রাষ্ট্র সব দেখছে! কীভাবে রাষ্ট্রের নজরদারির সামনে প্রতিনিয়ত নগ্ন হচ্ছেন ভারতের নাগরিকরা
Social Media Surveillance: গুজরাত বিধানসভায় একটি আইন পাশ করা হয়েছে। সমস্ত হাউসিং কমপ্লেক্সের মধ্যে যত ক্লোজ সার্কিট টিভি ক্যামেরা আছে, সেগুলোকে আঞ্চলিক থানার সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে।
জনৈক ব্যক্তি মানুষের অভিজ্ঞতা
অপ্রতিম সরকার, কলকাতার বাইরে, বেসরকারি অফিসে উঁচু পদে চাকরি করেন। রোজ গাড়ি নিয়ে অফিসে যান। সেদিন মেয়ের স্কুলের পুলকার না আসার ফলে মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে অফিস যেতে একটু দেরিই হয়েছিল। ফলে ব্যস্ত সময়ে গাড়ির পার্কিং পাওয়া যায়নি। যাঁরা অফিসের কাছাকাছি পার্কিং লটের দায়িত্বে আছেন, তাঁরা অনেক চেষ্টা করেও জায়গা বার করতে না পেরে অপ্রতিমকে বললেন, “আপনি দ্বিতীয় সারিতে গাড়ি রেখে, চাবি আমাদের দিয়ে যান, আমরা দেখে নেব। অসুবিধা হবে না।” অগত্যা উপায়ন্তর না দেখে, তাই করলেন অপ্রতিম। একটা টেনশন নিয়ে, গাড়ি রেখে, চাবি দিয়ে অফিসে ঢুকলেন তিনি। সারাদিনে খুব একটা অসুবিধা হয়নি, পার্কিং লটের ছেলেদের কোনও ফোনও আসেনি। শেষে সন্ধ্যের আগে যখন অফিস থেকে বেরোচ্ছেন, তখন একটা হোয়াটসঅ্যাপ আসে অপ্রতিমের ফোনে। মেসেজটি পুলিশের কাছ থেকে এসেছে। তাতে লেখা, “আপনার গাড়িটি আজকে সারাদিনে অবৈধভাবে পার্কিং করা হয়েছে, এই অভিযোগ আমাদের কাছে একজন সচেতন নাগরিক করেছেন, ফলে আপনার হাজার টাকা জরিমানা করা হলো এবং আপনার গাড়ির ফাস্টট্যাগের সঙ্গে যে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সংযুক্ত আছে সেখান থেকে সেই টাকা কেটে নেওয়া হলো।” সঙ্গে তাঁর গাড়িটির ছবি, পার্কিং লটের বাইরে পার্ক করা।
মেসেজটি পেয়ে খুব অবাক হলেন অপ্রতিম। জরিমানা করা হয়েছে, তার জন্য যত না অবাক হলেন, তার থেকে অনেক বেশি অবাক হলেন, ওই কথাটা পড়ে! একজন সচেতন নাগরিকের যে কোনও অভিযোগের ভিত্তিতে কি পুলিশ এই রকম সিদ্ধান্ত নিতে পারে? একবারও তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সুযোগ দেওয়া হলো না? এইভাবে যে কোনও কারুর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে কি টাকা কেটে নেওয়া যায়? হাজার টাকাটা হয়তো বড় বিষয় নয় কিন্তু বিষয়টা খুব অসুবিধার মনে হচ্ছে। এইরকম কোনও নতুন আইন হয়েছে নাকি? খবরের কাগজ খুব বেশি দেখা হয় না, কিন্তু বাড়ি গিয়ে তো দেখতে হবে বিষয়টা কী? ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরলেন অপ্রতিম।
বাড়ি ফিরেই সোজা বসে গেলেন ল্যাপটপ নিয়ে। বেশি খুঁজতে হলো না, একটা খবরের সূত্র চলে এল গুগলে। জুন মাসে কেন্দ্রীয় পরিবহন মন্ত্রী নীতিন গড়কড়ি এক জায়গায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছেন, কোনও সচেতন নাগরিক যদি এইরকম কোনও ছবি পুলিশের হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাতে পারেন, যেখানে দেখা যাবে কোনও গাড়ি অবৈধভাবে পার্কিং করা আছে, তাহলে সেই ব্যক্তিকে পাঁচশো টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে! এবং যাঁর গাড়ি ওই অবস্থায় থাকবে তাঁকে হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার শীঘ্রই আইনও আনতে চলেছে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সচেতন নাগরিকরা পুলিশের হয়েই কাজ করবেন এবং নজর রাখবেন কোথাও এই ধরনের কোনও অবৈধ পার্কিং হচ্ছে কিনা। এতে পুলিশের কাজ আরও সহজ হবে।
আরও পড়ুন- চাকরি চেয়ে লাঠি! কীভাবে রাতের অন্ধকারে করুণাময়ীতে অভিযান পুলিশের?
