কলঙ্কিত আরজি কর! কীভাবে রাধাগোবিন্দ তৈরি করেন শতাব্দীপ্রাচীন এই হাসপাতাল?
RG Kar Hospital History: রাধাগোবিন্দও বাবার দেখানো পথেই হাঁটেন। ডাক্তারি শিক্ষার পাশাপাশি বাংলায় ডাক্তারি পাঠ্যপুস্তক প্রকাশনার দিকে ঝোঁকেন তিনি
কলঙ্কের নাম আরজি কর! প্রতিদিন হাজারো মানুষ যে হাসপাতালে প্রাণ বাঁচানোর, সুস্থ হয়ে ওঠার আশা-স্বপ্ন নিয়ে আসেন, সেই হাসপাতালে এখন কেবলই দেওয়ালে দেওয়ালে ক্ষোভের দাগ, রক্তের দাগ, দুর্নীতির কলঙ্ক! অথচ এই আরজি কর হাসপাতালের ইতিহাস তো কম গর্বের ছিল না। ডাক্তার রাধাগোবিন্দ করের নাম অনুযায়ী তৈরি হওয়া এই আরজি কর হাসপাতালের অধুনা প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির অভিযোগ। এই হাসপাতালে চিকিৎসা করতে গিয়ে খুন ও ধর্ষিতা হয়ে গেলেন তরুণী চিকিৎসক! অথচ এই হাসপাতাল গড়েই উঠেছিল ইতিহাসের এক অদ্ভুত বাঁক বদলের পর্বে। সেই গর্বের ইতিহাস এই মুহূর্তে আবারও হয়তো মনে করা প্রয়োজন। মনে করা প্রয়োজন এক ঔপনিবেশিক দেশে কীভাবে হতদরিদ্র মানুষের সেবাই ছিল রাধাগোবিন্দ করের মতো চিকিৎসকদের একমাত্র লক্ষ্য!
ঔপনিবেশিক কলকাতার বিশিষ্ট চক্ষুবিশারদ চার্লস ম্যাকনামারার স্বপ্ন ছিল কলকাতায় একটি ভালো চক্ষু-হাসপাতাল তৈরি করার। এই হাসপাতাল তৈরির জন্য টাকা জোগাড় করতেই থিয়েটারের কিছু মানুষকে অনুরোধ করেন তিনি। পরিকল্পনা হচ্ছে, নাটকের উপস্থাপনা করে যে টাকা উঠে আসবে তা হাসপাতাল তৈরির কাজে ব্যবহৃত হবে। ১৮৭৩ সালের ২৯ মার্চ। টাউন হলে অভিনীত হয় দীনবন্ধু মিত্রের বিখ্যাত নাটক ‘নীলদর্পণ’। টিকিটের দাম সেই সময়ের নিরিখে বেশ বেশি! দু’টাকা। এই নাটকে অভিনয় করেছিলেন দুই ভাই, মাধু ও গোবি। এই গোবির ভালো নামই রাধাগোবিন্দ কর। ছোট ভাই মাধু, রাধামাধব কর বড় হয়ে ‘নাট্যাচার্য’ উপাধি পান।
আরও পড়ুন- আরজি করে মাদক, যৌনচক্র, মানব অঙ্গ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ! কেন চুপ মুখ্যমন্ত্রী?
রাধাগোবিন্দ করকে বহুমুখী প্রতিভা বললেও বোধহয় সবটা বোঝানো যায় না। নিজের বাড়িতেই জিমন্যাস্টিক্সের আখড়া খুলেছিলেন রাধাগোবিন্দ কর। শরীরচর্চা, সঙ্গীতচর্চা আর থিয়েটার ছিল রাধাগোবিন্দের পরিবারের শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত। আর ডাক্তারি ছিল এই শিকড়ের আদিতে। কীভাবে ডাক্তারির পেশায় এলেন রাধাগোবিন্দ? কীভাবেই বা তৈরি হলো আরজি কর হাসপাতাল?
