হারতে বসা রাজুর শেষ ভরসা? দার্জিলিংয়ে পদ্মে গুরুং

Lok Sabha Election 2024: এই অস্বস্তির মধ্যেই রাজুর পাশে এসে দাঁড়ান তাঁর রাজনৈতিক গুরু বিমল গুরুং। এই লোকসভা ভোটে শিষ্যের কাঁধেই নিজের ভরসার হাতটি রাখেন এই প্রভাবশালী গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা নেতা।

এক সময় বলেছিলেন বিজেপি রাজ্যে এলে নাকি রাজনীতিই ছেড়ে দেবেন তিনি। তারপর রাজনীতির নদীতে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। কে না জানে, পরিবর্তনই পৃথিবীতে একমাত্র ধ্রুব। আর সেই নিয়ম মেনেই পাহাড়ের রাজনীতিতে পোক্ত মোর্চানেতা বিমল গুরুংও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছেন অনেকটাই। এতটাই যে বিজেপির হাত ধরতেও আর দ্বিধা নেই তাঁর।

জলপাইগুড়ি লোকসভা আসনে বিজেপি প্রার্থী ডাঃ জয়ন্ত কুমার রায়ের সমর্থনে বুধবার মালবাজারে একটি জনসভা ছিল। যেখানে হাজির ছিলেন রাজ্যের প্রধান বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারী। সেই সভাতে হাজির হন মোর্চা নেতা বিমল গুরুং। বিজেপিকে সমর্থনের কথা আগেই জানিয়েছিলেন। সেই সভায় ফের একবার মুক্তকণ্ঠে বিজেপিকে সমর্থনের কথাও বলতে শোনা যায় তাঁকে। তবে তাতে অবশ্য বিশেষ অবাক নয় রাজনীতিক মহল। এমন একটা কিছু যে ঘটতে চলেছে, সেই আঁচ মিলছিল অনেক দিন ধরেই।

ভোট বড় বালাই। ২০১৭ সালে পাহাড়ে গোলমাল বাঁধার পর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল সিংমারি পার্টি। তার পরে সমতলের লিম্বুবস্তিতে এসে জেলার সংখ্যালঘু বিভিন্ন সম্প্রদায়কে নিয়ে মোর্চার অধীনে শাখা সংগঠন গড়েছিলেন গুরু। সেসময় বিজেপির বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষোভ ছিল চরমে। পাহাড়ে দল ভাঙনের খেলা শুরু করেছে বিজেপি, এমন অভিযোগও তুলেছিলেন গুরুং। সে সময় মোর্চা ভেঙে একের পর এক গুরুং-ঘনিষ্ঠ বেরিয়ে গেলেও তৃণমূলের সমর্থনে অটল ছিলেন গুরুং নিজে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই মুখ্যমন্ত্রী পদে ফিরিয়ে আনার কথা বারবার শোনা গিয়েছিল তাঁর মুখে।

আরও পড়ুন: ডায়মন্ড হারবারে নৌশাদের ‘বিশ্বাসঘাতকতা’-র জবাব দিতে পারবেন বামেদের লড়াকু প্রতীক উর?

তবে সময়-পরিস্থিতি সবই বদলেছে তার পর। ২০২২ সালেও গুরুংয়ের বিজেপিতে যাওয়ার গুঞ্জন উঠেছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চাইছিলেন জিটিএ নির্বাচন হোক। গুরুং চাইছিলেন ঠিক উল্টোটাই। এমনকী জিটিএ নির্বাচন হলে অনশনে বসারও হুমকি দিয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকেই কি তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্ষোভের শুরু। তা অবশ্য নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না। কখন যে গুরুং কার সঙ্গে, তা বোঝা খুব একটা সহজ কাজ নয়। ২০১৭ সালে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পর কার্যত অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন বিমল গুরং। ২০১৯ সালে ফের প্রকাশ্যে আসেন বটে, তবে বদলে গিয়েছিল তাঁর রাজনৈতিক রং। লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির সঙ্গে সখ্যতা বেড়েছিল তাঁর। তবে তা টেকেনি বেশিদিন। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে ফের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে তাঁর পাহাড়ে প্রত্যাবর্তন। সেসময় মমতাকে মা বলে সম্বোধন করেছেন তিনি। কখনও মমতাকে মা ডেকেছেন, কখনও তাঁর বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছেন। একুশ সালেই গুরুং ডাক দিয়েছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জাতীয় নেত্রী করার। তার পর আবার জিটিএ নির্বাচন নিয়ে ক্ষোভের শুরু।

২০২৪ লোকসভা আসতে না আসতেই পাহাড়ে রাজনীতির খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে। বিজেপির সঙ্গ ত্যাগ করে বিজেপি বিরোধী জোট 'ইন্ডিয়া'-য় যোগ দিয়েছে হামরো পার্টি। এ দিকে দলের অনুশাসন মানতে পারেননি কার্শিয়াংয়ের বিজেপি বিধায়ক বিষ্ণুপ্রসাদ শর্মা। টিকিট না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ বিষ্ণুপ্রসাদ ভোটের মুখে মুখে নির্দল হিসেবেই মনোনয়ন জমা দেন। সেফটিপিন চিহ্নে প্রচারও শুরু করে দেন তিনি। এদিকে বিষ্ণুর ক্ষোভ কপালে ঘাম জমিয়েছিল গতবারের বিজয়ী বিজেপি সাংসদ রাজু বিস্তার কপালে। হবে না-ই বা কেন! গোর্খাল্যান্ড ও দার্জিলিংয়ের ভূমিপুত্র বিষ্ণুপ্রসাদ। ফলে পাহাড়ে তাঁর যে আলাদা একটা জায়গা রয়েছে, তা অস্বীকার করার জো নেই রাজুর। ফলে সেই বিষ্ণুপ্রসাদের বিরুদ্ধে রাজুর লড়াই যে ভোটে সহজ হবে না তা ভালোই বুঝেছিলেন রাজু বিস্তা।

