কিলবিল সোসাইটি: ব্রাত্যর থিয়েটার না অভিনেত্রীর জীবন, সৃজিতের অনুপ্রেরণা কী?

Killbill Society Movie: সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের কিলবিল সোসাইটির ট্রেলার দেখে বোঝা গিয়েছে এখানে কৌশানী তাঁকে হত্যা করার জন্য পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়কে 'হায়ার' করেছেন।

নববর্ষের আগে, ১১ এপ্রিল মুক্তি পেতে চলেছে পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের নতুন চলচ্চিত্র কিলবিল সোসাইটি। এতক্ষণে সোশ্যাল মিডিয়া, ট্রেলার, পরিচালকের সাক্ষাৎকার— সমস্ত দেখে, খতিয়ে দর্শক এবং সৃজিতপ্রেমীরা এটুকু জেনেই গিয়েছেন যে, ২০১২ সালে মুক্তি পাওয়া সৃজিতেরই ছবি হেমলক সোসাইটির সিক্যুয়াল এটি৷ পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করেছেন আবারও। আছেন কৌশানী মুখোপাধ্যায়, অনিন্দ্য চ্যাটার্জী, বিশ্বনাথ বসু, সন্দীপ্তা সেনরা। নববর্ষের গোড়ায় টাটকা বাংলা সিনেমার প্রত্যাশী মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ভিড় জমাবেন সিনেমাহলে। তবে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সিনেমার সঙ্গে ছায়ার মতো জড়িয়ে থাকে নানা টুকরো বিতর্ক। প্রচার শুরু হতে না হতেই, সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে তুলকালাম চলে। মুক্তির আগেই সেই বিতর্কে নাম লিখিয়ে ফেলল কিলবিল সোসাইটিও। ছবির নাম শুনে তারান্তিনোর অ্যাকশন থ্রিলার কিলবিল মনে পড়েছে অনেকের। কেউ কেউ আবার বলতে শুরু করেছেন, সৃজিতের কিলবিল সোসাইটি আসলে বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী, তথা নাট্যকার ব্রাত্য বসুর একটি নাটক থেকে 'টোকা'!

সোশ্যাল মিডিয়াতে একাধিক পোস্টে একাধিক মানুষের দাবি, ব্রাত্য বসুর নাটক সুপারি কিলারের নানা অংশের সঙ্গে, মূল বিষয়ের সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের নতুন সিনেমার প্লট। জনৈক রাজর্ষি দে বলছেন, কিলবিল সোসাইটির ট্রেলারে দেখনো ঘটনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে ব্রাত্য বসুর সুপারি কিলার নাটকের বয়ান। অধ্যাপক অর্ণব সাহা ফেসবুকে লিখেছেন, “সম্প্রতি সৃজিত মুখার্জি তাঁর একটি ছবির আসন্ন ছবির ট্রেলার লঞ্চ করেছেন: ‘কিলবিল সোসাইটি’। পুরো ছবিটির কি-কনসেপ্ট ব্রাত্যর ‘সুপারি কিলার’ থেকে হুবহু টোকা। পরমব্রত ও কৌশানীকে নিয়ে অবিকল একই নির্যাস সিনেম্যাটিক প্লেটে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছবির সম্পর্কে গুগল করেও সেটাই জানা গেল। কিন্তু এই ছবির কোথাও ব্রাত্যর নাটকের প্রতি ঋণ স্বীকার আছে কি?”

 

আরও পড়ুন- অস্বস্তিকর, শ্বাসরোধী! কেন এই সময়ের সবচেয়ে জরুরি সিরিজ হয়ে উঠল অ্যাডোলেসেন্স?

