প্রতি পদে বিস্ময়, স্বাধীনতার ৭৫-এ বিশ্বকে ভারতের ক্ষমতা চেনাবে চেনাব সেতু

আজ সব প্রতিকূলতাকে জয় করে নতুন ইতিহাসের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে কাশ্মীর উপত্যকা তথা ভারত। জেনে নেওয়া যাক এই সেতুর নির্মাণ সম্পর্কিত কিছু খুঁটিনাটি তথ্য -

চারিদিকে বরফে ঢাকা পাহাড়। তার মাঝে সাদা মেঘের চাদরের ওপর দিয়ে এগিয়ে চলেছে রেলগাড়ি। স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর রেল সফরের অভিজ্ঞতা পেতে চাইলে আর মাত্র কয়েক দিনের অপেক্ষা। তারপর এক ট্রেনে পৌঁছানো যাবে সোজা ভূস্বর্গ কাশ্মীর। ভারতের উচ্চতম সিঙ্গেল আর্চ রেলসেতু হিসেবে খুলে যেতে চলেছে চেনাব রেলসেতু। ইতিমধ্যেই নির্মাণের কাজ প্রায় ৯৮% শেষ হয়ে গেছে। স্টিল এবং কংক্রিটের তৈরি এই সেতু কাশ্মীরের অর্থনীতি আমূল বদলে দেবে - এমনটাই মনে করা হচ্ছে। চেনাব নদীর ওপর ১.৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলসেতু ভূমি থেকে ৩৫৯ মিটার ( ১১৭৮ ফিট) উচ্চতায় তৈরি করা হয়েছে, যা আইফেল টাওয়ারের চেয়েও ৩০ মিটার বেশি উঁচু। জম্মু কাশ্মীরের রিসাই জেলার বাক্কাল এবং কৌরির দুগ্গা রেলস্টেশনের মধ্যে সংযোগ হিসেবে তৈরি হয়েছে। ২০০৪ সাল থেকে শুরু হয়েছে চেনাব সেতু নির্মাণের কাজ। এলাকার প্রতিকূল ও চরম আবহাওয়া নির্মাণ কাজের জন্য সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। তবে আজ সব প্রতিকূলতাকে জয় করে নতুন ইতিহাসের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে কাশ্মীর উপত্যকা তথা ভারত। জেনে নেওয়া যাক এই সেতুর নির্মাণ সম্পর্কিত কিছু খুঁটিনাটি তথ্য -

অবস্থানগত প্রতিকূলতা

উত্তর রেলওয়ের অধীনে শুরু হওয়া এই মেগা প্রজেক্টকে ২০০২ সালে ন্যাশনাল প্রজেক্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। উধুমপুর - শ্রীনগর - বারমুল্লা রেল লিঙ্ক প্রজেক্টের অধীনে এই সেতু নির্মাণের দ্বায়িত্ব দেওয়া হয় সাপুরজী পালোনজি গ্রুপের অ্যাফকন ইনফ্রাস্ট্রাকচার কোম্পানিকে। প্রজেক্ট ম্যানেজার এস এম বিশ্বমূর্তি বিবিসিকে জানিয়েছেন,' হিমালয় অঞ্চলের প্রতিকূল আবহাওয়া সেতু নির্মাণ করা খুবই বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। শীতকালে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে নেমে যায়। ফলে প্রচন্ড ঠান্ডায় সেতু নির্মাণের জন্য শ্রমিক ও কাঁচামাল এই জায়গা পর্যন্ত নিয়ে আসতেই অনেক বাধা এসেছে। এই এলাকার পাথুরে জমির কারণে সেতু নির্মাণ এক সময় অসম্ভব মনে হয়েছিল।'

এই প্রসঙ্গে কঙ্কন রেলওয়ের প্রতিনিধি বলছেন, ' আমি যখন ২০০৬ সালে প্রথম এই এলাকায় এসে পৌঁছাই তখন রিসাই থেকে এখানে যাতায়াতের জন্য বাস, গাড়ি, অটো এমনকি ঘোড়া কোনো কিছুই চলতো না। নির্মাণস্থলে পৌঁছানোর জন্য আগে ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তা তৈরি করা হয়। সেই রাস্তা দিয়েই পরবর্তীকালে কাঁচামাল পৌঁছানোর কাজ শুরু হয়।

যদিও এই সেতুর নির্মাণের মাধ্যমে সংযোগ স্থাপনের কথা শুরু ১৮৯৮ সালে ব্রিটিশ আমলে।আজ প্রায় ১২০ বছর পরে শুরু হতে চলেছে ঐতিহাসিক চেনাব রেলসেতু। দিল্লি কাশ্মীর রেলপথে থাকছে মোট ২৬ টি দীর্ঘ এবং ১১ টি ছোট সেতু। এর মধ্যে শ্রীনগরেই ৩৫ টি টানেলের মধ্যে দিয়ে ছুটবে ট্রেন যা প্রায় ১২.৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। ইঞ্জিনিয়ারদের মতে, পাথুরে মাটিতে টানেল নির্মাণ করা অত্যন্ত কঠিন কাজ ছিল। সবচেয়ে কঠিন ছিল সালাল হাইড্রো পাওয়ার বাঁধের কাছে নদীর গভীর খাদের মধ্যে টানেল নির্মাণের কাজ। এই সেতু নির্মাণে মোট ২৮ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে এখনও পর্যন্ত।

