স্কটল্যান্ডের একটি প্রাচীন লোককথায় উল্লেখিত আছে, ডাইনির সর্বক্ষণে সঙ্গী হলো কালো বিড়াল।
কালো বিড়ালকে নিয়ে হাজারো কুসংস্কার, কীভাবে ছড়াল?
Black Cat Superstition: নীলনদের দেশের অধিশ্বরী ছিলেন ব্যাস্টেট। তখন কালো বিড়াল কেউ হত্যা করলে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেওয়া হতো। পূজিত হতো কালো বিড়াল।
"অ্যাই মেঘনা একটু দাঁড়া বলছি। আগে কাউকে রাস্তা দিয়ে পেরিয়ে যেতে দে। দেখছিস তো কালো বিড়ালটা রাস্তা দিয়ে পেরোল।" কথাগুলো নিজের কিশোরী মেয়েকে বলছিলেন বছর পঁয়ত্রিশের এক বেশ ঝকঝকে সুন্দরী ভদ্রমহিলা। জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল, তিনি বারাসাতের বাসিন্দা। কয়েকদিন আগে এক সকালে স্থানীয় সার্কুলার রোড ধরে মেয়ের সঙ্গে হাঁটছিলেন বামুনপাড়ার অভিমুখে। বললেন, "কালো বিড়ালকে অশুভের প্রতীক হিসেবে শুনেছি বহুজনের মুখে। হয়তো সবই কুসংস্কার। তবু আমি যে মেয়ের মা। তাই একজন মা হয়ে মেয়ের ব্যাপারে যেচে কোনও অশুভের ঝুঁকি নিতে চাইনি পথিমধ্যে।"
অন্য ঘটনাটি দুর্গাপুরের। মাস ছয় আগে রেলস্টেশন লাগোয়া একটি খাবার হোটেলে থিকথিক করছে খদ্দেরের ভিড়। তারই মধ্যে হোটেলে ঢোকার এক কোণে রীতিমতো ভূরিভোজ করছে একটি পূর্ণবয়স্ক কালো বিড়াল। হোটেল মালিক জানালেন, নিজে হাতে রোজ তাকে তিনি খেতে দেন। অনেকে অনেক কিছু বলতে পারে। কিন্তু এটি তাঁর কাছে শুভের ইঙ্গিত। এই কালো বিড়াল প্রকৃতই ওঁর সৌভাগ্য ডেকে এনেছে। সেই কারণে তিনি তাকে যত্ন করে পোষেন। আদর করেন খুব। কোলে নেন। আবার নিয়ম করে সময়মতো নিয়মিত খেতেও দেন দুই বেলা।
সত্যি আজব হতে হয় বৈকি! বিষয়বস্তু এক। অথচ নানাজনের মনে সংস্কার ও কুসংস্কারের রকমারি মনযুদ্ধের ঠেলায় এই চারপেয়ে ম্যাঁও বাবাজীবনের প্রাণ যে প্রায় ওষ্ঠাগত। কারও মতে, যতসব অলক্ষ্মীর বাস। অন্যজনের দাবি আবার পুরোপুরি উল্টো। সৌভাগ্যের ঠিকানা পোষণ করেন মনের গভীরে। সৌজন্যে, সেই বহুল কথিত কালো বিড়াল। এই কৃষ্ণ মার্জার প্রাণীটিকে নিয়ে এহেন দ্বন্দ্ব আমাদের চেনাজানা দুই একটি ঘটনার মধ্যে শুধুমাত্র সীমাবদ্ধ নয়। এই সুসংস্কার ও অপসংস্কারের দ্বিচারি ব্যাপ্তি আমাদের দেশের নানা প্রান্ত স্পর্শ করে বিশ্বের নানা সমাজে গ্রোথিত হয়েছে সুগভীর পর্যায়ে। এমনকী রাজনৈতিক গণ্ডি অতিক্রম করে সাহিত্য, চিত্রকলা থেকে ইতিহাসের অলিন্দেও ঘটেছে এর অবাধ প্রবেশ। চিনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এ বিষয়ে দার্শনিক উদ্ধৃতিটি দিয়েছেন, "কালো বা সাদা যে রঙেরই বিড়াল হোক না কেন, যদি ইঁদুর ধরতে সক্ষম হয় তবেই সেটি উত্তম প্রজাতির বেড়াল।" সুতরাং তাঁর যে এমন কৃষ্ণকায় বিড়াল সম্পর্কে কোনও ছুঁতমার্গ নেই তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। চিনা প্রেসিডেন্টের কাছে রঙ বড় কথা নয়। দক্ষতা ও ক্ষিপ্রতাই তাঁর কাছে সর্বাগ্রে আদরণীয়। আসলে এটাই চিনা প্রধানের লৌহ কঠিন ব্যক্তিত্ব যেখানে কুসংস্কার কোনওমতেই প্রশ্রয় পায় না।
আরও পড়ুন-মানুষ নয়, ৩৬ বছর ধরে বিড়াল, ইঁদুরদের জন্য বর্ম তৈরি করেন এই শিল্পী! কেন?
