১১ মাস জেলও খেটেছেন! তবু কেন বাংলাদেশের জনগণের মন রাখতে ব্যর্থ শেখ হাসিনা?
Bangladesh PM Sheikh Hasina: হাসিনা মইনুলকে বলেছিলেন, "আপনারা কাজটা ভাল করেননি। আমি দ্রুত ফিরে আসব এবং তখন আপনাদের কাউকে ছেড়ে কথা বলব না।"
বাংলাদেশের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে, চাঁদাবাজির অভিযোগে এক মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। ২০০৭ সালে, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই তৎকালীন রাজনীতিতে 'মাইনাস টু' ফর্মুলার কথা শোনা যেতে থাকে। এই 'মাইনাস টু' ফর্মুলা কী? ফর্মুলাটি হলো, দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের (আওয়ামী লিগের শেখ হাসিনা ও বিএনপি-র খালেদা জিয়া) নেত্রীদের সরিয়ে রেখে দল পুনর্গঠনের চেষ্টা। ১৯৯০ সালের পর ২০০৭ সালে বাংলাদেশে ফের গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ২০০৮ সালে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর হওয়ায় আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা মজবুত হয়ে ফিরে আসেন। উল্লেখ্য, পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বহু বছর নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন হয়নি বাংলাদেশে। আর হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আছে প্রায় ১৬ বছর। ক্ষমতাগ্রহণের একদম শুরুতে নিরঙ্কুশ সমর্থন পেলেও, মানুষের মন রাখতে ব্যর্থ কেন হাসিনা সরকার?
১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই, শেখ হাসিনা গ্রেফতার হয়ে কারাগারে গিয়েছিলেন। তখন দল পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন প্রবীণ নেতা জিল্লুর রহমান। একটানা ১১ মাস কারাগারে বন্দি ছিলেন হাসিনা। ২০০৮ সালের ১১ জুন জামিনে মুক্তি পেয়ে বিদেশেযাত্রা করেন চিকিৎসার জন্য। সে বছর জামিন পাওয়ার পর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নানা নাটকীয় ঘটনা ঘটে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতার কুর্সি পায় হাসিনা সরকার। সে বার ৭ বছর পর ক্ষমতা পেয়েছিল আওয়ামী লীগ। অভিযোগ ছিল, শেখ হাসিনা এবং শেখ ফজলুল করিম সেলিম ২ কোটি ৯৯ লক্ষ টাকা চাঁদাবাজি করেছেন।
আরও পড়ুন- থমকে আমদানি রপ্তানি! বাংলাদেশে আন্দোলনের জেরে যেভাবে ক্ষতি কয়েক’শ কোটির
২০০৭ সালের ১৬ জুলাই, ভোরে হাসিনাকে ধানমণ্ডির বাড়ি 'সুধা সদন' থেকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। আদালতের শুনানির পর শেরে বাংলা নগরে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় বিশেষভাবে তৈরি সাবজেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে। হাসিনা গ্রেফতার হওয়ার আগে কয়েকটি ফোন করার অনুমতি চেয়েছিলেন। অনুমতি পেয়েওছিলেন। যাঁদের তিনি ফোন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন তখনকার আইন উপদেষ্টা মইনুল হোসেন। 'দ্য ডেইলি স্টার'-এর খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, সে দিন হাসিনা মইনুলকে বলেছিলেন, "আপনারা কাজটা ভাল করেননি। আমি দ্রুত ফিরে আসব এবং তখন আপনাদের কাউকে ছেড়ে কথা বলব না।" দেখা গেল, হাসিনা আমলে দু'দফায় জেল খাটেন মইনুল।
বাংলাদেশের সরকারি চাকুরিজীবীদের দুর্নীতি নিয়ে একের পর এক খবর আসছে। বিভিন্ন অবৈধ সম্পদের খোঁজও পাওয়া যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, কেন এই সকল দুর্নীতির বিরুদ্ধে হাসিনা সরকারের কোনও অবস্থান এখনও স্পষ্ট নয়? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবার যুক্তি দিয়েছেন, উন্নয়ন বাড়ার কারণেই নাকি দুর্নীতি হচ্ছে। প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তাঁদের জবাব দেন, বিএনপির আমল থেকেই প্রশ্ন ফাঁস হয়ে আসছিল। হাসিনার চিন সফরের পর বাংলাদেশের প্রাপ্তি নিয়ে বিভিন্ন দলে এবং গণমাধ্যমে যেসব মন্তব্য শোনা যাচ্ছিল, সেই বিষয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে, সাজিয়ে-গুছিয়ে উত্তর দেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী হাসিনা বলেন, "সমালোচনায় আমার কিছু যায় আসে না।" একজন রাষ্ট্রপ্রধান কি সত্যিই 'সমালোচনায় যায় আসে না' বলতে পারেন?
