নকশাল দমনে বিশ্বস্ত! যেভাবে রুনু গুহ নিয়োগীর ডানহাত হয়েছিলেন মস্তান হেমেন
Mastan Hemen Mondal: রুনু গুহ নিয়োগীই হেমেনকে বুঝিয়েছিল, "তুমি একজন প্রতিবিপ্লবী। বিপ্লবকে প্রতিহত করাই তোমার কাজ।" রুনু গুহ নিয়োগীর সাহচর্যেই নকশাল দমনে সক্রিয় ভূমিকা নেয় হেমেন।
হেমন্তকে তাঁর বাবা বললেন, "আজ থেকে তোর পড়াশোনা শেষ। থাক, আর স্কুলে যেতে হবে না। স্কুলে গেলেই ওরা আবার আসবে। ওরা এবার তোকে হাতে পেলে মেরেই ফেলবে। অনেক হয়েছে। স্কুলে যেতে হবে না।" বাবা মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী। বাবার কানে যে গোটা ঘটনার কথা কীভাবে এল তা প্রথমে বুঝতে পারেনি হেমন্ত। পরে জেনেছে, ওর স্কুল স্কটিশ চার্চ কলিজিয়েটের বহু শিক্ষক আসেন ওর বাবার বেডিং স্টোর্সে। তারাই জানিয়েছে, যারা হেমন্তকে বারেবারে স্কুল গেটে হামলা করছে আর বারেবারেই হাত ছাড়িয়ে হেমন্ত স্কুলে ঢুকে পড়ে বেঁচে যাচ্ছে, তারা রাস্তায় পেলে কোনওমতে ছাড়বে না তাকে। আক্রমণকারীদের বর্ণনাও বাবাকে দিয়েছেন শিক্ষকরা। যা শুনে ছোট ছেলেকে নিয়ে শেষমেশ এই কঠিন সিদ্ধান্তই নিলেন বাবা। ক্লাস নাইনেই ছেলেকে পড়াশোনা ছাড়াবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন তিনি। হেমন্ত মাথা নিচু করে শুনল। খুব একটা দুঃখ হলো কি তার? মনে হয় না। উল্টে হেমন্ত মনে মনে ভেবে নিল, "ভালোই হয়েছে, এবার মারের নাম বৃন্দাবন দেখিয়ে ছাড়ব"। যে কাজটা স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে করতে পারছিল না হেমন্ত, পাছে স্কুল তাড়িয়ে দেয় এই ভয়ে; এবার আর কোনও ভাবনাই তার রইল না।
পরের দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই পরেশনাথ মন্দিরের চাতালে ঠেকবাজি করতে চলে গেল হেমন্ত। ততক্ষণে জনা কয়েক চামচা জড়ো হয়ে গেছে। ক্লাস নাইনে লেখাপড়ায় ইতি হলেও হেমন্ত ওই ক্লাসে পড়া ছেলে মেয়েদের চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়। তার বাবাই খাতায় কলমে বয়স কমিয়ে ভর্তি করিয়েছিল হেমন্তকে। ফলে মানসিক গঠন, বা চেহারার গড়ন কোনও দিক থেকেই হেমন্তকে আর বালক বলা যাচ্ছিল না। তার শাগরেদরাও কমবেশি তাই-ই। হালকা গোঁফ, আর এক গাল নির্মল হাসি। হাসিখুশি চেহারা। যদিও অনুগামীদের হেমন্ত বলল, "লালা বাগানের রুস্তমদের এবার লালা ঝরিয়ে ছাড়ব, লেগে পড়!" হেমন্তর চোখ ঠান্ডা। লক্ষ্যে স্থির যেন। কথাগুলো বলছিল গভীর প্রত্যয়ে। হেমন্ত তখনও পাড়ার ডাকাবুকো ছেলে। হেমন্ত তখনও হেমেন মণ্ডল হয়ে ওঠেনি, গৌরীবাড়ির হেমেন মণ্ডল।
তবে হেমন্ত থেকে হেমেন হয়ে ওঠার যাত্রা শুরু হলো সেদিনই, সকালবেলা। রোদ ঝলমলে আলোয় অন্ধকারের দিকে যাত্রা করল হেমেন। এটা নেহাতই কোনও রূপক নয়, হেমেনের স্টাইল অফ অপারেশন হয়ে উঠল। সারা জীবন ধরে ছোট অথবা বড়, সকালবেলা কিংবা দুপুরের গনগনে রোদেই অপারেশন করেছে হেমেন মণ্ডল। খুল্লম খুল্লা! আমনে সামনে। বাকিরা যখন অন্ধকার নামার অপেক্ষায় থাকত, হেমেন মণ্ডল হাঁটত উল্টোপথে। প্রতিপক্ষ ঘুম থেকে উঠবে। ডেন-এ বসে আড্ডা দিচ্ছে। ঝলমলে সকাল। প্যাঁচ কষছে। রাতে কী করবে। অতর্কিতে হামলা। সামলে ওঠার আগেই দেখে, মূর্তিমান হেমেন দাঁড়িয়ে। "কী রে শ্লা, মারবার প্ল্যান কর্চ্ছিস, তা লে মার," ব্যাস শুরু। মারের ব্যাপারে হেমেন একপ্রকার নেশাগ্রস্ত। এই মিথ হয়ে যাওয়া মারের নেশা শুরু হলো পরেশনাথ মন্দিরের জটলা থেকে। ওই দিনই, সকালবেলা। হেমন্ত তখনও হেমেন মণ্ডল হয়ে ওঠেনি।