অপরদিকে, ইতালিতে একসময়ের জাতীয়তাবাদী জনপ্রিয় নেতা ছিলেন জুসেপ্পে গ্যারিবল্ডি। তিনিও জীবনে কোনওধরনের কুসংস্কারের তোয়াক্কা করতেন না। একদা একটি কালো বিড়াল পুষে ছিলেন। ওটির নাম দিয়েছিলেন দ্য ব্ল্যাক ক্যাট। ব্যক্তিগতভাবে তিনি বিশ্বাস করতেন না যে কালো বিড়াল অশুভের প্রতীক। বরং বলতেন, 'দ্য ব্ল্যাক ক্যাট' হলো তাঁর প্রকৃত বন্ধু।
ইংল্যান্ডের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথও কালো বিড়াল খুব পছন্দ করতেন। এমনকী তিনি নিজে উদ্যোগ নিয়ে একটি কালো বিড়াল পুষতেন। এমন প্রাণীকে নিজের প্রচেষ্টায় পোষ মানিয়ে ছিলেন প্রথিতযশা ফরাসি সাহিত্যিক আলেকজান্ডার দুমা। তিনি এতটাই ভালোবাসতেন যে সেই বিড়াল তাঁর বাসভবনে সবসময় থাকত। ব্রিটিশ লেখক অস্কার ওয়াইল্ডও কালো বিড়ালের খুব ভক্ত ছিলেন। এই প্রাণীর প্রতি তাঁর এত বেশি প্রীতি ছিল যে তাঁর রচনাতেও কালো বিড়াল জায়গা করে নিয়েছিল অনায়াসে।
বিশ্ববন্দিত সাহিত্যিক এডগার অ্যালান পো কালো বিড়াল নিয়ে রচনা করেছিলেন অন্যতম পৃথিবীখ্যাত গল্পের বই 'দ্য ব্ল্যাক ক্যাট।' কালো বিড়াল সম্পর্কে একাংশ মানুষের ভিতরে কী ভয়ঙ্কর রকমের কুসংস্কার আঁকড়ে আছে তা এই বইটিতে উল্লেখ করা রয়েছে সবিস্তারে। আবার প্রবাদপ্রতিম চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসোর কাছেও থাকত এক আদুরে কালো বিড়াল। খুব ভালোবাসতেন তাকে। তিনি একটি বিখ্যাত ছবি এঁকে ছিলেন, যাতে একটি কালো বিড়ালের অবয়ব রঙতুলির ক্যানভাসে জায়গা করে নেয়। ছবিটির নাম ছিল 'ব্ল্যাক ক্যাট উইথ বার্ড।'
স্কটল্যান্ডের একটি প্রাচীন লোককথায় উল্লেখিত আছে, ডাইনির সর্বক্ষণে সঙ্গী হলো কালো বিড়াল। ডাইনি জাদু করে এলাকার লোকদের ক্ষতি করত, আর এই বাহনটি এসব কুকর্মের সঙ্গ দিত। এমন বিশ্বাসের জেরে স্থানীয় বাসিন্দারা আজও পারতপক্ষে কালো বিড়ালকে অলুক্ষুণে ভেবে এড়িয়ে চলে। ফ্রান্স ও জার্মানিতেও কিছু কিছু লোকগাথায় উল্লেখ রয়েছে, এখানকার ডাইনিরা নাকি কালো বিড়ালকে কালোজাদুর 'মিডিয়াম' হিসেবে বশ করে রাখত সবসময়। ফলে ওইসব অঞ্চলে বহু মানুষের ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হতো এই প্রাণীর কারণে।
ব্রিটেনের কিছু মানুষ এমন ধারণা আজও বহন করেন যে কালো বিড়াল নাকি আদতে শয়তানের প্রতীক। এমনকি তাঁদের এও বিশ্বাস যে কোনও ভ্রমণের আগে আচমকা কালো বিড়াল দেখা গেলে সেই যাত্রা শেষমেশ অশুভ ঘটনার সাক্ষী থাকবেই।
ইতালি ও স্পেনে ১৩০০ ও ১৪০০ শতাব্দীতে মানুষের সমাজ ব্যবস্থায় কালো বিড়ালের অবস্থা আরও শোচনীয় ছিল। এখানকার কিছু অধিবাসীদের বিশ্বাস ছিল, কালো বিড়াল মানেই দুষ্ট প্রেতাত্মার সঙ্গে সেটি হরিহর আত্মা। তাই এলাকাবাসীর কল্যাণে কালো বিড়াল দেখলেই খতম করো, এমনই ছিল সেখানকার অন্ধ কুসংস্কার। এই ডিজিটাল যুগেও আফ্রিকা মহাদেশের একাধিক রাষ্ট্র সহ ইজিপ্ট, চিন, বাংলাদেশ, পাকিস্তানের বহু গোষ্ঠী একে অপবিত্রের ছায়া হিসেবে গণ্য করে এবং প্রয়োজনে নির্বিচারে মেরেও ফেলে প্রতিশোধের স্পৃহায়।
