ট্রিঙ্কাস-এর নৈশ গায়িকার প্রেমে পড়েছিল ছোটবেলার বন্ধু

Park Street Kolkata:

১.

সেই ইশকুলের সময় থেকেই বাংলা প্রশ্নপত্রে দেখেছি হামেশাই আসতো ‘নামকরণের সার্থকতা’ বিচার করো ধরণের প্রশ্ন। পার্ক স্ট্রিটে হাঁটতে হাঁটতে ভাবি প্রবৃত্তিমার্গের এই প্রতিনিধির নাম কে যে কেন ত্যাগ আর নিবৃত্তিমার্গের এক সন্তের নামে ঘোষণা করলো, কে জানে! ‘মাদার তেরেসা সরণি’! নিয়ন আলো আর মদিরার হাতছানির দিকে তাকিয়ে মনে হয় এ যেন বিপরীত দুনিয়া, ভোগ শুধুই ভোগ। তারপর দেখতে পাই, ‘সাউথ পার্ক স্ট্রিট সেমেট্রি’। ওখানে চিরশান্তিতে শায়িত আছেন হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। শায়িত আছেন স্যার উইলিয়ম জোন্‌স। মনে ঔদাস্যের বাতাস লাগে। মনে হয় বাহ্যিক চিত্তাঞ্চলের উপকরণ পেরিয়ে গভীর গভীরতর প্রদেশে পার্ক স্ট্রিট দিতে থাকে ভিন্ন বার্তা। পার্ক স্ট্রিটের এ মুখে, মল্লিকবাজারের উল্টোদিকে আরেক কবরখানা। শুয়ে আছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। সস্ত্রীক। এক অপার্থিব রাতে কবিতা পড়তে গিয়েছিলাম আমরা কয়েকজন। বলা ভালো, একা এবং কয়েকজন। প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই কথাটা সত্যি। মোমবাতির আলোয় পানভোজন এবং বাংলা কবিতা। কয়েকটি জোনাকি উড়তে উড়তে চলে গেল। উনিশ শতক থেকে একরাশ হাওয়া গাছের ডালে দুলতে দুলতে দেখিয়েছিল চাঁদ। আমরা এখনো বুঝতে পারিনি, ওই মহাকাশযান থেকে কখন নেমে এলাম মল্লিকবাজারের ভিড় আর কাবাবের গন্ধের ভেতর।

উপলক্ষটা ছিল মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মদিন। অর্থাৎ ২৫ জানুয়ারি। প্রধানত উদ্যোগটা জয়দেব বসু আর ম্ৃণাল চক্রবর্তীর, আমরা খানিকটা বাজনাদার। ফলে, ওই দুজনের সঙ্গে সেই রাতে ছিল ঋজুরেখ চক্রবর্তী, সুমিতাভ ঘোষাল, বিশ্বজিৎ পাণ্ডা, প্রবাসী কবি-সম্পাদক (ইউরোপ নাকি ডেনমার্ক?) মিহির আচার্য, প্রবীর দাশগুপ্ত আমি আর আমার বাল্যবন্ধু অভিজিৎ বসু। অভিজিৎ কস্মিনকালেও কবিতা লেখেনি। মূলত সিরিয়াস পাঠক। টুকটাক তর্জমা করে। এখন আমার ভগ্নিপতি। ও ক্যামেরা নিয়ে বৈঠকে হাজির ছিল। ভাগ্যিস। দু-চারখানা ছবিতে ধরা আছে সেই ম্যাজিক প্রহর। শাদাকালো। কেননা, অশরীরীদের উৎকর্ণ ছায়াগুলি সম্ভবত শুষে নিয়েছিল জাগ্রত পৃথিবীর যাবতীয় রঙ। প্রবীর দাশগুপ্তের ‘পিন্তানিনা সান্ডামেরি’ কবিতাটি শেষে আমি অন্তত, অন্তবীক্ষ থেকে ‘আহা, আহা, এনকোর, ব্রাভো’ এবং অজস্র অদৃশ্য করতালি শুনেছিলাম।