আরও পড়ুন- এলাকার ত্রাস হয়েও কচুরির দোকান দিতে হয়েছিল মস্তান কানা অজিতকে
এই অন্ধকার যাত্রার একটা শুরুয়াদ আছে। হেমেনদের পাড়ার কাছেই ছিল সুরশ্রী সিনেমা হল। সেখানে গৌরীবাড়ির লোকজন গিয়ে সিনেমার টিকিট কাটতে পারছিল না, টিকিট ব্ল্যাকারদের এমন উপদ্রব। তখন ম্যাটিনি শো-এর টিকিটের দাম ছ-আনা। ব্ল্যাকাররা বিক্রি করত দশ আনা, বারো আনায়। মূলত লালা বাগান, পেয়ারা বাগানের ছেলেরা এই কাণ্ডটা করছিল। গৌরীবাড়ির ছেলেদের তারা লাইনে পর্যন্ত দাঁড়াতে দিচ্ছিল না। টিকিট কিনতে হলে ব্ল্যাকে কিনতে হবে এবং তাদের থেকেই কিনতে হবে। গোটা হল ঘিরে রেখেছে তারা। হেমন্ত তখনও স্কুল ছাত্র। যদিও সাঙ্গপাঙ্গ জুটে গেছে। সব শুনে সে বলল, "মন্টে, প্রদীপ, স্বরাজ, চল তো দেখি শ্লাদের। ক'টা মাথা ঘাড়ে।" সেই ছিল বেপাড়ায় প্রথম হেমেনের সংগঠিত আক্রমণ।
সুরশ্রীর সামনে গিয়ে লালা বাগানের ছেলেদের একহাত নিল হেমেনরা। এরপরই গল্পের শুরু। লালা বাগানের ছেলেরা খুঁজতে শুরু করল হেমেনকে। খুঁজতে খুঁজতে স্কটিশচার্চ স্কুল পর্যন্ত ধাওয়া করল তারা। দু-তিন বার স্কুলগেটের সামনে ঘিরে ফেলল হেমেনকে। চাকু, চেন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার মুখে বারবার ওদের চক্রব্যূহ ভেদ করে ছিটকে স্কুলে ঢুকে গেল হেমেন। এরপরই বাবার এই নিদান। সেই বন্ধনহীন হেমন্ত চলেছে লালাবাগানের পথে। দিনে দুপুরে। হেমেন হয়ে ওঠার পথে হেমন্তর বড়সড় পদক্ষেপ। সাড়ে ছয় ফিটের হেমেনের সঙ্গে ওর সঙ্গী-সাথীরাও আছে। তখনও বোমার সঙ্গে পরিচয় হয়নি। হেমেন হাতে ব্যবহার করত পাঞ্চ। পাঁচ আঙুলের লোহার আংটির মতো অস্ত্রটি। সজোরে মুখে মারলে আর দেখতে হবে না! গায়ে আছে অসম্ভব জোর। ব্যাস, এটুকু সম্বল করেই লালা বাগান পেয়ারা বাগানের ছেলেদের উপর ঝাপিয়ে পড়ল হেমেন।
"খুজ্জিলি না? এসে গেছি দ্যাক!"
ব্যাস, মার মার আর মার। দু'পক্ষই মারছে। স্কুলে হাই জাম্প, লং জাম্পে ফার্স্ট হতো হেমেন। হাতাহাতি করতে করতেই খেলার মাঠের সেই বিদ্যা প্রয়োগ করে বসল। সটান পা তুলে প্রতিপক্ষের থুতনিতে। হাত চলছে, সঙ্গে পা-ও। রুস্তমরা ছত্রখান। এই ঘটনার পর থেকে নিজের এলাকায় দাদা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল হেমন্ত। তখনও সে গৌরীবাড়ির হেমেন মণ্ডল হয়ে ওঠেনি। তবে এলাকায় প্রতিপত্তি বেড়ে গেল, বিশেষত সমবয়সিদের মধ্যে। সংঘাতও বাড়ছিল পাল্লা দিয়ে।
গৌরীবাড়ি অঞ্চলের কাছেই চিৎপুর রেল ইয়ার্ড। খালপাড়। পাশে সিনেমা হল। মধ্যবিত্ত পাড়া আর পাশে বস্তি অঞ্চল। হেমেনরা যখন বড় হয়ে উঠছে তখন গৌরীবাড়ি অঞ্চলে সাত-আটজনের বাড়িতে গাড়ি। আর হাতেগোনা বেশ কয়েকজনের বাড়িতে ল্যান্ড লাইন টেলিফোন। গৌরীবাড়ির বাতাসে একটা বেয়াড়া ভাব ছিল। বখাটে ছেলেপুলের ভিড় ছিল একটা, বিশেষত মেয়েদের ওপর নিগ্রহের প্রশ্নে। আকছার, যখন তখন, মেয়েদের গায়ে হাত দিত পাড়ারই একদল। খালপাড়ের পাশেই যে বাসস্ট্যান্ড, সেখানে বাতিল দোতলা বাস দাঁড়িয়ে থাকত। সন্ধ্যা নামলেই পাড়া-বেপাড়ার মেয়েদের নিয়ে বাসের ভেতর ঢুকত এলাকার ছেলেরা। দুঃখের বিষয়, এই