বাঙালির দুর্গাপুজো শুরু হলো কীভাবে, কত খরচ হয়েছিল সেকালের পুজোয়?

দুর্গাপুজো মানেই বাঙালিদের কাছে সারা বছরের প্রতীক্ষার পরে কয়েক দিনের আনন্দ। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে, দেবীর বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন কারণে শুরু হওয়া সেই দুর্গোৎসব বছরের পর বছর অতিক্রম করেই আজ আমাদের চেনা রূপে আত্মপ্রকাশ করে...

 

রথের দড়িতে টান পড়লে কলকাতা দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। কলকাতায় দুর্গাপুজোর কথা বললে দুই ধরনের পুজোর কথা মাথায় আসে। বাড়ির পুজো এবং সার্বজনীন পুজো। যদিও প্রথমেই দুই ধরনের পুজো, অর্থাৎ সার্বজনীন এবং বাড়িতে দুর্গাপুজোর সূচনা হয়নি।

আশ্বিন মাসে দুর্গাপুজো অথবা দেবীর অকালবোধনের কথা প্রথম রামায়ণে পাওয়া গেলেও বঙ্গের দুর্গাপুজোর সূচনার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে অন্য এক রাজার নাম। কথিত আছে যে, বলীপুরের রাজা সুরথ ৫৫০ সাল নাগাদ যুদ্ধে নিজের সাম্রাজ্য হারানোর পরে মেধাস মুনির নির্দেশে দেবী মহিষাসুরমর্দিনীর পুজো করেছিলেন। এই পুজোর ফলস্বরূপ দেবীর আশীর্বাদে তিনি আবার তাঁর সাম্রাজ্য ফিরে পেয়েছিলেন। মার্কণ্ডে‌য় পুরাণে এই ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। সুরথের সাম্রাজ্যের কিছু অবশিষ্ট না থাকলেও দুর্গাপুরের কাছে গড় জঙ্গলে আজও মেধাস মুনির আশ্রম এই ঘটনার সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। এই আশ্রমে বাংলার প্রথম দুর্গাপুজোর আয়োজন করা হয়েছিল।

বাংলায় বাড়িতে দুর্গাপুজোর সূচনা নিয়ে একটা বিতর্ক থেকেই যায়। যদিও বিভিন্ন নথি এবং জনশ্রুতি তাহেরপুরের জমিদার কংসনারায়ণ অথবা মুর্শিদাবাদের ভবানন্দ মজুমদারের মধ্যেই কাউকে বাংলায় বাড়িতে দুর্গাপুজোর সূচনার কৃতিত্ব দিয়ে থাকে। কংসনারায়ণের আয়োজিত প্রথম দুর্গাপুজোর সময় নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কথিত আছে যে, কংসনারায়ণ দুর্গাপুজোতে প্রায় আট লাখ টাকা খরচ করেছিলেন। কংসনারায়ণ এবং ভবানন্দের দুর্গাপুজোর আয়োজনের আগে বাংলায় বাসন্তী পুজো বেশি প্রচলিত ছিল। কংসনারায়ণ হঠাৎ বাসন্তী পুজোর বদলে দুর্গাপুজোর প্রচলন কেন করেছিলেন, সেই বিষয়ে কোনও সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। বাঙালি অকালবোধনের কথা রামায়ণে পড়ে থাকলেও নিজের চোখে বাড়িতে আয়োজিত দুর্গাপুজো সম্ভবত এই আমলে প্রথম দেখেছিল।

আরও পড়ুন: মধ্যাহ্নভোজে ইলিশ, যন্ত্রণায় শিশুর মতো কান্না! কেমন ছিল স্বামীজির শেষের সেই দিন?

মুর্শিদাবাদের ভবানন্দ মজুমদার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের পূর্বসূরি ছিলেন। ১৬০৮ সালে তিনি দুর্গাপুজোর আয়োজন করেছিলেন এবং এই দুর্গাপুজো প্রায় দেড় শতক পরে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের আমলে বাংলায় আয়োজিত অন্যতম বড় এক উৎসবে পরিণত হয়েছিল। এই পরিবারের পুজোয় সর্বপ্রথম দেবী দুর্গাকে রাজরাজেশ্বরী রূপে পুজো করা হয়। কলকাতা এবং সংলগ্ন এলাকায় প্রথম দুর্গাপুজোর আয়োজনের সঙ্গে বড়িশার রায়চৌধুরীদের নাম জড়িয়ে আছে। লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়, সাবর্ণ রায়চৌধুরীর পূর্বসূরি ছিলেন। তিনি রায়চৌধুরী উপাধি পেয়েছিলেন। ১৬০৮ সালে তিনি আটটা, মতান্তরে নয়টা পরগনার জমিদারি পেয়েছিলেন। লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় ১৬১০ সালে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেছিলেন। সময়ের সঙ্গে এইসব জমিদার এবং রাজবাড়ির পুজোর জাঁকজমক বাড়তে শুরু করে। এই পুজোগুলি বাড়ির ভেতরে আয়োজিত হতো এবং কেবল নিমন্ত্রিতরা বাড়ির ভেতরে ঢুকে দুর্গাপুজো দেখতে পেতেন।

১৭৮৯, মতান্তরে ১৭৯০ সালে গুপ্তিপাড়ার এক বাড়ির দুর্গাপুজোতে এলাকার বেশ কিছু মানুষকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি, কারণ তাঁরা পুজোতে নিমন্ত্রিত ছিলেন না। সেই ঘটনার ফলে তাঁরা সকলে একসঙ্গে একটি দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন। এই দুর্গাপুজোয় সকলের অবাধ প্রবেশ ছিল। এই পুজোর আয়োজক বারো জন বন্ধু ছিলেন বলেই এই জাতীয় দুর্গাপুজোর নাম হয় বারোইয়ারি দুর্গাপুজো। এই বারোইয়ারি পুজো সার্বজনীন পুজো নামেও পরিচিত হয়, কারণ এই পুজোয় সকলেরই নিমন্ত্রণ থাকতো। যদিও অপর এক জনশ্রুতি অনুযায়ী, গুপ্তিপাড়ায় ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় একটি দুর্গাপুজোর আয়োজন হতো। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় এই দুর্গাপুজো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না হওয়ার কারণে বারো জন মানুষ এই পুজোর দ্বায়িত্ব নিয়েছিলেন। গুপ্তিপাড়ার এই নতুন ধরনের পুজোর কথা সেই সময়ের বিভিন্ন নথি থেকেও জানা যায়। এই দুর্গাপুজোয় দেবীকে বিন্ধ্যবাসিনীরূপে পুজো করা হয়। দেবীর এই রূপে পুজোর কারণে গুপ্তিপাড়ার একটি এলাকার নাম হয় বিন্ধ্যবাসিনীতলা। যদিও বর্তমানে গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা উৎসব দুর্গাপুজোর তুলনায় অনেক বেশি জনপ্রিয়। গুপ্তিপাড়ার বারোইয়ারি পুজোর ধারণা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। চুঁচুড়া, শান্তিপুর, কাঁচরাপাড়া এবং পরবর্তীকালে কলকাতায় এই ধরনের পুজো জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

দুর্গাপুজো মানেই বাঙালিদের কাছে সারা বছরের প্রতীক্ষার পরে কয়েক দিনের আনন্দ। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে, দেবীর বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন কারণে শুরু হওয়া সেই দুর্গোৎসব বছরের পর বছর অতিক্রম করেই আজ আমাদের চেনা রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে।

More Articles