নির্মাণ কাজ

২০০৯ সালের ডিসেম্বরে চেনাব সেতু তৈরির কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই ব্রিজের দৃঢ়তা ও নিরাপত্তা নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে বন্ধ হয়ে যায় নির্মাণ কাজ। ২০১০ সালে ফের একবার নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ঠিক ২০১৫ সালের মধ্যেই চালু হবে এই ব্রিজ।

কঙ্কন রেলওয়ে এবং ভারতের ডিফেন্স রিসার্চ এবং অর্গানাইজেশনের সাহায্যে এবং পরামর্শে বিস্ফোরণ প্রতিরোধে সক্ষম স্টিল ব্যবহার করা হয় চেনাব সেতুর তৈরিতে। জানা গেছে -১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাতেও সেতুর ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। ২০১৯ সালেই এই সেতুর আর্চ নির্মাণের কাজ শেষ হয়ে যায়। আর্চ নির্মাণের জন্য যে কেবল ক্রেন ব্যবহার করা হয়েছে তা বিশ্বের অন্যতম উচুঁ ক্রেন।আর এই সেতু ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটারের বেশি বেগে বয়ে চলা হাওয়াকে সহজেই সহ্য করতে পারবে। তবে দুধারের ব্রিজ তৈরি করতে সময় লাগে আরও দুই বছর। ব্রিজের একপাশের পাইল ১২৭ মিটার উঁচু এবং আরেকটি ১১০ মিটার উঁচু। এই মাসের শুরুতেই চেনাব রেলসেতু নির্মাণের কাজ প্রায় ৯৮% শেষ যায়। আপাতত চেনাবের গোল্ডেন জয়েন্টের প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে। এই কাজ শেষ হলেই রেলের মানচিত্রে জুড়ে যাবে কৌরি ও বাক্কাল। আপাতত জানা গেছে চলতি মাসের ১৩ তারিখেই খুলে দেওয়া হবে এই রেলসেতু। ইঞ্জিনিয়ারদের মতে, এই সেতুর আয়ু ১২০ বছর এবং এর উপর দিয়ে সর্বাধিক ১০০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চলাচল করতে পারবে। চেনাব সেতুর ওজন ১০,৬১৯ মেট্রিক টন। এই সেতুর কাজ সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের যে কোনো রেল প্রকল্পের মধ্যে সবথেকে বড় এবং চ্যালেঞ্জিং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কাজ বলে মনে করা হচ্ছে। চেনাব সেতুর নির্মাণে ২৮,৬৬০ মেট্রিক টন ইস্পাত এবং ৬৬ হাজার কাম কংক্রিট ব্যবহার করা হয়েছে। সেতুর নির্মাণের জন্য ৬০ থেকে ৭০% স্থানীয় শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে নেওয়া হয়েছে।

উপত্যকার অর্থনীতিতে বদল

এখনও পর্যন্ত রাজধানী থেকে কাশ্মীরের মধ্যে প্রধান ট্রান্সপোর্টের মাধ্যম সড়ক পরিষেবা যা যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। দুদিনেরও বেশি সময় লেগে যায় কোনো জিনিস কাশ্মীর থেকে রাজধানী পৌঁছাতে। ট্রেন পরিষেবা চালু হলে একদিনের কম সময়ে রাজধানী থেকে উপত্যকায় পৌঁছানো যাবে। উপত্যকার মধ্যেও একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছাতে সময় বাঁচবে মানুষের। ইতিমধ্যেই যে রেল পরিষেবা চালু রয়েছে তাতেও উপকৃত হয়েছে মানুষ। উপত্যকার এক নাগরিক বিবিসিকে জানিয়েছেন, ' সড়ক পথে একবার জ্যাম হলে বানিহাল থেকে শ্রীনগর পৌঁছতেই তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লেগে যায়। বানিহল থেকে যে চড়াই রাস্তা শুরু হয় তাতে কয়েকফুট পর্যন্ত বরফ জমে থাকে। ফলে সেই বরফ গলতেই অর্ধেক দিন শেষ পথে। প্রায় চার পাঁচ ঘণ্টা দেরীতে শ্রীনগর এসে পৌঁছাতাম। 

কাশ্মীরের অন্য এক নাগরিকের কথায়, বানিহালে সব ওষুধ পাওয়া যায় না। বাবার চোখের সমস্যা ও অ্যাস্থামার ওষুধ আনতে দুবার বানিহাল থেকে শ্রীনগর যেতে হয়। কিন্তু এখন খুব কষ্ট হয় না শ্রীনগর আসতে। নতুন এই চেনাব ব্রিজ উপত্যকার মানুষদের জন্য অন্য এক দিগন্ত খুলে দেবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

More Articles