তালিকায় হেমেনের দলের লোকেরাও ছিল। এই নিয়ে একদিন নিজের দলের কয়েকজন ছেলেদেরই পেটাল হেমেন। ক্যাচাল বেঁধে গেল দলে। হেমেনের হাতে মার খাওয়া ছেলেগুলো গিয়ে ভিড়ল হেমেনের অ্যান্টি লালা বাগানের রুস্তমদের দলে। একদিন সদলবলে তারা আক্রমণ করল হেমেনকে। পরেশনাথ মন্দির চত্বর এসবেরই সাক্ষী। এভাবেই চলছিল দিন। স্কুল নেই, পড়া নেই, শাসন নেই, ভালো ছেলে হওয়ার বালাই নেই। শুধু খাও-দাও আর মারপিট করো। এই মোটামুটি নিয়ম হয়ে দাঁড়াল। এই পর্যায়ে হেমেনের জীবন এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে মোড় নিল।
গৌরীবাড়ি এলাকায় রাস্তায় নক-আউট ফুটবল প্রতিযোগিতা হচ্ছে। এই খেলা নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় মারপিট লাগল। সেই মারপিট চলল দিনের পর দিন। এই সময় হেমেন খবর পেল, লালাবাগানের ছেলেরা বোমা জোগাড় করছে। বড় হামলা হবে। বয়সে বড় কিছু দাদা হেমেনকে পরামর্শ দিল, চেন-চাকু-চ্যালা কাঠে হবে না। বোমা চাই। কিন্তু বোমা দেবে কে? পাড়ারই একজন বলল, এই পরিস্থিতিতে একজনই পাশে দাঁড়াতে পারে। পান্নালাল মিত্তির। দেশবন্ধু পার্কের পাশে থাকেন মিত্তির মশাই। হেমেন গিয়ে একদিন দেখা করল পান্নালালের সঙ্গে। এমন টগবগে যুবকই তো কতদিন ধরে খুঁজছে পান্নালাল। হেমেনকে আশ্বস্ত করে পান্নালাল বললেন, "যত বোমা লাগে নিয়ে যাও, কোনও পয়সা লাগবে না।" এটা তখন পাতালপুরীর একটা সৌজন্য বলা যেতে পারে। অলিখিত নিয়ম। অন্ধকার জগতে স্বাগত তরুণ! তোমায় বোমা দিলাম। তুমি আমার লোক হলে। এর মধ্যে পয়সার কী আছে? হেমেনও যখন পরবর্তীকালে কাউকে বোমা দিয়েছে, কোনও পয়সা নেয়নি।
তো পান্নালালের বোমা নিয়ে আক্রমণ প্রতিহত করল হেমেন। একইসঙ্গে এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে বোমায় হাতেখড়ি হলো হেমেনের। হেমেনের ব্যাপ্তি এখন আর শুধু গৌরীবাড়িতে আটকে নেই। গৌরীবাড়িও তখন গোটা কলকাতা জুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে। সৌজন্যে, হেমেন মণ্ডল। ওকে তখন পুলিশ খুঁজছে। পাতালপুরীও জেনে গেছে নতুন এই অতিথিকে। জনা ১৫-২০র দল নিয়ে হেমেন তখন ত্রাস! গৌরীবাড়ি ও সংলগ্ন অঞ্চলের ৫৫ হাজার মানুষ রীতিমতো তটস্থ হেমেনের দলবল নিয়ে। লালবাজারের হিস্ট্রিশিট CRO-HS-R42716-1968 হেমেন বাহিনী সম্পর্কে লিখছে, নিজেদের আধিপত্য খাটাতে যখন তখন গৃহস্থ বাড়ির যে কোনও জিনিস উঠিয়ে নিয়ে যেত তারা। টিভি, সাইকেল, স্কুটার, গাড়ি এমনকী লরি! স্থানীয় এক প্রতিবেশী অনিতা দত্তের ভাইয়ের একটা ফ্ল্যাট ছিল। অভিযোগ, হেমেন বাহিনী ওই ফ্ল্যাটের একটি ঘর নিজেদের দখলে নিয়ে নেয় এবং অনিতা দত্তকে কাজের লোকের মতো খাটাতে থাকে। এই অভিযোগ লালবাজারের খাতায় জ্বলজ্বল করছে।
আরও পড়ুন- মস্তানের বাইকে মুখ্যমন্ত্রীর বউ! বাঘাযতীনের মস্তান কানা অজিত আজও কিংবদন্তি
হেমেনের দৌরাত্ম্য এমন পর্যায়ে গেল যে, ১৯৬৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রিভেনটিভ ডিটেনশন অ্যাক্টে পুলিশ গ্রেফতার করল হেমেনকে। ৯ মাস জেলে কাটিয়ে ৩ ডিসেম্বর ছাড়া পেল হেমেন। বেরিয়েই আবার শুরু তাণ্ডব। ২৬ ডিসেম্বর আবার গ্রেফতার হলো হেমেন। এবারের জেলযাত্রার মেয়াদ দাঁড়াল দু'মাসেরও কম সময়। হেমেন মণ্ডলকে কোনও সময়েই পুলিশ খুব বেশিদিন আটকে রাখতে পারেনি। কারণ অবশ্যই অর্থবল। প্রথম জীবনে পরিবারের অর্থবল, পরে নিজের টাকাপয়সা। সব মিলিয়ে পুলিশ প্রশাসন ম্যানেজ করে নিতে পারত হেমেন মণ্ডল। ডিসেম্বর মাসে ধরা পড়ে ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাড়া পেল হেমেন। এবার এক বড় ঘটনা ঘটে গেল হেমেনের জীবনে।
