রমজান শুরুর দিনটিই কেন সিএএ ঘোষণার জন্য বেছে নিলেন মোদি?
CAA and Matua Vote:সিএএ চালুর দিন হিসেবে ১১ মার্চকেই বাছা হলো কেন? ১২ মার্চ থেকেই শুরু হয়েছে রোজা। তাছাড়া ১১ মার্চ ছিল হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথি!
সকালেই দেশের শীর্ষ আদালত স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াকে বলেছিল, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নির্বাচনী বন্ডে কে কত টাকা কোন দলকে দিয়েছে বিস্তারিত তথ্য জানাতে হবে আদালতকে। বিজেপির পক্ষে অস্বস্তিকর এই নির্দেশকে নিমেষে শিরোনাম থেকে সরিয়ে বিজেপি বিকেলেই জানিয়ে দিল নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ চালু হয়ে গেল ভারতে। ২০১৯ সালের ভোটের আগে সিএএ-এনআরসির ধুয়ো তোলা হয়েছিল। কবে তা বাস্তব হবে এই নিয়ে জল্পনা ছিলই। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে সত্যি সত্যিই দেশে সিএএ চালু করে দিল বিজেপি! রামমন্দিরের প্রসাদ দিয়ে ভোট টানা যাবে না মোদি জানেন। ২০২৪ সালের ভোটের আগে তাই একের পর এক ঘোষণা-উদবোধন-উন্মোচন চলছেই বিজেপির তরফে। আর এই প্রতিটি ঘোষণা হচ্ছে দিনক্ষণ মেপেই। শুধু এসবিআইকে ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে তথ্য প্রকাশের নির্দেশের পাল্টা চাল নয়, বিজেপি অত্যন্ত ভেবেচিন্তেই ১১ মার্চ দিনটিকে সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট চালুর দিন হিসেবে বেছেছে। ১২ মার্চ থেকেই শুরু হয়েছে রোজা। তাছাড়া ১১ মার্চ ছিল হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথি!
হরিচাঁদ ঠাকুর কে? হরিচাঁদ হচ্ছেন মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রবর্তক। পিছিয়ে পড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের এবং দলিত হিন্দু উন্নয়নে কাজ করেছিলেন তিনি। এই হরিচাঁদ ঠাকুরের সন্তান গুরুচাঁদ ঠাকুর ১৯৩২ সালে মতুয়া হিন্দুদের জন্য একমাত্র সংগঠন শ্রীশ্রী হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন যা পরর্বতীকালে শ্রীশ্রী হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ মতুয়া মিশন নামে পরিচালিত হয়। ফলে হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথিতে মতুয়াদের মন জেতার সুযোগ হারাতে চায়নি বিজেপি। তৃণমূল ও বিজেপি মতুয়া ভোট টানতে মরিয়া। মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি বিজেপির বড় কর্মসূচি। অন্যদিকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার বলেছেন, মতুয়াদের আলাদা করে নাগরিকত্বের প্রয়োজন নেই। তাঁরা এ দেশেরই নাগরিক।
আরও পড়ুন-ভোটের ঠিক আগেই কেন CAA? কোন চাল বিজেপির?
মতুয়া তাহলে কারা? মতুয়া হিন্দুধর্মেরই একটি বিশেষ সম্প্রদায়। হরিচাঁদ ঠাকুর যে প্রেমভক্তিরূপ সাধন পদ্ধতির প্রবর্তন করেন তাই মতুয়াবাদ বলে পরিচিত। বাংলায় ৩৯টি বিধানসভা আসনে ২০ শতাংশের বেশি মতুয়া ভোট রয়েছে। নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং পূর্ব বর্ধমান জেলায় মতুয়ারা আছেন। হরিচাঁদের পুত্র গুরুচাঁদ চিরকালই বলতেন, যে রাজনৈতিক দল মতুয়াদের স্বার্থরক্ষা করবে তাঁরা তাদের পাশে থাকবেন। তাই হরিচাঁদ-গুরুচাঁদের ভক্তদের ভোট পেতে ১১ মার্চের চেয়ে ভালো দিন কীই বা হতে পারে?
পাশাপাশি ১২ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে রোজার উপবাস। মতুয়া ও মুসলিম- দুই সম্প্রদায়ের ভক্তি ও ভয় আদায়ের মোক্ষম অস্ত্র ছিল এই সিএএ। বনগাঁ আসনে শান্তনু ঠাকুরের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছিল নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি বিষয়ে। বনগাঁ আসন জিততে সিএএ তাসটি খেলতেই হতো।
আরও পড়ুন- বাংলায় এত অবাঙালি প্রার্থী কেন তৃণমূলের?
তবে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিষয়টা ঠিক কী তা নিয়ে মানুষের ধারণা স্পষ্ট নয় এখনও। এই আইনে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় কারণে নিপীড়নের জন্য এ দেশে আসা সংখ্যালঘু শরণার্থীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ এই তিন দেশ থেকে হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, পার্সি এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এই তিন দেশেই মুসলিমরা সংখ্যাগুরু। তাই ওই দেশ থেকে কোনও মুসলিম মানুষ এদেশে এলে কিন্তু নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বলছেন, ‘‘ইচ্ছা করে কালকের দিনটা বেছে নেওয়া হয়েছে। কারণ কাল থেকে রমজান শুরু হয়েছে। এই সিএএ, এনআরসির সঙ্গে যুক্ত। শুধুমাত্র আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে আনা হবে। শ্রীলঙ্কা, মায়নমার বাদ। এমন অনেক পরিবার রয়েছেন, যাঁদের এ পার বাংলা থেকে ও পার বাংলায় বিয়ে হয়েছে। তাঁরা যোগাযোগ করতে পারবেন না। ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব কখনও কেউ শুনেছেন?’’
ঠাকুরবাড়ির সদস্য তথা তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ মমতাবালা ঠাকুর বলছেন, ভোটের আগে সিএএ চালু হচ্ছে। তাহলে যে মানুষরা এখনও নাগরিক হননি তারা কীভাবে ভোট দিতে পারবেন? নাগরিকত্ব এখন দেওয়া হবে নাকি ভোটের ফলাফলের পর তা নিয়েও রয়েছে দ্বন্দ্ব। বিরোধীরা বলছে, মুসলিমদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক প্রমাণ করতেই এবং ধীরে ধীরে এনআরসি-র পথ প্রশস্ত করতেই বিজেপি এই আইন চালু করেছে ভোটের আগেই। ২০১৯ থেকেই সিএএ-এনআরসির বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। পাঁচ বছর তা ছিল স্তিমিতই। সেই ঝিমিয়ে থাকা আন্দোলনের ফোঁকর গলে বিজেপি নিজের প্রতিশ্রুতি রাখল অবশেষে। নাগরিকদের প্রতিবাদে রাষ্ট্রের কিছুই এসে যায় না।