লাগাম নেই খোদ যোগী আদিত্যনাথের! কেন বিজেপি নেতারাই ফুঁসছেন পুলিশের বিরুদ্ধে?

Yogi Adityanath: পুলিশের দুর্নীতি নতুন ঘটনা নয়। তবে ভোটার এবং বিজেপি কর্মীরা বলছেন, আদিত্যনাথ সরকারের অধীনে দুর্নীতি বহুগুণ বেড়েছে।

গত সেপ্টেম্বরে উত্তরপ্রদেশের সিদ্ধার্থ নগর জেলার শহর নওগড়ে আপনা দলের (সোনিলাল) বিধায়ক বিনয় ভার্মা প্রতিবাদে বসেছিলেন। আপনা দল হচ্ছে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির শরিক দল। অথচ নিজের সরকারের বিরুদ্ধেই জনসমক্ষে প্রতিবাদে বসেছিলেন বিনয়। কেন? তাঁর অভিযোগ, পুলিশ নিজের কাজ করছে না। তাই, পুলিশকে কাজ করতে বাধ্য করার জন্য তিনি বিক্ষোভে বসেছিলেন। বিনয়ের বক্তব্য, “আমার নির্বাচনী এলাকার বালি মাফিয়ারা গত মাসে চামার সম্প্রদায়ের একটি ছেলেকে খুন করেছে কিন্তু পুলিশ অপরাধীদের ধরতে চাইছে না। মাফিয়াদের সঙ্গে পুলিশরা মিশে আছে।" তিনি যে দলের শরিক, পুলিশ তো সেই দলেরই হাতে। তাহলে বিজেপির কি পুলিশের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই? নাকি পুলিশ বিজেপির নির্দেশেই কোথাও অতি সক্রিয় আর কোথাও অতি শান্ত? বিনয় ভার্মা বলছেন, তিনি তাঁর নির্বাচনী এলাকা সোহরতগড়ের তিনটি থানার স্টেশন হাউস অফিসার আর পুলিশ সুপারকে জেলার বাইরে বদলি করতে চান। কারণ "পুলিশ সুপার থানাগুলো বিক্রি করে দিয়েছেন।"

বিনয় ভার্মা একা নন। তাঁর সঙ্গে ওই বিক্ষোভে বসেছিলেন প্রায় ৫০ জন বিক্ষোভকারী। কেউ কেউ দলীয় কর্মী। আর বাকিরা আম নাগরিক। তবে পুলিশকে নিয়ে সবারই ভোগান্তি কমবেশি এক। কারও বাইক চুরি গেছে। কারও বাড়িতে ডাকাত পড়েছে। কারও প্রকাশ্য দিবালোকে গয়না ছিনতাই হয়েছে। আর সব ক্ষেত্রেই পুলিশের ভূমিকা এক! কোনও অপরাধের কোনও প্রতিকার নেই, তদন্ত নেই। অভিযোগ, মোটা টাকা ঘুষ না দেওয়া পর্যন্ত থানা এক পা নড়ে না। যদিও ২০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়েও পুলিশ কাউকে ধরেনি এই উদাহরণও আছে। আম জনতা তো ছাড়, খোদ বিধায়কই অসহায়! বিনয় ভার্মার আক্ষেপ, “ইস সরকার মে বিধায়ক কি কোন গরিমা না বচি হ্যায়”। বিনয় ভার্মা বলেছিলেন, অগাস্ট মাসে একটি বৈঠকের সময় মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথের কাছে এই বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন তিনি। কিন্তু পুলিশেরই এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছিলেন যে পুলিশ মামলা করেছে এবং অপরাধীদের গ্রেফতারও করেছে। যদিও, “এই তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। এখনও পর্যন্ত কেউ ধরা পড়েনি। কর্মকর্তারা মুখ্যমন্ত্রীকে বিভ্রান্ত করছেন,” দাবি বিনয়ের। ১ সপ্তাহ পর বিক্ষোভ প্রত্যাহার করে নেন বিনয়। অথচ, বিধায়কের এই বিক্ষোভে কোনও কাজই হয়নি। কোনও পুলিশ কর্মকর্তাকেই বদলি করা হয়নি।

আরও পড়ুন- বিজেপির সর্বোচ্চ পদে এরপর কে? মোদির উত্তরসূরী হওয়ার দৌড়ে উঠে আসছে যে যে নাম

