বিস্ফোরণে উড়েছিল ডান হাত! এক হাতে এলাকা কাঁপিয়েও খুন হন মস্তান দেবা দত্ত

Mastan Deba Dutta: রূপশ্রী নামে এক শিল্পীকে বিয়ে করে দেবা দত্ত। এই বিয়ে নিয়ে প্রচুর চর্চা শুরু হয়। কেউ কেউ বলতে শুরু করে, রূপশ্রীকে তুলে নিয়ে জোর করে বিয়ে করেছে দেবা মস্তান।

হেমেন মণ্ডলকে পুলিশের এক অফিসার বলেছিলেন, "এলাকা ছেড়ে দাও। শুনেছ তো দেবা দত্ত খুন হয়ে গেছে। তোমাকে আর দেবাকে টার্গেট করেছিল। তোমার কপাল ভালো, বাইরে ছিলে, বেঁচে গেছ। এখন এলাকায় ঢুকো না। নাহলে দেবার পরিণতি হবে। দেবা নেই। দেবা শেষ।" সময়টা ছিল ১৯৮৪-র ২৬ জানুয়ারি। শীতের হিমেল বাতাস বিকেলকে আরও গাঢ় করে তুলেছে। লাল একটা চাদর গায়ে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী কন্যার পড়া তৈরি করাচ্ছিল দেবা। ও আগের চেয়ে এখন অনেক শান্ত। তিন কন্যার পিতা। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পরই কসবা ছেড়েছিল দেবা। এখন ফিরে এসেছে। মোটের ওপর আপাত শান্তিপূর্ণ। তবে খুব নিশ্চিন্ত হওয়ার মতো পরিবেশ নেই। এলাকায় ফিরে আসার পর দু'বার হামলা হয়ে গেছে। তবু দেবা ঠিক করেছে এলাকা ছাড়বে না। কংগ্রেস আমলে একটা বাস বের করেছিল দেবা দত্ত। এলাকা কাঁপিয়ে হর্ন দিতে দিতে সেই মা তারা নামের বাস বিকেলবেলা ফিরে এসেছে। লাল চাদরটা গায়ে জড়িয়েই রাস্তায় নামল দেবা দত্ত। পড়া শেষ করে তার ছোট্ট মেয়ে সোমা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে। হঠাৎই সে শুনতে পেল সাইকেলের টায়ার ফেটে গেলে যেমন আওয়াজ হয় তেমন একটা আওয়াজ! তারপর আরও দু'বার । এরপরই জ্যাঠতুতো দিদির চিৎকার, "কাকু কাকু"! রাস্তায় তখন এক কাকা চিৎকার করছে, "সেজদা কথা বল, সেজদা কথা বল!" সোমা তখনও বুঝতে পারেনি বাবা আর ফিরবে না। রাস্তা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। কসবার রাস্তায় দেবার নিথর শরীর পড়ে আছে। সন্ধে নামছে কসবায়। বিদ্যুৎ তরঙ্গে খবর ছড়িয়ে যাচ্ছে, দেবা দত্ত নেই। দেবা দত্ত খুন হয়ে গেছে।

বিজন সেতু তখনও তৈরি হয়নি। রেল লাইনের এ পাড়ে বস্তি অঞ্চল। পাশে অভিজাত গড়িয়াহাট। রেল লাইনের ওপারে কিছু পুরনো অঞ্চল। পুরনো বাড়ি ঘরদোর। আর রাস্তা দিয়ে সোজা চলে গেলে রুবি পার্ক পর্যন্ত যাওয়া যায়। কারণ এরপর কোনও রাস্তা নেই। মাঠ, ধানক্ষেত, পুকুর-জলা ঘেরা বিস্তীর্ণ প্রান্তর। তবে কুমোর পাড়া ধরে যে রাস্তা গেছে পূর্বদিকে সেখানে বড় বড় বাড়িওয়ালা পুরনো পাড়া, পুরনো বারোয়ারি পুজো সবই ছিল। এইসব পাড়ায় কংগ্রেসি পরিবারও ছিল। ছিল সিপিআই। পরে সিপিআইএম শক্তি বৃদ্ধি করে। আশপাশের নানা কৃষক আন্দোলনকে হাতিয়ার করে শক্ত ভিতের উপর দাঁড়ায় সিপিআইএম। সঙ্গে উদ্বাস্তু মানুষের ভিড় তো ছিলই।

