এই কেফিয়ের একটি সুতোও যেন গাজার না হয়...
America And War-torn Gaza: দেখলাম ক্যাফেতে আরো অনেকের গলায়-মাথায়-পিঠে জড়ানো অমন কেফিয়ে।সেই কেফিয়ে, যা জড়িয়ে কয়েক হাজার গাজার শিশুদের দাফন করা হয়েছে গত কয়েক সপ্তাহে।
সায়মা জামশেদ। আমার বন্ধু, প্রতিবেশিনীও বটে। ২০২৩ সালের সেরা প্রাপ্তিগুলোর দিকে ফিরে তাকালে মনে পড়ে দুই নতুন বন্ধুর মুখ। তাঁদের একজন অবশ্য থাকেন সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড়ে। অন্যজন বাড়ি থেকে মাত্র মিনিট পাঁচেক দূরে।
লাহৌরি মা ও রাজশাহী বাবার কন্যা সায়মা। তাঁর বেড়ে ওঠা করাচিতে। যদিও গত দু'দশক ধরে তিনি অভিবাসী। সায়মার সঙ্গে কীভাবে পরিচয় হয়েছিল, ঠিক মনে পড়ে না। শুধু মনে আছে একটি হোলির অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানেই সম্ভবত প্রথম দেখা তাঁর সঙ্গে। যেখানে অকপটে সায়মা স্বীকার করে নিয়েছিলেন, তিনি AA। তাই তিনি ওই 'বিশেষ' পানীয়টি ছোঁবেন না। আমেরিকায় 'AA'-শব্দের মানে হল অ্যালকোহলিকস অ্যানোনিমাস। মদ্যাসক্তি কাটানোর জন্য নিবেদিত একটি সাপোর্ট নেটওয়ার্ক। তাঁর সেই দ্বিধাহীন স্বচ্ছতা এবং স্বতঃস্ফূর্ত ভাব সেদিন ভালো লেগেছিল আড্ডায় সকলেরই। পরে কবে যেন বন্ধু হয়ে উঠি আমি ও সায়মা জামশেদ।
আমরা প্রায়ই একসঙ্গে রান্নাবান্না করি। গান শুনতে যাই, বাজারও করতে যাই মাঝেমধ্যেই। সায়মা জামশেদ একজন প্রতিষ্ঠিত নৃত্যশিল্পী। পাশাপাশি কাওয়ালি শিল্পীদের সঙ্গে চমৎকার ঢোলকে সঙ্গতও করেন। যা আবার স্থানীয় রেডিও চ্য়ানেলে সম্প্রচারিত হয়। কোভিডকালে আমার অসুস্থতার দিনে বাড়ি বয়ে এসে খাবার পৌঁছে দিয়ে যান সায়মা। উদারমনা, নারীবাদী সায়মা তাঁর সিন্ধ প্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে একটি স্কুল চালান। আর তার জন্য় সারা বছর ধরে নানা ভাবে অর্থ সংগ্রহ করেন তিনি। কখনও অর্থসাহায্য মেলে পরিজনদের কাছ থেকে, তো কখনও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন বন্ধুবান্ধব। সাইমা জামশেদ ডেমোক্র্যাট। বারাক ওবামাকে ভোট দিতেন তিনি বরাবর। বারাক ওবামা ক্ষমতায় থাকাকালীন, পাকিস্তানে অন্তত ৩৭৩ বার বোমা বর্ষণ করেছে আমেরিকা, যাতে কয়েকশো নিরীহ মানুষের প্রাণ গিয়েছে। সাইমা জামশেদ ভুলতে পারেন না সেই শোক। তবু সায়মা জামশেদ ওবামাকেই ভোট দিয়েছেন প্রতিবারও। ভোট দিয়েছেন জো বাইডেনকে।
আরও পড়ুন: যুদ্ধের বাজারে জ্বালানি অমিল! মাটির সাবেক উনুনে ফুটে ওঠে ভাতই ভরসা এখন বিধ্বস্ত গাজায়
