তিন মাসের মাথায় ফের খুন হামাস-প্রধান, কেন সিনওয়ারকে 'কসাই' বলত ইজরায়েল?
Hamas leader Yahya Sinwar: দিন কয়েক আগেই ইরানের তেহরানে খুন হয়েছিলেন হামাসের পূর্বতন প্রধান ইসমাইল হানিয়াহ। তার পরে সেই কুর্সিতে বসেছিলেন হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার। তাঁর পরিণতিও হল হানিয়াহের মতোই।
প্রায় এক বছর পরেও যুদ্ধের তীব্রতা কমায়নি ইজরায়েল। গাজায় অব্যাহত রয়েছে তাদের হামলা। দিন কয়েক আগেই ইরানের তেহরানে খুন হয়েছিলেন হামাসের পূর্বতন প্রধান ইসমাইল হানিয়াহ। তার পরে সেই কুর্সিতে বসানো হয়েছিল হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার। তবে তাঁর পরিণতিও হল হানিয়াহের মতোই। সম্প্রতি ইজরায়েলের বিদেশমন্ত্রী কাট্জে দাবি করেছেন, গাজায় ইজরায়েলি সেনার অভিযানে মৃত্যু হয়েছে হামাসের বর্তমান প্রধান সিনওয়ারের।
একদিকে লেবাননে হিজবুল্লা, ইরান, অন্যদিকে গাজা, লাগাতার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল। বৃহস্পতিবার গাজার একটি ভবনকে নিশানা করে হামলা চালিয়েছিল ইজরায়েলি সেনা। আশঙ্কা করা হচ্ছিল, সেই হামলায় মৃতদের মধ্যে থাকতে পারেন হামাস প্রধানও। সূত্রের খবর, তিন জনের দেহ নিয়ে আসা হয়েছিল ডিএনএ পরীক্ষার জন্য। সেই পরীক্ষার পরেই সিনওয়ারের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে ইজরায়েল। এর আগেও একাধিক বার জল্পনা তৈরি হয়েছে সিনওয়ারের মৃত্যুর। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে গাজা শহরের একটি স্কুলে রকেট হামলা চালিয়েছিল ইজরায়েলি সেনা। তখনই রটে গিয়েছিল, সেই হামলায় সিনওয়ারের মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে। তবে তখনও বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়নি।
হামাস নেতাদের মধ্যে কুখ্যাত ছিলেন এই সিনওয়ার। হামাসের সঙ্গে ইজরায়েলের এই সাম্প্রতিক সংঘাতের জন্য দায়ী তিনিই। সূত্রের খবর, গত ৭ অক্টোবরের হামলার ছক ছিল সিনওয়ারেরই মস্তিষ্কপ্রসূত। তাঁর নির্দেশেই ইজরায়েলে অতর্কিতে হামলা চালিয়েছিল হামাস। যার পরেই গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করে দেয় ইজরায়েল। কার্যত হামাসকে খতম করার লক্ষ্য নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে নেমে পড়েছিলেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। এমনিতেই প্যালেস্টাইনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ইয়াসের আরাফতের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছিল ইজরায়েলের, সেই চুক্তি মতে কোনও সামরিক বাহিনী রাখতে পারে না প্যালেস্টাইন। আধা-সামরিক বাহিনী প্রয়োজনে থাকতে পারে। কিন্তু কোনও সামরিক বাহিনী বা সশস্ত্র সংগঠন তৈরি হলেই তাকে ইজরায়েলের হাতে তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে ওই চুক্তিতে। নাহলে প্যালেস্টাইনে হামলা করতে পারে ইজরায়েল। তার পরেও প্যালেস্টাইনে মাথা চাড়া দিয়েছে বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠন। যার মধ্যে অন্যতম হামাস।
আরও পড়ুন: ৩ ছেলে, ৪ নাতি-নাতনির পর ইজরায়েলের হাতে খুন হামাস নেতা! কে এই ইসমাইল হানিয়াহ?