বাংলাদেশের দৈনিক 'সমকাল'-এ লেখা হয়েছে, দু'বছর ধরে বাংলাদেশের বিদুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের পাওনা শোধ করেনি। এতে ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি বকেয়া পড়েছে। হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমাতে জরুরি পদক্ষেপ করে না সরকার। দাবি, অনিয়ম, দুর্নীতি,অপচয় রোধ করেই বিদ্যুতের খরচ কমানো যেত। বাংলাদেশের আরেক সংবাদমাধ্যম 'প্রথম আলো'-র তথ্য অনুযায়ী, ভর্তুকির চাপ সামলাতে বছরে চারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ার কথা বলা হয়। সরকার তরফে জানানো হয়, এভাবে আগামী তিন বছরে বিদ্যুতের মোট ভর্তুকি কমিয়ে আনা হবে। বাংলাদেশের 'মানবজমিন' পত্রিকায় লেখা হয়েছ, দেশে দীর্ঘদিন রপ্তানি আয় বাড়ছে না, এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। ফলে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে রাষ্ট্র। যেমন- এলসির মতো বকেয়া দিন দিন বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের 'দিগন্ত' পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, এলসি খোলার উদ্দেশ্য ছিল, সরকারের বড় প্রকল্প, বিপিসির জ্বালানি তেল, ভোগপণ্য আমদানি করা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এখন তার একটি বড় অংশই পরিশোধ করা যাচ্ছে না। ওই সংবাদপত্রেই লেখা হয়েছে, বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলি টিকিট বিক্রির সিংহভাগ নিজেদের দেশে নিতে পারছে না। একইভাবে, বিদেশি বিদুৎ ও জ্বালানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলির বকেয়া অনেক বেড়েছে।
আরও পড়ুন- অগণিত মৃত্যু, সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস! শাসক-বিরোধী সংঘর্ষে কতটা ক্ষয়ক্ষতি বাংলাদেশে?
'নিউ এজ' পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০২২ সালে চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে ৬১ লক্ষ ৩০ হাজার মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে নেমে গেছে। বিআইডিএস-এর গবেষণার তথ্য বলছে মাত্র ৬.২৯% মানুষ নিজস্ব আয় দিয়ে চিকিৎসার খরচ চালান। ৩২.৫৮% মানুষ সঞ্চিত অর্থ দিয়েই চিকিৎসা করান। এই গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ৬১.১৩% মানুষ হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় চিকিৎসা মেটাতে নাজেহাল হন।
সম্প্রতি বাংলাদেশের সরকারের বিরুদ্ধে তিস্তা প্রকল্প, কোটা সংস্কার, সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পেনশন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠেছিল। এরই মধ্যে কোটা সংস্কার নিয়ে উচ্চ আদালতের রায়ের পর থেকে টানা আন্দোলন ও অবরোধের কর্মসূচি শুরু করেছিল শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলনকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করতে লেগে পড়েন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্দোলনে মৃতের সংখ্যা অন্তত ১৫০। বিবিসি-র একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম, কোনও আন্দোলনের জন্য এত কম সময়ে এত মানুষের মৃত্যু হয়েছে।" 'ডয়েচ ডেল'-এর এক প্রতিবেদনে ওই সংবাদমাধ্যমেরই ঢাকা প্রতিনিধি হারুন উর রশীদ-এর ভাষ্যে লেখা হয়েছে, "আমার বয়স ৫২ বছর। আমি এরশাদ বিরোধী আন্দোলনটা দেখেছি। বিশেষ করে আমি যদি পয়েন্ট আউট করি, গণঅভ্যুত্থানের সময়টা দেখেছি। আমার মনে হয়েছে যে, আন্দোলনের যে প্যাটার্ন এবং আন্দোলনের যে অ্যাক্টিভিটিজ সেটি বড় আকারের আন্দোলনের। সহিংসা যদি বলেন সেটি উঁচু মাত্রায় পৌঁছে গেছে।" এই সংবাদমাধ্যমের অপর প্রতিনিধি সমীর কুমার দে বলেছেন, পরিস্থিতি এমন জায়গায় গেছে যে, গুলির মুখেও আন্দোলনকারীরা পিছু হটছেন না।