আরও গভীরে ঢুকতে শুরু করলেন অপ্রতিম। এইবার তাঁর আরও অবাক হওয়ার পালা। এমনিতে সবাই এখন জানেন, রাষ্ট্র আমাদের নজর রাখে। আমরা কোথায় কী করছি, সামাজিক মাধ্যমে কী কথা বলছি সব কিছু উপর থেকে দেখা হয়। আগে এই পরিমাণ নজরদারি না হলেও ২০১৪ পরবর্তীতে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হয়ে আসার পরে, সমস্ত কিছুর সঙ্গে আধার সংযুক্তিকরণ প্রায় বাধ্যতামূলক হয়ে যাওয়ার ফলে এই ব্যবস্থা এখন প্রায় বজ্র আঁটুনির পর্যায়ে চলে গেছে। সরকার বিরোধী কোনও লেখাপত্র সামাজিক মাধ্যমে পছন্দ করা বা শেয়ার করা এখন অপরাধ। এই সব কারণে জেল হওয়া এখন একটি স্বাভাবিক বিষয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু একজন নাগরিক অন্য নাগরিকের দিকে নজর রাখছেন এইটা আগে ছিল না।
খুঁজতে গিয়ে অপ্রতিম আবিষ্কার করলেন, আমেরিকাতে এইরকম একটা প্রক্রিয়া আগেই চালু হয়েছিল, তার নাম ছিল, ‘নেবারহুড ওয়াচ প্রোগ্রাম।’ ৯/১১-র পরে এই পদ্ধতি এতটা সফল না হলেও ইদানিং প্রযুক্তির উন্নতির ফলে এই প্রক্রিয়া ক্রমশ আরও গতি পাচ্ছে। এইবার দুই আর দুইতে, চার মেলানোর চেষ্টা করলেন অপ্রতিম। এই যে কোভিডের সময়ে বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন সরকারের পক্ষ থেকে আনা হয়েছিল, সেই আরোগ্য সেতু বা কোউইন এগুলোও তো একজন মানুষ তাঁর পাশের মানুষের দিকে যাতে নজর রাখতে পারেন তারই সংস্করণ ছাড়া কিছু নয়। প্রথমে বলা হয়েছিল, কোউইন দিয়ে কোভিডের পরীক্ষার ফলাফল আর ভ্যাক্সিনের রিপোর্ট জানা যাবে। এখন সরকার থেকে বলা হচ্ছে, কোনও শিশু কী কী ভ্যাক্সিন নিচ্ছে তার জন্যেও কোউইন লাগবে, সঙ্গে তাঁদের আধারকে যুক্ত করা হবে। তাহলে, জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি প্রতিটি মানবশিশু নজরদারির মধ্যে দিয়েই বড় হবে? এবার অপ্রতিমের মনে পড়ল একটা খবরের কথা।
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তরফ থেকে সাইবার স্বেচ্ছাসেবক নেওয়ার জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের কাজ হবে, সামাজিক মাধ্যমে কারা সরকার বিরোধী আচরণ করছে সেদিকে নজর রাখা। দেশের বেশ কিছু শহরে ফেসিয়াল রেকগনিশন বা মুখ দেখে চিনে রাখার পদ্ধতিও চালু হয়ে গেছে। অপ্রতিমের মনে পড়ল, কোনও একটি তথ্যচিত্রে দেখেছিলেন চিনে এই পদ্ধতি চালু আছে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে ক্যামেরা বসানো, তাতে প্রতিটি নাগরিকের ছবি তোলা হচ্ছে, মিলিয়ে দেখা হচ্ছে, তাঁর আগের কোনও অপরাধমূলক কার্যকলাপের ছবি আছে কিনা? তিনি সামাজিক মাধ্যমে কী বলছেন! সব কিছুর সঙ্গে মিলিয়ে দেখে তবে তাঁকে ‘সঠিক নাগরিক’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। এই স্বীকৃতি পেলে তবেই তিনি চাকরি পাবেন ভবিষ্যতে।
আরও ভয়ের কথা