২০২৩-র শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এ কথা বললে বোধহয় খুব ভুল হবে না যে আমেরিকার রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা আজ চরমে পৌঁছেছে? দেশের উত্তর-পূর্ব উপকূলের সাতটি রাজ্য আর পশ্চিম উপকূলের তিনটি রাজ্যের সঙ্গে দেশের কেন্দ্রীয় রাজ্যগুলোর বিভাজন ক্রমশই বেড়ে চলেছে। কট্টর থেকে কট্টরতর হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক বাতাবরণ। রক্ষণশীল সুপ্রিম কোর্টেও এসে পড়েছে দুর্নীতির সেই ছায়া। কংগ্রেসে ২০২০-নির্বাচনের পরে পরেই ৬ জানুয়ারি নাগাদ ভয়াবহ এক দাঙ্গার সাক্ষী ছিল ওয়াশিংটন। সেই ঘটনা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থকদের রমরমা বেড়েই চলেছে। আর সারা দেশে অগুনতি বন্দুকবাজ হামলা তো লেগেই রয়েছে। এ সবের মধ্যে স্বস্তি কোথাও নেই। যেসব রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন জো বাইডেন, সেগুলির থেকে আজ অনেকটাই পিছু হঠেছেন তিনি। অভিবাসী প্রবেশ রুখতে দেশের দক্ষিণে দেওয়াল বানানো হচ্ছে, আলাস্কাতে তেল তোলার ছাড়পত্র দিয়েছে তাঁর সরকার। চিন বা ভারত কারওর সঙ্গেই সম্পর্ক দারুণ কোনও উন্নতির কথা শোনা যাচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাইডেনের সময়কালে দু'টি বড় যুদ্ধ শুরু হয়েছে এবং চলছে। একটি ইউক্রেনে এবং আরেকটি গাজায়। আর এই দুই যুদ্ধের সঙ্গে আমেরিকা নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েছে। বিশেষত গত আড়াই মাসে গাজায় নিহত প্রায় ১৯ হাজার ফিলিস্তিনির রক্তে লাল হয়ে রয়েছে বাইডেন প্রশাসনের হাত। গত আড়াই মাসে আমেরিকা আর ঋষি সুনকের ব্রিটেন ছাড়া ইজরায়েলের পক্ষে প্রায় কেউই আর নেই। দেশের ৬০%-রও বেশি মানুষ গাজায় যুদ্ধবিরতি চাইলেও বাইডেন সরকার ইজরায়েলকে সমরাস্ত্র বিক্রিতেও বেশি আগ্রহী। এরই মধ্যে সম্পূর্ণ বিষয়টিকে গুলিয়ে দেওয়ার জন্য আসছে আরও একটি ভোট। ২০২৪-র নির্বাচন, যেখানে বাইডেনের প্রতিপক্ষ হতে চলেছেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট তথা রিপাবলিকান নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প। যিনি আবার নাকি এরইমধ্যে ঘোষণাও করে দিয়েছেন যে তিনি ফের প্রেসিডেন্ট হলে অন্তত প্রথম কয়েকটা দিন তো একজন স্বৈরাচারীর মতো ব্যবহার করবেনই।
অতএব সায়মা জামশেদ আগামীবারেও জো বাইডেনকেই ভোট দেবেন। সত্যি কথা বলতে, প্রতিপক্ষ ট্রাম্প হলে হয়তো উন্মাদকেও ভোট দিতে রাজি হয়ে যাবেন অনেকে। লেসার ইভিল অর্থাৎ নিরন্তর কম মন্দকে সিংহাসনে বাছতে থাকাই এখন মার্কিন রাজনীতির মূল কথা।
