অর্চনা-লতিকা কিংবা ননীবালাদের লড়াই মনে রাখে না ইতিহাস

International Women's Day 2024: মাঝেমধ্যে মনে হয় এই ইতিহাস অর্থাৎ হিস্ট্রি আদতেই 'হি'জ স্টোরি'। 'হার স্টোরি'-গুলোকে তাই মনে রাখে না ইতিহাসের বই।

শুধু ভারতবর্ষেরই নয়, গোটা বিশ্বের বিভিন্ন আন্দোলন, বিভিন্ন লড়াইয়ের ময়দানেই সামনের সারিতে থেকে যুদ্ধ করেছেন মেয়েরা। অথচ ইতিহাস তাঁদের বরাবর পর্দার নেপথ্যে রেখে দিয়েছে । নারী দ্বিতীয় লিঙ্গ, অর্ধেক আকাশ। সাফল্যের ভাগের ক্ষেত্রে সেই অঙ্ক আধাআধি তো দূরের, দশমিকেও মেলে কিনা সন্দেহ। তবু নারীরা লড়েছেন। জানপ্রাণ দিয়ে লড়েছেন। তা সে একশো বছর আগের স্বাধীনতার যুদ্ধ হোক বা আজকের সন্দেশখালি। বিদ্রোহের দীপশিখাটি জ্বালিয়ে এগিয়ে এসেছেন তাঁরা। না, এ কথা শুধু ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে নয়, বিশ্বের তাবড় সব আন্দোলনের ক্ষেত্রেই সত্য। ফরাসি বিপ্লব থেকে শুরু করে রুশ বিপ্লব, প্রায় সবখানেই নারীদের অংশগ্রহণ ছিল মনে রাখার মতো। তবু যেন তাঁকে ব্রাত্যই করে রাখল ইতিহাস।

স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে লক্ষ্মীবাঈ, প্রীতিলতা ওয়েদ্দার, কল্পনা দত্ত কিংবা মাতঙ্গিনী হাজরাদের মতো স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নাম শোনা যায় বটে। তবে সেই স্বর যেন বড় ক্ষীণ, অস্পষ্ট। সমাজ কখনও কোনও কালেই সেভাবে নারীর নেতৃত্বকে প্রশ্রয় দেয়নি। ফলে তাঁদের পিছনে ঠেলে রাখাটাই হয়ে দাঁড়ায় দস্তুর। মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে-বউরা তেমন ভাবে বিপ্লব বা আন্দোলনের পুরোভাগে এসে দাঁড়ানোর জায়গাটাই পাননি। কিন্তু খেটে খাওয়া নিম্নবিত্ত সমাজের মেয়েরা, পুঁজিই যাঁদের শ্রম, তাঁরা কিন্তু লড়াইয়ের ময়দানে হাতিয়ার তুলে নিতে দু'বার ভাবেননি। উনিশ শতকে সাঁওতাল বিদ্রোহকে কার্যত ইংরেজ উপনিবেশের বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধ বলা চলে। সেই যুদ্ধে সিঁধু-কানহোর নাম আমরা যেভাবে পাই, সেভাবে ইতিহাস বইয়ের পাতায় চোখে পড়ে না তাঁদের দুই বোন ফুলো ও ঝানোর নাম। অথচ সিঁধু-কানহোর সঙ্গে একই সারিতে দাঁড়িয়ে সেই লড়াই লড়েছিলেন তাঁরাও।

আরও পড়ুন: কাশ্মীর থেকে মণিপুর, ক্ষমতার হাতিয়ার যখন ‘ধর্ষণ’