গুজরাত বিধানসভায় একটি আইন পাশ করা হয়েছে। সমস্ত হাউসিং কমপ্লেক্সের মধ্যে যত ক্লোজ সার্কিট টিভি ক্যামেরা আছে, সেগুলোকে আঞ্চলিক থানার সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। অর্থাৎ কোন বাড়িতে কে আসছেন, কখন আসছেন, সব নজর রাখা হবে। বাইরে থেকে দেখলে হয়তো মনে হবে কোনও নাগরিকের সুরক্ষার জন্যই করা হচ্ছে, কিন্তু আদপে এই প্রক্রিয়া প্রতিটি নাগরিককে নজরে রাখার পদ্ধতি ছাড়া আর কী? তবে কি আমরা নজরদারি রাষ্ট্রেই বাস করছি? তবে কি গণতান্ত্রিক কোনও পরিবেশই আর অবশিষ্ট থাকবে না? তবে কি সরকারের যে কোনও অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপের আর কোনও বিরোধিতাই করা যাবে না? তবে কি তিনি যে নিয়মিত অল্ট নিউজের মতো স্বাধীন তথ্য অনুসন্ধানকারী সংস্থাকে টাকা দেন, তা সরকার জানে? কোথায় যেন পড়েছিলেন, সরকারকে এই তথ্য জানানো হয়েছে। আধারের সঙ্গে ভোটার কার্ড সংযোগ করানো চলছে। যদিও নির্বাচন কমিশন এখনও বলে চলেছে, বিষয়টা ঐচ্ছিক! কিন্তু জেনে অথবা না জেনে বিভিন্ন রাজ্যে এই কাজটি হয়ে চলেছে। বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধি আসলে সমস্যাটা বুঝতেই পারছেন না। এই কাজটি করা গেলেই একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়, প্রতিটি মানুষকে নজরদারির আওতায় আনা সম্ভব। কোন কোন মানুষ সরকারি সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন, কেন্দ্র কিম্বা রাজ্য সরকারের কোন কোন প্রকল্পে কে কে নথিভুক্ত করিয়েছেন নিজেদের, তা যদি জানা যায়, তাহলে কী কী করা সম্ভব, তা কি আন্দাজ করা যায়?
আরও পড়ুন- আবার প্রকাশ্যে সোশ্যাল মিডিয়া ও বিজেপির সম্পর্ক! সামনে আসছে যে চাঞ্চল্যকর তথ্য
একজন মানুষের ফোনের সঙ্গে আধার সংযুক্ত করা হয়েছে আইনের ফাঁক গলে, তারপর সেই ফোনের সঙ্গে সরকারি সুবিধাকে যুক্ত করা হয়েছে, সেই ফোনের সঙ্গে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সংযুক্ত করানো হয়েছে। তৈরি হয়েছে একটা ত্রিভুজ- যাকে পরিভাষায় ‘জ্যাম’ বলে। JAM- অর্থাৎ জনধন অ্যাকাউন্ট-আধার-মোবাইলের ত্রিভুজ। এই মুহূর্তে প্রতিটি মানুষকে যদি এই ত্রিভুজে এনে ফেলা যায় এবং সেই ত্রিভুজের সঙ্গে যদি ভোটার কার্ডকে সংযোগ করানো যায় তাহলেই শাসকদের সবচেয়ে সুবিধা। তাঁরা যেমন নির্বাচন কমিশনে দাখিল হওয়া ১৭সি ফর্ম দেখে বুঝতে পারবেন কে বা কারা কোন দলকে ভোট দিচ্ছেন, তেমনই নির্বাচকদের কাছে বিজ্ঞাপনও পাঠানো সম্ভব হবে সমস্ত তথ্য দেখে। এই জন্যেই হয়তো আধারকে কেউ কেউ ভারতের কেমব্রিজ অ্যানালিটিকাও বলেছেন। অনেকেই আবার ফোন থেকেই সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করেন, ফলে তাঁরা কে কোথায় কী লিখছেন, কোন লেখা বা ভিডিও পছন্দ করছেন তাও বোঝা সম্ভব হবে। তারপরে প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে কোনও একজন বা একাধিক নির্বাচকদের বাদ দেওয়া কি খুব কঠিন কিছু কাজ হবে?