আরও পড়ুন- ‘চাকরি দিলাম, মা-কে খাওয়াবি’! জ্যোতি বসুকেও থামিয়ে দিতেন মস্তান-মন্ত্রী রাম চ্যাটার্জি

দেবা দত্তর শেষ যাত্রা

এরই মধ্যে দিয়ে ঊনসত্তরে নকশাল আন্দোলন শুরু হওয়ায় কসবাতেও এই আন্দোলনের ঢেউ এসে লাগে। প্রথমে এলাকা দখলের লড়াই চলত কংগ্রেস ও সিপিএমের মধ্যে। নকশাল আমলের প্রথম দিকে কসবার মাঠ ও জলা ঘেরা জায়গাটাকে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করছিল নকশালপন্থীরা। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই নকশালপন্থীদের ঘাঁটি হয়ে ওঠে রুবি পার্ক লাগোয়া বিস্তীর্ণ অঞ্চল। সেই সময় বহু প্রবীণ মানুষের স্মৃতিতে আছে, ভ্যানে বোঝাই মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছে সিআরপিএফ। বহু সিপিআইএম নেতা গোপনে গ্রামে নকশালপন্থীদের আশ্রয় দিচ্ছিলেন। ফলে কেন্দ্রীয় বাহিনীর টার্গেট হয়ে গেল এই গ্রামগুলো। নকশালদের চিহ্নিত করার বিষয়ে স্থানীয় সিপিআইএম, কংগ্রেসের ভূমিকা ছিল। ফলে রক্ত ঝরছিল বৃহত্তর রুবি-কসবা-কালিকাপুর জুড়ে। সত্তরের দশকের এইসব রক্ত আর লাশ বয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য এখনও জীবন্ত প্রত্যক্ষদর্শীদের স্মৃতিতে। ফলে কংগ্রেস, সিপিআইএম আর নকশালদের সশস্ত্র সংঘর্ষে এলাকা দখলের লড়াইয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠল কসবাও।

এই লড়াইয়ে তিন পক্ষের তিনটি নাম আজও মানুষের মুখে ফেরে। কংগ্রেসের দেবা, সিপিআইএমের চিন্ময় আর নকশালপন্থী শ্যামল ভট্টাচার্য। সময়ের সীমানা পেরিয়ে বাকি দু'জনের নাম শুধু রাজনৈতিক মহলে চর্চিত হলেও দেবার পরিচিতি সাধারণ মানুষের মধ্যে আজও অমলিন। তবে সেই পরিচিতিতে ভয়, ভক্তি, ঘৃণা সবই মিশে আছে। দেবার মস্তান ইমেজই তাকে কসবা অঞ্চলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে রেখেছে। সত্তর দশকের কথা বলতে গেলে তাই দেবার কথাও বলতেই হবে।