শুধু ইতিহাসের পাতায় নয়, নারীর আন্দোলনের স্বর হয়ে ওঠাকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে প্রতি পদে পদে। শারীরিক, মানসিক থেকে যৌননির্যাতন, বাদ যায়নি কিছুই। স্বাধীনতা সংগ্রামী ননীবালা দেবীর যোনিতে এক বাটি লঙ্কাগুঁড়ো ঘষে দিয়েছিল তৎকালীন পুলিশ। পুলিশি মারের মুখে বাঘের মতো গর্জে উঠেছিলেন অকাল বিধবা ননীবালা। তাঁর কথা লেখা হয়নি কোনও ইতিহাস বইয়ে। রক্তঝরা আন্দোলন, দেশভাগ, এক বুক ক্ষত নিয়ে দু'শো বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার শৃঙ্খল থেকে স্বাধীন হল দেশ। কিন্তু পরিস্থিতি কি বদলালো! তেভাগা আন্দোলনের সময় গ্রামের দিকের মেয়েদের উপর প্রভূত অত্যাচার হয়েছে। অহল্যা, বাতাসির মতো অসংখ্য কমরেড শহিদ হয়েছেন। কৃষক-নেত্রী ইলা মিত্রের যোনিতে ফুটন্ত ডিম ঢুকিয়ে অত্যাচার চালানো হয়েছিল। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে মাথাচাড়া দিল নকশালবাড়ি আন্দোলন। রাষ্ট্রের পুলিশের নৃশংস অত্যাচার কার্যত পঙ্গু করে দিল গোটা একটা প্রজন্মকে। সেই আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকে লড়েছেন বহু মেয়ে। সত্তর দশকের উত্তাল সেই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর আসনে কংগ্রেসের সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। তাঁর মদতেই নকশাল দমনে উঠেপড়ে লাগল রাজ্যপুলিশ। নকশাল নেতাদের খোঁজে বাড়ি বাড়ি চলল ব্যাপক তল্লাশি, ধরপাকড়।

পরবর্তী দশকে দীর্ঘতম আইনি লড়াইয়ের হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছিল অর্চনা গুহ মামলা। আমাদের অর্চনাদি। পড়াতেন একটা স্কুলে। সে রাতে ওঁর ভাইয়ের খোঁজে দমদমের বাড়িতে হানা দিল রাষ্ট্রের পুলিশ। অর্চনা ছাড়াও বাড়িতে ছিলেন ওঁর মা, সৌমেনের স্ত্রী লতিকা ও তাঁদের সম্পর্কে আত্মীয়া-বন্ধু গৌরী চ্যাটার্জি। গভীর ওই রাতে তিনটি মেয়েকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে লালবাজার তুলে এনেছিল পুলিশ। আর তারপর টর্চার চেম্বার। অর্চনাদি, লতিকা ও গৌরীকে অমানুষিক অত্যাচার করেছিল ওরা। আর এই গোটা অত্যাচার পর্বটাই চলেছিল কুখ্যাত রুণু ঘোষ নিয়োগীর তত্ত্বাবধানে। অর্চনাদিদের ঝুলিয়ে রেখে পায়ের তলায় অবিরাম লাঠির বাড়ি মেরে গিয়েছে পুলিশ। সারা শরীরে অসংখ্য হাড় ভেঙে গিয়েছিল। একের পর এক কমরেডের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে যাওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে সাদা কাগজে সই করে দিতে।

How Nation torchered Naxal activist like Archana Guha, Latika Guha and the tale of their unstppoble spirit to fight international womens day by Krishna Bandyapdhyay Robibarer Royak

কোনও জবাব দিতে পারেননি অর্চনাদিরা। কারণ সত্যিই কিছু জানতেন না ওঁরা। জানার কথাও না। আন্দোলনকে সমর্থন করলেও পার্টির হোলটাইমার ছিলেন না তাঁরা। লতিকা তখন পড়াতেন গোখেল কলেজে। অর্চনাদি স্কুলে। ওঁদের পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না বাকি কমরেডদের বিষয়ে। রুণুর সঙ্গে আরও কয়েকজন পুলিশ জড়িত ছিল ওই ভয়ঙ্কর অত্যাচারে। রুণুর নির্দেশে লতিকার গালে একের পর এক ভয়ঙ্কর চড় মেরে গিয়েছিল পুলিশ। সে চড় এতটাই মারাত্মক ছিল, ভয়াবহ ভাবে ফুলে উঠেছিল লতিকার গাল, কালশিটে পড়ে গিয়েছিল পাঁচ আঙুলের। অর্চনাদির দুই হাতের কব্জি ও পা বেঁধে দুই হাঁটু আর কনুইয়ের মাঝে লাঠি ঢুকিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। তার পর পায়ের তলায় লাঠির বাড়ি। মাথার সমস্ত শিরা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার জোগার হয়েছিল অর্চনাদির। তার সঙ্গে ছিল পুলিশের লাথি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাথার চুল থেকে ঝুলিয়ে পর্যন্ত রাখা হয়েছিল অর্চনাদিকে। শরীরের বিভিন্ন অংশে চেপে ধরা হয়েছিল জ্বলন্ত চুরুট। শুধু শরীরি নির্যাতন নয়। এর সঙ্গে চলত অফুরন্ত গালিগালাজ। চোখ দিয়ে ধর্ষণ। পুলিশের ভয়াবহ অত্যাচারে অজ্ঞান হয়ে গেল অর্চনাদি। তারপর রাষ্ট্রের পুলিশের ভয়াবহ যৌননির্যাতনে কার্যত পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল অর্চনাদির গোটা নিম্নাঙ্গ।

