বিভূতিভূষণ। ছোট্ট এই জনপদ ঘিরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সাঁওতালি, আদিবাসী সম্প্রদায়ের পদচারণ। পল্লিগ্রামের মায়া মাখা মেদুরতা ঘিরে থাকে তাঁকে। চোখকে তা আরাম দেয়, মনকেও। সুউচ্চ শোরগোল তাকে ছোঁয় না তেমন। মায়াবী সেই জলহাওয়ায় শরীর শুধরানোর পাশাপাশি ঘুরে আসা যেতে পারে ঘাটশিলার দ্রষ্টব্য স্থানগুলি থেকে। পর্যটকদের জন্য যাবতীয় পসরা সাজিয়ে বসে থাকে ঘাটশিলা।
ঘাটশিলায় নেমেই প্রথম আকর্ষণ বুরুডি হ্রদ। পাহাড় আর জঙ্গল দিয়ে ঘেরা সেই হ্রদে নৌকোবিহার যেন স্বর্গীয় অভিজ্ঞতা, শরতের নীল আকাশ আর সাদা মেঘের ভেলা তাতে যেন 'চেরি অন দ্য টপ'। গিরিডি থেকে অল্পই দূরে ধারাগিরি জলপ্রপাত। তবে তার জন্য হাঁটতে হতে পারে বেশ কিছুটা পথ। বাদল সরকার তাঁর 'এবং ইন্দ্রজিৎ' নাটক শেষে বলেছিলেন, 'তীর্থ নয়, তীর্থপথ মনে যেন রয়।' ভ্রমণপীপাসুদের কাছে এর চেয়ে বড় সত্য আর নেই। ধারাগিরি প্রপাত ক্রমক্ষয়ীষ্ণু, তবে ওই যাত্রাপথ যে আপনাকে লাখ টাকার অভিজ্ঞতা দেবেই, সে ব্যাপারে সন্দেহের রেশ মাত্র নেই।
সুবর্ণরেখা পেরিয়ে ডান হাতের পথে আরেকটু হাঁটলেই রাতমোহানার চর। পাহাড়ি টিলার উপর থেকে সূর্যাস্ত দেখা সেখানে কোনও স্বর্গীয় অভিজ্ঞতার চেয়ে কম নয়। রেলস্টেশনের পূর্বে থানা লাগোয়া পশ্চিমে আদিবাসী দেবী রনকিনির মন্দির। দেবী উগ্ররূপা। পর্যটকদের এক অবশ্য দ্রষ্ঠব্য স্থান এই মন্দির। দহিজোড়ায় রয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের একটি আশ্রম। সেখানকার সন্ধ্যারতি আপনার ভ্রমণপথ জুড়ে ছড়িয়ে রাখবে স্নিগ্ধতার পরশ। রেলস্টেশন থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরেই রয়েছে ফুলডুংরি পাহাড়ের টিলা। সেটিও কিছু কম আকর্ষণের নয় পর্যটকদের কাছে। দহিজোড়া থেকে ঘণ্টা পাঁচেকের পথ সিদ্ধশ্বর পাহাড়ের শিব-পার্বতী মন্দির। টিলার পাশ দিয়ে মেঠোপথ পেরিয়ে ৯ কিলোমিটার দূরে বুরুডি বাঁধ। এখান থেকে চাষের কাজে জল পৌঁছয়। আশপাশ শান্ত। নীলচে-সবুজ শান্ত জলে ছায়া ভাসে দলমা পাহাড়ের।
ঘুরে দেখতে হবে ঘাটশিলা শহরও। দেখতে পারেন রাজ এস্টেটের দুর্গামন্দির। পাশাপাশি বিভূতিভূষণের বাড়ি গৌরীকুঞ্জ এক অবশ্যদ্রষ্টব্য স্থান ঘাটশিলার। অপুর পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাবেন অপুর পাঠশালায়, যেখানে এখন চলে পিছিয়ে পড়া খুদেদের জন্য বিনি পয়সার ক্লাস। ঘাটশিলা থেকেই দেখে আসতে পারেন পুরুলিয়ার দুয়ারসিনি। পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা ওই পথেই পড়বে সাতগুড়ুং নদী। সেখান থেকে একটু এগোলেই দেখা মিলবে ভালোপাহাড়েরও। ভিনরাজ্য থেকে সীমান্তে পা রেখে নিজের রাজ্যকে দেখার অনুভূতিটা কিন্তু বিশ্বাস করুন অন্যরকম। ঘাটশিলা থেকে ঘুরতে পারেন জামশেদপুরের জুবিলি পার্ক, ডিমনা লেক এমন দলমা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যও।
আরও পড়ুন: ঘর থেকে দু’পা গেলেই কাশ্মীর! সাধ্যের মধ্যে শিকারা-ভ্রমণ করা যাবে পাহাড়ে-ঘেরা এই জায়গায়
হাওড়া স্টেশন থেকে হাওড়া-বরবিল সুপারফাস্ট স্পেশাল বা হাওড়া-টিটলাগড় সুপারফাস্ট স্পেশাল ধরে ঘাটশিলায় পৌঁছে যান সকাল সকাল। পেয়ে যাবেন আরও বেশ কিছু ট্রেন। ঘাটশিলা জুড়ে অজস্র ছোট ছোট হোটেল রয়েছে। থাকার জায়গার অভাব নেই সেখানে। কাছেপীঠের স্থান ঘোরার জন্য পেয়ে যাবেন টোটো। রয়েছে গাড়ির ব্যবস্থাও। ফলে এই পুজোয় আপনার নিভৃতের আস্তানা হয়ে উঠতেই পারে বাড়ির পাশের এই জনপদ। বাঙালি অধ্যুষিত ঘাটশিলায় দুর্গাপুজোর আস্বাদও পেয়ে যাবেন আশপাশেই। ফলে ঘোরাও হবে, পুজো কাটানোও হবে আর ঘাটশিলার জল-হাওয়ার পরশে বিষমুক্ত হবে নাগরিক ব্যস্ততার ভিড়ে নুব্জ্য-ক্লান্ত শরীর।