আরও পড়ুন- এলাকার ত্রাস হয়েও কচুরির দোকান দিতে হয়েছিল মস্তান কানা অজিতকে

বালিগঞ্জ স্টেশনের কাছে একটা ক্লাব ছিল ১৯৬৫ সাল থেকেই। ক্লাবের নাম ছিল নৈজাতিক ক্লাব। ক্লাবের মেন্টর ছিলেন ডঃ হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়। পেশায় চিকিৎসক, নেশায় রাইফেল শ্যুটার। এই হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানেই নৈজাতিক ক্লাব মস্তানদের ডেরা হয়ে ওঠে। হরিয়া, বাবলু, মানিক পাল, রানা আর দেবা দত্ত। এই নামগুলো ক্লাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। এই ক্লাব খুব বড় পুজো করত। এলাকায় কংগ্রেসি ক্লাব বলে পরিচিতি ছিল এই ক্লাবের। যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে এইসব অঞ্চলে লাল ঝাণ্ডার দাপট বাড়ে। সেই সময় নৈজাতিক ক্লাব ছিল কংগ্রেসি মানুষজনের ভরসা। পরে যখন নকশাল দাপট বাড়ে, তখন নৈজাতিকের ছেলেদের সঙ্গেই তাদের মূল লড়াই হতো। নকশালদের এই অঞ্চলে বড় স্কোয়াড কমান্ডার ছিলেন শ্যামল ভট্টাচার্য। অন্যদিকে সিপিআইএম বাহিনীর বড় মুখ চিন্ময়। এই চিন্ময় সিপিআইএম অ্যাকশন স্কোয়াডের বড় মুখ কামারপাড়ার খোকা দাসের ভগ্নীপতি ছিল। আর নৈজাতিক ক্লাবের হয়ে রাজনৈতিক মস্তানির সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল দেবা দত্তর বিরুদ্ধে। আরেকজন ছিল রানা। এরা ছিল নকশালদের মূল টার্গেট। দেবা, রানার বিরুদ্ধে নকশাল এবং বামেদের মূল অভিযোগ ছিল এলাকায় খুন-সন্ত্রাস-ধর্ষণের। যুক্তফ্রন্ট আমল থেকে নকশাল আমল গড়াতেই দেবা বনাম শ্যামল-চিন্ময় লড়াই বড় আকার নিল। দেবা দত্তের সঙ্গেই তখন আরেকটা নাম কংগ্রেসি মস্তান হিসেবে উচ্চারিত হতো। পৃথ্বীশ বাগচী। তাকে ঘিরে বহু মজার কাণ্ড আছে কসবা অঞ্চলে। পৃথ্বীশ একবার এক বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার ঘরে তালা লাগিয়ে দিল। তার দাবি, সব মেয়েদের পাশ করিয়ে দিতে হবে। পাশ না করালে তালা খোলা হবে না।

শিক্ষিকা বলছেন, "এ কী করে সম্ভব! ওরা তো কিছুই লিখতে পারেনি!"

পৃথ্বীশ বলে, "জানি তো, তবু পাশ করায় দ্যান। একটা পাশ করলে বাপ-মা ভালো বিয়া দিতে পারব।"

দিদিমণির মাথায় হাত। এদিকে পৃথ্বীশও নাছোড়বান্দা।

ওই স্কুলেই আরেকদিনের ঘটনা। দশম শ্রেণির টেস্ট পরীক্ষায় আটকে গেছে এক ছাত্রী। শুনেই পাড়ার স্বঘোষিত অভিভাবক পৃথ্বীশ বাগচী এসেছে স্কুলে। দেখেই দিদিমণি বলে উঠলেন। "কী ব্যাপার, আপনি?"

"হ আইসি, মাইয়াডারে টেস্টে ওঠায় দ্যান।"

"ও তো কিছুই লিখতে পারেনি। কীভাবে ওঠাব?"

গলা নিচু করে পৃথ্বীশ বলেছিল, "আরে জানি! ওরে জানলা দিয়া কইসিলাম you are লেখ। ও লিখসে u r! কী কইরা নম্বর দিবেন, জানি তো! তবু টেস্টে উঠায় দ্যান। বাড়িতে বিয়া ঠিক করসে। পাত্রপক্ষ ম্যাট্রিক পাশ চায়। টেস্টে পাস করায় দ্যান তবু অ্যাডমিট কার্ডডা তো দেখাইতে পারব।"

এভাবেই পৃথ্বীশ নিজ দায়িত্বে নানা জনসেবা করত। তার একটাই হুমকি, "কইরা দ্যান নাইলে কিন্তু গেটে তালা লাগায় দিমু!" এসব মজার পাশে বহু সিরিয়াস অভিযোগও ছিল নৈজাতিকের মস্তানদের নিয়ে। স্বামী-স্ত্রী রাতে শুয়ে আছে। মস্তানরা গিয়ে উপস্থিত। স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীর গায়ে হাত দিচ্ছে - এমন অভিযোগও উঠেছে । যাইহোক, নকশাল আমলে এলাকায় ত্রাসের অভিযোগ ওঠে দেবা দত্তের বিরুদ্ধেই। গরিব অঞ্চলগুলিতে তাকে ত্রাসের অপর নাম বলেই বিবেচনা করত প্রতিপক্ষ। শ্যামল ভট্টাচার্যের নকশাল স্কোয়াড আর দেবা বাহিনীর রক্তক্ষয়ী লড়াই তখন মানুষের মুখে মুখে ফেরে। এই সময় নকশালদের দাপট বাড়তে থাকায় কসবা রক্তাক্ত হয়ে উঠলে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয় দেবা দত্ত।

