বাউরি, কোড়া, সাঁওতালদের মধ্যেও উগ্র হিন্দুত্ব কীভাবে জাগাচ্ছে বিজেপি?

BJP and Adivasi Vote : আদিবাসীগ্রামগুলিতে পদবিতে রুইদাস অথচ ধর্মে খ্রিস্টান বা বাউরি অথচ ধর্মে খ্রিস্টান এই সংখ্যা কম নয়।

তখনও নতুন ভারত তৈরি হয়নি। মানে রামমন্দিরে রামলালা (নাকি লাল্লা!) বিরাজমান হননি। আমার শিকড় একেবারে ঝাড়খণ্ড লাগোয়া আসানসোলে। আসানসোলকে সোজাসাপটা ভাগ করতে হলে মূলত দুইভাগে চিরে দেওয়া যায় স্টেশনকে মাঝে রেখে। রেললাইনের এদিক আর ওদিক। একদিকে সমস্ত আলো, সংস্কৃতি, মল, উন্নয়নের বাঁশ ও প্যান্ডেল। অন্যদিকে সন্ধ্যা হলে আলো নিভিয়ে দেওয়া পাড়া, নোংরা খালপাড়, উন্নয়নের বাঁশ এসেছে, প্যান্ডেল গড়া হয়নি। এমনই এক এলাকাতে, মাস খানেক আগে একগুচ্ছ মহিলা খিলখিলিয়ে ফিরছিলেন অপর পাড়ার আসানসোল থেকে। এরা সকলেই বাউরি, রুইদাস গোত্রের। কেউ অন্যের বাড়ি কাজ করেন, কেউ পাড়ায় চায়ের দোকান, কেউ বা ঘরেই। গেছিলেন কোথায়? জানা গেল, বিজেপির এক নেতার ডাকে কোনও ধর্নায় যোগ দিতে। যেতেই পারেন, তাতে চাপ নেই। কিন্তু মজার বিষয় হলো, এরা কয়েক মাস আগেই তৃণমূলের ডাকা ব্রিগেডেও গেছিলেন। ব্যবহার্য ভিড়ের অংশ তারা।

যেদিন নতুন ভারত তৈরি হলো, অর্থায় রামলালা (লাল্লা হবে কিনা এক প্যারাগ্রাফ পরেও ধন্দ কাটেনি) বিরাজমান হলেন, সেদিন জানা গেল, আসানসোলের সমস্ত বাউরিপাড়া, কোড়াপাড়ায় খিচুরি ভোগ খাওয়ানো হয়েছে। সারা দিনমান প্রসাদ ও হুল্লোড়। মহাবীর আখড়াগুলি গেরুয়া পতাকা ও প্রদীপে ভর্তি। হতেই পারে, ব্যবহার্য ভিড়!

কিন্তু বিজেপি যে হিন্দুত্বের কথা বলে তা তো উচ্চবর্গীয় হিন্দুত্ব। ব্রাহ্মণত্বের সেখানে মর্যাদা আছে, শূদ্রের নাই। এইবার ভক্তরা তেড়ে আসবেন! দেশের রাষ্ট্রপতি হলেন মুর্মু, তার আগে রামনাথ কোবিন্দ হলেন তপশিলি জাতির। শূদ্রের মর্যাদা নাই বললেই হলো? একজন শূদ্রকে তুলে এনে মর্যাদা (ক্ষমতা নয়) দিলেই সমগ্র শূদ্রের যে উন্নতি হয় না তা হাথরাসের ধর্ষিতা মনীষা বাল্মীকিরাই প্রমাণ করে দেন। বছরখানেক আগে, আমাদের পাড়ারই এক দিদির মোবাইল নম্বর খুঁজতে গিয়ে কিছুক্ষণ থমকে গেছিলাম। দিদির নাম সরিতা বাল্মীকি। পেশায় সাফাইকর্মী। তখন সদ্য হাথরাসের এই নির্যাতিতার ঘটনার কিছুদিন হয়েছে। সেই সরিতা দিদির (যাঁর এক কন্যাও রয়েছে) ফোনের হোয়াটস্যাপ ডিপিতে জয় শ্রীরাম! এক বাল্মীকির দেহ পুড়িয়ে দেওয়া হয়, আরেক বাল্মীকির ডিপি জয় শ্রীরাম?

