যোগীর মুখ পোড়াল ইন্ডিয়া! রামরাজ্য যেভাবে বাজিমাত করলেন রাহুল-অখিলেশ জুটি

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অখিলেশের কৃতিত্বেই কংগ্রেসও উত্তর প্রদেশে আমেঠি, রায়বরেলি সহ আরও চারটি আসনে জয় পেয়েছে।

রামরাজ্যেও হোঁচট খেয়েছে বিজেপি। এনডিএ জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গড়েছে ঠিকই কিন্তু বিজেপি ২৪০ এ এসেই থমকে গেছে। কোথায় 'গেরুয়া ঝড়'? কোথায় 'মোদি ঝড়'? কোথায় '৪০০ পার'? ২০১৪ সালে উত্তরপ্রদেশে বড় জয় পেয়েছিল বিজেপি। সেই বছর ৭১টি আসনে জয় পেয়ে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়েছিল দল। মোদির ক্ষমতায় আসার পেছনে উত্তরপ্রদেশের আসন সংখ্যাই বড় ভূমিকা নিয়েছিল। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেই বিজেপির আসন সংখ্যা ৬২-তে নেমে আসে। ২০০৪ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকারের পতনের সময় ৮০টির মধ্যে মাত্র ১০টি আসন পেয়েছিল বিজেপি। ২০২৪-এর নির্বাচনে রামমন্দির প্রতিষ্ঠার আবেগকে কাজে লাগিয়েই বিপুল ভোটে জয় পাবে ভেবেছিল গেরুয়া শিবির। জয়ের আশায় অর্ধনির্মিত মন্দিরেই রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।

উত্তরপ্রদেশ থেকে খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি লোকসভার সাংসদ কিন্তু সেই উত্তরপ্রদেশেই, শুধুমাত্র আসন সংখ্যা কমল তাই না, রীতিমতো হারল বিজেপি। ওই রাজ্যে ৮০টির মধ্যে ৩৭টি আসনে জয় পেল এসপি। অন্যদিকে, বিজেপি পেল ৩৩ টি আসন। বিরোধী জোটসঙ্গী কংগ্রেস জিতেছে ৬ টি আসন। সহযোগী আরএলডি (রাষ্ট্রীয় লোকদল) ২টি, আপনা দল(এস) ১টি এবং নাগিনা আসনে একক শক্তিতে লড়ে জিতেছেন দলিত সংগঠন ভীম আর্মির প্রধান তথা আজাদ সমাজ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রশেখর আজাদ। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির মুখ পোড়ার সবচেয়ে বড় কারণ অযোধ্যা ও বারাণসীতে তাদের হার। মোদি নির্বাচনী প্রচারে যাঁদের 'শাহজাদা' বলেছিলেন, সেই দুই শাহজাদা, অখিলেশ যাদব ও রাহুল গান্ধিই টেক্কা দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে।

২০১৪ সালে বারাণসীতে ৩ লক্ষ ৭১ হাজার এবং ২০১৯ সালে ৪ লক্ষ ৭৯ হাজার ভোটে জয় পাওয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবার মাত্র ১ লক্ষ ৫২ হাজার ভোটে অজয় রাইকে হারিয়েছেন। অজয় রাই দু'বার প্রধানমন্ত্রী কাছে হেরেও ফের প্রার্থী হয়েছিলেন। অন্যদিকে, কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধি রায়বরেলি কেন্দ্র থেকে উত্তরপ্রদেশে সর্বাধিক ব্যবধানে জিতেছেন। সেই ব্যবধান ৩ লক্ষেরও বেশি। অখিলেশের সমাজবাদী পার্টি ৩৭টি কেন্দ্রে জিতে লোকসভায় তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে স্থান পেয়েছে। লোকসভায় বিজেপি, কংগ্রেসের পরই অখিলেশের দলের নাম। ফৈজাবাদ আসনেই রামমন্দিরের অবস্থান কিন্তু এখানেও বিজেপি সমাজবাদী পার্টির কাছে হেরে গিয়েছে।