প্রবীর মারা যাবে সে বছরই, বসন্তে। ২৪ মার্চ। তারপর জয়দেব। কিছুদিন আগে শুনলাম বিশ্বজিৎ অসুস্থ। মিহির আচার্যের সঙ্গে আর কখনো দেখা হয়েছে কিনা মনে নেই, সুমিতাভ-র সঙ্গে কালেভদ্রে দেখা হয়, ঋজু এবং মৃণালদাও দূরের গম্বুজ। সেদিন আমরা সবাই কবিতা পড়েছিলাম। তারপর কয়েকজন চলে গেল বইমেলায়। আমি বাড়ি ফেরার পথে দেখেছিলাম, ফটকে আমাদের বিদায় জানাতে এসেছেন মধুসূদন আর অঁরিয়েৎ। অল্প আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। নোনাপুকুর ট্রাম ডিপো থেকে বেরোনো একটা ট্রাম ঢেকে দিয়েছিল সেই হাত নাড়া।
আমি অনেকবার ভেবেছি, শাদা রঙের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মাথায় নিকষ কালো পরী যেমন, সুরা-হুল্লোড়-কটাক্ষ-ক্রীড়া-মাংস এবং ভোগের দেহময় পার্ক স্ট্রিট ঘিরে তেমন কয়েকটি সমাধিক্ষেত্র। নীরব। কিন্তু অমোঘ। কালপুরুষের মতো উনিশ-বিশ-একুশ শতকের কুশীলবদের হৈ-হল্লার ওপর নজর রাখছে। পার্ক স্ট্রিটের পানশালায় বসে বোঝা যায় রমণ আর মরণ শব্দ দুটির অক্ষর সমাবেশ কত সদৃশ, সমরূপ আর ইশারায় ভরা! এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে তার কত না চিহ্ন বহন করছে মাদার তেরিসা সরণি! অলৌকিক-কে এখানে অনুভব করতে হয়। এ পথ বড়ো রমণীয়!

২.

ভুলভ্রান্তি আজকাল হামেশাই ঘটিয়ে ফেলছি। গত সংখ্যার বিবরণে দ্বিতীয় রেস্তোরাঁর নামটাই বলা হয় নি। স্রেফ তাড়াহুড়োয়। অধুনালুপ্ত সেই রেস্তোরাঁর নাম ছিল ‘স্কাই রুম’। অধুনালুপ্ত আরেকটি রেস্তোরাঁ তৎকালীন ভারত অধিনায়কের ‘সৌরভ্‌স্‌’। বেশ কিছু ব্রিকেচীয় স্মারক, যেমন ব্যাট, বল বা উইকেট কাঁচের মধ্যে সাজানো থাকতো ওই রেস্টুরেন্টের বিভিন্ন তলায়। ব্যক্তিগতভাবে এইসব পানাহারের কক্ষগুলির সঙ্গে মিশে আছে স্মৃতি। আমার ছেলেবেলার বন্ধু পম্‌পম্‌ (নাম পালটাচ্ছি না)। ট্রিঙ্কাস-এর নৈশ-গায়িকার প্রেমে পড়লো। গত শতকের শেষ দিকের কথা। ছোটোখাটো চেহারার সেই রূপসী মেয়েটিকে দেখাতে বিভিন্ন বন্ধুকে খেতে আমন্ত্রণ জানাতো সে। লুকোবো না, বয়স প্রায় ষাট হল, আমিও সেই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে বার কয়েক গেছি। চমৎকার গাইতেন তিনি। পমপম বেশ কয়েকবার ওঁর সঙ্গে কথা বলেছিল। খানিকটা আলাপ পরিচয় হয়েওছিল। তারপর নতুন শতকে আমাদের অনেকেরই ‘রক্তের ভিতরে এক দ্বীপ আছে, যেখানে স্টিমার ছাড়ে সঠিক দশটায়’!
পার্ক স্ট্রিটে কিন্তু, এই ‘কেজো’ কথারও একটা শক্তিশালী প্রচলন আছে। সেখানে ভাবালুতার কোনো জায়গা নেই। অনেক সময়ই লক্ষ করেছি পানশালায় জটলা করে বসে আছেন একদল বা দু-তিনজন সুবেশী পুরুষ। কদাচিৎ নারীরাও। এঁদের দেখেই বোঝা যায়, কোনো সাহেবি বা কর্পোরেট সংস্থার উচ্চপদস্থ অফিসার। কখনো কখনো এম. ডি. বা মালিক-আধা মালিকরাও থাকেন। এঁদের আলোচনার বিষয় মূলত বিজনেস-ষ্ট্র্যাটেজি, কোলাবরেশন, স্টক মার্কেট, নয়া দিশা অথবা প্ল্যানিং। অনেক সময় মাঝারি কর্মীদের গুলতানি, অফিস কেচ্ছা, বসের শ্রাদ্ধ এবং অন্য কোম্পানির অফার। সঙ্গে পানাহার। এরই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে বড়ো বড়ো লাল-কমলা চীনে লণ্ঠনের ওড়াউড়ি, বেলুনওলা, ভিক্ষার্থী বালক-বালিকা আর আজকাল গিটার হাতে অল্পবয়সীদের গান! সেখানেও একেবারে হাতে গরম উপার্জনের ঝুড়ি বসানো থাকে পায়ের কাছে। আর এক মদির মুদ্রা কামনা লেনদেনের হাতছানি ছিল ফ্রি-স্কুল স্ট্রিটের দিকে, বিশেষত একটু বেশি রাতে, হাতে টানা রিক্সার মাধ্যমে। যমুনা সিনেমা (অধুনালুপ্ত) থেকে একটু এগিয়ে গলিতে ঢুকে একসময় মারিজুয়ানা এবং অন্যান্য নেশার ছোটোখাটো আখড়া ছিল। সেখানে, ন’য়ের দশকের মার্কিন কবি স্টিফেন উইলিয়াম রুড-এর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সে-ও আজ বছর পঁয়ত্রিশ হল! এখানেই বুঝতে শিখি ‘গরিব’ সাহেবও আকছার হয়!

