ফ্যান উথলে পড়ে যাচ্ছে ঢাকনা! ৩০০ বছর আগের যে ঘটনাই বদলে দিয়েছিল পৃথিবীকে

Steam Engine : পেপিন প্রথাগতভাবে ডাক্তারির ছাত্র। সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে তিনি বানিয়েছিলেন স্টিম ডাইজেস্টার, যার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে ভবিষ্যতের প্রেসার কুকার।

ছোটবেলায় অনেকেই দেখেছি মায়েরা কাঠের উনোনে ভাত রান্না করতেন, এখনও অনেকেই করেন গ্রামাঞ্চলে। ভাত ফুটে যাওয়ার পরে হাঁড়ির ঢাকনা ঠেলে ফ্যান উপচে পড়ত। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি এমন হতো যে, ঢাকনাটিকে হাঁড়ির মুখে চেপে রাখাটাই অসম্ভব। এমনকী ঢাকনার উপরে ভারী কোনও জিনিস চাপা দিয়ে রাখলেও উত্তপ্ত বাষ্প তাকেও ঠেলে ফেলে দেয়। শোনা যায়, এই কাজটাই করার চেষ্টা করছিল এক কিশোর, আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর আগে। বারবার সে দেখছিল ঢাকনাটা পড়ে যাচ্ছে। কী মুশকিল! ছোটবেলায় আমরাও তো তাই দেখেছি। কে ঠেলছে এই হাঁড়ির ঢাকনা? এই বাষ্পের ভেতরে তাহলে নিশ্চয়ই একটা শক্তি জমা হচ্ছে, যা ঢাকনাকে ঠেলে ফেলে দিচ্ছে। ব্যাপারটা ভাবিয়ে তুলল কিশোরটিকে। সে চিন্তা করল, তাহলে এই শক্তি দিয়েই তো আমাদের রোজকার জীবনের কাজগুলো সেরে ফেলতে পারি অনায়াসে। সেই কৌতুহলী কিশোরই ছিলেন পৃথিবী বদলানোর অন্যতম কারিগর জেমস ওয়াট। কিশোর জেমস সম্পর্কিত এই গল্পটি বহু আলোচিত। এর আগেও বাষ্পের শক্তি ভাবিয়েছে অনেক প্রজন্মকে কিন্তু জেমসের বুদ্ধির পালে ভর করেই বদলেছে সভ্যতার গতিপথ, মানুষ অবাক হয়ে দেখেছে এভাবেও পরিবর্তন আনা সম্ভব।

জল ফুটিয়ে উৎপন্ন বাষ্পের শক্তি দিয়ে যে কিছু কাজ করা যায়, এই বুদ্ধি টমাস নিউকোমেন ও টমাস স্যাভেরি নামক দুই ব্রিটিশ যন্ত্র বিশারদের মাথাতেও এসেছিল একশো বছর আগেই। সেই মতো কিছু যন্ত্রও তাঁরা বানিয়েছিলেন। তাঁদেরও আগে ডেনিস পেপিন নামে একজন ফরাসি স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সর্বপ্রথম এই বাষ্পীয় ইঞ্জিনের ধারণা দেন বলে জানা যায়। পেপিন প্রথাগতভাবে ডাক্তারির ছাত্র হলেও, তিন কালজয়ী বিজ্ঞানীর (হাইগেনস, বয়েল ও হুক) সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন অনেকদিন। সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে তিনি বানিয়েছিলেন স্টিম ডাইজেস্টার, যার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে ভবিষ্যতের প্রেসার কুকার। ১৬৯০ সালে তিনি ও বিখ্যাত গণিতজ্ঞ লিবনিজ যৌথভাবে তৈরি করেন বাষ্পীয় ইঞ্জিনের তাত্ত্বিক মডেল। সেটা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বারবার আবেদন সত্ত্বেও কোনও আর্থিক অনুদান দেয়নি তৎকালীন রয়াল সোসাইটি। সোসাইটির মাথায় তখন নিউটন। কলনবিদ্যা অর্থাৎ ক্যালকুলাস কে তৈরি করেন? নিউটন না লিবনিজ? সেই বিতর্কের কোনও সমাধান আজও হয়নি। পরবর্তীতে, ১৬৯৮ সালে টমাস স্যাভেরি পেপিনের এই মডেলের উপর নির্ভর করেই বানান মাইনাস ফ্রেন্ড নামে জল তোলার পাম্প। এদিকে টমাস নিউকোমেনও ততদিনে বানিয়ে ফেলেছেন বাষ্পীয় ইঞ্জিন, যার নাম ছিল নিউ কোমেন ইঞ্জিন। পেয়ে গিয়েছেন পেটেন্টও।

