নয় মাসের ধাক্কা! কীভাবে দেহের ৩০ লক্ষ লোহিত কণিকা নষ্ট হয়ে গেল সুনীতা উইলিয়ামসের?

Sunita Williams: সুনীতা বেবিফিটের সমস্যা নিয়ে ফিরেছেন। এক্ষেত্রে পায়ের পাতা এতটাই পাতলা হয়ে গেছে যে স্বাভাবিক হাঁটতে গেলে কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে।

২০২৪ সালের ৫ জুন বুচ উইলমোরকে সঙ্গে নিয়ে বোয়িং সিএসটি-১০০ স্টারলাইনার ক্যাপসুলে চেপে তৃতীয়বার মহাকাশে পাড়ি জমিয়েছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মহাকাশচারী সুনীতা উইলিয়ামস। কথা ছিল তড়িঘড়িই ফিরে আসবেন, কিন্তু তা আর হলো কই! মহাকাশযানের হিলিয়াম গ্যাস লিক করে ঢুকে যাচ্ছিল প্রপালশন সিস্টেমে; অনেকগুলো থ্রাস্টারও ঠিকঠাক কাজ করছিল না, সেজন্য সেই ত্রুটিপূর্ণ ক‍্যাপসুলকে পৃথিবীতে খালি ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছিল নাসা। ফলস্বরূপ সুনীতা ও বুচের ৮ দিনের নভোসফর ২৮৬ দিন দীর্ঘায়িত হলো। আমাদের রোজের জীবনে অফিস যাওয়ার সময় লোকাল ট্রেন যদি সিগন্যালে মিনিট পনেরো দাঁড়ায়, বা বাইরে বেরিয়ে বৃষ্টিতে যদি আমরা আধঘণ্টাও আটকে পড়ি, তাহলে কী অবস্থা হয় ভাবুন, সেখানে সাড়ে নয় মাস!

প্রতিমুহূর্তে তাঁদের নিয়ে উদ্বিগ্ন থেকেছে মহাকাশপ্রেমী অগণিত মানুষ। গত ন'মাসে মাঝে মাঝেই সুনীতা ও বুচ বিশ্ববাসীর সঙ্গে ছোট ছোট মুহূর্ত ভাগ করে নিয়েছেন, বড়দিন পালন করেছেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন! মোদ্দা কথা, তাঁরা আশ্বাস দিয়েছেন, আশা জুগিয়েছেন যে দেরি হলেও ঠিকই ফিরে আসবেন। তারপরেও একটা শঙ্কা কাজ করছিল অনেকের মনে। যদি কোনও গণ্ডগোল হয়, নামার সময় যদি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় হঠাৎ করে! সেসব আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে, এলন মাস্কের ড্রাগনে চেপে তাঁরা পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন সফলভাবে কিন্তু তাঁদের শারীরিক অবস্থা আর আগের মতো নেই।

আরও পড়ুন- এবার আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে যাচ্ছেন ভারতীয় নভোশ্চর! নয়া মাইলফলক ছুঁতে পারবে ISRO?

এত অত‍্যাধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা সত্ত্বেও তাঁদের এমন কী শারীরিক ক্ষতি হলো? আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন পৃথিবী থেকে প্রায় ৪০৮ কিলোমিটার উপর দিয়ে ২৮ হাজার ১৬০ কিলোমিটার বেগে ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রতি ৯৩ মিনিটে এটি পৃথিবীকে একবার চক্কর খায়। অর্থাৎ দিনে প্রায় পনেরো বার ঘুরপাক খাচ্ছে। এই জায়গায় মহাকর্ষের টান প্রায় নেই বললেই চলে। বিজ্ঞানীরা এই পরিস্থিতির নাম দিয়েছেন ‘মাইক্রো গ্র্যাভিটি’ বা প্রায় ‘শূন্য মহাকর্ষ’। দীর্ঘ দিন এই অবস্থায় থাকলে মানব শরীরে বিভিন্ন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। মাধ্যাকর্ষণের (আমাদের হাড়ের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ) অনুপস্থিতিতে মানব শরীরে প্রতিমাসে শতকরা ১-১.৫ শতাংশ খনিজ পদার্থ ক্ষয় হতে থাকে, এমনকী নতুন করে হাড়ের কোষগুলি স্বাভাবিক হারে উৎপাদিতও হয় না। এর ফলে হাড়ের ঘনত্ব ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে, যা পৃথিবীতে ফেরত আসার পরে নভোচারীদের জন্য খুবই বিপজ্জনক। সুনীতা তো বেবিফিটের সমস্যা নিয়ে ফিরেছেন। এক্ষেত্রে পায়ের পাতা এতটাই পাতলা হয়ে গেছে যে স্বাভাবিক হাঁটতে গেলে কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে। মহাশূন্য থেকে ফেরার সময় স্পেস অ‍্যানিমিয়ায় আক্রান্ত হন সুনীতা। এই ক'মাসে তাঁর শরীর থেকে প্রায় ৩০ লক্ষ লোহিত কণিকা নষ্ট হয়ে যায়।