নতুন আইন আসছে
যদিও কেন্দ্রীয় সরকার দেশের সর্বোচ্চ আদালত পেগাসাস নিয়ে যে কমিটি করেছিল তাকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেনি, তবুও আদালত জানিয়েছিল যে, তাঁদের কাছে এমন কোনও তথ্য নেই, যে সরকারের তরফেই ব্যক্তি নাগরিকের ফোনে আড়ি পাতা হয়েছিল। এবার সরকারের তরফ থেকে ‘ইন্ডিয়ান টেলিকম বিল ২০২২’ আনা হয়েছে, যার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, প্রতিটি নাগরিক ইদানিং যে হোয়াটসঅ্যাপ করেন বা জুম মিটিং, গুগল ডুয়ো ব্যবহার করছেন তার প্রতিটিই যাতে সরকার জানতে পারে, তার জন্য আইন আনা হচ্ছে। অর্থাৎ এতদিন কিছুটা হলেও যা ছিল গোপন, তা সরকার ইচ্ছে করলেই দেখতে পারে। তার মানে আপনার আমার প্রতিটি হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ, ফেসুকের মেসেজ সব চাইলে সরকার পড়তে পারে এবং সেই অনুযায়ী কিছু মনে হলে যে কাউকে গ্রেফতার করতেও পারে। তারপর আমাকে-আপনাকেই প্রমাণ করতে হবে যে আমি বা আপনি ষড়যন্ত্র করিনি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। এ যদি নজরদার রাষ্ট্র না হয় তাহলে কী?
যদিও এখনও নির্বাচকদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক মানুষই সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করেন, তাই এই ধরনের সর্বগ্রাসী শক্তি আরও ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠার আগেই, প্রতিটি সাধারণ মানুষের দরজায় দরজায় পৌঁছনো জরুরি। কিন্তু এই কষ্টকঠিন কাজটা কে করবে, বা কোন রাজনৈতিক দল করবে? একটা কথা এখনও সত্যি, মানুষই শেষ কথা বলে। কোনও সর্বগ্রাসী রাষ্ট্র তার সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করলেও একদিন মানুষের শক্তির কাছে পরাজিত হতে বাধ্য কারণ মানুষই প্রযুক্তি তৈরি করেছে, মানুষই বিপ্লব করেছে এবং করবে। বিখ্যাত লেখক এবং সমাজকর্মী অরুন্ধতী রায় এই কথাটিই বলেছেন যে, মোবাইল ফোন এবং সামাজিক মাধ্যমের বাইরে এসে যদি মানুষের কাছে পৌঁছনো যায়, তবেই এই লড়াই জেতা সম্ভব। যদি বেশ কিছু দেশে এই নজরদারি এড়িয়ে কোনও কোনও আন্দোলন সফল হতে পারে, যদি শ্রীলঙ্কার মতো দেশ, যা মূলত চিনের প্রযুক্তি এবং নির্দেশে চলেও শেষপর্যন্ত মানুষের গণঅভ্যুত্থান ঠেকাতে পারেনি, তাহলে এই দেশেও সম্ভব হতে পারে।