শিয়ালদা সরগরম : রনি ডেভিডসন বনাম ভানু বোসের কুখ্যাত গ্যাং ওয়ার
Kolkata Mastan Rony Davidson : চার তেরিয়া যুবকের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছেন বৃদ্ধ ভানু। সারা গা ক্ষত-বিক্ষত, রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সেই অবস্থায় রনির গ্যাংকে তাড়া করছেন ভানু।
অসিত মজুমদারের চলনে বলনে যে স্বভাবজাত একটা রেলা আছে তার পেছনে বড় কারণ অবশ্যই ভানু বোস। সত্যেন কিংবা শচী মিত্তিরের মতো শাগরেদরা বসে যাওয়ার পর অসিতই ছিল ভানু বোসের, যাকে বলে রাইট হ্যান্ড। রাজ্যপাট অনেকটা গুটিয়ে গেলেও ভানু বোস তো ভানু বোসই। আর তার চ্যালাদেরও একটা দাপট তখনও রয়েছে। তো, ক্রিক রো-র ছোটা শের অসিত ভাবল চুলটা একবার কাটিয়েই নিই। তখন ভরদুপুর। ভানু বসের ৩৩ নং ক্রিক রো-র ডেরা থেকে বেরিয়ে সে ঢুকল পাড়ার সেলুনে। ২০২৪ সালে ক্রিক রো-র মুখে যেখানে সিপিআইএমএলের (লিবারেশন) অফিস আছে, ১৯৮০ সাল নাগাদ সেই বাড়ির নীচে ছিল পাড়ার জনপ্রিয় এক সেলুন। অসিত সোজা ঢুকে গেল সেলুনে। সেলুন তখন ফাঁকা। বসে পড়ল রিভলভিং চেয়ারে। আয়নায় নিজের মুখটা দেখে নিয়ে চোখ বন্ধ করার আগে রেলা নিয়ে নাপিতের উদ্দেশ্যে বলল, "চুলটা হালকা ছোট করে দে"।
চেয়ারে বসে মাথাটা এলিয়ে দিতেই একটু তন্দ্রা লেগে এল। তবু শিকারির ঘ্রাণ তো, অসিত অনুভব করল পাশের চেয়ারে কে যেন এসে বসল, চুপচাপ সন্তর্পণে। এই ভঙ্গিটা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গি না। চোখ বন্ধ রেখেই কপাল কুঁচকাল অসিত। তারপর নাপিতকে চুল কাটা থামাবার ইঙ্গিত করে ঘাড় ঘোরালো। ঘাড় ঘুরিয়েই চমকে যাওয়ার পালা। রনি ডেভিডসনের গ্যাংম্যান বসে আছে নিশ্চল পাথরের মতো। ভানুর প্রতিদ্বন্দ্বী রনি কী জিনিস তা হাড়ে হাড়ে চেনে ভানু গ্যাংয়ের প্রত্যেকেই। স্থির চোখে তাকিয়ে রয়েছে রনির চ্যালা। গতিক ভালো নয় বুঝতে পেরেই উঠতে যায় অসিত। সেলুনের আয়নার সামনে শোয়ানো ছিল কতগুলি গোঁফ কাটার ছোট ছোট কাঁচি। অসিত চেয়ার ছেড়ে উঠতে গেলেই ওই ছোট কাঁচি সপাটে ওর পেটে ঢুকিয়ে দেয় রনির পাঠানো 'দুশমন'। পেটে কাঁচিটা ঢুকিয়ে তালা খোলার মতো একটা চাবির প্যাঁচ মারল বেপাড়ার মস্তান আর সেলুনের মেঝেতেই লুটিয়ে পড়ল অসিত মজুমদার। এনআরএস-এ নিয়ে যেতে যেতেই সব শেষ। ভর দুপুরে ভানুর ক্রিক রো-তেই এভাবে খুন হয়ে গেল ভানু বোসের শেষ সেনাপতি। আর তুবড়ির গতিতে নাম ছড়াল রনি ডেভিডসনের। লোকের মুখে মুখে ফিরতে লাগল অসিতের খুনের ঘটনা। লোকে বলতে শুরু করল এমন হাতের কাজ, এ তো শিল্পী ছাড়া কেউ করতে পারবে না। শুধু মস্তান না, শিল্পী মস্তান জুটিয়েছে রনি তার গ্যাংয়ে। নিজেকে যেন আরও গুটিয়ে নিল ভানু বোস। এমনকী তার জীবনের শেষ পর্যায়ের ছবিও তুলতেন না। বাড়ি থেকে বেরও হতেন হিসেব কষে।