ওই সময় চিৎপুর রেল ইয়ার্ডকে ঘিরে ওয়াগন ব্রেকারদের একটা গ্যাং চলত গৌরীবাড়ির অদূরেই। এই নিয়ে গ্যাংওয়ার লেগে থাকত। একবার একটি গ্যাং লখিয়া বলে এক দুর্ধর্ষ দুষ্কৃতীকে তাদের দলের অন্তর্ভুক্ত করে। হেমেনের তখন তুঙ্গে বৃহস্পতি! নাম হি কাফি হ্যায়! লখিয়ার বিপক্ষ গোষ্ঠী হেমেনকে টানতে চাইল দলে। ওয়াগন ভাঙার প্রথম লুঠ হেমেনকে দিতে চাইল ওরা। কিন্তু হেমেন এই চক্করে জড়াতে চাইল না। এদিকে লখিয়াকে কেন্দ্র করে রুস্তমদের সাম্রাজ্যে তোলপাড় চলছিল। হেমেন মণ্ডলও জড়িয়ে যাচ্ছিল। এই সময় হেমেনের কাছে খবর এল, লখিয়া শ্যামবাজারের কাছে একটা ঠেকে আসছে। লখিয়াকে এক হাত নিতে শ্যামবাজার ছুটল হেমেন। এদিকে পুলিশের কাছেও খবর গেছে শ্যামবাজার মোড়ে বড় অ্যাকশন করতে আসছে হেমেন মণ্ডল। হেমেন তখন পুলিশেরও নজরে। মানিকতলা থানার বড় ফোর্স চলল শ্যামবাজারের দিকে। ১৯৬৭ সাল। গোলবাড়ির কাছে হেমেন বাহিনীকে এক প্রকার ঘিরে ফেলল পুলিশ। মুহূর্তে শুরু হয়ে গেল বোমাবাজি। এই সময় লখিয়াও রয়েছে স্পটে। বোমাবাজি করতে গিয়ে একটি বোমা গিয়ে লাগল পরশুরাম রাই নামের এক সিপাইয়ের পেটে। স্পট ডেথ হয়ে গেল পরশুরামের। ছোটখাট অভিযোগ নয়, একেবারে কর্তব্যরত পুলিশ কর্মী হত্যা! হুলিয়া জারি হয়ে গেল হেমেনের বিরুদ্ধে। এই প্রথম বড়সড় ঘটনায় নাম জড়াল হেমেন মণ্ডলের। গৌরীবাড়ি ছেড়ে দিল হেমেন। গা ঢাকা দিয়ে উঠল ওয়েলিংটনে পিসির বাড়ি কিন্তু সেখানেও একসময় পুলিশ রেইড হয়ে গেল।
হেমেন সম্পর্কে একটা জনশ্রুতি আছে। হেমেন নাকি প্রথম জীবনে নকশাল হয়ে গিয়েছিল। এই ধারণাটা তৈরি হয়েছিল এই সময়েই। পালাতে পালাতে আর কোনও আশ্রয় বাকি ছিল না। গোটা রাষ্ট্রশক্তি পেছনে পড়ে গিয়েছিল। এই পর্যায়ে হেমেনকে আশ্রয় দেয় কিছু নকশালপন্থী। ডক্টর্স লেনে ওদের আশ্রয়েই ছিল হেমেন। পরে একটা প্রেসেও আশ্রয় নেয়। রাতে কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে হেমেন, রেডিওতে জ্যোতি বসুর ভাষণ শুনছে। বাংলার পুলিশ মন্ত্রী বলছেন, "হেমেন মণ্ডলকে গ্রেফতার করতেই হবে।" হেমেন বুঝল, কলকাতা আর তার জন্য নিরাপদ না। ওই সময় নকশালপন্থীরা তাকে গোপীবল্লভপুরের সেফ শেল্টারে রাখতে চাইল। ওরা হয়তো ভেবেছিল ভবিষ্যতে কখনও হেমেনের বাহুবলকে নিজেদের রাজনৈতিক প্রয়োজনে কাজে লাগাতে পারবে। তাই সাহায্যের হাতও বাড়াচ্ছিল কিন্তু এই সাহায্য গ্রহণ করল না হেমেন। বরং সে ঠিক করল পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাবে আশ্রয় নিতে। এ লাইনে একটা যোগাযোগ হেমেনের ছিল। সে এক গল্প! গৌরীবাড়িতে হেমেনের এক চ্যালা ছিল, দেবু। দেবু বলত, ওর জামাইবাবু ওদের সংসার চালায়। নাম বিভূতি সাহা। পরে হেমেন জেনেছিল, বিভূতি সাহা স্মাগলিংয়ের কাজে যুক্ত ছিল। বাঙাল এই ভদ্রলোক ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বেনারসী শাড়ি , হাকোবা চিকন, লখনউ চিকনের শাড়ি চালান করত। বিভূতি সাহার বর্ডারে লোক ছিল। তাদের ধরেই স্মাগলিং গ্যাংয়ের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান যাওয়ার বন্দোবস্ত করল হেমেন। ১৯৬৯ সাল। হেমেন ঢাকা যাবে শুনে তার বাবা নগদ দশ হাজার টাকা হেমেনের হাতে দিলেন। টাকাটা সেই সময় একটা বড় মূল্য। যদিও ভারতের টাকা থেকে পাকিস্তানে টাকার মূল্য তখন বেশি ছিল। যাইহোক, কলকাতার পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে হেমেন চলল ঢাকায়।
