বিদায় নিচ্ছে বিতর্কিত ত্রিফলা আলো, কেমন ছিল শহরের পথবাতির ইতিহাস?
Kolkata Triphala Street Light : বাল্ব থেকে ফ্লুরোসেন্ট টিউব লাইট, তারপর একে একে মার্কারি ভেপার সোডিয়াম ভেপার হয়ে অবশেষে বিতর্কিত ত্রিফলা আলো
সম্প্রতি কলকাতা পুরসভার তরফে জানানো হয়েছে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে লাগানো ত্রিফলা আলোর দিন শেষ হতে চলেছে। তার জায়গায় ফিরছে আগের আলোই। জন্মলগ্ন থেকেই এই আলোকে ঘিরে নানারকম বিতর্কের সম্মুখীন হতে হয় সরকারকে। কোথাও বরাদ্দ টাকা কারচুপির অভিযোগ, তো কোথাও আবার আলো চুরির দায়, জর্জরিত এই অভিনব আলোগুলি। পুর কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, নতুন আলো লাগানোর পরপরই কম করে এক হাজার বাতি চুরি হয়ে যায়। এছাড়াও বেশিরভাগ জায়গাতেই ভেঙে গিয়েছে বাতিস্তম্ভ। আরও বিভিন্ন জায়গায় অকেজো হয়েই পড়ে আছে আলোগুলি। এমনকি এর ছেঁড়া তার থেকে বহু জায়গায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে একাধিক দুর্ঘটনাও ঘটেছে বলেও জানা গিয়েছে। ফলে এসব দ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না অভিনব ত্রিফলাগুলি। অতঃপর, বিদায়ের ঘণ্টা বাজিল।
আজকাল হামেশাই একটা ছবি ঘুরে ফিরে আসে টাইমলাইনে। আকাশ থেকে তোলা নিচের কলকাতার ছবি। ঝলমলে লাগে শহরটাকে। রাতের বেলাও দিন মনে করে ভ্রম হয়। কিন্তু এর শুরুটা মোটেই এতটা আলোকিত ছিল না। একটা সময় রাত নামলেই ঘনিয়ে আসতো নিকষ অন্ধকার। বিদ্যাসাগরের ছেলেবেলার রাস্তার আলোয় পড়াশোনা করার যে গল্পটা শুনে সকলে বড়ো হয়েছি, সেই গল্পের সময়কালের দিকে তাকালে দেখবো সেসময় অবশ্য ইলেকট্রিক তো দূর, গ্যাসের আলোর কৌলিন্যও জোটেনি তিলোত্তমার কপালে। তখন যেটা ছিল তা হল কেরোসিনের বাতি। তবে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে শহরের রাস্তাতে কেরোসিনের আলোটুকুও ছিল না। রাত নামলেই খিল পড়ত বাড়ির দরজায়। নিতান্ত প্রয়োজন না পড়লে বাহিরমুখো হতো না কেউই। হলেও পাটকাঠির মশলই ছিল একমাত্র ভরসা। এরপর পুরসভাই নিয়ে আসে কেরোসিনের আলো। যদিও বাড়ির অন্দরে তখনও রাজ করছে সেজের আলোই।
আরও পড়ুন : কলকাতা ভোলেনি বন্দরের ‘গ্যাংযুদ্ধ’! সেকালের হত্যাকাণ্ডের সমাধানে ঘুম উড়েছিল পুলিশের
এরপর ১৮০৭ সাল। লন্ডনের রাস্তায় প্রথম জ্বলে উঠলো গ্যাসের আলো। বাংলা অবধি সে খবর ছড়িয়ে পড়তে অবশ্য কেটে গেল আরও বছর পনেরো। ১৮২২ সালের ৩০ মার্চ তৎকালীন বাংলা দৈনিক ফলাও করে খবর করল গ্যাসবাতি নিয়ে। তারপর আরও কেটে গেল আরও অনেকগুলো বছর। ১৮৫৭ সালের ৬ জুলাই কলকাতার রাস্তায় প্রথম জ্বলে উঠলো গ্যাসের পথবাতি। কলকাতাকে লন্ডন বানানোর যে কথা আজকের শাসক দলের প্রধান প্রায়ই বলে থাকেন সেই কথাই যেন সেকালে সত্যি হল তিলোত্তমার পথে পথে। কালীপ্রসন্ন সিংহ ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য় লিখেছিলেন, কীভাবে সন্ধ্যে হলেই সন্ধ্যে হলেই মই নিয়ে ছুটে পথে পথে আলো জ্বালিয়ে বেড়াতো মুটেরা। প্রথমে কাপড় দিয়ে কাচ পরিষ্কার করা, তারপর চাবি ঘুরিয়ে গ্যাস বের। সবশেষে দেশলাই ধরিয়ে আলো জ্বালাতো তারা। শুধু তাই নয় এই আলো জ্বালানোর সময়ও বেঁধে দিয়েছিল পুরসভা। সেই নির্ঘণ্ট মেনেই ঘড়ি মিলিয়ে আলো জ্বালাতে এবং নেভাতে হতো। সাহেবি আমল বলে কথা, এর নড়চড় হতো না মোটেই। জানা যায়, এই আলো জ্বালাতে যে কয়লার গ্যাস প্রয়োজন পড়ত, তার জোগান দিত ওরিয়েন্টাল গ্যাস কোম্পানি। এরপর অচিরেই এই গ্যাস বাতি ঢুকে পড়ে শহরের উচ্চবিত্তের অন্দরেও। শোভাবাজার রাজবাড়ির হাত ধরেই শুরু হয় এই চল।