তখন শিয়ালদা কাঁপছে রনির নামে। রনির মাথায় ছোড়দার হাত। ততদিনে একের পর এক হামলা সে করেছে ভানু বসের উপর। একদিকে নকশালদের দাপট ছিল, তার উপর রনি ডেভিডসন। টলোমলো সাম্রাজ্য রাস্তায় ফেলেই ঘরে ঢুকে যাচ্ছেন কলকাতার বেতাজ বাদশা। অসিতের মৃত্যু যেন ভানু শিবিরের কাছে শেষ পেরেক পোঁতার সশব্দ আওয়াজ হয়ে প্রতিধ্বনিত হলো।
রনি ডেভিডসন থাকত ভানু বোসের পাশের পাড়াতেই, একেবারে গা ঘেঁষে পাশের পাড়া। আর পাশের পাড়া থেকেই এত দাম পেতে হবে তা বোধহয় ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি ভানু। কিন্তু পাশের পাড়াই পাহাড় হয়ে দাঁড়াল তার জীবনে। পাশের পাড়া হলেও দুই পাড়ার চরিত্র, জনবিন্যাস ছিল একদম আলাদা।
আরও পড়ুন- মিতা বলে ডাকতেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতার ‘মস্তান’ ভানু বোসের ম্যাজিক আজও অমলিন
ভানু বোসদের পাড়া হিন্দু অধ্যুষিত আর পাশের পাড়া খ্রিস্টান। শুরুতে এই পাড়ার সঙ্গে সুসম্পর্কই ছিল ভানু বোসের। দাঙ্গার সময় বউবাজারের আফগান গুন্ডাদের সঙ্গে লড়াইয়ে ভানুর সঙ্গ দিয়েছিল ক্রিক লেনের এই সব বাঙালি খ্রিস্টানরা। এমনই এক বাঙালি খ্রিস্টান হাসি। হাসির ভালো নাম বলে দেওয়ার মতো এখন আর কেউ নেই। এই হাসি নাম লেখায় ভানু বোসের গ্যাংয়ে। ভালোই চলছিল। এপাড়া ওপাড়া মোটামুটি সদ্ভাব বজায় ছিল কিন্তু একদিন আচমকাই হাসি বেপাত্তা হয়ে গেল। হাসির বউ তখন অন্তঃসত্ত্বা। হাসিকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। ভানু বোসের সঙ্গে একটা উঁচু নিচু চলছিলই। তবে কি হাসিকে সাফই করে দিল নিষ্ঠুর বোস? এমন ভাবনা যখন ক্রিক লেনের অলিতে গলিতে ঘুরছে তখন খবর এল, হিন্দ সিনেমার সামনে হাসিকে মেরে ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে ঢুকিয়ে দিয়েছে কেউ বা কারা। কে করতে পারে? কে করবে এ কাজ ভানু ছাড়া! দু'টি পাড়া পাশাপাশি, এই ঘটনার পর যেন অদ্ভুত শৈত্য নেমে এল অধিবাসীদের মধ্যে। হাসির স্ত্রী এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন। নাম রাখা হলো গনা। ভানু বোসের বিরুদ্ধে এক রাশ ঘৃণা নিয়ে বড় হয়ে উঠতে লাগল গনা। বোসকে সে দেখে নেবেই। বাপের খুনের বদলা নিয়েই ছাড়বে। কিন্তু গনা কৈশোরে পা দিয়েই কেমন অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে লাগল। ভানু বোস প্রতিষ্ঠান, তাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়তে হলে জাতের প্রতিদ্বন্দ্বী দরকার। গনার পক্ষে সেই আসন নেওয়া কখনই সম্ভব ছিল না। সেই শূন্যস্থান পূরণে উঠে এল রনি, রনি ডেভিডসন। বাঙালি খ্রিস্টান পাড়ার সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ভদ্র যুবকটি। মা স্কুল টিচার। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবার থেকে আসা রনিই হয়ে দাঁড়ালো ভানুর কাছে ত্রাসের অপর নাম।