উত্তরপ্রদেশ যোগী আদিত্যনাথ শাসিত। পেশিবহুল হিন্দুত্ববাদী নেতার ইমেজ তৈরি করেছেন তিনি। তাঁর প্রশাসন আমলা এবং পুলিশ কর্মকর্তাদের উপর অত্যধিক নির্ভর করে। ২০১৭ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই একজন 'দক্ষ' প্রশাসক হিসাবে দেখা হয়েছে যোগীকে। যিনি নাকি রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার উন্নতি করেছেন, সে যে উপায়েই হোক না কেন। যোগী আদিত্যনাথ বুলডোজার নীতি এনেছেন। যথাযথ বিচার ছাড়াই অভিযুক্ত অপরাধীদের পুলিশি এনকাউন্টার করিয়েছেন। মুসলিম এবং অন্যান্য প্রান্তিক গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে সম্পত্তি গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। এবার, সাত বছর ধরে রাজ্যের আধিকারিকরা যে ব্যাপক ক্ষমতা ভোগ করে এসেছেন তাই যেন ব্যুমেরাং হয়ে দেখা দিয়েছে যোগী রাজ্যে। বিশেষ করে পুলিশকে নিয়ে বিজেপির কর্মীদের মধ্যেই অসন্তোষ দেখা দিচ্ছে৷ শুধু আপনা দলের মতো বন্ধু শক্তিরাই অখুশি নয়। বিনয় ভার্মার দাবি, ভারতীয় জনতা পার্টির বেশ কয়েকজন বিধায়ক তাঁকে সমর্থন করেছিলেন। তারা প্রকাশ্যে আসছেন না ভয়ে।

২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি খোদ গেরুয়া গড়ে খারাপ ফলাফল করেছে। ভারত জুড়ে ৬৩টি আসন কমেছে বিজেপির যার মধ্যে ৩০টিই উত্তরপ্রদেশে। ফলস্বরূপ, বিজেপি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি এবং সরকার গঠনের জন্য জোটের উপর নির্ভর করতে হয়েছিল। চারশো পারের বুলি স্তিমিত হয়ে গেছিল এর পরেই। উত্তরপ্রদেশে দলের খারাপ ফলের পর থেকেই এখানকার বিজেপি কর্মীরা ক্ষুব্ধ এবং উত্তেজিত। তারা বারবার অভিযোগ করছেন, আদিত্যনাথ সরকার তাদের কথায় কর্ণপাতও করে না। মাঠে-ঘাটে কী চলছে, সরকার এবং দলীয় হাইকমান্ডের তা নিয়ে কোনও ধারণাই নেই। অভিযোগ, আদিত্যনাথ সরকারি সংস্থাগুলিতে কর্মীদের প্রভাব কমিয়ে দিচ্ছেন। ভোটারদের অভিযোগের সমাধান করার এবং দলের হয়ে প্রচার করার ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছেন। যার ফলে ১০টি বিধানসভা আসনে আসন্ন উপনির্বাচন এবং ২০২৭ সালে রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি বিপদে পড়বে বলেই ধারণা বিশ্লেষকদের।

আরও পড়ুন- যোগীরাজ্যে কেন হারল বিজেপি? বিস্ফোরক সত্য ফাঁস করলেন উত্তরপ্রদেশের নেতারাই

যোগীর প্রতি, বিজেপির প্রতি এই হতাশা নতুন নয়। দলের বিধায়ক এবং সাংসদরা ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রকাশ্যেই পুলিশের উপর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ২০২২ সালের মে মাসে, একটি থানার বাইরে বিক্ষোভ করার জন্য ছয়জন বিজেপি কর্মীকে মিরাটে গ্রেফতার করা হয়েছিল। অভিযোগ ছিল, বিজেপি কর্মীদের থানায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি। বিজেপির নেতাদের একাংশ বলছেন, “অখিলেশ যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন সমাজবাদী পার্টির কর্মীরা থানায় ঢুকে একজন এসএইচও-কে কলার ধরে ঘেরাও করে রাখতে পারতেন কিন্তু এখন যদি কোনও বিজেপি কর্মী একজন ভোটারকে সাহায্য করার জন্য থানায় যান, তবে থানার আধিকারিক সেই কর্মীকে হেনস্থা করবেন।" কেন পুলিশের এই বাড়বাড়ন্ত হলো! পুলিশ কি বিজেপিরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে তবে?

