উত্তর কলকাতার দোল নিষেধ ভাঙার কার্নিভাল
Holi 2024: কে এত রং দিল, ভাবতে ভাবতেই বাড়ি। আরেকটু বড় হলে আবিরের ছোঁয়াচ, ভাঙা প্রেমের লেজুড় পরকীয়ার মতো হয়তো জুড়ে থাকবে এমনই সারাদিন। তারপর স্মৃতিতে সেই রং ফিকে হবে।
রঙে ভেজা রাস্তাঘাট থিতিয়ে যাওয়া রক্তাভ হয়ে ওঠে কখনও। এই রাস্তাতেই তো একসময় লাশ ঢিপি হয়ে থাকত, পাশ দিয়ে কারফিউ জারি রাখা পুলিশ জিপ হেঁটে যেত নির্দ্বিধায়। সেই রাস্তায় যত রংই এখন জমা হোক, চড়চড়ে দুপুর সেইসব রঙে জল ঢাললে নালায় গিয়ে মিশবে একগাদা লাল রংই। অমন লাল খুব চট করে চোখে পড়ে না সারাবছর। 'মাসিকের রং' বলে যে বন্ধু খিল্লি করত কৈশোরে পা রাখার আগেই, সে-ও খানিক থমকে যায় ওই রং দেখলে। সব ফুর্তি ফুরিয়ে গেলে ওই রং হু হু করে ধেয়ে আসে একরাশ বিষাদশূন্যতা নিয়ে। দুপুরটা হঠাৎ কেমন মরে যায়। মড়ার মতো ঘুমের মধ্যে কিছুক্ষণ বন্ধ হয়ে যায় পাড়ার হৃৎপিণ্ড। এমনকী, যে নিশ্বাস ওঠানামার শব্দ এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি, এ-জানালা থেকে ও-জানালা বেয়ে সমবেত হয়, সে-ও থেমে যায়। পায়রার একটানা যে বকমবকম দুপুরের মার্কামারা আবহসঙ্গীত, তা-ও চুপ একদম। কেবল রোদ বাড়ে, রাস্তায় রক্ত থুড়ি রং শুকোয়, আর বিকেল নেমে আসে ঝুপ করে। এই মৃত রঙের সামনে কোনও রামধনু সে আনবে না, গোধূলির ওই 'বড় নাজেহাল আকাশ' সেদিনের জন্য পর্দানসীন। কীসের যে শোক, কে জানে!
'বসন্তের মর্মবেদনা'- শব্দবন্ধটা কী সহজভাবেই না ব্যবহার করেছিলেন প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়! সত্যি সত্যি ওই মর্মবেদনা যারা চিনেছে, বা চিনেছি, এই কলকাতা উত্তরেই আমাদের বাস। তারা জানি, 'ও শ্যাম যখন-তখন, খেলো না খেলা অমন' বা 'আজ হোলি খেলব শ্যাম'-এর চিনচিনে যে সুর, উত্তর কলকাতার দোলের সুর ওইটাই, 'ওরে গৃহবাসী'-র কোরাস নয়। 'হোলি কে দিন দিল খিল যাতি হ্যায়'-এর আশ্চর্য ওই সুর, রাহুল দেববর্মনের বুনে দেওয়া, শুনলেই মনে পড়ে যায়, এরপর গব্বর আসবে, গুলি চলবে মরচে পড়া গাদাবন্দুক থেকে। কিছুক্ষণ সে কী 'সন্নাটা' ও দমচাপা নীরবতা, খুনোখুনি শুরু হল বলে! সেখানে কোথাও 'নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন' লাগবে না, বরং এই ফুল ব্যোদলেয়ারের 'শয়তানে'র ফুল। পাড়াতেও তাই মারপিটের শব্দতরঙ্গ হঠাৎ ওঠে, হঠাৎই নেমে যায়। 'রঙ্গ বরসে' শুনতে শুনতে আনমনা হবেন রঙিন শাড়ি পরা আইবুড়ি শিবুপিসিরা, যাকে জয় গোস্বামীর 'হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষ'-তে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম আমরা। এমন কত নানা লিঙ্গপরিচয়ের শিবুপিসি যৌবনে নেহাতই অবহেলায় ফিরিয়ে দিয়েছেন পাড়ার চেনা-অচেনা কোনও দাদার মাথা চুলকানো, লাজুক প্রস্তাব, অথচ এখনও রং সামলে, অপার একাকিত্বের সমুদ্র নিয়ে অপেক্ষায়, কারও জন্যও নয় এমনকী, হয়তো বা নিজেরই জন্য।
