সহজ ছিল না শুরুর দিনগুলো, কলকাতার গর্ব মেট্রো যে পথ পেরিয়ে এল

কলকাতার বুকে কান পাতলে যে প্রাণের স্পন্দন শোনা যায়, অবশ্যই তার নাম পাতাল রেল। কিন্তু এই সফর এখন আর শুধু আবেগ নয়, শহরবাসীর কাছে অপরিহার্য প্রাত্যহিকী।

তখনও ঘরে ঘরে ঝিরঝিরে সাদা-কালো টিভি। সন্ধেবেলা বিনোদন বলতে 'চিত্রহার'। আবেগ তৈরি করত 'মিলে সুর মেরা তুমহারা’। সারা দেশকে এক করে দেওয়ার মন্ত্র। এই গানেই বাংলা আন্দোলিত হতো- `তোমার সুর মোদের সুর’-এর ছন্দে। বাংলার গর্বের নতুন পাতাল রেল থেকে বেরিয়ে আসছেন একে একে অমলাশঙ্কর, সুচিত্রা মিত্র, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নীরন্দ্রনাথ চক্রবর্তীরা। কলকাতার গৌরবের সঙ্গে যাঁদের নাম আদি-অনন্তকাল জোড়া থাকবে, তাঁদের সঙ্গে এক হয়ে গিয়েছিল কলকাতার পাতাল রেলের সফর। পাতাল রেল মানে তখন এক বিস্ময়ের নাম। নতুন শিয়ালদহ স্টেশন থেকে মেট্রো যাত্রা শুরু করতে পারে, কিন্তু সেদিনের কথা কোনওদিন ভুলতে পারবে না কলকাতা। পাতাল রেল কথাটার মধ্যে আছে এক মুছে না যাওয়া আবেগ।

তাই কলকাতা মেট্রো ঘিরে কখনও কোনও দুঃসংবাদ জন্ম নিলেও এর গৌরব ম্লান হওয়ার নয়। বরং একদিন কলকাতার স্বপ্নের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল যে পাতাল রেল, আজ তাই কলকাতার লাইফ লাইন। কখনও কখনও খবরে সামনে আসে, মেট্রোয় ভোগান্তি, মেট্রোর আটকে যাওয়া, যান্ত্রিক গোলযোগ- এসব সঙ্গে করেও শহরবাসীকে নির্ভরযোগ্যভাবে গন্তব্যে পৌঁছে দেয় কলকাতা মেট্রো।

আজ কলকাতা মেট্রোর উন্নতির পিছনে একটা দীর্ঘ ইতিহাস লুকিয়ে আছে। ১৯২১ সালে ব্রিটিশ আমলে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর প্রস্তাব ওঠে। তবে শেষ পর্যন্ত ১৯২৩ সালে তহবিলের অভাবে সেটি সম্ভব হয়নি। ভারতের স্বাধীনতার বহু বছর পর ১৯৮৪ সালের ২৪ অক্টোবর থেকে বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয় কলকাতা মেট্রোর যাত্রা। সেইদিন কলকাতার বুক চিরে যখন এগিয়ে চলা ট্রাম, বাসের ভিড়, তখন শহরবাসীকে যানজটমুক্ত সফরের অদ্ভুত অভিজ্ঞতা দিল এই মেট্রো। কলকাতার মাটির নিচে এগিয়ে চলা এক অপার বিস্ময়, যে সফরের নাম পাতাল রেল।

আরও পড়ুন: দেশের সব মেট্রো স্টেশনকে বলে বলে গোল দেবে শিয়ালদহ মেট্রো, কী কী ব্যবস্থা অন্দরে

ছুঁয়ে দেখা যাক, প্রথম দিনের কলকাতা মেট্রোর সফর। তিন দশক পেরিয়ে চলুন পিছনে।

ফিরে দেখা
১৯৮৪ সালের ২৪ অক্টোবর। কলকাতায় মাটির নীচ দিয়ে সেদিন প্রথম যাত্রা শুরু করল মেট্রোরেল। সেইদিনই হয়তো কলকাতার বুকে বেজে উঠেছিল- তোমার সুর, মোদের সুর...। সারা পৃথিবীর ইতিহাসে সেদিন লেখা হয়ে গেল কলকাতার নাম। অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে শুরু হল পাতাল রেলের গর্বের সফর। সফর শুরু হল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হাত ধরে। সেদিন ইন্দিরা গান্ধী এসপ্ল্যানেড থেকে ভবানীপুর (নেতাজী ভবন) ৩.৪০ কিলোমিটার দৈর্ঘ‍্যবিশিষ্ট রুটে ভারতের প্রথম তথা এশিয়ার পঞ্চম মেট্রো পরিষেবা কলকাতা মেট্রোর উদ্বোধন করেন। তপনকুমার নাথ এবং সঞ্জয় শীল কলকাতার প্রথম মেট্রোর চাকা ঘুরিয়েছিলেন। ফলে পাতাল রেলের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁদের নামও। কারণ তাঁরাই ছিলেন প্রথম মেট্রোর চালক।

পরপর ওই বছরই ১২ নভেম্বর চালু হয় দমদম থেকে বেলগাছিয়া ২.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট রুট। ১৯৮৬ সালের ২৯ এপ্রিল টালিগঞ্জ অবধি ৪.২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রো সম্প্রসারিত হলে এসপ্ল্যানেড থেকে টালিগঞ্জ অবধি ১১টি স্টেশন নিয়ে ৯.৭৯ কিলোমিটার পথের কাজ সম্পূর্ণ হয়। ১৯৯২ সালের ২২ নভেম্বর দমদম থেকে বেলগাছিয়া অংশটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ সেই সময় এই বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র অংশটি খুব একটা জনপ্রিয়তা পায়নি।

