উন্নয়নের নামে বনভূমি ধ্বংস! কেন্দ্রের বিরুদ্ধে যে যে দাবি নিয়ে পথে নামল বনগ্রাম
Forest Conservation: ২০০৬ সালের বন অধিকার স্বীকৃতি আইন (FRA) অনুযায়ী, বনে বসবাসকারী এবং বন-নির্ভর আদিবাসী এবং অন্যান্য় সম্প্রদায়ের অধিকার রয়েছে বনভূমি ও বনভূমি ও বনজ সম্পদের উপর।
শিয়রে লোকসভা ভোট। চারদিকে কান পাতলেই দল বদলের খবর। আর ঠিক এমনই একটি পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ অন্যরকম একটি ইস্যু নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠল পশ্চিমবঙ্গের গ্রামসভাগুলি। জঙ্গলের অধিকারের লড়াই আজকের নয়। এর আগেও বিভিন্ন ভাবে জঙ্গল-জমির লড়াই লড়েছে মানুষ। লোকসভা ভোটের ঠিক আগে আগে বুধবার আলিপুরদুয়ার, কালিম্পং, দার্জিলিং, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং সুন্দরবনের বনগ্রামগুলো একজোট হয়েছিল কলকাতার মহাজাতি সদনে।
জঙ্গলের অধিকার। ২০০৬ সালের বন অধিকার স্বীকৃতি আইন (FRA) অনুযায়ী, বনে বসবাসকারী এবং বন-নির্ভর আদিবাসী এবং অন্যান্য় সম্প্রদায়ের অধিকার রয়েছে বনভূমি ও বনভূমি ও বনজ সম্পদের উপর। আইন প্রতিটি এলাকার গ্রামসভার হাতে অধিকার দিয়েছে, নিজস্ব এলাকার বনজ সম্পদ, বনভূমি এবং বনের জমি ও সমস্ত অ-কাষ্ঠল সম্পদের দেখাশোনা ও বিলিব্যবস্থা করার। অথচ গত দুই দশক ধরে সেই আইনটি কার্যকর করার ব্যাপারে কোনও আগ্রহই দেখায়নি সরকার। বরং গত কয়েক বছরে জঙ্গল ধ্বংস করা হয়েছে যথেচ্ছভাবে। উন্নয়নের নামে নষ্ট করা হচ্ছে একের পর এক বন। বনচ্ছেদনের সঙ্গে সঙ্গেই উচ্ছেদ করা হচ্ছে বননির্ভর মানুষদেরও। তাদের জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতি তাতে বিনষ্ট হচ্ছে। নদী, গাছ ও বন্যপ্রাণ তো নির্বিচারে ধ্বংস হচ্ছেই। কেন্দ্রীয় সরকারের এই উদাসীনতা ও যথেচ্ছভাবে জঙ্গলনিধনের বিরুদ্ধেই গর্জে উঠেছে বনগ্রামগুলি।
আরও পড়ুন: দেদার জঙ্গল সাফাই! দুশ্চিন্তা কানহা, বান্ধবগড়ের মতো জঙ্গলের অস্তিত্ব নিয়েও
এদিন মহাজাতি সদনের ওই অনুষ্ঠানে একজোট হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের বহু বনগ্রাম। এছাড়া আদিবাসী, উপজাতি সম্প্রদায়ের বহু মানুষ সামিল হয়েছিলেন ওই অনুষ্ঠানে। উত্তরবঙ্গের রাভা জনজাতির একটা বড় অংশ হাজির হন সেখানে। প্রায় ১২০০ জন সদস্য হাজির হন অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন সুন্দর সিং রাভা, সুপেন হেমব্রম, প্রবীণ মোতে ( মহারাষ্ট্র), বিশ্বনাথ রাভা, অলোক শুক্লা ( হাঁসদেও) , নকুল বাস্কে, সীমাঞ্চল ( ছত্তীশগড়) ও অন্যান্যরাও। যেভাবে নির্বিচারে বনচ্ছেদন করে উন্নয়নের নামে পুঁজিবাদের চর্চা চলছে দেশ জুড়ে, তার বিরুদ্ধে সভায় গর্জে ওঠেন বক্তারা। এই অভিযোগ যে মিথ্যা নয়, তার প্রমাণ ছত্তীশগড়ের হাঁসদেও, সিকিম উত্তরবঙ্গের রংপো, পশ্চিমবাংলার ঠুড়ঙ্গা ও পাচামি, মহারাষ্ট্রের গাড়চিরোলির মতো জায়গা। ওই সভা থেকে বনে থাকা মানুষের অধিকারের প্রতি রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা এবং ক্রমাগত বনলুটের বিরুদ্ধে গ্রামসভা প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে সভায়। আজ থেকে নয়, দীর্ঘদিন ধরেই এর বিরুদ্ধে লড়ছে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি বনগ্রাম। তাদের তরফে জানানো হয়, কবে সরকারের 'গণতান্ত্রিক চেতনা' ফিরবে সেই অপেক্ষা না করে, বনাধিকার আইন, ২০০৬-এ অন্তর্ভুক্ত অধিকারগুলির বাস্তবায়ন শুরু করেছে তারা প্রতিটি গ্রামে গ্রামে। সরকারি বাধা সত্ত্বেও, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর থেকে দক্ষিণে, বহু জেলাতেই গ্রামসভা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই গ্রামসভা শুধুমাত্র প্রতিরক্ষার ঢাল নয়। গ্রামসভা তাদের কাছে স্বায়ত্তশাসন এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সুরক্ষিত করার হাতিয়ার। গ্রামসভার মধ্য দিয়েই সার্বিক ও সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে উঠতে পারে বলে দাবি তাদের।