আরও পড়ুন: জামা ছিঁড়ে খালি গায়ে রঙ খেলার কাছে হাজার গোলে হেরে যায় তিন আঙুলের আবিরের দোল
প্রথম বয়ঃসন্ধির যেটুকু কদম ফুল, তার অনেকাংশ লুকিয়ে, পাড়ার দোলে পিচকিরি থেকে পিছলে হাতে করে রং মাখানোর ধিকিধিকি উত্তেজনায়। সেই ছোটবেলায়, যখন পিচকিরি ছিল বন্দুক, রংভরা বেলুন হয়তো বা গ্রেনেড, তখন কার্গিল যুদ্ধ বা বাগদাদের যুদ্ধ টিভিতে দেখা গিয়েছে। সদ্য 'ম্যায় হুঁ না' দেখে বন্দুক-বোমাবাজিতে উৎসাহও বেড়েছে বইকি। কিন্তু এখন তো বদলে গেছে সময়। এক-দু'জন বান্ধবী বা বন্ধু অথবা প্রেমিক বা প্রেমিকা কিংবা তেমন কেউ— কত স্পর্শ যে পুরুষের থেকে নারীতে, নারীর থেকে পুরুষে, নারীর থেকে নারীতে অথবা পুরুষের থেকে পুরুষের শরীরে হুকিং হওয়া বিদ্যুতের মতো সঞ্চারিত হচ্ছে, পূর্ণ সম্মতিতে তো বটেই, সূক্ষ্ম শিরশিরে ভাবেও! কে এত রং দিল, ভাবতে ভাবতেই বাড়ি। আরেকটু বড় হলে আবিরের ছোঁয়াচ, ভাঙা প্রেমের লেজুড় পরকীয়ার মতো হয়তো জুড়ে থাকবে এমনই সারাদিন। তারপর স্মৃতিতে সেই রং ফিকে হবে। কিন্তু প্রথম দিন তো রঙের কার্নিভাল, লাজুক মুখ নামানো। নিষেধ ভেঙে চুরমার হয়ে ছড়িয়ে যায় বাগবাজার থেকে আহিরীটোলার রাস্তায়। আত্মমৈথুনের পর ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ হাতে জড়িয়ে থাকার অবসাদ ছাপিয়ে ঠিক বেখাপ্পা রামধনু ওঠে চিৎপুর রোডের ওপর-আকাশে, কোনও রঙের যেখানে ঠিক নেই।
ওই মাতাল এগিয়ে আসছে। কোনওমতে গাইছে, 'আজ না ছোড়েঙ্গে'। কতজনের বুক কেঁপে উঠবে অন্দরমহলে, ভূতের মতো ওই মাতালের গলা শুনেই। এমন গানের ছুতোয় কতবার বাড়ির লোক, বাইরের লোকের রংমাখা হাত ধেয়ে এসেছে! ভূতেরই মতো। মাতাল অবশ্য তার পরেই গাইছে, 'মনে করো আমি নেই, বসন্ত এসে গেছে/ কৃষ্ণচূড়ার বন্যা...'। সুমন কল্যাণপুরের সেই আশ্চর্য কণ্ঠস্বরে শোনা গান বেসুরো, বেতালা হয়ে ছিটকে ছিটকে পড়ল কিছুক্ষণ পাড়ায়। সেই কোন সকালে, বা ঝুঁকি না নিয়ে আগের দিন এনে রাখতে হয়েছে মনসুরের দোকানের থেকে রেওয়াজি পাঁঠার মাংস, আর তার ঝোলের জন্য অন্যান্য বাজার। নইলে কোন বেয়াড়া বাচ্চা দুম করে রং ছুড়বে নতুন পাঞ্জাবিতে। আর অকুতোভয়রা অবশ্য সাবান দিয়ে স্নান করে নতুন রংয়ের চামড়া নিয়ে, গিরগিটি সেজে মাটনের ঝোল বাটি থেকে ঢালে ভাতের গিরিখাতে। সেসময় স্নান ফুরোয়নি কত কিশোরীর, অথবা মধ্যবয়স্কার। রং তো উঠে যাবে, না-চাইতেই যে স্পর্শটা, তা তুলবে কোন সাবান?