 

এই অস্বস্তির মধ্যেই রাজুর পাশে এসে দাঁড়ান তাঁর রাজনৈতিক গুরু বিমল গুরুং। এই লোকসভা ভোটে শিষ্যের কাঁধেই নিজের ভরসার হাতটি রাখেন এই প্রভাবশালী গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা নেতা। আর তার জন্য বিজেপির হাত ধরার ক্ষেত্রেও যে তার কোনও বাধা নেই, তা কার্যত স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন গুরুং। এমনকী দার্জিলিং-সহ বাকি আসনগুলিতে বিজেপি প্রার্থীকেই সমর্থনের কথাও ঘোষণা করে দেন তিনি। একসময় প্রভাব-প্রতিপত্তি সবই ছিল বিমল গুরুংয়ের। তবে ক্রমশ তা অপসৃয়মান। তাই বলে সমস্ত জনসমর্থনই যে তিনি হারিয়েছেন, তা কিন্তু নয়। সেই জনসমর্থন নিয়েই রাজুর পাশে দাঁড়িয়েছেন গুরুং। আর সেই লাভের গুড় এসেছে পড়েছে পাহাড়ের বিজেরপির পাতেও। বিজেপির হয়ে গুরুংয়ের এই এগিয়ে আসা সেখানকার বিজেপি প্রার্থীদের বেশ খানিকটা সহায়তা করবে বলেও আশাবাদী পাহাড়ের বিজেপি নেতৃত্ব।

পাহাড় সমস্যার স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান ও ১১ জনজাতির তপশিলি উপজাতি স্বীকৃতির দাবিতে দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন চালিয়ে আসছে বিমলের বাহিনী। তবে গত কয়েক বছরে এই বিষয়টি নিয়ে বিজেপি তেমন কোনও পদক্ষেপ করেনি। সেই ক্ষোভ থেকে গুরুং আদৌ বিজেপির পাশে দাঁড়াবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় ছিল। তবে মার্চের শেষেই গুরুং জানিয়ে দেন, তাঁদের দল বিজেপির সমস্ত প্রার্থীদের হয়ে লড়বে। তাঁদেরকে আগামী লোকসভা নির্বাচনে জেতানোর জন্য একশো শতাংশ চেষ্টা করবে।

এর নেপথ্যে কি শুধুই রয়েছে গুরু-শিষ্য সমীকরণ নাকি অন্য কিছু? প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। ২০১৯-এর জয়ী রাজু বিস্তার মান বাঁচাতেই কি পাহাড়ে বিজেপির হাত ধরলেন গুরুং। মার্চের শেষে দার্জিলিংয়ে গিয়ে সিংমারির মোর্চার কার্যালয়ে গিয়ে বিমল দাজুর সঙ্গে দেখা করে এসেছিলেন রাজু। সেসময়েই এনডিএ-তে যোগ দেওয়ার জন্য গুরুংকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আসেন রাজু। সেই ডাক কার্যতই ফেরাতে পারেননি মোর্চা নেতা গুরুং। মুখে দুই দলের রাস্তা আলাদা হওয়ার কথা বললেও শেষমেশ পথ এসে মিলেই গিয়েছে গেরুয়া শিবিরে।

আরও পড়ুন:সত্যিই বিজেপির পুতুল হয়েছেন প্রশান্ত কিশোর? ফলবে সব ভবিষ্যদ্বাণী?

মার্চের মাঝামাঝি এসে হঠাৎ করেই অজয় এডওয়ার্ডের হামরো পার্টি যোগ দেয় বিজেপি বিরোধী ইন্ডিয়া জোটশিবিরে। এদিকে, গত পঞ্চায়েত ভোটে তারা বিজেপির সঙ্গেই এক ছাতার নিচে ছিল। লোকসভা ভোট আসতেই শিবির বদলায় তারা। যা খানিকটা হলেও অস্বস্তিতে ফেলেছিল বিজেপিকে। তার উপর বিষ্ণুপ্রসাদের দলত্যাগ ছিল বিজেপি এবং রাজুর উপর উপরি চাপ। আর সেই চাপ থেকে উদ্ধার করতেই দেবদূতের মতোই আবিভূর্ত হলেন গুরুং। বুধবার মালবাজারে সভা থেকে মোর্চা থেকে শুরু করে পাহাড়ের সমস্ত জনজাতি, উপজাতিকে বিজেপিকে সমর্থন করার ডাক দেন শুভেন্দু অধিকারী। বিমল গুরুংয়ের পাশে থাকা যে পাহাড়ে তাঁদের কিছুটা বাড়তি আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে, তা বোঝা গেল এদিনের সভা থেকেই। পাহাড়ে যেমন এই রোদ তো এই মেঘ, কুয়াশা। আপাতত পাহাড়ের রাজনীতি দেখে তেমনটাই মালুম হচ্ছে। পাহাড়ের মানুষের পক্ষপাত যে কার দিতে যেতে চলেছে, তা বোঝা পাহাড়ের ওই আবহাওয়া বোঝার মতোই কঠিন এই মুহূর্তে।

More Articles