আরও পড়ুন- কৃষক-ক্ষোভের আঁচ! যে যে ভুলে ৩৮টি আসন খোয়াতে হল বিজেপিকে?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছিলেন, অখিলেশ এবং রাহুলের জোট জয়ের মুখ দেখবে না। আবার, বুথফেরত সমীক্ষার ফল দেখে মনে করা হচ্ছিল, উত্তরপ্রদেশে একতরফা লড়াই হয়েছে। অন্যদিকে, ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোরও একই দাবি করেছিল কিন্তু তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী মেলাতে পারেননি। সর্বভারতীয় সংবাদ সংস্থায় একটি সাক্ষাৎকারে তিনি রাহুলের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, "তুমসে না হো পায়েগা"। পরামর্শ দিয়েছিলেন, রাহুল গান্ধির সরে দাঁড়ানো উচিত বলে। ভোটের চূড়ান্ত ফল বেরনোর তিনদিন পর, ভুল স্বীকার করেছিলেন তিনি। জানিয়েছিলেন, আর কোনওদিন ভোটের ভবিষ্যদ্বাণী করবেন না প্রশান্ত। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের পঞ্চম দফার শেষে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বিজেপি ২০১৯-এর রেকর্ড ধরে রাখবে। তাঁর দাবি ছিল, বিজেপি এবার ২৭০-এর নিচে নামবে না। ভোটের ফলে দেখা গেল কিছুই মিলল না। ভোটের ফল ঘোষণার তিনদিন পর তিনি বলেলেন, "আমি আর কখনও নির্বাচনের আসন সংখ্যা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করব না। আমি আমার বিশ্লেষণ আপনাদের জানিয়েছিলাম। আজ আমি সেই ক্যামেরার সামনেই মেনে নিচ্ছি আমার বিশ্লেষণে ভুল ছিল। শুধু ভুলই নয় তাতে ২০ শতাংশেরও তফাৎ ছিল।" তবে ভোটের ফলের সঙ্গে ভবিষ্যদ্বাণী না মিললেও বুথফেরত সমীক্ষার সঙ্গে তা মিলে গিয়েছিল।

গত বিধানসভা ভোটেই ধর্মীয় মেরুকরণের স্লোগান দিয়ে ভোটের ফলে বাজিমাত করেছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটেও মেরুকরণই তাঁদের মূল অস্ত্র ছিল। অন্যদিকে, বিরোধী দলনেতা অখিলেশ, রাহুলরা ঠিক করেছিল ধর্মীয় মেরুকরণের তাস তাঁরা খেলবেন না। একই রাজ্যে যেখানে বিজেপি হেভিওয়েট নেতা মন্ত্রীদের নিয়ে প্রচার করছিল, অখিলেশরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছে যেতে ছোট ছোট পথসভা করছিলেন যা সাজসজ্জায় তুলনামূলক সীমিত বলেই ধরা যায়। এই পথসভা থেকেই অখিলেশ সব স্তরের ভোট আনতে সফল হয়েছেন। একইভাবে প্রিয়াঙ্কা গান্ধি বঢরাও আমেঠি-রায়বরেলিতে পথসভা করেছিলেন।