ভাঙের খই ফোটে গলির ভেতর। বস্তির দোল যতটা সোচ্চার, ততটাই আন্ডারগ্রাউন্ড। সবে আগুন লেগে উদ্ধার হওয়া দশ ফুট বাই দশ ফুটের সারিতে কিচ্ছুটি চাপা নয়। কার মাথায় বোতল ভাঙছে, রক্ত গড়াচ্ছে দিনভর, তাই বলে কি সে বাঁদুড়ে রং এড়িয়ে গেল? হাত ধরে টানাটানির জবাব কখনও সপাট, কখনও আচমকা কাছে ঘেঁষে আসায়। আর নাচ। সে কী নাচ! ডিজে মাটির বুক গমগম করাচ্ছে, দূর থেকে শোনা যায়। হাসপাতালের পাশের দোকান থেকে কেনা কান্ট্রি স্পিরিট আর সস্তার বিয়ার চলবে সন্ধেবেলাও। সঙ্গে গলি-ঘেঁষা ইলেকট্রিক দোকানের উপহার টুনি বাল্ব। দূরে, কিছুটা মাথা তুললে দেখা যায় বাড়ির ভেতর আলো। ঘরের ভেতর বোতল আর গ্লাসের ওদিকে প্রগলভ মেলামেশার শেষ নেই। কোথাও বাজছে 'আওয়া না চোলি মে রং' ইত্যাদি অথবা 'বলম পিচকারি', কোথাও ঘরের ভেতর 'যৌবনেরই ঝড় উঠেছে আকাশ-পাতালে/ নাচের তালের ঝংকারে তার আমায় মাতালে'।
আরও পড়ুন:হাতে লং উইকেন্ড, শহর থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে পুরুলিয়ায় কাটুক এবারের দোল
এর মধ্যে, ওই কালান্তক দুপুর-বিকেলে 'চলে যায়/ বসন্তের দিন চলে যায়/মরি হায়'-এর টানা কোকিলডাক চলেছে হয়তো। 'আকাশ আমায় ভরল আলোয়, আকাশ আমি ভরব গানে'- কী আশ্চর্য অঙ্গীকার! আলোর দোল? অমন আলো কোথা থেকে জোগাড় হল? 'সুরের আবির হানব হাওয়ায়', না, কালীপুজোর বাজি বেচে যে দোকান, সেই দোকানই 'অথেন্টিক যাদবপুরের আবির' বলে যা দিয়েছে, এর শক্তি তার চেয়ে বেশি। 'নাচের আবির হাওয়ায় হানে', ক্রিয়াপদের সঙ্গে জুড়ে থাকা এই উত্তম পুরুষ আর প্রথম পুরুষের বদল মাথায় নিয়েই দিন ফুরোয়।
তাসায়, নেশায় আর আশায় বসন্ত চলে যায়, এই উত্তর কলকাতায়— একথাও কবিতায় বলেছিলেন প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁরই কিছুটা কবিতাংশ পড়ে থাকে দিনের শেষে।
তবে হৃদয় ব্যথার জলে ডোবা
ওপর ওপর ফূর্তি হ'ল ঘোর
নাচ হ'ল গান হ'ল যা হয়তো বা
নিছক বিষাদ.... নিতান্ত হুল্লোড়এত বিষাদ কোথাত্থেকে আসে
এত বিষাদ...কোথায় ফিরে যায়
মাঝখানে যে হল্লা চারি পাশে
আমাকে খায়...তোমাকেও তো খায়