সন্তানের জন্ম দিতে না চাওয়া সত্যিই স্বার্থপরতা?
Anti Natalism: 'অ্যান্টি-ন্যাটালিজম' বলছে সন্তান জন্ম দেওয়াই অনৈতিক। অ্যান্টি-ন্যাটালিস্টরা এই সামাজিক ধারণার বিরুদ্ধে যে, সন্তানহীনতা আসলে স্বার্থপরতা।
বিয়ে অর্থাৎ সন্তান উৎপাদন। বিয়ে না করলে চাপ এক ধরনের, কিন্তু বিয়ে করে সন্তান নিতে না চাওয়ার সিদ্ধান্তের পরে আসা চাপ সম্পূর্ণ অন্য। তবে, গত বেশ কয়েক দশকে আমাদের চারপাশে এমন দম্পতিদের সংখ্যা বাড়ছে, এমন মহিলাদের সংখ্যা বাড়ছে যারা সন্তান নিতে চাইছেন না। মহিলাদের গর্ভধারণ, গর্ভপাত সবেতেই সামাজিক, এমনকী রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আছে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনের পর প্রথম কয়েক দিনে, আমেরিকায় মেয়েদের জরুরি গর্ভনিরোধক কেনার হার বেড়ে যায়। মার্কিন দু'টি সংস্থা জানিয়েছিল, গত সপ্তাহের তুলনায় প্রায় ১,০০০% বেশি বিক্রি হয়েছে মহিলাদের গর্ভনিরোধক। ইন্ট্রাইউটেরাইন ডিভাইস বসাতে ডাক্তারদের কাছে যাওয়ার হার বেড়ে যায় ৭৬০%! কেন? কারণ মার্কিন প্রশাসন মেয়েদের গর্ভপাতের বিরোধী। মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট গর্ভপাতের সাংবিধানিক অধিকার বাতিল করেছে আড়াই বছর আগেই। মার্কিন মহিলাদের বড় অংশের মনে আশঙ্কা ছিল ট্রাম্প প্রশাসন মেয়েদের গর্ভধারণ ও গর্ভপাতের অধিকারকে আরও খর্ব করতে পারে। এখন আমেরিকার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ রাজ্যই গর্ভাবস্থার প্রথম ছয় সপ্তাহের পরে, বা প্রায় সম্পূর্ণভাবেই গর্ভপাত নিষিদ্ধ করেছে।
২০১৯ সালের একটি বক্তৃতায়, ভাইস-প্রেসিডেন্ট-নির্বাচিত জেডি ভ্যান্স বলেছিলেন, "মানুষ তাদের সম্প্রদায়ের সঙ্গে, পরিবারের সঙ্গে, দেশের সঙ্গে আরও বেশি সংযুক্ত হয়ে ওঠে কারণ তাদের সন্তান রয়েছে"। ২০২১ সালে, জেডি ভ্যান্স টুইট করেছিলেন যে, কম জন্মহার মানুষকে 'অসামাজিক' করে তুলেছে। ২০২৪ সালে ট্রাম্পের এক সমাবেশে আরকানসাসের গভর্নর সারাহ হাকাবি স্যান্ডার্স বলেছিলেন, তাঁর সন্তানরা তাঁকে বোঝায় জীবনে কী গুরুত্বপূর্ণ, সন্তানরা তাঁকে বিনয় শিখিয়েছে। স্যান্ডার্স বলেছিলেন, কমলা হ্যারিসের দুই সৎ সন্তান আছে, কিন্তু নিজের কোনও সন্তান নেই, ফলে তিনি 'নম্র' নন।
রাজনীতির জগতের বাইরেও অনেকেই একই মত পোষণ করেন। শুধু আমেরিকাতে নয়, সারা বিশ্বেই এমন মানুষ আছেন। জন্মহার হ্রাসকে আত্মকেন্দ্রিক সংস্কৃতির লক্ষণ মনে করেন এই মানুষরা। ধর্মের সঙ্গে মেয়েদের সন্তান জন্ম দেওয়াকে সরাসরি জুড়ে দেওয়া হয়। অনেক নিঃসন্তান মানুষ সন্তান চান, কিন্তু সন্তান হয় না। অনেকেই ব্যক্তিগত বা অর্থনৈতিক কারণে সন্তান নাও চাইতে পারেন। কিন্তু বর্তমানে এই সন্তান জন্ম না দেওয়া ঘিরে আরেকটি আন্দোলন তৈরি হচ্ছে। 'অ্যান্টি-ন্যাটালিজম' বলছে সন্তান জন্ম দেওয়াই অনৈতিক। অ্যান্টি-ন্যাটালিস্টরা এই সামাজিক ধারণার বিরুদ্ধে যে, সন্তানহীনতা আসলে স্বার্থপরতা। অ্যান্টি-ন্যাটালিস্টরা বিশ্বাস করেন, আসলে তাঁরা তাঁদের অনাগত সন্তানদের রক্ষা করছেন, সন্তানদের অবহেলা করছেন না। সন্তানহীনতা একটি নৈতিক পছন্দ।
আরও পড়ুন- 4B Movement: বিয়ে-সন্তান-যৌনতাকে ‘না’! কেন এত জনপ্রিয় হচ্ছে এই আন্দোলন?