জুলাই মাসের শেষের দিকে মৃত্যু হয় হামাসের প্রাক্তন প্রধান ইসমাইল হানিয়াহের। তাঁর পরিবারের সদস্যদের গাজায় খুন করা হয়েছিল আগেই। ইসমাইলের মৃত্যু হয় তেহরানে। তার পরে হামাসের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল সিনওয়ারকে। তিনি আগে ছিলেন হামাসের সশস্ত্র শাখার প্রধান। সেখান থেকে গোটা হামাসের দায়িত্বই দিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের একটি শরণার্থী শিবিরে জন্ম সিনওয়ারের। সেখানে তিনি পরিচিত ছিলেন আবু ইব্রাহিম নামেও। শোনা যায়, ১৯৪৮ সালে নকবার সময় বাস্তুচ্য়ুত হন তিনি। সিনওয়ার-ঘনিষ্ঠদের কেউ কেউ বলে থাকেন, তাঁর পরিবার নাকি আগে বসবাস করত আল মাজদল শহরে। ১৯৪৮ সালে ইজ়রায়েল রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর এই শহর প্যালেস্টাইনের হাতছাড়া হয়। শহরটির নাম বদলে রাখা হয় অ্যাশকেলন। জানা যায়, গাজ়ার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যারাবিক স্টাডিজ় নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন সিনওয়ার। ছাত্রজীবনেই অবশ্য ইজ়রায়েল-বিরোধী একাধিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। তারপর তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ চব্বিশটি বছর কেটেছে ইজরায়েলের জেলেই। ফিলিস্তিনিদের প্রতি অনুভূতিপ্রবণ ছিলেন না তিনি একেবারেই, এমন বদনামও রয়েছে সিনওয়ারের।
হিংসা ছড়ানোর অভিযোগে ১৯৮২ সালে প্রথম গ্রেফতার হন। তখন তিনি মাত্র ২০। ১৯৮৫ সালে আবারও গ্রেফতার হলেন সিনওয়ার। কারাগারে এই দ্বিতীয় মেয়াদে হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনের সঙ্গে আলাপ ও ঘনিষ্ঠতা হয় তাঁর। হামাসের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা আল-মাজাদ প্রতিষ্ঠা করার নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন সিনওয়ার। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৫। ১৯৮৮ সালে দু’জন ইজ়রায়েলি সেনাকে হত্যার ঘটনায় যুক্ত থাকার অভিযোগে আবারও গ্রেফতার হন সিনওয়ার। তার পর প্রায় ২২টি বছর কেটেছে তাঁর ইজরায়েলি জেলের অন্ধকার কুঠুরিতে। ইজ়রায়েলিদের হয়ে কাজ করছেন অভিযোগে খুন হয় ১২ জন ফিলিস্তিনি। এই হত্যাকাণ্ডেও নাম জড়িয়েছিল সিনওয়ারের। ২০০৬ সালে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ইজ়রায়েলে ঢুকেছিল হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জাদ-দিন আল-কাসাম। ইহুদি-প্রধান দেশটিতে ঢুকে তারা দুই ইজ়রায়েলি সেনাকে হত্যা করে, এক জনকে পণবন্দি করেছিল। পণবন্দি সেনার মুক্তির বিনিময়ে সিনওয়ারকে ছাড়তে বাধ্য হয় ইজ়রায়েল। শুধু সিনওয়ার নয়, আরও বেশ কয়েক জনকে ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল ইজরায়েল সরকার। এরই মধ্যে শরীরে দানা বাঁধে ক্যানসার। তবে সেই বিপত্তি কাটিয়ে ২০০৭ সালে সুস্থ হয়ে ওঠেন সিনওয়ার। ২০১১ সালে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে হামাসের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি। জেলে বসে একটি আধা আত্মজীবনীমূলক বইও লেখেন সিনওয়ার। যার নাম 'দ্য থর্ন অ্যান্ড দ্য কার্নেশন'। শোনা যায়, জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিলেন সিনওয়ার। এ-ও শোনা যায়, তিনি হামাসে যোগ দেওয়ার পরেই নাকি ইজ়রায়েলের উপর হামাসের হামলার ঘটনা বাড়তে থাকে।
শরণার্থী শিবিরে জন্মানো, ইজরায়েলের জন্য ভূখণ্ড হারানো থেকে শুরু করে ছোট থেকে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে মনের ভিতর লালন করা হিংসা ও ঘৃণার বীজ মহীরুহ হতে সময় লাগেনি। জেলের অন্ধকার থেকে উঠে এসে ক্রমে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠন হামাসের শীর্ষে পৌঁছনো। ২০১৩ সালে গাজায় হামাসের পলিটব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হওয়া, তার পর ২০১৭ সালে হামাস অধিকৃত গাজা ভূখণ্ডের সর্বোচ্চ শাসকও নির্বাচিত হন। আমেরিকার সন্ত্রাসবাদী-কালো তালিকায় ছিল সিনওয়ারের নাম। 'খান ইউনিসের কসাই' হিসেবেও খ্যাতি ছিল তাঁর। ইজরায়েল তাঁর নাম দিয়েছিল 'প্যালেস্টাইনের ওসামা বিন লাদেন'। ইজরায়েলকে ধ্বংস করাই নাকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল সিনওয়ারের ধ্যান-জ্ঞান। হামাসের প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের নেপথ্যেই ছিল এই সিনওয়ারের অবদান। অনেকেই মনে করেন, খাতায়-কলমে ইসমাইল হানিয়েহ হামাস-প্রধানের ভূমিকায় থাকলেও সিনওয়ারই ছিলেন অলিখিত প্রধান। ইজরায়েলের বিরুদ্ধে তাঁর অনমনীয় ভাব, গরম-গরম ভাষণ এবং সাধারণ ফিলিস্তিনিদের ইজরায়েলের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার পিছনেও অন্যতম ছিলেন তিনিই। নিজের দলের এক সমকামী নেতার মৃত্যুর পিছনেও নাকি ছিলেন এই চরম রক্ষণশীল হামাস নেতা। ইজরায়েলে চরম ডানপন্থী নেতা ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ফের ইজরায়েলের প্রতি ক্ষোভ বাড়তে থাকে তাঁর। যার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া গিয়েছিল ৭ অক্টোবর ইজরায়েলে হামলার ঘটনায়।
দক্ষ নেতা, কূটনীতিক হিসেবে নিজেকে বারবার প্রমাণ করেছেন সিনওয়ার। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো ড্যানিয়েল বাইম্যান আল জাজিরাকে জানান, একদিন বন্দিমুক্তির বদলে তাঁকে ছাড়তে বাধ্য় হয়েছিল ইজরায়েল। সেখান থেকেই ইজরায়েলকে আরও বড় ধাক্কা দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন সিনওয়ার। ইসমাইল হানিয়েহর পর ক্রমে হামাসের সর্বেসর্বার ভূমিকায় খাতায়-কলমেও উঠে এলেন তিনি। তবে বেশিদিন নয়। হামাসের শীর্ষপদে বসার মাস তিনেকের মাথাতেই ইজরায়েলি হামলায় শেষ হয়ে গেলেন সিনওয়ারও। সিনওয়ার একা নন, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে একের পর এক হামাস নেতাকে পর পর খতম করে গিয়েছে ইজরায়েল। সেই তালিকা দীর্ঘ।