সত্যিই কি হুবহু এক? ব্রাত্য বসু ‘সুপারি কিলার’ নাটকটি লেখেন ২০১০ সালে। তা প্রথম মঞ্চস্থ হয় ২০১১ সালে। এই নাটকের মূল চরিত্রে দময়ন্তী। তিনি একজন সিরিয়াল কিলারকে ভাড়া করেন। সুপারি কিলারের নাম র‍্যাঞ্চো। র‍্যাঞ্চোকে দময়ন্তী ৩ জনকে খুন করার টাকা দেন। একজন হলেন জঙ্গম, তাঁর সহকর্মীর স্বামী। আর দ্বিতীয়জন দেবদাস, দময়ন্তীর প্রাক্তন প্রেমিক। দময়ন্তী প্রতিশোধ নিতেই এদের খুন করার 'সুপারি' দেয় র‍্যাঞ্চোকে। জঙ্গমকে গুলি করা হয় আর দেবদাসকে কুপিয়ে হত্যা। এই দুটো খুনের পর দময়ন্তী ওই সুপারি কিলারকে জানান, তৃতীয় টার্গেট তিনি নিজেই। দময়ন্তী নিজেকেই হত্যা করতে চান। কেন? ব্রাত্যর দময়ন্তী চরিত্রটি উত্তরে বলেছিলেন,

“কারণ বাঁচার মানে কী আমি জেনে গিয়েছি"। বলেছিলেন, “বিরক্তিকর, উত্তেজনাহীন এবং শেষ পর্যন্ত প্রতিহিংসার আঁচহীন। প্রতিশোধ নিয়ে ফেললে আমার চোখে জল আসে। কেন? জঙ্গম আর দেবদাস- দুটোর উপর প্রতিশোঢ নেওয়ার পরই আমার চোখে জল এল। আমি কেঁদে ফেললাম। তার মানে আমার হৃহয় এমনকী প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যও যথেষ্ট প্রস্তুত নয়!”

এই দ্বন্দ্বে বাঁচার ক্লান্তি থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন দময়ন্তী। নাটক যত গড়ায় দেখা যায়, র‍্যাঞ্চো সিরিয়াল কিলার হয়েও মৃত্যুকে নিয়ে রোম্যান্টিসাইজ করার চেয়েও, জীবনের দর্শনকে গুরুত্ব দেন বেশি। র‍্যাঞ্চোই দময়ন্তীকে বলেছিলেন, “মৃত্যুর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে অন্তত একবার জীবনকে বিশ্বাস করতে হবে আপনাকে দময়ন্তী।" শেষ অবধি জীবনকে জিতিয়ে দিয়েছিলেন ব্রাত্য।

সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের কিলবিল সোসাইটির ট্রেলার দেখে বোঝা গিয়েছে এখানে কৌশানী তাঁকে হত্যা করার জন্য পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়কে 'হায়ার' করেছেন। হেমলক সোসাইটি যাঁরা দেখেছেন, জানেন যে সেখানে কোয়েল মল্লিকের চরিত্রটি আত্মহত্যা করতে চাইছিলেন। পরবব্রত 'আনন্দ কর' সেজে এসে তাঁকে বলেন, তিনি আত্মহত্যাকে কীভাবে 'স্মুদ' করা যায় সেই সাহায্য করবেন কোয়েলকে। নিজেকে শেষ করতে গিয়ে 'ছড়িয়ে' লাট না করে, বরং 'প্রফেশনাল' হওয়া ভালো। ছবি যত গড়ায়, ততই জিতে যায় জীবন। নিজেকে শেষ করে দিতে চাওয়া সমস্ত মানুষের মধ্যে জীবনের খিলখিল হাসি জাগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন সৃজিত। অনুমেয়, কিলবিল সোসাইটিও সেই পথেই হাঁটবে। নায়িকার সুপারি কিলার ভাড়া নেওয়ার প্রসঙ্গ থেকেই স্বাভাবিকভাবেই ব্রাত্য বসুর নাটকের সঙ্গে মিল পাওয়া যাচ্ছে কিলবিল সোসাইটির। তাহলে কেন সিনেমার কোথাও সেই উল্লেখ নেই? কেন ব্রাত্য বসুর নাটকের অনুপ্রেরণার উল্লেখ নেই? সত্যিই কি সৃজিত অনুকরণ করলেন?