এরপর কেটে যায় টানা ৩২ টি বছর। একছত্র রাজত্ব চালায় গ্যাসবাতি। ১৯৮৯ সালে তাতে ভাগ বসায় বৈদ্যুতিক আলো। তিন বছরের প্রক্রিয়া শেষে কিলবার্ন অ্যান্ড কোম্পানি সৌজন্যে ১৯৮২ সালে ঝলমল করে ওঠে হ্যারিসন রোড তথা আজকের মহাত্মা গান্ধী রোড। এটিই শহরের সেই রাস্তা যেখানে প্রথম বৈদ্যুতিক আলো জ্বলেছিল।
৭১- এর বাংলাদেশ যুদ্ধের সমসাময়িক কলকাতার ব্ল্যাকআউট অথবা উত্তম সুচিত্রার বিখ্যাত ছবি ‘সবার উপরে’-এর সেই অমোঘ বিচারের দৃশ্য এসব কিছুই যেন মাদকতা ধরায় অতীতচারিতার। সেযুগের লাইট পোস্টগুলির লোহার কারুকাজও ছিল দেখার মতো। যদিও ক্রমেই তাদের জায়গা হয় কেবল ইতিহাসের পাতায়। জায়গা দখল করে আখাম্বা লোহার খুঁটি। শুধু পোস্ট নয় সময়ের সঙ্গে বদলায় আলোর ধরনও। বাল্ব থেকে ফ্লুরোসেন্ট টিউব লাইট, তারপর একে একে মার্কারি ভেপার সোডিয়াম ভেপার হয়ে অবশেষে বিতর্কিত ত্রিফলা আলো। আজ আবার সেই ত্রিফলাও চলেছে অস্তাচলে। তবে এলইডি রাজ করছে স্বমহিমায়। কম খরচে উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করছে শহর এবং শহরতলি। দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের পর আরও বেশি করে উঠে এসেছে অপরাধ ঠেকাতে রাস্তার আলোর গুরুত্বের দিকটি।
আরও পড়ুন : পৃথিবীর বৃহত্তম টেলিস্কোপে মহাকাশের রহস্যময় আলো, কীসের ইঙ্গিত পাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা?
কিন্তু এই অতিরিক্ত আলো পরিবেশের অন্য কোনও বিপদ ডেকে আনছে না তো? সম্প্রতি চর্চায় উঠে এসেছে এই দিকটি। কলকাতা শহরে অতিরিক্ত আলোর ব্যবহার নিয়ে চিন্তা প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদরা। অতিরিক্ত আলোর কারণে পেঁচা, শিয়ালের মতো যে সব পশুপাখি রাতে খাবারের সন্ধানে বেরোয়, তাদের স্বাভাবিক জীবনকে ব্যাহত করতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন উদ্ভিদবিদ্যার গবেষকরা। এমনকী জলাশয়ের ধার থেকে আলো খুলে দেওয়ার জন্য পুরসভাকে চিঠিও দিয়েছেন পরিবেশকর্মীরা। এই পরিস্থিতিতে পরিবেশবান্ধব লাইট এবং গ্লোসাইন বোর্ডের কথা ভাবা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। দেশপ্রিয় পার্ক, ম্যাডক্স স্কোয়ার, যতীন দাস পার্ক সহ বহু জায়গায় বসানো হয়েছে সোলার প্যানেল। এর ফলে কমেছে বিদ্যুতের বিলের খাতে খরচও।
একটা সময় ছিল কেবল উৎসব, পার্বনেই ঝলমলে হয়ে উঠতো শহর। এখন অবশ্য কলকাতার বেশ কিছু রাস্তায় সারাবছরই আলোময় আমেজ। দুর্গাপুজো, কালীপুজোর আলো তো আছেই, পাশাপাশি ডিসেম্বরের পার্কস্ট্রিটের আলোর রোশনাইও নজর কাড়ে। শুধু আলো দেখতেই হাজার হাজার মানুষ ভিড় করে সেখানে। আলো নিয়ে শৌখিনতার অন্ত নেই। অন্দরসজ্জার প্রয়োজনীয় অংশ হিসেবেও এর জুড়ি মেলা ভার! তবে আলো জ্বলুক সব দিক মাথায় রেখেই। এর জেরে প্রাণীকুলের কারোর জীবনেই আঁধার ঘনিয়ে আসুক এমনটা কাম্য নয়।