আরও পড়ুন- মোদির রামরাজ্য এক অন্ধকারাচ্ছন্ন ভারতবর্ষের কথাই বলে

তাহলে আসানসোলের বাল্মীকি সম্প্রদায় কি উত্তরপ্রদেশের ধর্ষিতা, মৃতা বাল্মীকির পাশে নেই? দুই শ্রেণিই তো দলিত, দুই শ্রেণিই তো বঞ্চিত। তাহলে একে অন্যের পাশে নেই কেন? এই পাশে থাকানোর কাজটি করার কথা ছিল যাদের, যারা 'দুনিয়ার মজদুর'-দের এক হতে বলত তারা কাজটি করতে পারেনি বলেই কি? বিজেপি বা গেরুয়া শক্তি কীভাবে এত জনপ্রিয় হলো তপশিলী জাতি, উপজাতিদের কাছে? ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি মাছের চোখে তির বিঁধিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যেই। এবার সেই তির যাতে না খসে যায় কোনওভাবে তার মরিয়া চেষ্টা। বিজেপি জানে, ভোটে জিততে মুসলিম ভোটের তাদের দরকার নেই। ভারতের জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ মুসলিম। হিন্দুর সংখ্যা প্রায় প্রায় ৮০ শতাংশ। বয়েই গেছে ১৫ শতাংশের ভোট! তবে এই হিন্দুদের মধ্যেও তো সক্কলে সমান নন। উঁচুতলার হিন্দুদের নিয়েই হবে না। পশ্চাতে রহিছে যারা, তাঁদেরও সঙ্গে নিতে হবে। কিন্তু সঙ্গে নিয়ে কতদূর হাঁটা হবে? বেশিদূর যে নয় তা বিজেপির ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়প্রীতি নিয়ে সামান্য চর্চা করলেই জানা যাবে। সঙ্গে নিতে হবে, কিন্তু সঙ্গে রাখা যাবে না। আদিবাসী, জনজাতিদের সঙ্গে দরকার কারণ, দেশের জনসংখ্যার প্রায় ১৬%-এর কিছু বেশিই হচ্ছে তপশিলি জাতি এবং প্রায় ৯ শতাংশের কাছাকাছি তপশিলি উপজাতি (যদিও হিসেবটা ২০১১ সালের কারণ সরকার জনগণনা করিয়ে আসল তথ্য দেশের মানুষকে দেয়নি)।

দেশের সমস্ত হিন্দু জাতি ও উপজাতিদের, এবং বিলুপ্তপ্রায় জনজাতিদের তাই সঙ্গে দরকার। ভারতের মোট ১৮টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে প্রায় ৭৫টি সম্প্রদায় রয়েছে যাদের অস্তিত্ব একটা সময়ে লুপ্তপ্রায় ছিল। সঙ্গে চাই বললেই তো হলো না। দিবে আর নিবে। তাই বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘প্রধানমন্ত্রী জনজাতি আদিবাসী নয়া মহা অভিযান’ নামক কর্মসূচি শুরু করেছেন। মাস খানেক ধরে দেশের ১০০ টি জেলার জনজাতি অধ্যুষিত গ্রাম থেকে বাসিন্দাদের আধার কার্ড সংগ্রহ করা হচ্ছে। এই জনজাতির মানুষদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পশ্চিমবাংলাতেও কাজ চলছে। 'লুপ্তপ্রায়' হতে বসা তিন জনজাতি রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রামের লোধা এবং পুরুলিয়ার বিরহড়, আলিপুরদুয়ারের টোটো সম্প্রদায়। বিজেপির তপশিলি জাতি ও তপশিলি উপজাতি মোর্চা তাই গ্রামে গ্রামে, প্রান্তে প্রান্তে কাজ করছে ব্যাপক হারে।

সাঁওতাল ভোট টানতে দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি করা ছিল বিজেপির দারুণ কৌশল। সেই দ্রৌপদী মুর্মুকে নতুন সংসদ ভবনের অনুষ্ঠানেও দেখা যায় না। রাম মন্দিরের অনুষ্ঠানেও দেখা যায় না। নিন্দুকরা বলেন, শূদ্র বলেই দেখা যায় না। একজন দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি করে দেওয়া মানেই সমগ্র সাঁওতাল জাতির উন্নতি না, সমস্ত আদিবাসীর সমানাধিকার না। সমানাধিকারও দেব না, মর্যাদাও দেব না। ভোট চাইব? আদিবাসী সংস্কৃতির সঙ্গে, আদিবাসী ধর্মচর্চার সঙ্গেও তো বিজেপির 'সনাতন' চর্চার কোনও মিল নেই। তাহলে কেন আদিবাসীদের মন পাওয়া যাচ্ছে? এই পিছিয়ে পড়া জনজাতি কি বিজেপির মধ্যে 'ত্রাতা'-কে খুঁজে পাচ্ছে?