যেকোনও কারণেই হোক খ্রিস্টান পাড়ার সঙ্গে সাংস্কৃতিক পার্থক্যও বেশ স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল ভানু বোসের কাছে। ক্রিক লেনের খ্রিস্টান পাড়া কোনও যে সে খ্রিস্টান পাড়া ছিল না, রীতিমতো খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারকদের আখড়া ছিল। মনে রাখতে হবে, এই পাড়াতেই লোরেটোর শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করে থাকতে শুরু করেন মাদার টেরেসা এবং ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার সময় তিনি এই পাড়াতেই আছেন। পরবর্তীকালে তিনি মিশনারিজ অফ চ্যারিটি গড়ে তুলছেন। তখনও তিনি ক্রিক লেনের পাড়াতেই থাকেন। এই মিশনারিদের আনাগোনা, খ্রিস্টধর্মের প্রচার কি বিরক্ত করছিল ভানু বোস কে? আজ তা বলা কঠিন। কিন্তু বড়দিনের উৎসবে যেভাবে আলো নিভিয়ে রাখতে বাধ্য করতেন ভানু বোস, তা বিদ্বেষ না থাকলে করা সম্ভব না। যাইহোক এই বিদ্বেষ বা জীবন সংস্কৃতির ফারাকের পাশেই দুই পাড়ার টানাপড়েনে ভাগ বসাল রাজনীতি। রনি বুঝে গেছিল ভানু বোসের ক্ষমতার একটা বড় উৎস তার রাজনৈতিক যোগাযোগ। সুতরাং ভানুকে ধাক্কা দিতে চাই রাজনৈতিক শেল্টার। বিধান চন্দ্র রায়, অতুল্য ঘোষের জমানা শেষ হতেই ক্ষমতা কমতে লাগল ভানুর। নকশালদের আঘাত আসতে শুরু করল। তার মোকাবিলা করতে প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সির নেতৃত্বে এলাকায় এলাকায় গড়ে উঠছিল যুবক সমিতি। অনেক যুব মুখ। শিয়ালদা অঞ্চলের রাজনীতিতেও পরিবর্তন আসছিল।
রনি-ভানু দ্বন্দ্ব বুঝতে হলে শিয়ালদা অঞ্চলের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বও বোঝা উচিত। রনিরা যখন বড় হয়, শিয়ালদার বিধায়ক ছিলেন আব্দুর রউফ আনসারি। এই ভদ্রলোকের সঙ্গে নানা কারণে খারাপ সম্পর্ক ছিল ভানু বোসের। রউফ সাহেবের বদলে জাতীয় কংগ্রেস যেবার বিনয় বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রার্থী করল, বিনয় বাবুর জন্য ভোটে খেটে ছিলেন ভানু বোস। সেবার বিনয় বন্দ্যোপাধ্যায় শিয়ালদার বিধায়ক হন। সে একাত্তর সালের ঘটনা। কিন্তু বিনয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাস্তা মসৃণ ছিল না। তারই রাজনৈতিক শিষ্য সোমেন মিত্রর প্রভাব এলাকায় বাড়ছিল। ঠিক পরের বছর, ১৯৭২ সালের ভোট। বিনয়বাবুর বদলে যুবনেতা সোমেনকে শিয়ালদা কেন্দ্র থেকে প্রার্থী করল