গত পরশু রাত সাড়ে দশটায় দেখলাম, মুলা রুজ-এর সামনে তিনটি ছেলে বিট্‌লস-এর কভার গাইছে। মনে পড়ে গেল, কী আশ্চর্য! একই গান একই ভাবে পথতরুণের কণ্ঠে শুনেছি লন্ডনের চিনে পাড়ায়, সেখানেও দু-পাশে ছিল লাল-গোলাপি চিনে লণ্ঠন আর খাদ্য-মদিরার উপাদেয় সুবাস! প্রকৃতপক্ষে, লন্ডন শহরের আনাচেকানাচে, গলি মহল্লায় ঘুরতে ঘুরতে যে রাস্তাকে বারংবার মনে পড়েছে, তার নাম ‘পার্ক স্ট্রিট’। শুধু বাড়িঘর স্থাপত্য বা স্থাপত্যের রঙেই নয়, এমনকি ক্যাফে বা পানশালার ভঙ্গিমার সাদৃশ্যেই নয়, হয়তো বেশ খানিকটা, সড়ক বাস্তবতায়। নানা দেশবিদেশ, ভাষা, আদবকায়দা, চেহারা, চাউনি, আলস্য, দ্রুতি, পথনিশানা, রহস্য, গুঞ্জন এবং ছায়াময়তায় ওদেশে টুকি করে গেছে পার্ক স্ট্রিট। ‘পিটার ক্যাট’ রেস্তোরাঁ থেকে একটু এগিয়ে আলো-আঁধারিতে বসে নয়ের দশকের শেষে, নতুন সহস্রাব্দের গোড়ায় আপনমনে বেহালা বাজাতেন টুপি পরা এক নিঃসঙ্গ ইহুদি বৃদ্ধ। সেই সুর কোনো জনপ্রিয় সংগীতের নয়, এক অদ্ভুত আশ্চর্য উদাস-করা দীর্ঘশ্বাস। পাশের টুক্‌রিতে কোনোদিনই টাকা-পয়সা জমা হতে দেখিনি। ওই রাস্তায় বিনা প্রয়োজনে কেনই বা কেউ যাবে! এমন এক আপনভোলা শিল্পীকে টাকাই বা দেবে কেন? আজ মনে হয়, তিনি হয়তো বাজাতেন নিজের জন্য, অথবা সংগীতের সাধনায়। অথবা, আমারই মতো, স্মৃতিসান্নিধ্যের ঈপ্সায়। ভাস্কর চক্রবর্তী, নিজেকে বলেছিলেন, ‘শহরের প্রেত’। পুরনো কাল, পুরনো মানুষ, পুরনো সম্পর্ক, পুরনো আমি – সবাইকে জাপ্টে রাখে পার্ক স্ট্রিট। আমিও ত সেরকমই ‘প্রেত’। ভূত অর্থে অতীত। কবরখানা থেকে এশিয়াটিক সোসাইটি, ওদিকে পার্ক শো হাউস সিনেমা হল, কিংবা সার্কাস এভিনিউ-এর মুখ পর্যন্ত এই রাস্তায় নানা বয়সে তো বটেই, মনে হয় নানা নামে, নানা পরিচয়ে, নানা ভূমিকায় ‘হাজার বছর ধরে’ হেঁটে চলেছি। ‘সমবেত নির্জ্ঞানে’ ঢুকে গেছে এই সড়ক বাস্তবতা!
৩.