শুধু অর্চনাদি, লতিকা কিংবা গৌরী নয়, রাষ্ট্রের পুলিশের হাতে একই রকম অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছিল মলয়াকেও। মলয়াও পড়াত একটা স্কুলে। ফলে পার্টির হোলটাইমার ছিল না সে-ও। অসুস্থ কমরেডদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, চিকিৎসা করানো— সেই সব ব্যাপারগুলো সামলাতো মলয়া। মলয়ার তখনকার সঙ্গী গৌতম ছিলেন পার্টির হোলটাইমার। মলয়াকে তুলে নিয়ে গিয়ে নৃশংস অত্যাচার চালায় পুলিশ। কমরেডদের নাম-ঠিকানা চাওয়া হয়েছিল। অথচ কিছুই জানত না ও। আটান্ন দিন পরে যখন ও ছাড়া পায়, শরীরের পিছনে একফোঁটা মাংস ছিল না ওঁর। মেরে মেরে হাড় বের করে দিয়েছিল পুলিশ। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে একটা বই লিখেছিল মলয়া— 'লালবাজারে আটান্ন দিন'। পুলিশি অত্যাচারের এক ভয়ঙ্কর দলিল সেই বই।

How Nation torchered Naxal activist like Archana Guha, Latika Guha and the tale of their unstppoble spirit to fight international womens day by Krishna Bandyapdhyay Robibarer Royak

আমরা কমরেডরা একে অপরকে নাম ধরে ডাকতাম। শুধু অর্চনাদি ছিলেন আমাদের দিদি। আমাদের সকলের। আমরা জেলখানার এক ওয়ার্ডে একসঙ্গে ছিলাম বেশ কিছুদিন। মাঝেমধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন অর্চনাদি। কখনও জন্ডিস তো কখনও অন্য কিছু। ভীষণ আস্তে কথা বলতেন অর্চনাদি। অসম্ভব ব্যক্তিত্বময়ী। সকলকে স্নেহ করতেন। আসলে ওঁর স্বভাবটাই ছিল অমনটা। আর একজন ছিলেন আমাদের সঙ্গে জেলে। আমরা সকলেই তাঁকে ডাকতাম মাসিমা বলে। আসল নাম শান্তি দেব। র্গাপুর থেকে ওঁকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। তখনই মাসিমার অনেক বয়স। দুওঁর ছেলে রাজনীতি করতেন। ছেলের খোঁজ পেতে বৃদ্ধা মাকে জেলখানায় তুলে এনে নৃশংস অত্যাচার চালিয়েছিল রাষ্ট্রের পুলিশ। জেলের মধ্যে বারবার অজ্ঞান হয়ে যেতেন মাসিমা। আমাদের আর এক কমরেড রাজশ্রী দাশগুপ্ত। আন্দোলনে নেমে পায়ে গুলি খেয়েছিল রাজশ্রী। পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে জেল হাসপাতালে ভর্তি করে। একটু সুস্থ হতেই গ্রেফতার। ওই গুলি খাওয়া পায়েই রাজশ্রীকে সবচেয়ে বেশি মেরেছিল পুলিশ। অর্চনাদি, লতিকা, গৌরী- এঁদের সকলকে গ্রেফতার করা হয়েছিল অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আইন ( Maintenance of Internal Security Act) অর্থাৎ মিসা-র আওতায়। চুয়াত্তরের দিকে বন্দিমুক্তির সময়ে জেল থেকে ছাড়া পেলেন ওঁরা। প্রায় সকলেই জেল থেকে বেরিয়েছিলেন প্রায় পঙ্গু হয়ে। অন্য কমরেডরা তাঁদের সেবা-শুশ্রুষা করে সুস্থ করে তোলেন।

পরবর্তীকালে অর্চনাদির ভাই সৌমেন গুহ এবং এপিডিআর যৌথভাবে রুণু ঘোষ নিয়োগীর মতো অত্যাচারী পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে। প্রায় উনিশ বছর ধরে চলেছিল সেই ঐতিহাসিক মামলা। অর্চনাদির হয়ে প্রথম দিকে মামলা লড়েছিলেন আইনজীবী অরুণপ্রকাশ মুখোপাধ্যায়। পরে অবশ্য আদালতে নিজেই সওয়াল-জবাব করা শুরু করেন মামলাকারী সৌমেন গুহ। সেই মামলায় অর্চনাদি জিতেছিল বটে। কিন্তু ভারী হাস্যকর ছিল সেই জয়। বিচারে এক মাসের সাজা হয়েছিল রুণুর। কিন্তু সেই সাজাটুকুও খাটতে হয়নি তাঁকে। তখন এ রাজ্যে ক্ষমতায় বামফ্রন্ট সরকার। যে কোনও সরকারই যে আদতে এক, তা প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল আর একবার। বাম আমলেই পদোন্নতি হল রুণু ঘোষ নিয়োগীর। সেই রুণু ঘোষ নিয়োগী, যে মেয়েরা গ্রেফতার হলেই খুশি হত। এক অদ্ভুত আনন্দে ঝলমল করে উঠত ওদের চোখ-মুখ।