পুলিশের দুর্নীতি নতুন ঘটনা নয়। তবে ভোটার এবং বিজেপি কর্মীরা বলছেন, আদিত্যনাথ সরকারের অধীনে দুর্নীতি বহুগুণ বেড়েছে। আগে যদি ১০০০ টাকা ঘুষ দিতে হতো, সেটা এখন দিতে হচ্ছে ১০ হাজার টাকা৷ আম্বেদকর নগর জেলার বিজেপির জেলা সহ-সভাপতি মনোজ মিশ্র খোদ স্ক্রোল.ইন-এর কাছে স্বীকার করেছেন যে থানাগুলিতে ভয়াবহ দুর্নীতি রয়েছে যাতে বিজেপি নিজেই লাগাম টানতে পারছে না। এই জেলার পিছিয়ে পড়া বর্ণের ভোটাররা থানায় দুর্নীতি নিয়ে চরম অসন্তুষ্ট। এখন অসন্তোষ বিজেপির প্রতিও! তাঁদের অভিযোগ, তাঁরা যদি সাহায্যের জন্য বিজেপি অফিসে যান, সেখানেও সুরাহা মেলে না। এমনকী স্থানীয় নেতৃত্ব যদি থানার এসএইচওকে কিছু কাজ করার নির্দেশও দিতে পারেন না। অনেক অনুনয়-বিনয় করে বলতে হয় 'আপ দেখে লিজিয়ে'! অর্থাৎ কাজের কাজ কিছুই হয় না।

আরও পড়ুন- উত্তরপ্রদেশ কী করে মেরুকরণ রাজনীতির সূতিকাগার হলো?

কাটেহারি বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন। আর এই অঞ্চলে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মধ্যে বিজেপির প্রতি অসন্তোষ বাড়ছে ক্রমেই। কিছুদিন আগে কাটেহারির রাজভরদের গ্রামের এক ব্যক্তিকে এসসি এসটি আইনে ভুলভাবে অভিযুক্ত করা হয়। রাজভাররা সরকারিভাবে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মধ্যেই পড়ে কিন্তু তাঁদের অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া জাতি হিসাবে দেখা হয়। এদের বিজেপি নিজের দলে টানতে পেরেছে। কিন্তু এখন বিজেপির বিরুদ্ধেই বাড়ছে অভিযোগ! অভিযোগ, ওই ব্যক্তির উপর থেকে অভিযোগ প্রত্যাহার করার জন্য পুলিশ ২৫ হাজার টাকা ঘুষ চাইছে। ওই গ্রামে প্রায় ৩৫০ রাজভার ভোটার রয়েছেন। কেউই উপনির্বাচনে ভোট দেবেন না বলে জানিয়েছেন।

তাহলে একে একে সমর্থ হারানোর ভয় কি কাজ করছে না আদিত্যনাথের মধ্যে? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পুলিশের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন যোগী। গোরখপুর জেলার পিপরাউলি ব্লকের ভারতীয় জনতা পার্টির সভাপতি ধর্মরাজ গোন্ড বলেছেন, "যোগীজির সমস্যা হলো তিনি প্রতিক্রিয়ার শুনতে চান না। তিনি আধিকারিকদের কথা শুনবেন কিন্তু নিজের কর্মকর্তাদের কথায় কান দেবেন না। ফলস্বরূপ, বিজেপি উত্তরপ্রদেশেই সমর্থন হারাচ্ছে।

অভিযোগ, বিধায়করা অবধি সাধারণ নাগরিকদের অভিযোগ মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরতে পারেন না কারণ তারা ভয় পান যে, যোগী তাঁদের সরিয়ে দেবেন। অথচ রাজ্যে সরকারি চাকরির শূন্যপদ নেই। শূন্যপদ এলেই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়। দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলাদের কোনও ভয় নেই যে প্রশাসন তাঁদের শাস্তি দেবে। যোগীর হিন্দুত্ববাদ, গোরক্ষা, রামমন্দির তো অনেক হলো। এবার ভোটারদের মনেও প্রশ্ন জাগছে আর কতদিন ধর্ম আর মন্দিরের নামে ভোট দেবেন তারা! উন্নয়ন হবে কবে? যে পুলিশকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন যোগী, সেই পুলিশই কি কাল হয়ে আদিত্যনাথের শাসনের ভিত্তি নাড়িয়ে দেবে?

More Articles