কংগ্রেস। বর্তমান বিধায়ককে টিকিট না দিয়ে তারই এক কনিষ্ঠ সতীর্থকে টিকিট দেওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারলেন না বিনয়। প্রিয়রঞ্জন দাস মুন্সির দেওয়া টিকিটে সে বছর জিতলেন সোমেন মিত্র। টিকিট না পেয়ে দমলেন না বিনয় বন্দ্যোপাধ্যায়। পরের বারের প্রস্তুতি নিতে থাকলেন। এই পর্বেই ভানু বোসের সঙ্গে হৃদ্যতা বাড়ে বিনয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের। অন্যদিকে যুব বিধায়ক সোমেন মিত্রর ছায়ায় আশ্রয় নেয় রনি ডেভিডসন। বাড়ির পাশেই এক হাসপাতালের ক্যান্টিনের বরাত পায় রনি। পাড়ার কয়েকটা ছেলেকে চাকরিও দেয় সেখানে। একটু টাকা ছড়িয়ে দলবল বাড়াতে থাকে রনি। ক্রিক লেনের রামসীতা মন্দিরের পাশেই রনির বাড়িতে আড্ডা জমতে থাকে ওমর মিঞার। আরও অনেক যুবক আসে রনিকে ঘিরে। সারা দুপুর কী যেন 'চর্চা' চলে। এই আড্ডাতেই আসতে শুরু করে ভানু বোসের পাড়ার উঠতি যুবক বাচ্চু ভৌমিক। যা নিয়ে ভানু-রনি দ্বন্দ্ব নতুন মাত্রা পায়। বাচ্চু কেন ছোকরা রনির ঠেকে যায়। কী দুষ্কর্মের পাঠ নিতে ওই ছোকরার ঠেকে যায় বাচ্চু? পাড়ার অভিভাবক হিসেবে ভানু বোস এ নিয়ে রীতিমতো শাসন গর্জন শুরু করে দেয় বাচ্চুর উপরে। রনির চ্যালা বাচ্চু ভৌমিকও দমে যাওয়ার পাত্র না। মাথা নিচু সে করবে না। ভানু বোস এলাকার বিখ্যাত ছোটকা হতে পারে। ওদেরও ছোড়দা আছে। ছোড়দা বিধায়ক। এলাকায় নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ শুরু হয়েছে। বাচ্চু বোঝে নবীনের হাওয়া জোরদার। এই হাওয়ার সঙ্গেই থাকতে হবে। তাছাড়া অশক্ত বাঘ, আর কত দিন রাজত্ব করবে। রাজনীতিতে পালা বদল এসেছে বাহুবলেও বদল আসবে।
এমন যে তলে তলে ঘটছে ধুরন্ধর ভানু বোস কি টের পাচ্ছেন না? পাচ্ছেন। একটু সতর্কও হচ্ছেন। আর পুরনো সুহৃদ বিনয় বন্দ্যোপাধ্যায়ে সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছেন।
আরও পড়ুন- রণ পায়ে ছাদ টপকাতেন! ফিরে দেখা কলকাতার ত্রাস ভানু বোসকে
অসিত খুনের বহু দিন আগের ঘটনা। ক্রিক রো-র বিখ্যাত জামাইয়ের চা দোকানে চা খাচ্ছেন ভানু। সেদিন লোকজন তেমন নেই। একাই আছেন বাঘ। হঠাৎ দেখেন বাচ্চু পাশ কাটিয়ে গেল। ক্রিক লেনে রনির পাড়ায় ঢুকল। কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এল। আড়চোখে ছোকরার দিকে তাকান ভানু। চোখ দুটো জ্বলছে। এসব চোখ ভানুর চেনা। এসব চোখ দেখলেই ভানুর নজর চলে যায় কোমরের দিকে। হাতের মুভমেন্টের দিকে। বাচ্চুর দিকে তাকিয়ে ভানু বুঝলেন যা ভেবেছিল তাই, ব্যাটাচ্ছেলে মেশিন নিয়ে এসছে! ভানু সতর্ক হলেন। আজ তাড়াহুড়োয় যন্ত্রটা সঙ্গে করে আনেননি ভানু। এদিকে বাচ্চু এগিয়ে আসছে। রনির চামচা! এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে বাচ্চু ঝাঁপিয়ে পড়ল ভানু বোসের উপর। ভাবা যায়! ভানু বোসকে তাঁর পাড়ায় হামলা! ভাবা যেত না কিন্তু এখন ভাবতে হচ্ছে। বাচ্চু ঝাঁপিয়ে পড়তে ই ভানু ওর হাতের পিস্তল কাড়তে চাইলেন। পড়ল না। দিলেন এক রদ্দা, পিস্তল ছিটকে পড়ল রাস্তায়।