How Nation torchered Naxal activist like Archana Guha, Latika Guha and the tale of their unstppoble spirit to fight international womens day by Krishna Bandyapdhyay Robibarer Royak

নকশাল-পরবর্তী আমলেও কিন্তু এই জায়গাটা বদলায়নি। বরং অত্যাচার বেড়েইছে। পরবর্তীকালে মাওবাদীদের উপর নৃশংস অত্যাচার করা হয়েছে। বিশেষত গ্রামের মেয়ে, আদিবাসী নিম্নবিত্ত মহিলাদের উপর যে কী ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়েছে, তা বলার নয়। জঙ্গলমহল-সহ একাধিক গ্রামীণ এলাকার আন্দোলনকারীদের উপরে যারপরনাই অত্যাচার করেছে মাওবাদী দমনে সচেষ্ট পুলিশ। জেলবন্দিদের স্যানিটারি ন্যাপকিন দেওয়াটা নিয়মের মধ্যে পড়ে। কিন্তু অধিকাংশ জায়গায় আজও তা দেওয়া হয় না। আদালতের নির্দেশে যখন কোনও অভিযুক্তের জেল হেফাজত হয়, সে সময় জেলে এনে প্রথমেই তাঁর তল্লাশি নেওয়া হয়। যোনির ভিতরে হাত ঢুকিয়ে তল্লাশি করে পুলিশ। ভয়ঙ্কর যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে থাকেন বন্দিরা। এমনও দেখা গিয়েছে, বন্দিদের স্তন পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে, তাঁরা 'সদ্য মা' কিনা। বুকে দুধ না মিললেই তাঁকে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে 'মাওবাদী' বলে। শহরের নয় যাঁরা, তাঁদের উপরে নির্যাতন হয়েছে আরও বেশি। কত বন্দি ইতিমধ্যেই সাজা কাটিয়ে ফেলেছেন চোদ্দ বছরেরও বেশি। কিছুদিন আগেই তাঁদের সাজা ঘোষণা হল। আমৃত্যু যাবজ্জীবনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাঁদের। শিলদা ক্যাম্পে মাওবাদী আক্রমণের ঘটনায় এমন কতজনকে ধরা হয়েছে, যাঁরা আদৌ সেই মামলায় জড়িতই নয়। বুদ্ধেশ্বর মাহাতোর মতো কত বন্দির জীবন শেষ হয়ে গেল কারাগারেই। পুলিশের মারে নষ্ট হয়ে গিয়েছে ওঁর দু'টো কিডনিই। জেলে ঠিক মতো ডায়লিসিস পর্যন্ত হয়নি। এখন টিবি ধরা পড়েছে বুদ্ধেশ্বরের। বৃদ্ধা মা চেয়েছিলেন, ওঁর কোলে এসে মরুক ছেলেটা। না, রাষ্ট্রের পুলিশ তেমনটা হতে দেয়নি। মাঝেমধ্যে মনে হয়, রুণুর মতো এইসব পুলিশ অফিসারদের বোধহয় মানববিরোধী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। নাহলে কীভাবে সম্ভব এই নারকীয় অত্যাচার, নির্যাতন!

রাষ্ট্রনেতারা বলছেন, দেশের সবচেয়ে বড় বিপদ আজ মাওবাদ। দিন কয়েক আগে জেল থেকে ছাড়া পেলেন সাইবাবা। শরীরের প্রায় ৯০ শতাংশ অংশই পঙ্গু তাঁর। মাকে শেষবার দেখার জন্য প্যারোলের আবেদন জানিয়েছিলেন সাইবাবা। সেই আবেদন মঞ্জুর হয়নি তাঁর। অধ্যাপনা, চাকরি— সব শেষ হয়ে গেল। কে ফিরিয়ে দেবে ওঁর এগারোটা বছর? জেলে পচে মরে গেলেন স্ট্যানস্বামী। ভারভারা রাও অসুস্থ। শর্তাধীন জামিন পেলেও স্বস্তি নেই তাঁর। নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সোমা সেন মাওবাদী সন্দেহে দীর্ঘদিন ধরে জেলবন্দি। মাটিতে শুতে পারতেন না। গ্লুকোমা বাড়তে বাড়তে প্রায় অন্ধত্বের পথে সোমা। কতগুলো বছর জীবন থেকে নষ্ট হয়ে গেল ওঁদের শুধুমাত্র রাজরোষে।