সান ফ্রান্সিস্কো বে এরিয়াতে শীতকাল দৃশ্যতই বিষন্ন। সেপ্টেম্বরের পর থেকেই দিন ছোট হয়ে আসতে থাকে। নভেম্বর দিনের জন্য আলো বাঁচানোর পাগলামিতে ঘড়ির কাটা পিছিয়ে যায় এক ঘন্টা করে। ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় টানা বৃষ্টি। বছরের এই সময়টাই দেশের সব বড়ো জলাধারগুলির ভরে ওঠার মরশুম। এই জল দিয়েই গোটা দেশের ৪০ শতাংশ ফল ও সবজি চাষ হয়। বিখ্যাত নাপা ভ্যালির ওয়াইনক্ষেতের আঙুর গাছগুলিতে প্রাণ আসে। স্কি রিসর্টগুলোতে শুরু হয় দাপাদাপি। তবে এই কনকনে ঠান্ডায় আর একটানা বৃষ্টির মধ্যে, বিশেষত বিকেলের পর ঘরবন্দি হয়ে থাকা ছাড়া আর বিশেষ কোনও উপায় খোলা থাকে না হাতে।
ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বেলে এগনগ-এ হুইস্কি মিশিয়ে বই পড়ে সন্ধেটা কাটছিল কোনওমতে। এমন সময় সায়মা এসে হাজির। তাঁর বাড়ির পাশে বার্কলে ইউনিভার্সিটির কাছে আমার পুরোনো পাড়ায় নাকি একটি নতুন ক্যাফে খুলেছে। সেখানে দারুণ দারুণ সব চা পাওয়া যায় বলেও শুনেছি। আদেনি চা, ইয়েমেনি সুগন্ধি দুধ চা! আমি অবশ্য সূর্যাস্তের পর চা-কফিতে ঘোর অবিশ্বাসী। তবে ঘরবন্দি থাকার চেয়ে অবশ্যই ক্যাফে দেলাহ-তে যাওয়াটা লোভনীয় বিকল্প…
অগত্যা বেরিয়ে পড়া গেল। ক্যাফে দেলাহতে পৌঁছলাম যখন, তখন সন্ধে প্রায় সাড়ে সাতটা। দেখি, নানান বয়সের পড়ুয়া, বিশ্ববিদ্যালয়কর্মী, প্রতিবেশী ও পর্যটকের ভিড়ে গমগম করছে ক্যাফে। মৃদু আরবিক টানে ইংরেজিতে কথা বলছেন ক্যাফে-কর্মীরা। আদেনি চা আর কুনাফে অর্ডার করে ক্যাফের কোণে একটা টেবিলে বসলাম। জলের গ্লাস নিয়ে ফিরে এসে সায়মা বললেন, "দেখেছ? আমি বললাম- "কী?" ও চোখ দিয়ে ইশারা করল, পাশে বসা তিনটি মেয়ের দিকে…
পাশে বসে হোমওয়ার্ক করছে তিনটি মেয়ে। মাথায় হিজাব, গলায় কেফিয়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম ক্যাফেতে আরো অনেকের গলায়, মাথায়, পিঠে জড়ানো অমন কেফিয়ে।
সেই কেফিয়ে, যা জড়িয়ে কয়েক হাজার গাজার শিশুদের দাফন করা হয়েছে গত কয়েক সপ্তাহে। এই ক্যাফেতে বসে থাকা তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীরা হয়তো কোনও এক হতভাগ্য শিশুর আত্মীয়, হয়তো বা তাঁদের জন্য সহানুভূতিশীল। কিংবা নেহাৎই ফ্যাশনের তাড়নায় গায়ে তুলে নিয়েছে ওই সাদা কালো প্রতিবাদ। আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদের সাতমহলা প্রাসাদের সিন্দুকে এক দশক কাটানোর পর কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যে- সব গুলিয়ে যায়। সব কিছুকেই আপেক্ষিক মনে হয়… তবু…
আরও পড়ুন:মেরুদণ্ড টুকরো টুকরো করে দিয়েছে ইজরায়েলি বোমা! যেভাবে অথর্ব হচ্ছে গাজার শিশুরা
মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ! তাই চোখ বুজে এই অবিশ্বাসী আমি একবার প্রার্থনা করে নিলাম- 'জয় রামকৃষ্ণ', মনে মনে বললাম, "এই কেফিয়ে জড়িয়ে বসে থাকা তরুণ-তরুণীদের কারওর শিকড় যেন গাজা না হয়…"