১৮৩৫ সালে মেকলে সাহেব কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ তৈরি করেন। তিনি চেয়েছিলেন ইংরেজি শিক্ষিত আধা-সাহেব বাঙালি ডাক্তার তৈরি করতে। কিন্তু ভাষা বড় বালাই! ইংরেজিতে ডাক্তারি পড়তে পারার মতো বাঙালি নেই। এদিকে ইংরেজদের ডাক্তারদের চাহিদা বাড়ছে। ১৮৪৫ সালে ইংরেজির পাশাপাশি ওই কলেজে হিন্দুস্থানি ক্লাস শুরু হয়। ১৮৫২ সালে এখানে বাংলা ক্লাসও শুরু করা হয়। কিন্তু বাংলায় ডাক্তারি পড়াবেন কে? বাংলাতে লেখা ডাক্তারির বইও নেই তখন। তখন মেধাবী ছাত্রদের বেছে নিয়ে সহকারী অধ্যাপক রূপে নিযুক্ত করা হয়। রাধাগোবিন্দের বাবা দুর্গাদাস কর ছিলেন তাঁদেরই একজন। দুর্গাদাস পড়াতেন মেটিরিয়া মেডিকা, অর্থাৎ ভেষজ তত্ত্ব। এখানে পড়াতে পড়াতেই তিনি মেটেরিয়া মেডিকা বিষয়ে বাংলাতে একটি বই লেখেন ‘ভৈষজ্য রত্নাবলী’।
পরবর্তীকালে রাধাগোবিন্দও বাবার দেখানো পথেই হাঁটেন। ডাক্তারি শিক্ষার পাশাপাশি বাংলায় ডাক্তারি পাঠ্যপুস্তক প্রকাশনার দিকে ঝোঁকেন তিনি। বাবার মতোই নিজেও আধুনিক ভেষজতত্ত্ব নিয়ে প্রথম বই লেখেন। পরে ‘ভিষক-সুহৃদ’, ‘এনাটমি’, ‘কর-সংহিতা’, ‘সংক্ষিপ্ত ভেষজতত্ত্ব’, ‘সংক্ষিপ্ত শিশু ও বালক চিকিৎসা’, ‘রোগী-পরিচর্যা’, ‘নতুন ভেষজতত্ত্ব’, ‘প্লেগ’, ‘স্ত্রীরোগচিকিৎসা’, ‘গাইনোকোলোজি’ এবং ধাত্রীসহায়-এর মতো একাধিক বই লেখেন রাধাগোবিন্দ। ১৮৯৮ সালে কলকাতায় প্লেগের আতঙ্ক দেখা দিলে রাধাগোবিন্দ একটি ছোট বই লেখেন প্লেগের হাত থেকে বাঁচার 'টিপস' হিসেবে।
আরও পড়ুন- চড়া দামে ব্যবহৃত সিরিঞ্জ, গ্লাভস, তুলো, প্রস্রাবের ব্যাগ বিক্রি করেছেন সন্দীপ ঘোষ?
বিলেত থেকে চিকিৎসা নিয়ে পড়াশোনা করে ফিরে ১৮৮৬ সালে মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অক্ষয়কুমার দত্ত, বিপিন মৈত্র, কুমুদ ভট্টাচার্য প্রমুখের সঙ্গে মিলিত হয়ে রাধাগোবিন্দ একটি নতুন বেসরকারি মেডিক্যাল স্কুল গঠনের চেষ্টা শুরু করেন রাধাগোবিন্দ। বৈঠকখানা রোডের ভাড়া বাড়িতে তৈরি হওয়া এই স্কুলটির নাম ছিল ‘ক্যালকাটা স্কুল অব মেডিসিন’। ১৯০২ সালে এই স্কুল উঠে আসে রাধাগোবিন্দের নিজস্ব বাড়িতেই। স্কুলের সঙ্গে সেই প্রথম, মাত্র ৩০টি শয্যা নিয়ে যুক্ত হয় নিজস্ব হাসপাতাল। পরে স্কুলটি নীলরতন সরকারের তৈরি ‘কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জেনস’-এর সঙ্গে মিলে যায়। স্কুলটি ১৯১৬ অবধি চলে। তারপর ‘বেলগাছিয়া মেডিক্যাল কলেজ’ নামে সরকারি স্বীকৃতি পায় এই স্কুল। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পেয়ে এই কলেজের নাম হয় ‘কারমাইকেল কলেজ’। তখন অবশ্য রাধাগোবিন্দ প্রয়াত। ১৯১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। জীবদ্দশায় কখনই রাধাগোবিন্দ নিজে অধ্যক্ষ হননি এই কলেজের। হাসপাতালের পরিচালনার দায়িত্বে ছিল ‘মেডিক্যাল এডুকেশন সোসাইটি অব বেঙ্গল’ নামে একটি সংগঠন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কলেজটি অধিগ্রহণ করে। তখন থেকে এই কলেজ ও হাসপাতালের নাম হয় ‘আর জি কর হাসপাতাল’।
ঐতিহাসিক এই কলেজ এই গর্বের জন্য দেশের সংবাদ শিরোনামে নেই। এখন আরজি কর দেশের চোখে 'ক্রাইম স্পট'। এই হাসপাতালেই কর্তব্যরত অবস্থায় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তরুণী চিকিৎসক। এই হাসপাতালেই ভাঙচুর চালিয়েছে দুষ্কৃতীরা। এই হাসপাতালেই বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য, মানব দেহ, মানব অঙ্গ পাচারের চক্র চলার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে খোদ প্রাক্তন অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। শাসকের কৃপাধন্য হয়ে যিনি বছরের পর বছর এই ঐতিহাসিক হাসপাতালকে কলঙ্কিত করেছেন বলে অভিযোগ! রাধাগোবিন্দ করের পরিবারও প্রতিবাদে নেমেছে পথে, বিচার চেয়ে আওয়াজ তুলেছে। এই হৃতগৌরব ফিরবে কিনা, বিচার আদৌ হবে কিনা সেই প্রশ্নের উত্তর যদিও অজানাই এখনও!