How Nation torchered Naxal activist like Archana Guha, Latika Guha and the tale of their unstppoble spirit to fight international womens day by Krishna Bandyapdhyay Robibarer Royak

আমরা প্রতিটা সময়ে দাঁড়িয়ে ভাবি, আগের সময়টা বুঝি এর চেয়ে ভালো ছিল। ব্রিটিশরা বোধহয় নকশাল আমলের পুলিশের থেকে দয়ালু ছিল, কিংবা রুণুরা বোধহয় আজকের রাষ্ট্রের পুলিশের থেকে কম নির্দয়! আসলে কিছুই বদলায় না। না অত্যাচারীর চাবুক বদলায়, না নিপীড়িতের যন্ত্রণায় কুঁচকে যাওয়া মুখ। সমস্ত আন্দোলনে যুগ যুগ ধরে মেয়েরা সামনের সারিতে উঠে এসেছে। ইতিহাসে জায়গা পাননি তাঁরা। আজকের সন্দেশখালির দিকে চেয়ে দেখুন। সেখানেও তো শেষপর্যন্ত এগিয়ে এসেছে গ্রামের মেয়েরাই। রুখে দিয়েছে শাহজাহান-উত্তম-শিবুদের। তাঁদের পাশে কোনও রাজনৈতিক দল ছিল না। কিন্তু ইতিহাস যখন লেখা হবে, তখন মেয়েরা কীভাবে যেন পিছন দিকে চলে যায়। মাঝেমধ্যে মনে হয় এই ইতিহাস অর্থাৎ হিস্ট্রি আদতেই 'হি'জ স্টোরি'। 'হার স্টোরি'-গুলোকে তাই মনে রাখে না ইতিহাসের বই। নকশালবাড়িতে প্রথম শহিদ হয়েছিলেন আট মহিলা। তাঁদের সঙ্গে ছিল এক কিশোর আর মায়েদের পিঠে বাঁধা দুই শিশু। সেই শিশুদের লিঙ্গ জানা হয় না আর। মণিপুরেও তো সেই একই ছবি দেখি আমরা। বারবার পুরুষশাসিত সমাজ সেখানে হাতিয়ার করে মেয়েদের স্তন ও যোনিকে। বারবার জন্মায় মনোরমারা। আর বারবার সমস্ত আবরণ, আভরণ খুলে রাস্তায় নামতে হয় মেয়েদের। মনে আছে মণিপুরের মায়েদের সেই ঐতিহাসিক নগ্নমিছিল, যা কাঁপিয়ে দিয়েছিল গোটা বিশ্বকে।

আরও পড়ুন: নারীর অধিকারের লড়াইয়ে বারবার জেল, সেই অদম্য নার্গিসকেই এবার শান্তির নোবেল

আসলে মেয়েরাই পারেন। কোনও কিছু কি আদতে পাল্টায়? মেয়েদের উপর বারবার অত্যাচার হয়েছে, অত্যাচার হবে। তবু ছাইয়ের ভিতর থেকে আগুনপাখির মতো উঠে দাঁড়াবেই মেয়েরা। ভয় না পেয়ে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে লড়াই করবে। কিছুতেই তাঁদের পাঁজরকে গুঁড়িয়ে দিতে পারবে না রাষ্ট্রশক্তি, পুরুষশক্তি। আসলে সমস্ত সংগ্রাম, সমস্ত লড়াই, সমস্ত দলের মধ্যেই সেই পিতৃতন্ত্রের আস্ফালন থেকেই যায়। তাকে সমূলে উৎপাটন করা সহজ নয়। তা-ই লড়াই চালিয়ে যেতেই হবে। ইতিহাস মনে রাখবে না। তারা ভুলে যাবে মেয়েদের নেতৃত্বকে। একেবারে পিছনের সারিতে ঠেলে দিতে চাইবে তাদের। তার পরেও এই নারীর জেগে ওঠা স্বরটুকুই সত্য, পিতৃতান্ত্রিক এই চিন্তার বিরুদ্ধে লড়াইটুকুই ধ্রুব।

(অনুলিখন: সোহিনী দাস)

More Articles