কোটা সংস্কার নিয়ে শেখ হাসিনা শুরু থেকেই বলে আসছেন, এই সমস্যার সমাধান আদালতেই হবে। ২১ জুলাই হাইকোর্টের রায় খারিজ করে বাংলাদেশের সুপ্রিমকোর্ট। নিদের্শ দেওয়া হয়, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৯৩% নিয়োগই হবে মেধার ভিত্তিতে। এবং বাকি ৭% সংরক্ষিত। তার মধ্যে ৫% মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য, ১% ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য এবং বাকি ১% বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য। রায়ে এও বলা হয়েছে যে, সরকার চাইলে এই অংশ কম বেশি করতে পারবে। প্রশ্ন উঠছে, বাংলাদেশের মতো দেশে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য শুধুমাত্র ১% সংরক্ষণ কি ন্যায্য? বিক্ষোভকারীরা অভিযোগ করেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের নামে ভুয়ো প্রার্থীদের সুবিধে পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভুয়ো প্রার্থীদের চিহ্নিত করতে সরকার কোনও পদক্ষেপ করছে কিনা, সেই নিয়ে এখনও স্পষ্ট জানানো হয়নি। সংরক্ষণ সংস্কারের দাবি করেছিলেন আন্দোলনকারীরা। সংরক্ষণ নাকচ করার কথা বলেননি আন্দোলনকারীরা। দেখা যাচ্ছে, নতুন রায়ে অন্য শ্রেণির সংরক্ষণ অনেকটাই কমে গিয়েছে। এভাবে কি ইচ্ছেমতো সংরক্ষণ বাড়ানো বা কমানো যায়? সংরক্ষণ তো জনগণনার ভিত্তিতে হওয়ার কথা। অন্য শ্রেণির সংরক্ষণ কমিয়ে কি সরকার বিক্ষোভকারীদেরই কাঠগড়ায় তুলতে চাইছে?
আরও পড়ুন- স্বৈরাচারী এরশাদকেও গদি ছাড়তে হয়! বাংলাদেশে গণআন্দোলন কি আর সেই ক্ষমতা রাখে?
দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, যারা নিজেদের 'রাজাকার' বলছেন, ছাত্রলীগ তাদের বুঝে নেবে। ১৬ জুলাই 'মানবজমিন' পত্রিকার শিরোনাম ছিল, 'ফের হেলমেট বাহিনীর তাণ্ডব'। পত্রিকাটিতে লেখা হয়, ছাত্রলীগ সাধারণ পড়ুয়াদের ওপর হামলা চালিয়েছে। আহত শিক্ষার্থীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে গেলেও ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সম্পাদকের কথা মতো, এটাই কি তবে সেই 'বুঝে নেওয়া' ছিল?
বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখনও উত্তপ্ত। দেশে ইন্টারনেট বন্ধ, কার্ফিউ জারি। পড়ুয়ারা বলছেন, স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। পড়ুয়ারা সরকারের কাছে ৯টি দাবিও রেখেছেন। বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মেট্রোপলিটনে পুলিশ বারবার জনগণকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কার্ফিউ আইন ভাঙলে, ১ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। বলা হচ্ছে, পড়ুয়াদের উত্তেজিত করা আসলে সন্ত্রাসবাদীদের ছক। এত মানুষ যে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, সবারই কি সন্ত্রাসীবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ হতে পারে? প্রায় ১৫০ জন শিক্ষার্থীর প্রাণ হারিয়েছেন। তাঁদের সকলকেই কি তবে সন্ত্রাসবাদীদের ছকের অংশ বলে দাগিয়ে দেওয়া হবে? বিরুদ্ধ মত জানালেই কি তাঁদের 'সন্ত্রাসী' আখ্যা দেওয়া যায়? প্রশ্ন উঠছে, কোটা সংস্কারের সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নেই কেন? এমন এক পরিস্থিতিতে মানুষ যখন বুঝতে পারছেন তাঁদের অস্তিত্ব মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে, গণতন্ত্রের নামে রাষ্ট্রকাঠামোর কেবল নিপীড়নই করা হচ্ছে, এই কাঠামোর মধ্যে থেকে নিষ্পেষণের সমাপ্তি ঠিক কী?