২০১৯ সালের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, ভারতে গড়ে ৬২% মানুষ ভোট দেয়। আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভোটদাতাদের হার ৭২%। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জাতির ভোট পেয়েছিল ২২ শতাংশ। আঞ্চলিক দলগুলি এই গোষ্ঠীর ভোট পেয়েছিল ৪২ শতাংশ। ২০১৯ সালে বিজেপি ৪৪ শতাংশ ওবিসি ভোট পেয়েছিল। আঞ্চলিক দলগুলি পেয়েছিল ২৭ শতাংশ। ২০২৪ সালে কী হবে এই হিসেব বিজেপি বহু আগেই কষে ফেলেছে। আনন্দবাজারের এক প্রতিবেদনে উল্লেখযোগ্য তথ্য চোখে পড়েছিল। পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম জেলায় সম্পূর্ণ লোধা অধ্যুষিত গ্রামের সংখ্যা ৩৯৮টি। দীর্ঘদিন ধরেই গ্রামাঞ্চলে পড়ে থেকে নীরবে কাজ করে গিয়েছে আরএসএসের শাখাগুলি। শেষ হিসেব অনুযায়ী এই রাজ্যে আরএসএসের ১৯০০ টি শাখা রয়েছে। কিছুকাল আগেই ঠিক হয়েছে, ২০২৪ সালে এই রাজ্যে আরও ৭০০ টি শাখা শুরু করবে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ। এই সেবকরা কাজ করেন একেবারেই তৃণমূল স্তরে। যে স্তরে একসময় পৌঁছনোর কথা ছিল বামেদের। তৃণমূল নানা 'শ্রী' ও ভাণ্ডার প্রকল্প দিয়ে সেই জনজাতির ভোট জয় করার চেষ্টা করেছে। বিজেপির আরও নিবিড়ে কাজ করেছে। লক্ষ্যণীয়, গত কয়েক বছরে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে থেকে পদ্মশ্রী প্রাপকদের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু মর্যাদা দিয়ে প্রকৃত ক্ষমতায়ন কি হয়েছে? স্বাধীনতার পর থেকে এখনও, দেশের দরিদ্রতম মানুষদের মধ্যে আদিবাসী ও তপশিলি জাতির মানুষরাই এগিয়ে। দেশের সম্পদের অধিকাংশটাই উচ্চবর্ণীয়দের হাতে। ২০১২ সালের সরকারি হিসেব বলছে, দেশে ২২ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। সেই দারিদ্র উচ্চবর্ণের মানুষদের ক্ষেত্রে ৯ %, ওবিসিদের ক্ষেত্রে ২০%, তফশিলিদের ক্ষেত্রে ৩০%।

বিজেপি বিরসা মুণ্ডাকে 'আনসাং হিরো' হিসেবে তুলে ধরছে। বিরসা মুণ্ডার জন্মবার্ষিকী উদযাপন স্থানীয় মুণ্ডারা করেনই। বিরসা জয়ন্তী হিসাবেই দিনটি পালিত হয়। ২০২১ সালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার একটি সিদ্ধান্তের পরে বিজেপি সরকার দিনটির নাম পরিবর্তন করে 'জনজাতীয় গৌরব দিবস’ বলে পালন করার কথা জানায়। অর্থাৎ উপজাতীয় বীরদের সম্মান জানাতে এবং উপজাতি সম্প্রদায়গুলিকে তাদের প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এই দিনটির নাম বদল, জানায় বিজেপি। মজার ব্যাপার, বিরসার নামটিই বাদ চলে গেল 'আনসাং হিরো' প্রমাণ করতে গিয়ে। উল্টে এল জনজাতির গৌরবের কথা। যে গৌরব সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে আসলে নেই। দিনের নাম পাল্টে দিলেই গৌরব আসেও না। বরং উপজাতির মানুষরা চেয়েছিলেন 'উলগুলান দিবস' নাম হোক। উলগুলান অর্থাৎ বিপ্লব। কিন্তু বিজেপি সে রসে মজে যাওয়ার দল তো নয়। এখানে বিপ্লব নয়, আনুগত্যই প্রধান।