পার্ক স্ট্রিটের সম্ভবত সর্বকালীন আতঙ্ক হল, স্টিফেন কোর্ট-এর আগুন। স্বচক্ষে দেখি নি, মানে সরেজমিনে উপস্থিতি ছিল না, কিন্তু টেলিভিশনে সেই মর্মন্তুদ দৃশ্য দেখে সহ্য করতে পারি নি। ওপরের তলা থেকে সন্ত্রস্ত, উদ্‌ভ্রান্ত মানুষজন ঝাঁপ দিচ্ছিলেন নীচে। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও। আগুন জ্বলেছিল প্রায় দশ-বারো ঘণ্টা জুড়ে। সে সময় সারা কলকাতার কান্না যেন ঝরে পড়ছিল পার্ক স্ট্রিটের ওপর। দমকল, পুলিশ, বিশেষ আরক্ষাবাহিনী, সাধারণ ওই তল্লাটের বাসিন্দা – সবাই প্রাণপণ দৌড়োদৌড়ি করছিলেন। যদি একটা প্রাণও বাঁচানো যায়। ২০১০ সালের মার্চ মাসের এই দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন চল্লিশেরও বেশি মানুষ। যতদূর জানা যায়, শর্ট-সার্কিট ছিল এই বিপর্যয়ের মূল কারণ। মহম্মদ শাহিদ হুসেন নামের এক ব্যক্তি প্রবল সংকল্পে বেশ কয়েকজনের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন, মনে আছে, মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে। দৈনিক কাগজে তাঁকে নিয়ে লেখালেখিও হয়েছিল। এই ঘটনার দিন সাতেক পরে পার্ক স্ট্রিটে গিয়ে দেখেছিলাম, অন্ধকার নিষ্প্রাণ বহুতল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্টিফেন কোর্ট। সর্বাঙ্গে দহনচিহ্ন। কালো সেই দাগগুলো চিরন্তন এক ট্রমা হয়ে অনেক পরিবার এবং মানুষকে আমৃত্যু জ্বালাতন করে যাবে। কাঁদাবে। এখনকার আলো ঝলমল স্টিফেন কোর্ট দেখলে কেউ সেই অভিশপ্ত দিনের আন্দাজ পাবে না। এই হয়তো কালের নিয়ম।
বড়োদিন আসছে। পার্ক স্ট্রিট হয়ে উঠছে আরো মায়াবী, আরো ঝলমলে, আরো দ্যুতিময়। অ্যালেন পার্কে উদ্‌যাপন হবে সেই ঈশ্বরপুত্রের পবিত্র জন্মদিবস, যিনি শিখিয়ে গেলেন, আত্মত্যাগ আর মানবমুক্তির সাধনা। অভিজাত মানুষের ঔজ্জ্বল্যে, চোখ ধাঁধানো আলোর মালায়, মনে হবে এই পথ যেন প্রাণের উৎসবে অনন্য আর অন্তহীন। মানুষ মানুষ আর মানুষ ছড়িয়ে দেবে প্রেম, সহযোগ, সম্প্রীতি আর শুভ কামনার বার্তা। আমরা তারই দায়বদ্ধতায় মনে রাখবো, চেষ্টা করবো, ‘পিটার হু?’ রেস্তোরাঁর উল্টোদিকে ফুটপাতে বড়ো হচ্ছে মলিন পোশাক আর দারিদ্র্যে নতজানু যে শিশুগুলি – ওরা যেন স্কুলে যায়। যেন ওদের ভিক্ষাবৃত্তিই একমাত্র জীবিকা না হয়ে ওঠে। ভরসা থাকুক পার্ক স্ট্রিটের অঙ্গীকারে আর চিত্রকল্পে। আমার প্রিয়জন, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ডাকসাইটে অধ্যাপক রাজীব চৌধুরী একদা আমাকে বলেছিল, এই রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে পুরো বাঙালি জাতিনির্মাণের ইতিহাস এবং প্রক্রিয়াটা বোঝা যায়। কথাটা ঠিকই। পুলিশের দপ্তর, কলেজ, পর্ষদের অফিস, সুরা, এশিয়াটিক সোসাইটি, রাত হুল্লোড়, কবরখানা, দেহ থেকে দেহাতীত, খাদ্যসম্ভার, ভৌতিকতা আর গবেষণা, সাহেব আর পথশিশু, বিলিতি গাড়ি আর নেড়ি কুকুরের এমন সহাবস্থান কোথায় পাবেন আপনি? আপনি আমিও খুঁজছি হয়তো নিজেদের, স্মৃতি এবং ভালোবাসা! দেখা হয়ে যাবে একদিন!

More Articles