বন-নির্ভর মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার এই লড়াই সম্পর্কে সরকার সব জানে। তা সত্ত্বেও তারা নির্বিকার। একাংশের দাবি, কেন্দ্রীয় সরকার সম্প্রতি 'বন সংরক্ষণ আইন (সংশোধন), ২০২৩'-এর মধ্য দিয়ে ঘুরপথে গ্রামসভাকে গুরুত্বহীন করে তুলে আমাদের লড়াইয়ের অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে। সমস্ত বন-নির্ভর মানুষের অস্তিত্বের ওপর সরাসরি আক্রমণ নামছে। নামাচ্ছে কর্পোরেটের ধামাধরা কেন্দ্রীয় শাসকদল যারা 'উন্নয়ন'-এর নামে বনের বেসরকারিকরণ, বনজ সম্পদের লুঠ এবং গ্রামসভার উচ্ছেদ চায়। যখনই এ ব্যাপারে কেন্দ্র সরকারকে প্রশ্ন করা হয়েছে, তখনই প্রতিবাদীদের 'উন্নয়নবিরোধী' বলে দাগিয়ে হয়েছে বলে অভিযোগ। বনগ্রামের তরফে এ দিন দাবি করা হয়েছে, সরকার যদি কখনও বিষয়টি বিবেচনা করে, তাহলে তারা দেখতে পাবে- কীভাবে পরিকাঠামোর অভাব, স্বাস্থ্য পরিষেবা ও শিক্ষার অভাব এবং দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়তে লড়তে শেষ হয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ জীবন। সমাজের এই মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধান করার বদলে, সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প- আমাদের বন, জমি, জীবিকা, ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে এক গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এখনও পর্যন্ত দেশ ও রাজ্যের অসংখ্য বন এই ভয়ঙ্কর ক্ষয়ক্ষতির যজ্ঞে তলিয়ে গিয়েছে। সেই সব জঙ্গলের পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। কিন্তু যা এখনও রয়েছে, সেসব সংরক্ষণ করা ভীষণ ভাবে জরুরি। কারণ গোটা বাস্তুতন্ত্রটাই কিন্তু একে অপরের উপর নির্ভরশীল। ফলে একটি কোনওভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে, অন্যগুলি ভেঙে পড়া অস্বাভাবিক নয়। বনে থাকা মানুষেরা বহু শতাব্দী ধরেই বনাঞ্চল রক্ষা করে এসেছে। মানব সমাজের সার্বিক মঙ্গল জনসংখ্যার কোনও এক অংশের উচ্ছেদের মূল্যে হতে পারে না বলেই দাবি করা হয়েছে এদিন। বন অথবা মানব সমাজের উন্নয়ন- এই দুইয়ের মধ্যে কোনও একটা বেছে নেওয়ার রাজনীতিকে সরাসরি 'না' বলা হয়েছে এদিনের সভা থেকে। বরঞ্চ তার বদলে বনগ্রামগুলি এমন এক বিকল্প ব্যবস্থা করতে চাইছে, যেখানে মানুষ ও প্রকৃতি- একে অন্যকে জড়িয়ে ভালো থাকতে পারে। চালু 'উন্নয়ন' ব্যবস্থাকে অস্বীকার করার কথাও বলা হয়েছে এদিনের সভায়। যেখানে বন-প্রকৃতি ও মানুষ- এই দু'য়েরই বেঁচে থাকার অধিকার সুরক্ষিত হবে, এমন এক সমাজব্যবস্থা তৈরি করার কথা বলা হয়েছে এদিনের এই সভা থেকে।
এদিনের এই যৌথমঞ্চ থেকে একগুচ্ছ দাবিদাওয়া তুলে দেওয়া হয়েছে সরকারের কাছে। সেগুলি হল—
- 'বন অধিকার আইন, ২০০৬' যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
- 'বন সংরক্ষণ সংশোধনী আইন, ২০২৩' অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।
- বনগ্রামে গ্রামসভা গঠনে সহযোগিতা না করা সমস্ত সরকারি কর্মকর্তাদের অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে।
- বনের জমি দখল বা যে কোনো সরকারি কাজ যা বনগ্রামে গ্রামসভার অধিকার লঙ্ঘন করে তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
আরও পড়ুন:বিপদের চরম সীমায় পৃথিবী! নির্বিচারে জঙ্গল কাটার যে মাশুল দিতে হবে আপনার সন্তানকেও…
যে বা যারা বনগ্রামের গ্রামসভার কাজে বাধা দেবে এবং দেশের বন ধ্বংস করবে তাদের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে হবে বনগ্রামের তরফে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে। বন এবং বন-নির্ভর আদিবাসী সহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের ক্ষতি করে এমন সমস্ত প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ভবিষ্যতেও সার্বিকভাবে রুখে দাঁড়ানোর কথাও বলা হয়েছে এদিনের সভামঞ্চ থেকে। লোকসভা ভোটের আগে এই ধরনের সভা এক অর্থে ভীষণ রকম প্রাসঙ্গিক বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। বিশেষত গ্রামীণ বনাঞ্চল এলাকার জনজাতি ও উপজাতির মানুষদের ভোটঅঙ্কের হিসেবে ভালোই প্রভাব ফেলতে পারে বনগ্রামের এই সভা বলেও মনে করছেন কেউ কেউ