২০২২ সালের নভেম্বরে যখন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু বিরসার গ্রামে গিয়েছিলেন তখন বিরসা মুণ্ডার ভাইপো বুধরাম মুণ্ডা এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা রাষ্ট্রপতিকে একটি চিঠি দিয়ে দিনটি বদলে 'বিরসা মুণ্ডা আদিবাসী দিবস' করার অনুরোধ জানান। দ্রৌপদী নিজে আদিবাসী, তিনি কিন্তু এই আবেদনে সাড়া দেননি। বলাবাহুল্য, দেওয়ার 'ক্ষমতা' তাঁর নেই।

আদিবাসী সার্বভৌমত্ব এবং আদিবাসীদের নিপীড়ন করার জন্যই তৈরি জমি ও শ্রম নীতির অবসান চেয়েছিলেন বিরসা। ব্রিটিশরা সেই উলগুলানকে দমিয়ে দিলেও আদিবাসী আন্দোলনের ইতিহাসে, ভারতের ইতিহাসে বিরসার নেতৃত্ব উজ্জ্বল। ২০০০ সালে, ছোটনাগপুরের আদিবাসী সম্প্রদায় যে পৃথক ঝাড়খণ্ড রাজ্যটি চেয়ে আসছিল, তা তাঁর জন্মবার্ষিকীতেই গঠিত হয়েছিল। কিন্তু বিজেপি বিরসাকে তুলে ধরছে সম্পূর্ণ অন্য দৃষ্টিতে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ বিরসা মুণ্ডাকে এমন একজন নেতা হিসাবে উপস্থাপন করতে চেয়েছে যিনি ঔপনিবেশিক খ্রিস্টধর্মকে প্রত্যাখ্যান করে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। লড়াই খ্রিস্ট ধর্মে ভাঙিয়ে নিয়ে চলে যাওয়ার বিরুদ্ধে, সম্মান হিন্দু ধর্ম গ্রহণের জন্য। উলগুলানের জন্য বা আদিবাসীদের জোট বাঁধানোর জন্য না।

আসানসোল বা বহু স্থানেই যেখানে আদিবাসী সম্প্রদায় রয়েছে সেখানে খ্রিস্টধর্ম প্রচারকদের বড় ভূমিকা রয়েছে অনস্বীকার্য। এখনও, আদিবাসীগ্রামগুলিতে, এমনকী আসানসোলের যে স্থানগুলির কথা হচ্ছিল সেখানে পদবিতে রুইদাস অথচ ধর্মে খ্রিস্টান বা বাউরি অথচ ধর্মে খ্রিস্টান এই সংখ্যা কম নয়। আদিবাসী এলাকার কাছাকাছি তাই চার্চও মেলে। এখানে বিজেপি একটি তত্ত্ব সফলভাবে খাড়া করতে পেরেছে, তা হলো, আদিবাসীরা হচ্ছে 'অনগ্রসর হিন্দু', এদের মূলধারায় আনতে হবে৷ অনগ্রসরদের টাকা দিয়ে, সুবিধা দিয়ে ভোট তো টানার লড়াই পুরনোই। এখানে বিজেপির 'অ্যাডভান্টেজ' কোথায়? হিন্দুত্ব। ঠিক যেভাবে 'মুসলিমরা খুব বেড়েছে' ন্যারেটিভ তৈরি করে উচ্চবর্ণদের মাথা মোড়ানো গেছে, নিম্নবর্ণের কাছে কাজটা সহজই ছিল। কারণ এরা ব্যবহার্য ভিড়।

আরও পড়ুন- রাম মন্দিরে দ্রৌপদী মুর্মু নেই, কঙ্গনা রানাওয়াত আছেন! কেন?