তখনকার এক ঘটনা। প্রেসিডেন্সি কলেজ তখন নকশালদের ডেরা। একদিন আত্মগোপনের সময় ওই এলাকার পাশ দিয়েই যাচ্ছিল দেবা দত্ত। নকশালপন্থী ছাত্রদের কেউ কেউ চিনে ফেলে তক্ষুনি তাকে ধরে নিয়ে যায় কলেজের ভেতর। সিদ্ধান্ত নেয়, কংগ্রেসি মস্তানকে এখানেই গুলি করে মারবে। কিন্তু সিদ্ধান্ত কার্যকর করার আগে কসবার ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কসবার কমরেডরা জানায়, "যে অঞ্চলের মানুষকে অত্যাচার করেছে দেবা সেই এলাকায় এনে ওকে মারা হবে।" প্রেসিডেন্সির এক অধ্যাপকের গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। ড্রাইভারের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে দেবাকে উঠিয়ে নকশাল ছাত্ররা উঠে পড়ল। ড্রাইভারকে বলল, "কসবা চলো"। কসবার নাম শুনে ড্রাইভারের আর মাথা কাজ করছে না! কসবায় তখন কোনও ড্রাইভার ঢোকেই না, এমন ডেঞ্জার! এদিকে পিস্তল তো কোমরে ধরে রয়েছে। ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছেন আর রাস্তায় পুলিশ খুঁজছেন। এরকম অবস্থায় সিগন্যালে এসে গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে। পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল। ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে চিৎকার জুড়ে দেন— ডাকাত ডাকাত! অন্যান্য পুলিশও ছুটে আসতে থাকে। এসব দেখে নকশাল ছাত্ররা গাড়ি থেকে নেমে পালায়। আর পালাতে পালাতে দেবাকে লক্ষ্য করে বোমা মারে। এই ঘটনায় দেবা মরে না কিন্তু ডান হাত বিস্ফোরণে উড়ে যায়। এক হাত নিয়েই এলাকা কাঁপাচ্ছিল দেবা।

আরও পড়ুন- নকশাল দমনে বিশ্বস্ত! যেভাবে রুনু গুহ নিয়োগীর ডানহাত হয়েছিলেন মস্তান হেমেন

তার কদর আরও বেড়ে যায় ১৯৭১ সালে, যখন বালিগঞ্জ আসন থেকে বিধানসভায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আসেন সুব্রত মুখার্জি। দেবা, রানা, পৃথ্বীশরা ওই ভোটে খেটেছিল সুব্রত মুখার্জির পক্ষে। সুব্রত জেতেন। পরের বছর, ১৯৭২ সালেও এই কেন্দ্রে থেকে দাঁড়িয়ে জিতে মন্ত্রী হন সুব্রত। দেবা ছিল সুব্রতর খাস লোক। স্বাভাবিকভাবেই এলাকায় তার প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। নিজের সামাজিক মর্যাদা বোঝাতে পঞ্চকালী পুজো শুরু করে দেবা। বারীন ঘোষাল, সুপ্রকাশ গড়গড়িদের মতো বিখ্যাত অনুষ্ঠান আয়োজকদের সঙ্গে ভিড়ে কসবায় অনুষ্ঠান শুরু করে দেবা। মহম্মদ রফি এসেছিলেন দেবার মঞ্চে। এই অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকেই নিজের জীবন সঙ্গিনী খুঁজে পায় দেবা। রূপশ্রী নামে এক শিল্পীকে বিয়ে করে দেবা দত্ত। এই বিয়ে নিয়ে প্রচুর চর্চা শুরু হয়। কেউ কেউ বলতে শুরু করে, রূপশ্রীকে তুলে নিয়ে জোর করে বিয়ে করেছে দেবা মস্তান। যদিও এই তথ্য সর্বাংশে সত্য নয়। বাপের বাড়ির অমতেই দেবাকে বিয়ে করেছিলেন রূপশ্রী দত্ত। পাত্রীর অসম্মতিতে এই বিয়ে হয়েছিল, তথ্যটি সঠিক নয়। বিয়ে করে সংসার করে দেবা। দলের তরফে রেশন দোকানের লাইসেন্স দেওয়া হয় দেবার ভাইকে। দেবা বের করে একটা বাস। বাড়িতে নিয়মিত আসত ভেড়ির মাছ। তার মৃত্যুর পরও এই ভেট আসা বন্ধ হয়নি। যদিও ঘর বাঁধার ৯ বছরের মাথায় আকস্মিক এই খুনের ঘটনায় গভীর শোকে পড়েন রূপশ্রী, তিন মেয়েকে নিয়ে! কিন্তু ভেঙে পড়েননি । কঠোর জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে দাঁড় করিয়েছেন কন্যাদের।