মাধ্যাকর্ষণের টানের অভাবে হৃৎপিণ্ড সহ শরীরের অন্যান্য পেশিগুলিও ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং শরীরের রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতিও পরিবর্তিত হয়। রক্তের প্রবাহ উর্ধ্বমুখী হয়ে পড়ে, ফলে মাথায় রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। শুধু রক্তই নয়, অন্যান্য তরল পদার্থও জমা হয় মাথায়, ফলে নভোচারীরা অবিরাম ঠান্ডার মতো অনুভূতি অনুভব করতে পারেন। এই অতিরিক্ত তরল পদার্থ নভোচারীদের চোখের ওপর চাপ সৃষ্টি করে চোখের তারারন্ধ্রকেও বিকৃত করে দেয়, ফলে ফিরে আসার পর তাঁদের দৃষ্টিশক্তির সমস্যা দেখা দিতে পারে। অনেকসময় মাথা ঘোরার মতো সমস্যায় ভুগতে হয় নভোচারীদের।

কিডনি মানব শরীরে শোধনের কাজ করে। কিন্তু ক্রমাগত হাড়ের খনিজ পদার্থ ক্ষয়ের ফলে কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। নাসার এক পরিসংখ্যানে গত দুই বছরে দীর্ঘ মহাকাশযাত্রাজনিত কারণে ৩০টিরও বেশি কিডনিতে পাথর হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

আরও পড়ুন- ২৮৬ দিন পর পৃথিবীতে! যে শারীরিক সমস্যায় জেরবার হতে হবে সুনীতা উইলিয়ামসদের

তারপর মহাকাশে উচ্চশক্তির কণাগুলির সংস্পর্শে আসার বিপদ তো রয়েছেই। পৃথিবীতে, আমরা চৌম্বকমণ্ডলের একটি আবরণ দ্বারা সুরক্ষিত এবং এই কণাগুলির ক্ষতিকারক প্রভাব সরাসরি আমাদের ওপর এসে পড়ে না কিন্তু মহাশূন্যে সেসব সুবিধা মেলে না। সাধারণত লো-আর্থ অর্বিটে ঘোরার সময় মহাকাশচারীদের যে বিকিরণের সম্মুখীন হতে হয়, তাতে ৬০০০ লোকের বুকের এক্সরে করা সম্ভব! এই উচ্চ শক্তি সম্পন্ন কণার স্রোত নভোচারীদের ওপর এসে পড়লে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়, বিশেষ করে স্পেস ওয়াকের সময়। এই মিশনের ক্ষেত্রে সুনীতা উইলিয়ামস তো ৬২ ঘণ্টা ৬ মিনিট স্পেস ওয়াক করেছেন, যা ইতিহাসের অন্য যে কোনও মহিলার চেয়ে বেশি।

এত প্রতিকূলতা, অনিশ্চয়তার মাঝে তাঁরা আশাহত হননি, বরং বিভিন্ন মৌলিক গবেষণা, আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনের বিভিন্ন যন্ত্রাংশের মেরামতি করে সময় ব‍্যয় করেছেন। মূলত বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের উন্নতিকরণের পাশাপাশি বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে সময় পার করেছেন এই দুই মহাকাশচারি। এমনকী স্পেস স্টেশনে কী করে বীজ থেকে অঙ্কুরোদগম করা যায়, সে বিষয়েও কাজ করেছেন সুনীতা ও বুচ। তবে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেছেন, সেটি হচ্ছে এই অনাকাঙ্খিত দীর্ঘ মহাকাশ যাত্রার ক্ষেত্রে কীভাবে শারীরিক সমস্যার মোকাবিলা করা যাবে। তাঁদের এই নভোসফর ভবিষ্যতে মহাকাশ অভিযানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হবে বলে বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস।

More Articles