এই অঞ্চলে দশমীর দিন আখড়া বেরোয়। আখড়াগুলি মহাবীর থান নিয়ন্ত্রিত। এখানে লাঠিখেলার চর্চা হয়। এখন রামনবমীতেও দাপট। এই আখড়া আগে দেখতে পাড়ায় পাড়ায় ভিড় জমত। ট্যাবলোর উপর রাম সীতা হনুমান সেজে পাড়ার ছেলেমেয়েরাই চেপে বসত। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে লাঠিখেলা। কয়েক বছর ধরে লাঠির জায়গা নিয়েছে অস্ত্র। এই অঞ্চলেই কয়েক বছর আগে দাঙ্গা হয় যাতে আসানসোলের 'ওপাড়ার' ইমামের ছেলে মারা যান। সকলেই জানেন, রামনবমীর মিছিল কেন মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় সমস্যা তৈরি করল। সকলেই জানেন, কেন ওই দাঙ্গায় বেশ কয়েকজন খুন হয়ে গেলেন। সকলেই জানেন, কীভাবে একটা ভিড়কে তৈরি করে তাঁদের ব্যবহার করা হলো উস্কানি দিতে। ব্যবহার্য ভিড়। যখন যেদিকে পারুক লেলিয়ে দিলেই হলো। এই বাউরি, বা কোড়াপাড়ার আখড়ার, মিছিলের চেহারা পাল্টে গেছে। লাঠিখেলার চর্চা নয় সেখানে উগ্রতার প্র্যাক্টিস সফলভাবে শুরু হয়েছে।

তাহলে, অন্য ধর্ম এসে 'ক্ষীর খেয়ে যাচ্ছে' বোঝানোর গল্পে এত দম যে ভুলিয়ে দেওয়া যায় নিজের চাকরি না পাওয়ার কথা, কলে জল না পাওয়ার কষ্ট, রাস্তা না ঠিক হওয়ার যন্ত্রণা? হাতে অস্ত্র, মুখে ধর্মের স্লোগান দিয়েই নামিয়ে দেওয়া যায় যুদ্ধে এমন গোষ্ঠী তৈরি করা এতই সহজ? একজন মানুষের উন্মাদনার চেয়ে সমষ্টির উন্মাদনা অনেক শক্তিশালী। মনে রাখতে হবে, বিজেপি আসলে একটি জনশক্তি তৈরি করেছে রামের নামে। এই রামনামে ভক্তির চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে 'সবক শেখানো'। এই জনশক্তি, নিজেরা কী পেল তা নিয়ে ভাবিত নয়। এই জনশক্তি জানেও না আসলে হিন্দুরাষ্ট্রে দলিত হিন্দু, পিছড়াবর্গ হিন্দুদের ঠাঁই নেই। ক্ষমতায় আসার পর এই 'নিচুতলার হিন্দু'-রাই বাদ পড়বে প্রথম। কোনওদিনও দলিতরা ব্রাহ্মণের সমান 'সামাজিক মর্যাদা পাবে না'। কোনওদিনও নিচুতলার পদবিওয়ালা মানুষরা ডাক্তার, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক হলেও আর সকলের মতো সমান হবেন না অনেকের চোখে। প্রশ্ন উঠবে 'বাউরি' ডাক্তার আদৌ চিকিৎসা করতে সক্ষম তো? খিল্লি হবে, 'মুণ্ডা' শিক্ষক আসলে কোটায় চান্স পাওয়া, তর্ক হবে 'হেমব্রম' হয়েও কীভাবে গায়িকা হচ্ছে কেউ! তবু, সমষ্টির মগজধোলাই সহজ। বিশেষ করে সমষ্টিকে যদি দীর্ঘদিন ক্ষমতা না পাওয়াতে অভ্যস্ত করে রাখা যায়, অশিক্ষায় অভ্যস্ত করে রাখা যায়, 'না পাওয়া'-কে ভবিতব্য বিশ্বাস করিয়ে রাখা যায়। সমষ্টির উন্মাদনা চিরকালই ব্যবহার্য।

বন্ধু অর্ক ভাদুড়ি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন আসানসোলের সেই ইমামের। ইমামকে 'রাম' নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। ইমাম তাঁকে বলেছিলেন রামায়ণের গল্প তিনি শুনেছেন। শুনেছেন, রামচন্দ্র খুব বড় রাজা ছিলেন। দেশ ভালো চললে তাকেই রামরাজ্য। তারপরই বলেছিলেন, "আমার ছেলেকে যারা খুন করল, তারা রামকে চেনে না, হিন্দু ধর্মকেও জানে না, ইসলাম সম্পর্কেও জানে না। যদি ওরা সত্যিই ধর্ম সম্পর্কে জানত, তাহলে অমন ফুটফুটে ছেলেটাকে মারতে পারত না। ওদের হাত কাঁপত। আমি ওদের ক্ষমা করে দিয়েছি।” তবু, এত কিছুর পরেও সমষ্টির উন্মাদনা যদি আগ্রাসী হয়, এককের বিশ্বাস সেখান বটবৃক্ষের মতো বিশাল হতে পারে। শুধু শিকড় মেলার ইচ্ছে থাকতে হবে।

More Articles