এবিষয়ে অবশ্যই পিছিয়ে ছিল না ভারতও। ওড়িশা, তামিলনাড়ু, রাজস্থানের বিভিন্ন প্রান্তিক গ্রামাঞ্চলে একদা কালো বিড়াল নির্বিচারে হত্যা করার নিদর্শন রয়েছে। স্থানীয় মানুষেরা প্রাচীনকালে কোনও অশনি সমস্যা নিরসনে ফকির বা ওঝার উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল ছিলেন। সেই ফকির বা ওঝাও সুযোগ বুঝে কালোজাদুর নাম করে কালো বিড়াল নৃশংসভাবে নিকেষ করতেন।
আরও পড়ুন-পোষ্য বিড়াল থাকলে স্কিজোফ্রেনিয়া হতে পারে আপনার! ভয়াবহ তথ্য গবেষণায়…
তবে কয়েক হাজার বছর আগে উল্টোপুরাণ হিসেবে মিশরে কালো বিড়াল ছিল মর্যাদার প্রতীক। তদানীন্তন সময়ে নীলনদের দেশের অধিশ্বরী ছিলেন ব্যাস্টেট। তখন কালো বিড়াল কেউ হত্যা করলে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেওয়া হতো। পূজিত হতো কালো বিড়াল। এমনকী মরে গেলে সেই প্রাণীটির মমিও তৈরি করে রাখা হতো স্মারক হিসেবে। এমনই ছিল সেখানকার সেদিনের কালো বিড়ালের কদর। কিন্তু সেই সৌভাগ্য বেশিদিন কপালে জোটেনি। পোপ গ্রেগরি (নবম) ১২৩৩ সালে আকস্মাৎ ঘোষণা করেন, কালো বিড়ালের মধ্যে শয়তানের আত্মা আশ্রয় নিয়ে রয়েছে। আর সেইসময় থেকেই ক্রমান্বয়ে সারা বিশ্বে কালো বিড়াল সম্পর্কে নানা কুসংস্কার বাসা বাঁধতে থাকে।
আমাদের দেশের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে কালো বিড়ালকে আজও অমঙ্গলের সংকেত হিসেবে মানা হয়। একইসঙ্গে মণিপুর, মিজোরাম, গোয়া, রাজস্থান, তামিলনাড়ু সহ অন্ধ্রপ্রদেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে একে আবার শ্রীবৃদ্ধির ও শুভর প্রতিনিধি হিসেবে গ্রাহ্য করা হয়। এমনকী কেরলের একাংশ উপজাতি কালো বিড়ালকে দেবতার প্রতিভূ হিসেবে পুজোও করে থাকে বংশানুক্রমে। অন্যদিকে বৈশ্বিক নিরিখে জাপান, স্কটল্যান্ড, ফ্রান্সের একাংশ নাগরিকদের মনে এতটাই সুখের ইঙ্গিত বহন করে যে তাঁরা একে অপরকে কালো বিড়াল উপহারও দেন।
প্রাচীন ভারতের বহুচর্চিত শকুন শাস্ত্রে এই কালো বিড়াল সম্পর্কে শুভ ও অশুভের নানা প্রবচন উল্লিখিত থাকলেও জাপানের হিমেজি শহরে এটি কিন্তু নির্দ্বিধায় এক অবাক করা বিনোদনের উপাদান। এখানে বিশ্বে প্রথম ও একমাত্র কালো বিড়ালের ক্যাফে রয়েছে। যেখানে উপভোক্তারা নামমাত্র মূল্যে অদ্ভুত পরিষেবা পেতে পারেন। কালো বিড়ালের সঙ্গে খেলা করা ও সময় কাটানোর পাশাপাশি এদের সাময়িক পোষ্য হিসেবে গ্রহণ করা সম্ভব। সেখানে খদ্দের হিসেবে ঢুকে ওদের খাওয়ানোও যায় পরিমিত পর্যায়ে। এই ক্যাফের অন্দর দুনিয়ায় কালো বিড়াল তাই ভালো মন্দের বেড়াজাল ছিন্ন করে কেবলমাত্র মানুষকে প্রমোদ দেয় ও আমোদ নেয়।