"এবার আয় শালা!" গর্জন করে উঠলেন ভানু। ডন বৈঠক দেওয়া পেটাই চেহারা নিয়ে জাপটে ধরলেন বাচ্চুকে। আর তারপরই সেই বিখ্যাত প্যাঁচ। বাচ্চুর মুণ্ডু ভানু বোসের পেশিবহুল হাতের প্যাঁচে আটকে গেছে। এভাবে আর দশ মিনিট থাকলেই বাচ্চু অতীত হয়ে যাবে।
পাড়ায় ততক্ষণে আলোড়ন পড়ে গেছে। বাড়ি থেকে ছুটে এসেছেন বাচ্চু র মা, দিদিরা! "ছোটকা ছেড়ে দাও, পায়ে পড়ি তোমার" বলছে ওরা। পা জড়িয়ে ধরেছে ভানু বোসের। বাড়ির মেয়েদের মিনতিতে কাজ হলো সেদিন, বাচ্চুকে ছেড়ে দিলেন ভানু। এক ধাক্কা মেরে ছিটকে ফেলে দিলেন, কিছুটা দূরে গিয়ে আছড়ে পড়ল বাচ্চু। ধুঁকছে ছেলেটা, জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। কিন্তু দমবার পাত্র নয় রনির চ্যালা। ভানুর দিকে চোখ পাকিয়ে কিড়কিড় করে উঠল বাচ্চু। এতকিছুর পরও ছোঁড়া বলছে, "তোমাকে ছাড়ব না ছোটকা, তোমার দিন শেষ। রনির দিন আসছে"।
"হ্যাই শালা", গর্জন করে আবার ব্যাটাকে ধরতে গেলেন ভানু বোস। পালিয়ে গেল বাচ্চু। কিন্তু ভানু বোস বুঝলেন এবার সম্মান নিয়ে টানাটানি হবে। আবার গ্যাংটাকে ঢেলে সাজানোর ছক কষতে লাগলেন গ্রেট ভানু বোস।
ততদিনে বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছে। বহু হিন্দু শরণার্থী শিয়ালদা লাগোয়া অঞ্চলে এসে উঠেছে। এভাবেই এলাকায় এসেছে নিতাই মামু, বংশ মামু। ডাকাবুকো ছেলে ছোকরার দল। ডাক্তার লেনের দাদা কচি পুটুর শেল্টারে রয়েছে ওরা। ভানু বোস দেখলেন এমন আগুনখোর ছেলে এখন দরকার। নিতাই বংশদের নিয়ে এলেন ক্রিক রো-র মেসে। ভানুর ছেলে শংকর বোস বড় হয়েছে। বাড়ির নীচে গ্যারাজ চালায়, চার চাকা গাড়ির গ্যারাজ। অনেকে নিচু গলায় শংকর সম্পর্কে বলে, স্টেন গান চালাতে তার নাকি জুড়ি নেই। ভানুর সাম্রাজ্যের একদিন সেই হাল ধরবে, এমনটাই আশা ভানু ভক্তদের।
ভানুর সাম্রাজ্য যেহেতু রাজনৈতিক ভরসায় বেড়েছে তাই রাজনৈতিক শেল্টার জরুরি। সেই সঙ্গে বয়সও বেড়েছে। নতুন বন্ধু জোটানোর বয়স নেই। ওদিকে প্রতিপক্ষ রনি সোমেন মিত্রর শেল্টারে রয়েছে। ভানু ঠিক করল বিনয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেই থাকবে সে। তারপর দেখা যাবে যা থাকে কপালে! এদিকে, রনি একটু অন্য স্টাইলে গ্যাং সাজাচ্ছে। ওমর মিঞাকে সেই সোমেন মিত্রর ক্যাম্পে নিয়ে এসেছে। শিক্ষিত, পয়সাওয়ালা পাঠান পরিবারের ছেলে ওমর। অর্থাৎ রনির দলে শুধু নিম্নবিত্ত রুস্তম না, একটু বড় ঘর থেকে আসা দাবাং ছেলেপুলে ভিড় জমাচ্ছে। শিক্ষা আছে, টাকা আছে, প্রতিষ্ঠিত আত্মীয় স্বজন আছে কিন্তু স্বপ্ন দেখে বাহুবলী হওয়ার। দাদা হবে, ডন হবে। এমন লোকজন জুটেছে রনির।