আরও পড়ুন:এক কক্ষপথ পার, নতুন সূর্যের অপেক্ষায় আজও যুদ্ধক্লান্ত গাজা
গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণার পর থেকে হামাস গোষ্ঠীকে ধ্বংস করাই ছিল ইজরায়েলি বাহিনীর মূল লক্ষ্য। সে কথা একাধিক বার ঘোষণাও করেছেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। গত মার্চ মাসে হামাসের ডেপুটি সামরিক কম্যান্ডার মারওয়ান ইসাকে হত্যা করে ইজরায়েলি বাহিনী। ইজরায়েলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় ছিলেন তিনিও। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বেইরুটে ইজরায়েলি ড্রোন হামলায় মারা যান হামাসের ডেপুটি প্রধান সালেহ আল আরৌরি। হামাসের সামরিক শাখা কাসেম ব্রিগেডের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এই ব্যক্তি। গত অগস্টে ইজরায়েলি হামলায় মৃত্যু হয় হামাস নেতা ডেইফের। সেই ২০০০ সাল থেকে ইজরায়েলের কালো তালিকায় ছিলেন ডেইফ। এবার সেই তালিকায় ঢুকে পড়ল সিনওয়ারের নামও। একই ভাবে লেবাননের জঙ্গিগোষ্ঠী হিজবুল্লাহ জঙ্গিদের খতম করতেও উঠেপড়ে লেগেছে ইজরায়েল। ইতিমধ্যেই হিজবুল্লাহের শীর্ষনেতাকে হত্যা করেছে ইজরায়েলি সেনা। সাম্প্রতিক পেজার হামলায় মৃত্যু হয়েছে একাধিক হিজবুল্লাহ কম্যান্ডারের। লেবানন ও গাজা, দু'জায়গাতেই যুদ্ধের আগ্রাসন জারি রেখেছে ইজরায়েল। ইতিমধ্যেই গাজায় নিহতের সংখ্যা পেরিয়ে গিয়েছে ৪১ হাজার। সিনওয়ারকে হত্যার পরেই নেতানিয়াহু ঘোষণা করেছেন, এই যুদ্ধের সমাপ্তি হতে পারে কালই, যদি হামাস অস্ত্রত্যাগ করে বন্দি ফেরাতে রাজি থাকে।
Yahya Sinwar is dead.
— Benjamin Netanyahu - בנימין נתניהו (@netanyahu) October 17, 2024
He was killed in Rafah by the brave soldiers of the Israel Defense Forces.
While this is not the end of the war in Gaza, it's the beginning of the end. pic.twitter.com/C6wAaLH1YW
সিনওয়ারের মৃত্যুর পর কার হাতে যেতে চলেছে পরবর্তী হামাস প্রধানের ভার? সে নিয়ে এখনও কিছু জানানো হয়নি হামাসের তরফে। মনে রাখতে হবে, হিজবুল্লাহ তো বটেই, হামাসকেও কিন্তু প্রত্যক্ষ ভাবে মদত জুগিয়ে চলে ইরান। সম্প্রতি লেবাননে ইজরায়েলি হামলায় হিজবুল্লাহ প্রধান নাসরুল্লাহের মৃত্যুর পরে পরেই ইজরায়েলে হামলা করে দিয়েছিল ইরান। সেই হামলা আটকাতে পারেনি ইজরায়েলের শক্তিশালী আয়রন ডোম। হামাস-নেতা সিনওয়ারের মৃত্যুর পরেও কি তেমনই কোনও পদক্ষেপ নিতে চলেছে ইরান? হিজবুল্লাহ অবশ্য আগেই ঘোষণা করেছে, সিনওয়ারের মৃত্যুর ফলাফল ভালো হবে না মোটেই ইজরায়েলের জন্য। তারা এর পর যুদ্ধের আগ্রাসন বাড়াবে। সিনওয়ারের এই মৃত্যু কতটা প্রভাব ফেলতে চলেছে আসলে চলমান এই যুদ্ধে? কার্যত কি সিনওয়ারকে হত্যা করে হামাসের বিরুদ্ধে জয়ের দিকেই একধাপ এগিয়ে গেল নেতানিয়াহুর দেশ? উঠেছে একাধিক প্রশ্ন।