কিন্তু হেমেন কিছু একটা না ঘটিয়ে শান্তি পায় না। ঢাকা গিয়েও গণ্ডগোল ডেকে আনল হেমেন। শেষমেশ ঢাকার পুলিশও ওর পেছনে পড়ে গেল। যাইহোক, ঢাকায় হেমেন পৌঁছল শাড়ি স্মাগলিংয়ের এক কিং পিন-এর ডেরায়। ওখানে গিয়ে স্মাগলিং-এর কাজেও কমবেশি যুক্ত হয়ে গেল সে। আগেকার দিনে গেরস্থরা বাইরে ঘুরতে গেলে বেডিং সঙ্গে নিত। এই ভাঁজ করা বিছানাকে বলা হতো হোল্ড অল। হেমেনরা এই হোল্ড অলের ভেতরে চোরাই বেনারসী ভরে ঢাকার আশেপাশে সাপ্লাই দিত। এই কাণ্ড করতে গিয়ে ট্রেনের মধ্যেও মারপিটে জড়িয়ে পড়ে হেমেন। বিভূঁই বলে তার স্বভাবে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। এই হোল্ড অল-গুলো হেমেনরা চাপিয়ে দিত কুলিদের মাথায়। একবার হোল্ড অল সমেত ধরা পড়ে গেল পুলিশের হাতে। ধরা পড়ে হেমেন ভাবছিল, এ খবর পুলিশ কে দিল কে? গ্যাংয়ের কেউ লিক করছে? তেমন তো কাউকে মনে হয় না! ভাবতে ভাবতেই হেমেন উপলব্ধি করে, মোট বয়ে নিয়ে যাওয়া কুলিরাই পুলিশকে জানাতে পারে। পরে হেমেন জেনেছিল, ঢাকা হোক বা কলকাতা- কুলিদের মধ্যে পুলিশের ইনফর্মর থাকে। আরও জেনেছিল, কুলিদের একটা বিশেষ ক্ষমতা থাকে। ওরা মাথায় মাল চাপালেই বুঝে যায় এটা নিছক মালপত্র নাকি কোনও বেআইনি সামান। কুলিদের এই ওজনের চরিত্র বিশ্লেষণের ক্ষমতাকে কাজে লাগায় পুলিশ। যাই হোক, হেমেন আর তার সঙ্গী দেবু ধরা পড়ে গেল মাল সমেত। ঘটনাটা ঘটে কমলাপুর রেলস্টেশনে। পাকিস্তান পুলিশ হেমেন আর দেবুকে স্টেশনের বাইরে একটা দোকানে নিয়ে যায় মাল সমেত। একথা সেকথার পর শুরু হয় দরদাম।
"যে কাম করসেন, জেল কেউ আটকাইতে পারব না," পুলিশ বলছে।
হেমেন শুনে বলল, "আপনিই কিছু একটা করুন।"
"কিস্যু করার নাই, দ্যাখেন যদি হাজার চারেক টাকা দ্যান তো দেখতে পারি।"
হেমেনরা রাজি হয়ে গেল। হেমেন মাল পত্তর সমেত পুলিশের কাছে থেকে গেল। আর দেবু চলল মহাজনের কাছে টাকা আনতে। টাকা নিয়ে দেবু ফিরে এল কমলাপুর রেলস্টেশনে। পুলিশরা গল্প করছে। দেবু আসতেই হেমেন ওর হাত ধরে সাইডে নিয়ে গেল। পুলিশ ভাবছে, দেবুর থেকে টাকা নিচ্ছে হেমেন। টাকাই নিচ্ছিল হেমেন। আর কানে কানে দেবুকে ফিসফিস করে বলছিল, "আমি ওদের টাকা দেখাব, আর তুই হোল্ড অলটা রিকশায় তুলে পালিয়ে যাবি।"
টাকার গোছা হাতে নিয়ে হেমেন পুলিশকে নিয়ে চলল একটু তফাতে। টাকা দেখে পাকিস্তান পুলিশের চোখ জ্বলজ্বল করছিল। ওরা দেখলই না রিকশায় মাল চাপিয়ে হালকা করে দেবু বেরিয়ে গেল। এদিকে হেমেন পুলিশকে দেখিয়ে দেখিয়ে টাকা গুনেই যাচ্ছে। আড়চোখে দেখে নিল, দেবু হাওয়া। ব্যাস হেমেন এবার ফর্মে। খচরামিতে ও চিরকালই পিএইচডি। টাকা গুনছে আর ভুল করে ফেলবার ভান করছে। এক সময় হঠাৎ বলে বসল, "হ্যাঁ এই নিন আপনাদের এক হাজার।"
পুলিশরা চমকে উঠে বলে, "কীসের এক হাজার, চার হাজারের কথা হইসে!"