অন্যদিকে রনিদের গুরু সোমেন মিত্র তো মহাগুরু লোক। মুম্বইয়ের ভারত কাঁপানো ডন হাজি মস্তান কলকাতায় এলে একবার সোমেন বাবুর সঙ্গে দেখা করে যান। সঞ্জয় গান্ধীর স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে সোমেন বাবুও যান হাজির ডেরায়। তবে সোমেন বাবুর রাজনৈতিক শেল্টার বাংলায় একজনই দেন, তিনি গনি খান চৌধুরী। গনি রেলমন্ত্রী হতেই সোমেন মিত্র সিগারেটের প্যাকেটের সঙ্গে থাকা রাংতা কাগজে চিঠি লিখে রেলে চাকরি দিতে শুরু করলেন অনুগামীদের। রনি ডেভিডসনকেও চাকরি বিলানোর কোটা দিলেন সোমেন মিত্র। এখানেই রনি ভানু বোসদের চেয়ে আলাদা হওয়ার দাবি রাখতে পারে। ভানুরা ছেলেদের গ্যাংয়ে রিক্রুট করেছে কিন্তু গ্যাং সামলানোর পাশাপাশি এলাকায় চাকরি দিল রনি। সোমেন মিত্রর বদান্যতায় হলেও, চাকরি তো দিল! রনির অনুগামীরা বলতে লাগলেন, ভানু বোস তো বিধান রায়, অতুল্য ঘোষ সবার সঙ্গে ওঠাবসা করত। দিয়েছে কখনও কাউকে চাকরি? রনি দেয়, দিতে জানে রনি। প্রয়োজনে নিতেও জানে। চাকরি নয়। জান।
সময় বয়ে যাচ্ছিল। পাঁচ বছর যেন চোখের পলকে বয়ে গেল। আবার একটা নির্বাচন সামনে এল। ১৯৭৭ সালের বিধানসভা নির্বাচন। বিনয় বন্দ্যোপাধ্যায় হারানো শিয়ালদা আসন ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠলেন। বিনয়ের সঙ্গে কোমর বাঁধলেন ভানু বোসও। বিধায়ক সোমেন মিত্রর বিরুদ্ধে জনতা দলের টিকিটে প্রার্থী হলেন বিনয়। বুড়ো হাড়ের ভেলকি দেখাতে মাঠে নামলেন ভানু। সদলবলে। বিনয় জিতলেন, সোমেন হারলেন। ভানু বোস ভাবলেন হারানো সাম্রাজ্য এবার ফিরে পাওয়া এবার সময়ের অপেক্ষা।
ওদিকে অন্য কিছু হচ্ছিল, যা ভানু বোস ভাবতেও পারছিলেন না।
রনি ডেভিডসন স্থানীয় যে হাসপাতালের ক্যান্টিন লিজে চালাত সেখানে কাজ করত তাঁর পাড়ার ছেলে অশোক গোমস। নির্বাচনের ফল বের হয়েছে তখন। সোমেন মিত্র হেরে গেছেন। ভোরবেলা উঠেছে অশোক। ক্যান্টিনে যাবে। ক্রিক লেনের রাস্তায় বেরিয়ে হঠাৎ দেখে, কালো চাদরে মাথা মুড়ে অনতিদূরে দাঁড়িয়ে রনি ডেভিডসন। অশোক বলল, "রনিদা এত সকালে? কী ব্যাপার?" রনি বলে, "কিছু না তুই যা, ক্যান্টিনে যা"। অশোকের মনে হলো রনির গলায় চাপা উত্তেজনা ।
শিয়ালদা কোলে মার্কেটে অক্ষয় কোলে যে মাছের আড়ৎ করে দিয়েছিল ভানুকে তা দেখভালের জন্য ওই ভোরে একবার যেত ভানু। তবে কি রনি বদলা নেবে বলে দাঁড়িয়ে আছে? সোমেন মিত্রের হারের বদলা?