আরও পড়ুন- ঘোড়ার দড়ি ছিঁড়ে জন্ম নিল ‘একাকী ঢেউ’! বিজ্ঞানের সব বোঝাপড়া তোলপাড় যে আবিষ্কারে…

এই মেশিনের গঠন ছিল খুবই সাধারণ। একটা বয়লারে জল ফোটানো হতো, উৎপন্ন বাষ্প একটা পাইপের ভেতর দিয়ে যেত মেশিনে। সেই বাষ্পের চাপে মেশিনের ভেতরে থাকা পিস্টন ওঠা নামা করত। ফলে পিস্টনে একটা সরলরৈখিক গতির সৃষ্টি হতো। একটা ধাতব দণ্ডের সাহয্যে সেই সরলরৈখিক গতি থেকে প্রাপ্ত শক্তি পরিবর্তিত করা হতো ঘূর্ণনে, যা দিয়ে মেশিন চালানো হতো। তখনকার দিনে, সাধারণত খনি থেকে জল তুলতে এই ইঞ্জিন ব্যাবহার করা হতো কিন্তু সেগুলো খুব একটা কাজের ছিল না। তাদের পিছনে যা জ্বালানি পুড়তো লোকজনের তাতে বিশেষ লাভ হতো না।

 

পরিবর্তে জেমসের বানানো বাষ্পীয় মেশিন অনেক বেশি কাজের। তরুণ জেমস তখন বিখ্যাত গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষ মেকানিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের পাশেই তাঁর কর্মশালা। সপ্তদশ শতাব্দীর ষাটের দশকে তিনি ঘাঁটাঘাঁটি করছেন পেপিনের স্টিম ডাইজেস্টার নিয়ে। কী করে তার কার্যক্ষমতা বাড়ানো যায়? ইতিমধ্যে, গ্লাসগোর নামকরা অধ্যাপক অ্যান্ডার্সন তলব করলেন জেমসকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একখানা নিউকোমেন ইঞ্জিন বিগড়ে গেছে, মেরামত করতে হবে। দক্ষ প্রকৌশলী ওয়াট ইঞ্জিনের সিলিন্ডারের বাষ্প ধারণ ক্ষমতা মাপলেন তার নিজের তৈরি যন্ত্র দিয়ে। সেই সঙ্গে মাপলেন সিলিন্ডারের তাপগ্রহীতা। তিনি দেখলেন, এই ইঞ্জিনের কার্যক্ষমতা (কী পরিমাণ তাপের বিনিময়ে কতটা কাজ পাওয়া যাচ্ছে, তাদের অনুপাতই হচ্ছে কার্যক্ষমতা। কোনও ইঞ্জিন কত শক্তিশালী তা পরিমাপ করা হয় এই কার্যক্ষমতা দিয়েই) খুব কম। ওয়াট ইঞ্জিনের সিলিন্ডারের বাইরের দিকটা পর্যাপ্ত পরিমাণে ঠান্ডা করার ব্যবস্থা করেন, ফ্লাই হুইলও লাগিয়ে দেন। সেই সঙ্গে যোগ করে দেন একটি স্পিড কন্ট্রোলার বা বেগ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র। বিজ্ঞানের পরিভাষায়, কুলিং সিস্টেমকে উন্নত করেন জেমস, আর তাতেই ইঞ্জিনের কার্যক্ষমতা বেড়ে যায় বেশ কয়েকগুণ। কল-কারখানা, খনিতে রাতারাতি উৎপাদন বাড়তে লাগল। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চাহিদাও বাড়তে থাকল ওয়াটের এই বাষ্পীয় ইঞ্জিনের। ১৭৬৯ সালে ওয়াট পেয়ে যান বিখ্যাত এই যন্ত্রের পেটেন্ট।

ইতিমধ্যেই ওয়াটের সঙ্গে যুক্ত হন এক সফল উদ্যোক্তা, ম্যাথু বোল্টন। পেশাগতভাবে একজন ইঞ্জিনিয়র তিনি। তাঁরা দু'জন খুললেন বোল্টন-ওয়াট অ্যান্ড সন্স কোম্পানি। আরও গতি পেল বাষ্পীয় ইঞ্জিন উৎপাদনে। বিভিন্ন মিলে, কল-কারখানায় উৎপাদন বাড়তে লাগল হু হু করে। সারা ইউরোপ জুড়ে শুরু হয় শিল্পবিপ্লব। সাগর, মহাসাগরে এতদিন যে জাহাজ চলত পালের ভরসায়, তাতে লাগল মেশিন। রাজপথে ঘোড়ায় টানা গাড়ির বদলে এলো স্টিম ইঞ্জিন চালিত মোটর গাড়ি। আরও দ্রুত হলো মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা। সভ্যতার ইতিহাসে, এক নতুন যুগের সূচনা হলো, বাষ্পের যুগ।

More Articles