ফিরে আসা যাক সত্তরের আখ্যানে। এই সিদ্ধার্থ জমানাতেই সুব্রত মুখার্জি কসবার বহু যুবককে চাকরি দেন। এই চাকরির একটা অংশ দেবার হাত ধরে হয়েছে। দেবাকে ঘৃণা করার লোক যেমন কসবায় ছিল, আবার তার প্রতি কৃতজ্ঞ লোকও ছিল। সব মিলিয়ে প্রতিপক্ষের কাছে ত্রাস বা মস্তান হলেও এলাকায় তার বহু অনুগামীও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এত কিছুর পরও ১৯৭৭ সালে বালিগঞ্জ কেন্দ্র থেকে হেরে যান সুব্রত মুখার্জি। রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসে। কেন্দ্রে জনতা সরকার। রাজ্যে যে রদবদল আসছে তার ইঙ্গিত ছিল স্পষ্ট। তবু সুব্রত মুখার্জির মনে হয়েছিল, তিনি এত চাকরি দিলেন এলাকায়, এত জনসংযোগ করলেন — তার কোনও দাম থাকল না? সুব্রত মুখার্জিকে কেউ বা কারা বুঝিয়েছিলেন, যাদের হাতে তিনি এলাকা ছেড়ে রেখেছেন তাদের জন্যই এই হার দেখতে হলো। অভিযোগের তির যে দেবা দত্তের দিকে তা বুঝিয়ে বলবার অপেক্ষা রাখে না। এইসব নানা কারণে দেবার সঙ্গে কি শেষের দিকে সম্পর্ক খারাপ হয়েছিল সুব্রত মুখার্জির? কেউ এই নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও, কিছু ইঙ্গিত ছিলই। শেষ জীবনে সুব্রত বিরোধী শিবির লক্ষ্মী বসুর এনএলসিসি-র সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ছিল দেবার। যাতায়াত শুরু করেছিল। সেই কারণেই দেবার মৃত্যুর পর নকশাল শিবির থেকে বলা হয়েছিল, দেবাকে হত্যার পেছনে তার নিজের দলের হাত থাকতে পারে। এই অঞ্চলে নৈজাতিকের বিপরীতে সিপাইআইএমের অ্যাকশন বাহিনীর নেতৃত্ব দিত চিন্ময়। এই চিন্ময়ের বিরুদ্ধে বহু কংগ্রেস হত্যার অভিযোগ আছে। সিদ্ধার্থ জমানায় কসবা ছাড়ে চিন্ময়, হুগলিতে আত্মগোপন করে। সেখানে কৃষক ফ্রন্টে কাজ করত চিন্ময়। আর শ্যামল ভট্টাচার্য? আগুনখোর এই নকশালপন্থী পরে বাম আমলে একটা বাস বের করেছিল কিন্তু সিপিএমের কিছু নেতার প্রবল প্রতিরোধে সেই ব্যবসা থেকে হাত গুটিয়ে নিতে হয়। শেষ জীবনে গড়িয়াহাটের ভেতরে একটি বাড়িতে থাকতেন। শেষ জীবনে কালীভক্ত হয়ে উঠেছিলেন আগুনখোর বিপ্লবী। লেক অঞ্চলের একটি কালীবাড়িতে সন্ধেবেলা মা-কে প্রণাম করতে আসতেন শ্যামল। তার খোঁজ এখন অনেকেই আর দিতে পারে না। উত্তাল সত্তরের কসবার সশস্ত্র আখ্যানের তিন চরিত্র দেবা-চিন্ময়-শ্যামল এখন শুধুই স্মৃতি।

More Articles