চৌধুরী চরণ সিংকে বিজেপি সরকার মরণোত্তর ভারতরত্ন দিয়েছিল। এরপরই তাঁর নাতি জয়ন্ত সিং রাষ্ট্রীয় লোক দল ইন্ডিয়া জোট ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন। অখিলেশ তারপরও কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে লড়াই করে গেছেন। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে মায়াবতীর সঙ্গে জোট করেছিল অখিলেশের দল। এবার তাঁর দলিত ভোটব্যাঙ্কে প্রভাব ফেলতেই ১৫জন দলিতকে প্রার্থী করেন অখিলেশ। সপা থেকে মুলায়ম-অখিলেশের পরিবারের পাঁচজন যাদবকে প্রার্থী করা হয়। যাদব সম্প্রদায় বাদে ওবিসিদের মধ্যে থেকে আরও ২৭ জনকে প্রার্থী করা হয়েছিল। অন্যদিকে ১১ জন উচ্চবর্ণকেও প্রার্থী করেন তিনি। তালিকায় ছিল ৪ জন ব্রাহ্মণ, ২ জন ঠাকুর, ২ জন বৈশ্য, একজন পঞ্জাবি খত্রী। অখিলেশের এই কৌশলই রামমন্দিরের আবেগকে পিছনে ফেলে দিয়েছিল। অনগ্রসর, দলিত ভোটব্যাঙ্কই অখিলেশের ভোটবাক্স ভরাল। বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, অগ্নিবীর প্রকল্প নিয়ে ক্ষোভ, সংবিধান বদলে দেওয়ার আতঙ্ক রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে দিল। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অখিলেশের কৃতিত্বেই কংগ্রেসও উত্তর প্রদেশে আমেঠি, রায়বরেলি সহ আরও চারটি আসনে জয় পেয়েছে। দলিত পাসি সম্প্রদায়ের নেতা অবধেশ প্রসাদও বিপুল ভোট পেয়েছেন। উত্তরপ্রদেশে ইন্ডিয়া জোটের সাফল্যে অখিলেশকেই সর্বোচ্চ কৃতিত্ব দিচ্ছেন পর্যবেক্ষকরা।

মোদি বারবার 'ডবল ইঞ্জিন' নীতির কথা বলে থাকেন। যোগীরাজ্যে 'ডবল ইঞ্জিন' নীতি সত্ত্বেও ধাক্কা খেল বিজেপি। বিজেপির অন্দরেই মনে করা হচ্ছে, যোগী প্রচারে থাকলেও উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে তাঁর সক্রিয়তার অভাব ছিল। রামমন্দিরের নেপথ্যে যোগীর ভূমিকার অবহেলা করে মোদি শুধুমাত্র নিজেরই প্রচার করে গেছেন বলে নিয়মিত প্রচার চালিয়েছিলেন অখিলেশ। এই সব কিছু রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে দিয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। দলের অন্দরের অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রী যাঁদের প্রার্থী করার সুপারিশ দিয়েছিলেন তা নস্যাৎ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নিজের মতো প্রার্থী বাছাই করেছিলেন, যার জন্যই এখন ভরাডুবি। শাহ ওম প্রকাশ রাজভড়ের সঙ্গে আসন সমঝোতার সিদ্ধান্ত নিলে যোগী শিবির তাতে আপত্তি জানিয়েছিল। ভোটগণনার শেষে গেরুয়া শিবির যেন শাহ শিবির ও যোগী শিবিরে ভাগ হয়ে গেছে। শাহ শিবির যোগীকে হারের জন্য দায়ী করছে। মন্দির বানাতে যে বাসস্থান, দোকান ভাঙা পড়েছে তার ক্ষোভেই ভোটে এই ফল হয়েছে বলে তারা মনে করছে। অন্যদিকে, যোগী শিবিরের দাবি, বারাণসীর দায়িত্ব ছিল 'টিম নরেন্দ্র মোদি'র। গুজরাতের নেতাদের নিয়ে এসে প্রতিপত্তি বিস্তার, তাঁদের হাতেই সব প্রকল্পের বরাত, ওখানের নেতা এনে এই রাজ্যে দায়িত্ব দেওয়া এই সকল কিছুকে ক্ষোভের কারণ হিসেবে দেখছে যোগী শিবির। অন্যদিকে, বারাণসীতে কাশী বিশ্বনাথ করিডোর তৈরি নিয়েও সেখানের স্থানীয় বাসিন্দারা একাধিকবার অভিযোগ জানিয়েছেন। মোদির লোকসভা কেন্দ্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত গুজরাতি নেতারা সেদিকে নজর দেননি বলেই অভিযোগ তুলছে দল। উন্নাওয়ের সাংসদ সাক্ষী মহারাজ জয়ী হয়েছেন কিন্তু আবারও ব্যবধান কমেছে। তিনি অন্দরের সংঘাতকেই কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। শাহ রায়বরেলি থেকে রাজ্যের মন্ত্রী দীনেশ প্রতাপ সিংহকে প্রার্থী করেছিলেন, তাতে স্থানীয় বিধায়ক অদিতি এবং আরও বেশ কিছুজন ক্ষুব্ধ হয়ে প্রচারগুলিতে আসা বন্ধ করে দেন। বিজেপির বিদয়ী সাংসদ লাল্লু সিং, মন্দিরই তাঁকে নির্বাচনে জিতিয়ে দেবে এই আত্মবিশ্বাসে নির্বাচনী প্রচারই করেননি। ভোট আবহেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠছিল। উত্তরপ্রদেশের ভোটের ফল সেই জল্পনা আরও বাড়িয়ে দিল।