Kolkata Metro

কলকাতা মেট্রোর নির্মাণের সময়। ছবি সৌজন্য: ট্যুইটার

টালিগঞ্জ অবধি সম্প্রসারণের দীর্ঘ আট বছর পর ১৯৯৪ সালের ১৩ অগাস্ট দমদম থেকে বেলগাছিয়া শাখাটিকে ১.৬২ কিলোমিটার সম্প্রসারণ করে শ্যামবাজার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হল। সেই বছরের ২ অক্টোবর ০.৭১ কিলোমিটার এসপ্ল্যানেড থেকে চাঁদনি চক শাখাটি চালু হয়।

কলকাতা মেট্রো ততদিনে আবেগের সীমানা পেরিয়ে হয়ে উঠেছে এক নির্ভরযোগ্য সফরের নাম। এরপর ১৯৯৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে শ্যামবাজার-শোভাবাজার-গিরিশ পার্ক (১.৯৩ কিলোমিটার) ও চাঁদনি চক-সেন্ট্রাল (০.৬০ কিলোমিটার) শাখা ২টি চালু হয়। গিরিশ পার্ক থেকে সেন্ট্রালের মধ্যবর্তী ১.৮০ কিলোমিটার পথ সম্পূর্ণ হয় ১৯৯৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। এর ফলে তখনকার মতো মেট্রো লাইনটির কাজ সম্পূর্ণ হয়। ২০০৯ সালে টালিগঞ্জ (বর্তমান মহানায়ক উত্তমকুমার) স্টেশন থেকে গড়িয়া বাজার (বর্তমানে কবি নজরুল) স্টেশন পর্যন্ত সম্প্রসারিত নতুন মেট্রো পথের সূচনা হয়।

পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন
১৯৪৯ সাল। তখন পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায়। কলকাতার ক্রমবর্ধমান ট্রাফিক সমস্যা সরকারের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। সেই সমস্যা সমাধানে সরকার শহরে একটি ভূগর্ভস্থ রেলপথ নির্মাণের কথা বিবেচনা করে। এই মর্মে একটি ফরাসি বিশেষজ্ঞ দলকে দিয়ে সমীক্ষা চালানো হলেও কোনও সুসংহত সমাধানসূত্র পাওয়া যায় না। আজ কলকাতার গর্বের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে যে মেট্রোর নাম, তার রূপায়ন সহজ ছিল না। অনেক বছর পর, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে কলকাতা আশায় বুক বাঁধল।

১৯৭২ সালের ২৯ ডিসেম্বর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই প্রকল্পের শিলান্যাস করেন। পাতাল রেলের স্বপ্নে বীজ বপন করল মহানগরী। ১৯৭৪ সালে নির্মাণ কাজ শুরু। প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও অর্থের জোগান বন্ধ থাকা, আদালতের নানা স্থগিতাদেশ, কাঁচা মালের অনিয়মিত সরবরাহ ইত্যাদির কারণে প্রকল্পের দেরি হতে থাকে। তবে তদানীন্তন রেলমন্ত্রী আবু বরকত আতাউর গণি খান চৌধুরীর বিশেষ উদ্যোগ, কর্মদক্ষতা ও কূটনৈতিক দূরদর্শিতার ফলে প্রকল্পের কাজে দ্রুততা আসে। তারপর অনেকগুলো বছর পেরিয়ে কলকাতা পেল তার স্বপ্নের পাতাল রেল। পাতাল রেল তো পেল কলকাতা। কিন্তু প্রথম দিনগুলো কেমন ছিল? খুলে গেল স্বয়ংক্রিয় দরজা, ট্রেনের ভেতরে প্ল্যাটফর্মের নাম ঘোষণা, প্ল্যাটফর্ম আসার আগেই সুন্দর কণ্ঠস্বরে প্ল্যাটফর্মের দিক ঘোষণা। এসবের সঙ্গে বিস্ময় তো ছিলই, কিন্তু কলকাতা কি সেদিন পাতাল রেলে দুরুদুরু বুকে পা রাখেনি? সেদিনের অভিজ্ঞতা নতুন ছিল ঠিকই, তবে আজ তো নির্ভয়ে কলকাতাবাসীর কাছে `হ্যাপি জার্নি’র নাম পাতাল রেল।

শিয়ালদহ-র উদ্বোধন
এতদিন যানজটমুক্ত আরামদায়ক সফরের নাম ছিল কলকাতা মেট্রো। এবার শিয়ালদহ-র চমক কলকাতাবাসীকে তো বটেই সমগ্র দেশকেও তাক লাগাল। স্টেশনের ভেতর দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্যের মাধ্যমে সুন্দরভাবে রাজ্যের সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যেই সোমবার উদ্বোধন হলো ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো করিডরের অষ্টম স্টেশন শিয়ালদহর। এদিন হাওড়া ময়দান স্টেশন থেকে উদ্বোধন করেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, ২০২৩ সালের মধ্যে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। ১৪ জুলাই থেকে আমজনতা শিয়ালদহ স্টেশন থেকে মেট্রো সফর করতে পারবেন।

কলকাতার বুকে কান পাতলে যে প্রাণের স্পন্দন শোনা যায়, অবশ্যই তার নাম পাতাল রেল। কিন্তু এই সফর এখন আর শুধু আবেগ নয়, শহরবাসীর কাছে অপরিহার্য প্রাত্যহিকী।

More Articles