"কোথায় চার হাজার? এক হাজারের কথা হয়েছে," গলা হাঁকিয়ে বলে হেমেন।
"দ্যাখেন চার হাজার না দিলে মাল ছাড়ুম না," পুলিশের এই কথায় এবার হেমেন হেসে ফেলে।
মাল কোথায়? মাল তো হাওয়া।
পুলিশরা চমকে উঠে দ্যাখে, সত্যিই তো! মাল নেই। হেমেনের দিকে অসহায়ভাবে তাকায় তারা। হেমেন বলে, "তাই বলছিলাম এটা নিন, না হলে গোটাটাই ফক্কা হয়ে যাবে!" পুলিশরা এক হাজার টাকা নিয়ে গজর গজর করতে করতে চলে যায়।
আরও পড়ুন- মস্তান থেকে মন্ত্রী! দাঁড়িয়ে থেকে গোটা বাজার লুঠ করিয়েছিলেন রাজ্যের এই মন্ত্রী
এই ঘটনার পরে আবারও পুলিশের খপ্পরে পড়ে হেমেন। এবারও টাকা নিয়ে আসছি বলে পালাতে যায় হেমেন। মাঠ পেরিয়ে পালাবার সময় শুনতে পায় পাকিস্তান পুলিশ ইন্ডিয়ান স্পাই, ইন্ডিয়ান স্পাই বলে চিৎকার করছে। হেমেন দেখে জনস্রোত তাকে ঘিরতে আসছে। এই প্রথম ব্যাপক ভয় পেয়েছিল হেমেন। সে যাত্রা কোনওক্রমে উতরে যেতেই কলকাতা ফেরার জন্য অস্থির হয়ে উঠল গৌরীবাড়ির হেমেন মণ্ডল। কিছুদিনের মধ্যেই বর্ডারের আড়কাঠি ধরে পশ্চিমবঙ্গের গেদে স্টেশনে এসে পৌঁছল। এবার আবার কলকাতা পর্ব শুরু হলো হেমেনের জীবনে। ১৯৭০ সালের জুন মাসে হেমেন যখন কলকাতা ফিরল, তখন উত্তাল নকশাল আমল। গৌরীবাড়ির পুরনো গ্যাংকে পুনর্গঠিত করার কাজ শুরু করে দিল হেমেন কিন্তু কলকাতায় ফিরেও রেহাই পেল না সে। কলকাতা পুলিশ তাকে ভুলে যায়নি। কনস্টেবল হত্যায় যাবজ্জীবন হলো হেমেনের। ১৯৭৫ সালে হাইকোর্টে প্রমাণের অভাবে এই মামলা থেকে খালাস হলো হেমেন কিন্তু পুলিশের উচ্চপদস্থ একাংশ হেমেনের বিরুদ্ধে আদা-জল খেয়ে লেগেছিল। মূলত সেই অংশের তৎপরতাতেই ওই বছরই মিসা আইনে গ্রেফতার হলো হেমেন। মিসা থেকে আবারও দু-মাস পর বেরিয়ে এল হেমেন।
এবার হেমেনের উপলব্ধি হলো, রাজনৈতিক আশ্রয়ে না গেলে এই অস্থিরতা কাটবে না। এই প্রথম শত ঘোষের হাত ধরে কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় যুক্ত হলো হেমেন মণ্ডল। এই পর্যায়ে উত্তর কলকাতার রাজনীতির সুবাদে অজিত পাঁজার সান্নিধ্যও পায় হেমেন। উত্তর কলকাতায় এই দুই নেতা বহু রইস মস্তানের মেন্টর বলে পরিচিত হতেন। এই দুই বর্ষীয়ান নেতা ছাড়াও সেই সময়ের দুই যুব নেতৃত্ব সুব্রত মুখার্জি ও সোমেন মিত্রের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা হয় হেমেনের। তবে নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে সোমেন মিত্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতিও ঘটে। পরবর্তী জীবনেও হেমেন বহুবার বলেছে, সোমেন মিত্রের সঙ্গে যাওয়াটা তার জীবনের মস্ত ভুল ছিল। বরং নিজেকে সুব্রত মুখার্জির লোক বলতে ভালোবাসত হেমেন। সুব্রত মুখার্জির ছত্রছায়ায় তখন তারিবাবা, ওমর, রাকেশরা উঠছে। হেমেনও এই দলে ভিড়ে গেল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই নিজেকে পিংপং বল মনে হতে লাগল হেমেনের। রাজনৈতিক নেতাদের পায়ে পায়ে আর ঘুরতে ইচ্ছা করছিল না। হেমেন খুঁজছিল এক শক্ত ঠাঁই। ঠিক এই সময়েই রুনু গুহ নিয়োগীর সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে হেমেনের। রুনু গুহ নিয়োগীই সেই ব্যক্তি, যিনি হেমেনকে বুঝিয়েছিলেন, "তুমি একজন প্রতিবিপ্লবী। বিপ্লবকে প্রতিহত করাই তোমার কাজ।" রুনু গুহ নিয়োগীর সাহচর্যেই নকশাল দমনে সক্রিয় ভূমিকা নেয় হেমেন। এই সময়ই হারু আদক নামের এক গুন্ডাকে হত্যার অভিযোগে জেল হয় হেমেনের। এই জেলযাত্রায় একটি ঘটনার মধ্যে দিয়ে পুলিশের চোখে ব্লু আইড বয় হয়ে ওঠে হেমেন। হেমেনের এই জেলযাত্রায় তখন আজিজুল হক, শিশির ভট্টাচার্য্যরা রয়েছেন।