আরও পড়ুন- ধ্রুব রাঠী, রভীশ কুমাররা পারেন, বাংলার ইউটিউবাররা পারেন না কেন?

সে রাজ্যে গত বিধানসভায় ভোটে দেখা গিয়েছিল, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের মুসলিম মহিলাদের ভোট অনেকটাই বিজেপিতে গিয়েছিল। কিন্তু এবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেভাবে মুসলিমদের বিরুদ্ধে কটাক্ষ করেছেন, তাতে অখিলেশ যাদবের পাল্লাই ভারী হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। উত্তরপ্রদেশে মোট জনসংখ্যার ২০-২২ শতাংশ মুসলিম। ২০২২ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছিল, অন্তত ৮-৯% মুসলিম ভোট গিয়েছিল বিজেপিতে। চলতি লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে, হিন্দু ভোট মেরুকরণের লক্ষ্যে মুসলিমদের সব থেকে বেশি আক্রমণ শানিয়েছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজে। এতে বিরোধী জোট ইন্ডিয়াকেই সমর্থন পেতে লাভ করে দেওয়া হয়েছে। মুসলিম সমাজ থেকেও যে বিপুল অংশের ভোট বিজেপিতে আসতে পারে তা ২০২২-এর উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন থেকে ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। এক সময় দল সিদ্ধান্তেও এসেছিল, মেরুকরণের রাজনীতি ছেড়ে প্রচার করবে উন্নয়নের কথা কিন্তু উন্নয়নের ফিরিস্তি যেন বিজেপির '৪০০ পার' লক্ষ্যপূরণের আশ্বাস দিতে পারছিল না। শেষে চড়া গলায় মুসলিমদের আক্রমণের পথকেই বেছে নিয়েছিলেন মোদি।

বলা হয়, যেখান থেকে উত্থান হয়, সেখানেই পতনের বীজ বোনা থাকে। ২০১৪-র 'গেরুয়া ঝড়'-এর পর ২০২৪-এ বিজেপির ফল তা আরও একবার প্রমাণ করল। এই একটি রাজ্যই বিজেপিকে মজবুত করেছিল। ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রধানমন্ত্রী দিয়েছে এই রাজ্যই। প্রসঙ্গত, মোদি ১২ বছর গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকলেও, উত্তরপ্রদেশ হয়েই সংসদে গিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে ওই রাজ্যের বারাণসী আসনে জয় পেয়েই প্রথমবারের মতো সাংসদ হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, ভারতের যে অংশটা 'হিন্দি বলয়' বা 'গো বলয়' নামে পরিচিত তার গোড়াটাই হলো উত্তরপ্রদেশ। মোদির গ্যারান্টির পরও স্বয়ং রাম জন্মভূমিতে হেরে গেল বিজেপি। কাশীতে গিয়ে বলেছিলেন, মুসলমানরা হিন্দুদের মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নেবে। সেই কেন্দ্রে আড়াই লক্ষ ভোটে হেরেছে বিজেপি। বলেছিলেন, "এসপি এবং কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে রামলালাকে আবার টেন্টে ফিরিয়ে দেবেন আর রামমন্দিরে বুলডোজার চালিয়ে দেবেন। এদের যোগীর থেকে শেখা উচিত বুলডোজার কোথায় চালানো উচিত।" এই সকল কথার পরও রাজ্যবাসী বিজেপিকে হারিয়েছে। এরপর আশা করা যায় মোদি আর ২০৪৭-এর কাল্পনিক ভারতের কথা ভাববেন না।

More Articles