আরও পড়ুন- ধোঁয়াটে ক্রিক রো-র ঝলমলে জলসা! কলকাতা কাঁপাত মস্তান ভানু বোসের কালীপুজো
না, ক্রিক লেন বা ক্রিক রো-তে না। রনি ভানুর উপর হামলা চালালো ভরা কোলে মার্কেট চত্বরে। ভানু সবে মার্কেটে ঢুকবেন। চারদিক থেকে চারজন ঘিরে ধরল। কালো চাদর সরিয়ে সামনে দাঁড়াল রনি। তারপর এলোপাথাড়ি চাকুর আঘাত। ব্যাপক ধস্তাধস্তি। লোক দাঁড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম। চার তেরিয়া যুবকের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছেন বৃদ্ধ ভানু। সারা গা ক্ষত-বিক্ষত, রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সেই অবস্থায় রনির গ্যাংকে তাড়া করছেন ভানু। সেদিন অ্যাকশন করে সরে আসে রনিরা। ভানুকে ফুটপাতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখে রনি ভাবে ভানু শেষ। কিন্তু রনি ভুল ভেবেছিল।
ওইদিন আহত, মর্মাহত বাঘ আবার উঠে দাঁড়িয়েছিল। ভরা শিয়ালদা চত্বর দিয়ে ঘষটাতে ঘষটাতে দেহটাকে নিয়ে এল যেন। নিজেই নিজেকে বইছেন ভানু। নীলরতন সরকার মেডিক্যালের এমারজেন্সিতে এসে অচৈতন্য হয়ে পড়ল। রক্তে মেঝে ভেসে যাচ্ছে। ওই ঘটনার পরও যখন ভানু মরল না, রনিরা আবার বড়সড় হামলার ছক কষল। এবারই সেই বিখ্যাত ঘটনা যার জেরে মধ্য কলকাতা দেখেছিল বৃদ্ধ বাদশার শেষ প্রত্যাঘাত।
হামলার জের কাটিয়ে, হাসপাতাল পর্ব কাটিয়ে ভানু বোস সবে থিতু হয়েছেন। এক রাতের ঘটনা। ক্রিক রো-র বাড়িতে রাতের খাওয়ার পর বারান্দায় হাত ধুচ্ছেন ভানু। পাশে জগ হাতে দাঁড়িয়ে স্ত্রী রানু বোস। ভানু বোস হাত ধুতে ধুতেই খেয়াল করলেন নীচে ঝোপের মধ্যে কী যেন নড়াচড়া করছে। রনি!
চোখ বড় করে অন্ধকারের দিকে তাকালেন ভানু। ঠিক এমন সময়েই গুলিটা চলল এবং ভানুর উদ্দেশে ছোঁড়া গুলি গিয়ে লাগল ভানুর স্ত্রীর পায়ে। ক্রোধে, ক্ষোভে উন্মত্ত ভানু বোস চিৎকার করে নামলেন ক্রিক রো-র রাস্তায়। ততক্ষণে বাজ পড়েছে ক্রিক রো-তে। রানুকে নিয়ে হাসপাতাল ছুটল একদল। আর ভানুর পুরনো-নতুন সঙ্গীরা মরণ কামড় দিতে দাপিয়ে বেড়াল ক্রিক রো, ক্রিক লেন। বৃদ্ধ ভানু দু'হাতে অস্ত্র নিয়ে চিৎকার করছেন, "রনি, রনি আজ তুই শেষ হবি অথবা আমি"। যদিও সেই রাতে কেউই শেষ হয়নি। দু'জনেই এই ঘটনার পর অনেকদিনই বেঁচে ছিল। পরে জানা গিয়েছিল সেদিন গুলি ছুঁড়েছিল ওমর মিঞা। লক্ষ্য ছিল ভানু বোস, ভুলবশত লাগে তার স্ত্রীর পায়ে। ওই দিন ভানু ঘরণীর ওই সংবাদে কেঁপে উঠেছিল পাতালপুরী। ইনু মিত্তির, শচী মিত্তির, বড়দা জগা বোস ছুটে আসে। সারা রাত ধরে চলে তোলপাড়। শিয়ালদা সরগরম।
তারপর একদিন ভানু বোস চলে গেলেন অগম পাড়ে। রনি থিতু হতে চাইলেন স্বাভাবিক জীবনে। পুরোটা ফিরতে পারলেন না। তবু সরে এলেন। এলাকার নতুন দাদা হয়ে উঠলেন ওমর। ভানু-রনি জমানা মুছে গেল কালের অতলে। শুধু গল্প হয়ে বেঁচে রইল শিয়ালদার আনাচে কানাচে। কিছু দিন আগে কোভিড কেড়ে নিল রনির প্রাণ। তাঁর শিক্ষয়িত্রী স্ত্রীরও। মরে পড়ে ছিলেন রনি ডেভিডসন। কারও কাছে ত্রাতা, কারও কাছে ত্রাস। মৃত্যুর সামনে সবাই যেমন অসহায়, সেভাবেই মরে পড়ে ছিলেন। দরজা ভেঙে কয়েকদিন পর তার দেহ উদ্ধার করেন সজল ঘোষ। বর্তমানে তিনি বিজেপির কাউন্সিলর। রনির মৃত্যুতে সমাপ্তি ঘটে এক ইতিহাসের।