৭৬ সালের ঘটনা। জেল ভাঙার মিশন নেয় নকশালপন্থীরা। এই কাজে জেলের কর্মীদের একাংশও নকশালদের সঙ্গে হাত মেলায়। হেমেন এক গভীর রাতে নিজের সেলে বসেই শুনছে তোড়জোড় চলছে জেল ভাঙার। অনেক দিন ভালো অ্যাকশন হয়নি, শরীরটা মোচড় দিয়ে উঠল হেমেন। পরনের লুঙ্গিটা প্যাঁচ মেরে নিল। ওর কানে তখন রুনু নিয়োগীর দেওয়া সেই মন্ত্র ঘুরছে- "হেমেন তুমি একজন প্রতিবিপ্লবী।" সেলের সদর দরজায় লুঙ্গি কোমরে গুঁজে দাঁড়িয়ে পড়ল হেমেন। নকশালদের সঙ্গে ভিড়ে যাওয়া সেপাইদের উত্তম মধ্যম দিল। শ্রেণিশত্রু নকশাল যুবকদের সঙ্গেও লড়ে গেল। ততক্ষণে জেল ঘিরে ফেলেছে পুলিশ। প্রতিবিপ্লবী হেমেনের তৎপরতায় সেবার জেলভাঙা কর্মসূচি ব্যর্থ হলো নকশালদের। আর নম্বর বাড়ল হেমেনের। পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা অনুভব করলেন, হেমেনের মতো একজন কাজের ছেলেকে জেলে রাখার মানেই হয় না। ছেড়ে রাখলে বরং ফোর্সের কাজেই লাগবে। কিছু দিনের মধ্যেই জেল থেকে মুক্তি পেল হেমেন। কথা রেখেছিল হেমেন মন্ডল। সোর্স হিসেবে খবর দেওয়া না, পুলিশের বদলে নিজেই নকশালদের ডেরা থেকে তুলে এনে লালবাজারে পৌঁছে দিত। রুনু গুহ নিয়োগীর জিপে ঘুরতে দেখা যেত হেমেনকে। সে তো প্রতিবিপ্লবী, প্রশাসনকে সাহায্য করা তার তো স্বাভাবিক ধর্ম।
এভাবে হেমেনের রাজ্যপাট ভালই চলছিল। রুনু গুহ নিয়োগীর পরামর্শে নিলামের ব্যবসাতেও নেমেছিল হেমেন। কলকাতার নিলামের ব্যবসায় তখন বেতাজ বাদশা শংকর পাইক। বেহালার শংকর পাইক আর খড়্গপুরের রামবাবু মিলে তখন নিয়ন্ত্রণ করছে রেলের নিলামের কারবার। হেমেন ও ভিড়ে গেল এই কারবারে। সত্তরের ওই অশান্ত সময়ে হেমেন মণ্ডল চরিত্রটি এক গুরুত্বপূর্ণ আখ্যান। নকশাল দমনে পুলিশ মস্তানদের একাংশকে কাজে লাগাচ্ছে। পুলিশের কাজ মস্তানরা করছে। রুনু গুহ নিয়োগীর এই মডেলের সেরা উদাহরণ হেমেন মণ্ডল। নকশাল জমানা পেরিয়ে গেলেও রুনু গুহর হয়ে কাজ করত হেমেন। জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর রুনু গুহ নিয়োগীর ট্রান্সফার হয়ে যায় কম গুরুত্বপূর্ণ অন্য দফতরে। কিন্তু আশির দশকে কলকাতায় ও রাজ্যে ডাকাতি বাড়তে থাকায় আবার রুনু গুহ নিয়োগী স্ব-মহিমায় ফিরে আসেন। সেই ডাকাত দমনেও হেমেন বাহিনীকে কাজে লাগান রুনু। হেমেন গোপন ডেরা থেকে ডাকাতদের ধরে নিয়ে চলে আসত লালবাজারে। সিগারেটে সুখটান দিয়ে অন্য অফিসারদের কটাক্ষের সুরে রুনু বলতেন, "কী হে, কী সব সোর্স পুষেছ। খবরটাও ঠিকমতো দিতে জানে না। এই দেখো হেমেনকে। খবর দেয় না, তোমার-আমার কাজটা নিজেই করে নিয়ে আসে।"
ফলে যা হয়, হেমেন মণ্ডলের নামে গৌরীবাড়ি তখন কাঁপছে। হেমেনের নামে ভয়ে থানার পুলিশ পর্যন্ত গৌরীবাড়ির পথ মাড়াচ্ছে না। এই অবস্থা চলছে ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পরও। রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলেও হেমেনের দাপট অব্যাহত ছিল মূলত লালবাজারের বড়কর্তাদের গুড বুকে থাকার জন্যই।
আরও পড়ুন-যৌনকর্মী, বেপরোয়া প্রেমিকা! কে ছিলেন কলকাতার প্রথম মহিলা মস্তান নির্মলা দাসী?
তবে সেই গৌরীবাড়ি থেকেই জীবনের সবচেয়ে বড় প্রতিরোধের মুখেও পড়তে হয়েছিল হেমেনকে। হেমেনের বাহিনীর বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর বড় অভিযোগ ছিল চাঁদার জুলুমের। হেমেন ততদিনে জগদ্ধাত্রীপুজো শুরু করেছে। পুজোয় অতিথি হিসেবে মঞ্চে হাজির হয়েছেন মিঠুন চক্রবর্তী। তখন দেশজুড়ে চলছে মিঠুন ঝড়। আগে ছেলেরা অমিতাভ বচ্চনের চুলের কাটিং রাখত, তখন শুরু করেছে মিঠুনের জুলপি কাট হেয়ার স্টাইল। আশির দশক। বাঙালির ম্যাটিনি আইডল, স্বপ্নের নায়ক হেমেনের মঞ্চ কাঁপাচ্ছেন। একটু চাঁদার জুলুম তো হবেই! ব্যাপারটা এমন জায়গায় পৌঁছয় যে, একদিন হেমেনের গুরু রুনু হেমেনকে জিজ্ঞাসা করেন, "কী রে চাঁদা তো বিরাট পরিমাণে উঠছে, কী বলিস?" একটু লজ্জা পেয়ে হেমেন বলে, "ওই পুজোতে একটু ওঠে।" কিন্তু ঘটনা ছিল অন্য। হেমেনের একটা অঘোষিত নীতি ছিল। দু'নম্বরি কারবার করছে এমন উদাহরণ থাকলে হেমেন বাহিনীকে মাসোহারা দিতে হতো। মানে হিসেব পরিষ্কার, তুমি বেআইনি কারবার করো। তুমি থানাকে পাঁচ টাকা করে মাসোহারা দাও। আমি হেমেন মণ্ডল, আমি পুলিশের সহযোগী আমাকে তাই দশ টাকা করে মাসে মাসে দিতে হবে। জলের মতো পরিষ্কার হিসেব!"