আরও পড়ুন-উৎপলেন্দুর ছবি সরাসরি রাজনৈতিক কর্মের সম্প্রসারণ…

ইনস্ক্রিপ্ট যোগাযোগ করেছিল পরিচালকের সঙ্গে। সৃজিত মুখোপাধ্যায় স্পষ্ট বলছেন, "কিলবিল সোসাইটি অ্যাঞ্জেলিনা জোলির জীবনের একটি ঘটনানির্ভর ছবি। এটি একটি মীমাংসিত বিষয়।" এই বিষয়ে বাড়তি কোনও শব্দ খরচ করতে চাননি তিনি।

হলিউডের বিখ্যাত অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি সত্যি সত্যিই নিজেকে হত্যা করানোর জন্য একজন 'হিটম্যান' বা সুপারি কিলার ভাড়া করার কথা ভেবেছিলেন। তখন তাঁর বয়স নিতান্তই কম। ২০ পেরিয়েছেন সবে। অ্যাঞ্জেলিনা বলেছিলেন, তিনি ভেবেছিলেন যে, আত্মহত্যা করার চেয়ে যদি কেউ তাঁকে খুন করে তাহলে তাঁর প্রিয়জনদের কাছে অ্যাঞ্জেলিনার মৃত্যুর ধাক্কা সহ্য করা অনেক সহজ হবে। নিউইয়র্কে সুপারি কিলার খুঁজে পাওয়া অতটাও কঠিন নয়। ফলে সেই পথেই হেঁটেছিলেন তিনি। টাকাও জমাতে থাকেন।

আইএমডিবিকে এক সাক্ষাৎকারে অ্যাঞ্জেলিনা বলেছিলেন, তিনি যদি আত্মহত্যা করে মারা যেতেন, তাহলে তাঁকে ঘিরে থাকা বন্ধু-স্বজনরা মনে করতেন যে অ্যাঞ্জেলিনার জন্য তাঁদের যতটা করা দরকার ছিল, যতটা পাশে থাকা দরকার ছিল তা তাঁরা পারেননি। কিন্তু যদি তিনি অন্যভাবে মারা যান, কেউ যদি তাঁকে খুন করে তাহলেই আর এই ভাবনাগুলো আসবে না।

আরও পড়ুন-বাংলা সিনেমার শ্মশানযাত্রা! যে যে নিয়মে পুড়ছে সিনেমাপাড়া

তবে, শেষ অবধি এই পরিকল্পনা কার্যকর হয়নি বলাই বাহুল্য। সুপারি কিলার সবটা শুনে যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন তাতে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন অ্যাঞ্জেলিনাই। সাক্ষাৎকারে অ্যাঞ্জেলিনা বলেছিলেন, "তিনি (ওই সুপারি কিলার) যথেষ্ট ভদ্রলোক ছিলেন। আমাকে বলেছিলেন এই বিষয়টা সম্পর্কে আরেকটু চিন্তা করতে এবং দুই মাসের মধ্যে তাঁকে আবার ফোন করতে পারি।" আর ফোন করা হয়নি অ্যাঞ্জেলিনার। জীবনে নানা পরিবর্তন আসে এবং নিজেকে শেষ করার ভাবনা থেকে সরে আসেন তিনি।

দ্য টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, সৃজিত মুখোপাধ্যায় তাঁর নতুন সিনেমার নেপথ্যে অ্যাঞ্জেলিনার ঘটনাটির ছায়াকে স্বীকার করেছেন। অ্যাঞ্জেলিনা তাঁর জীবনের এই ঘটনাটি সম্পর্কে প্রথম প্রকাশ্যে বলেছিলেন ২০০১ সালে। ব্রাত্যর থিয়েটার অবশ্য তারও পরে। ব্রাত্য কি নিজে অ্যাঞ্জেলিনার জীবনের এই ঘটনা সম্পর্কে অবগত? এই বিষয়ে ব্রাত্য বসু অবশ্য কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে সুপারি কিলারের ছায়া হোক, বা অ্যাঞ্জেলিনার ঘটনার অভিঘাত, সৃজিতের কিলবিল সোসাইটি যে মুক্তির আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে যাচ্ছে, তা অনস্বীকার্য। পোস্টারে "মরতে চাইলে, বাঁচতে হবে" ক্যাচলাইন স্পষ্ট করে দিচ্ছে, সৃজিত আলোর কথা বলছেন। জীবনকে জিতিয়ে দিয়েছিলেন ব্রাত্য নিজেও। আবার অ্যাঞ্জেলিনাও মৃত্যুর ছায়া মুছে ফেলে আলোরই পথযাত্রী হয়েছিলেন। নেহাতই কাকতালীয়? কে কার অনুপ্রেরণা?

More Articles