অ্যান্টি-ন্যাটালিজম আসলে কী?
১৯৭০-এর দশকে, 'অ্যান্টি-ন্যাটালিজম' শব্দটি ব্যবহার করা হতো সরকারের সেই সব নীতির ক্ষেত্রে যেখানে একটি দেশের উর্বরতার হার কমানোর জন্য নানা প্রকল্প নিচ্ছে শাসক। যেমন ১৯৭৫-১৯৭৭ সালে এদেশে জরুরি অবস্থার সময় লক্ষ লক্ষ পুরুষের নির্বীজকরণের প্রচার চালানো হয়৷ এই জাতীয় নীতিগুলি অতিরিক্ত জনসংখ্যা এবং দারিদ্র্য মোকাবিলার জন্যই তৈরি করা হয়েছিল। পরবর্তী বেশ কয়েক দশক এই ধরনের সচেতনতা প্রচার করে মানুষকে পৃথিবীর স্বার্থে সন্তান ধারণ বন্ধ করতে উত্সাহিত করা হয়েছিল।
তবে ২০০৬ সালে প্রথম অ্যান্টি-ন্যাটালিজম একটি নৈতিক দর্শন হিসেবে উঠে আসে। দু'টি বই প্রকাশিত হয়েছিল তখন। বেলজিয়ান সমাজকর্মী থিওফিল ডি জিরাউডের 'দ্য আর্ট অফ গিলোটিনিং প্রোক্রেটরস', এবং দক্ষিণ আফ্রিকার দার্শনিক ডেভিড বেনাটারের 'বেটার নেভার টু হ্যাভ বিন'। বেশি সন্তান জন্মে পৃথিবীর উপর কী চাপ পড়ছে এই ধারণার উপর জোর দেওয়ার পরিবর্তে, এই নতুন অ্যান্টি-ন্যাটালিজম অজাত সন্তানদের ক্ষতির উপর জোর দেয়। এই দার্শনিকরা যুক্তি দেন, মানুষজন সন্তানের জন্ম না দিয়ে আসলে সেই অজাত শিশুটিকে জীবনের অন্তর্নিহিত বেদনা, সমাজের চাপ, মানসিক অস্থিরতা থেকে বাঁচিয়ে দিচ্ছেন। পাল্টা যুক্তি আসে, যে শিশু জন্মাচ্ছে না সে যেমন যন্ত্রণা পাচ্ছে না ঠিকই, তবে সে তো আনন্দও পাচ্ছে না! জীবনের সুন্দর দিকগুলি থেকে সে বঞ্চিত হচ্ছে। ডেভিড বেনাটার লিখেছিলেন, "যারা নেই-ই, তারা বঞ্চিতও হতে পারে না"।
২০১৯ সালে এই অ্যান্টি-ন্যাটালিজম ভারতে এক নতুন রূপ দেখে। মুম্বইয়ের একজন ব্যবসায়ী রাফেল স্যামুয়েল, তাঁর সম্মতি ছাড়াই তাঁকে জন্ম দেওয়ার জন্য নিজের বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে মামলা করার চেষ্টা করেন। ঘটনাটি অদ্ভুতুড়ে ঠেকলেও, বংশবৃদ্ধির নৈতিকতা, যৌক্তিকতা সম্পর্কে কিন্তু ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের মধ্যেও কথাবার্তা শুরু হয়। এই মুহূর্তে প্রায় ২৩০,০০০ সদস্য সহ বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন অ্যান্টি-ন্যাটালিস্ট গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। ২০২১ সালের মার্চ মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত 'স্টপ হ্যাভিং কিডস' গোষ্ঠী কানাডা, বাংলাদেশ এবং পোল্যান্ড জুড়ে বিক্ষোভের আয়োজন করে। সেই বছরই, আসাগি হোজুমি এবং ইউইচি ফুরুনো অ্যান্টি-ন্যাটালিজম জাপান তৈরি করেন এবং ২০২৩ সাল থেকে টোকিওতে এই গোষ্ঠী নানা প্রচার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। ২০২৪ সালের গোড়ার দিকে, নিমরোদ হারেল নামে একজন ইজরায়েলি কর্মী ৩০টিরও বেশি শহরে জন্মবিরোধী প্রচারের জন্য ইওরোপ সফরের পরিকল্পনা করেন।
অ্যান্টি-ন্যাটালিস্টরা স্বাভাবিকভাবেই নানা রূপে সমালোচিত হন। অধিকাংশেরই অভিযোগ অ্যান্টি-ন্যাটালিস্টরা স্বার্থপর, পরবর্তী প্রজন্মকে বড় করার চেয়ে তাদের নিজস্ব স্বাধীনতা, নিজস্ব সুখকে তারা অগ্রাধিকার দিচ্ছে। অ্যান্টি-ন্যাটালিস্টরা বলছেন, সন্তানের জন্য সন্তান জন্ম দিচ্ছেন, এমন কোনও কারণ তাঁরা দেখতে পান না। বাবা-মা নিজেদের জন্যই, নিজেদের ইচ্ছা ও সুবিধার্ধেই সন্তানের জন্ম দেন। তাহলে এক্ষেত্রে স্বার্থপর কে? অ্যান্টি-ন্যাটালিস্টদের যুক্তি, সন্তান না নেওয়ার বিষয়টি বরং অনাগত সন্তানকে অনেক জটিলতা থেকে রক্ষা করছে।
আরও পড়ুন- আঁতকে ওঠা তথ্য সমীক্ষায়! নিঃসন্তান হবেন ভবিষ্যতের জাপানি মহিলারা! কেন?