একবার এক রিপোর্টার হেমেনকে প্রশ্ন করেন, "আপনি পানের দোকান থেকে এক হাজার টাকা নেন?"
হেমেনের পাল্টা প্রশ্ন, "কোন পানের দোকান? ওই মোড়ের মাথার কালো করে, মোটা করে থ্যাবড়া মতো দোকানদারটা?"
রিপোর্টার বললেন, "হ্যাঁ হ্যাঁ ওঁর কথাই বলছি।"
ঠোঁটের কোণায় তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে হেমেন বলল, "জানেন পানের দোকানের আড়ালে ক'টা বেআইনি কারবার চলে ওর? টাকা দেবে না তো কী করবে?"
এদিকে বাম জমানা থিতু হতেই এলাকার বামপন্থীদের টার্গেট হতে লাগল হেমেন মণ্ডল। আগেই বলেছি, গৌরীবাড়িতে মেয়েদের শ্লীলতাহানি হতো আকছার। ছিল মস্তানদের উপদ্রব, রুস্তমদের দাপাদাপি। এই সময় গৌরীবাড়িতে শান্তি কমিটি তৈরি করলেন এলাকার মানুষ। এই পর্বটাকে আরও একটু বিশদে বোঝা দরকার। হেমেন তখন নিজেই একটা নাম। তার নাম নিয়ে বহু ছেলে লোককে চমকাত। নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে বাড়িওয়ালা ভাড়াটে সমস্যাতেও জড়িয়ে পড়েছিল হেমেন। সিপিএম অনেকদিনই ওকে টার্গেট করেছিল। গৌরীবাড়ির প্রথম শান্তি কমিটির সেক্রেটারি হয়েছিল হেমেন নিজে এবং প্রস্তাব দিয়েছিল এলাকায় যার যা অভিযোগ, লিখে একটা বন্ধ বাক্সে ফেলে দিন। তখনও এলাকায় নিয়ন্ত্রণ ছিল হেমেনের কিন্তু এরপর একটা ঘটনায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে যায়। লাবু বলে এলাকায় একজন সিপিআইএম কর্মী ছিল। প্রবল জনপ্রিয়। ফ্রি কোচিং করাত এলাকায়। এই লাবু একদিন একটা নারীঘটিত কেলেঙ্কারির প্রবল প্রতিবাদ করল। ঘটনা ঘটিয়েছিল হেমেনের দলেরই একটা ছেলে। প্রতিবাদ করায় লাবুকে চড় থাপ্পড় মারল। লাবুর এই হেনস্থার ঘটনায় এলাকায় মানুষ গর্জে উঠল। সামনের সারিতে প্রতিবাদ জানাল এলাকার মহিলারা। হেমেন বাহিনীর বিরুদ্ধে রাস্তায় নামল তারা। দিনটা ছিল ২৬ জানুয়ারি, ১৯৮৪। হেমেন নিজে গাড়ি চালিয়ে বউ বাচ্চা নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে। ওই দিনই শান্তি মিছিল বের করেছিল শান্তি কমিটি- হেমেনের বিরুদ্ধে। হেমেন যখন ফিরে এল, গাড়িটা পাড়ার দিকে সবে বাঁক নিয়েই দেখে পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। বউ বাচ্চাকে নামিয়েই আরও একটু এগোতে গেল হেমেন কিন্তু পুলিশের মধ্যে থাকা হেমেনের পরিচিত কয়েকজন ওকে এগোতে দিল না। এদের মধ্যে একজন নিজের জিপে তুলে নিল হেমেনকে। তার চোখ মুখে আতঙ্ক।
হেমেনের সেই পুলিশ বন্ধু হেমেনকে বলল, "এলাকায় কোনওভাবে ঢুকবি না এখন। গোটা এলাকা শান্তি মিছিল দখল নিয়েছে। গলা নিচু করে ওই বন্ধু হেমেনকে বলল, "দেবা দত্ত খুন হয়ে গেছে।" হেমেনের বুঝতে বাকি রইল না, পরিকল্পিতভাবেই উত্তর এবং দক্ষিণে দুটো শান্তি মিছিল বের করা হয়েছিল। টার্গেট ছিল দু'জন! এক, দেবা দত্ত; দুই, হেমেন মণ্ডল। দেবা দত্ত চলে গেল ওই দিন। বরাত জোরে বেঁচে রইল হেমেন। ১৯৮৫ সাল। কয়েকমাস পরেই গৌরীবাড়ি ছেড়ে সল্টলেকে চলে যায় হেমেন মণ্ডল।