সত্যিই সন্তান জন্ম দিতে না চাওয়া স্বার্থপরতা?
বেঙ্গালুরুর একজন অ্যান্টি-ন্যাটালিস্ট শ্যামা। তিনি যখন কোনও খারাপ সংবাদ দেখেন, খারাপ অভিজ্ঞতা হয়, তখন এই ভেবে স্বস্তি বোধ করেন যে অন্তত তাঁর সন্তানদের কখনই এমন কষ্ট ভোগ করতে হবে না। তাই তিনি সন্তান জন্ম দিতে চান না। নিজে না-ও চাইতে পারেন সন্তানের জন্ম দিতে। কেন অন্য বাবা-মা সন্তান নেবেন কিনা সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলছেন তিনি? শ্যামার মতো অ্যান্টি-ন্যাটালিস্টরা বলেন, এই পৃথিবীতে আরেকটি জীবন নিয়ে আসা এবং সেই শিশুর উপর অনিবার্য যন্ত্রণার জীবন আরোপ করার চেয়ে সন্তানের জন্ম না দেওয়া কম অন্যায়ের।
দার্শনিকরা বলছেন, সন্তানের জন্ম আসলে ভবিষ্যতের নিজের ছাপ রেখে যাওয়া মাত্র। যেখানে বাবা-মায়ের অস্তিত্ব তাদের নিজের জীবনকাল অতিক্রম করে থেকে যাচ্ছে পৃথিবীতে। অ্যান্টি-ন্যাটালিস্টরা বলছেন, শিশুরা ভবিষ্যতের অংশীদার নয়। মার্ক্সবাদী অ্যান্টি ন্যাটালিস্ট অনুগ্রহ কুমার বলছেন, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বেশিরভাগ নেতাই নিঃসন্তান। নিজের পরিবারের গড়ার লক্ষ্য থেকে সরে তাঁরা সকলের ভালো ভবিষ্যতের জন্য লড়াই করতে পারেন স্বাধীনভাবে।
ইতিহাস বলছে, হলোকাস্ট এবং হিরোশিমা-নাগাসাকির পারমাণবিক বোমা হামলার পরে, ইহুদি এবং জাপানি লেখকরা জন্ম দেওয়ার বিষয়ে কিছু ভুক্তভোগী মানুষের আশঙ্কার কথা নিজেদের লেখায় তুলে ধরেছিলেন। নৃবিজ্ঞানী জেড সাসারের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের আশঙ্কা, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা পরিবার বৃদ্ধির উপর প্রভাব ফেলছে। জাপানি অ্যান্টি-ন্যাটালিস্টরা, সন্তান জন্মকে সেই ভেন্ডিং মেশিনের সঙ্গে তুলনা করেন যেখানে প্রতিবার কেউ টাকা ঢোকালেই খেলনা বেরিয়ে আসে। বাচ্চারা পৃথিবীতে এসে কী ধরনের জীবন পাবে, কীভাবে বাঁচবে তা না জেনেই বাবা-মায়েরা জীবনের চাকা ঘুরিয়ে দেন। অজাত শিশুদের কাছ থেকে সম্মতি নেওয়ার উপায় থাকে না। তাই সন্তান জন্ম দিতে না চাওয়াকে স্বার্থপরতা বলা যায় না। উল্টে, শুধু বাবা-মা হওয়ার সাধ বা নিজেদের বংশ রেখে যাওয়ার তাড়নায় সন্তানকে পৃথিবী এনে বিড়ম্বনায় ফেলার অধিকার কি বাবা-মায়ের আছে? প্রশ্ন তোলেন অ্যান্টি-ন্যাটালিস্টরা।