আয়লা, আমফান, ফণির পর ডানা! গত দু'দশকে কেন একের পর এক ঘূর্ণিঝড় বাংলায়?
Cyclone in Bengal: য়লা, ফণী,বুলবুল, আমফান, ইয়াস, রেমালের পর এবার ডানা। অতীতে এই ঝড়গুলির দাপটে রাজ্যের উপকূলবর্তী এলাকায় প্রচুর প্রাণহানি এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কেন এত ঘনঘন ঘূর্ণিঝড়?
ধেয়ে আসছে ডানা। ইতিমধ্যেই বঙ্গোপসাগরের উপরে তৈরি নিম্নচাপ শক্তি বাড়িয়ে অতি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরিত হয়েছে। ক্রমশ ওড়িশার ভিতরকণিকা থেকে ধামারার মধ্যবর্তী এলাকায় এগিয়ে আসছে সেটি। সেখানেই ল্যান্ডফলের আশঙ্কা ডানা-র। ল্যান্ডফলের সময় ডানার গতিবেগ ঘণ্টায় ১০০-১১০ কিলোমিটার থাকার কথা। ডানা-র আতঙ্কে কাঁপছে ওড়িশা ও বাংলা, দুই রাজ্যই। দিন কয়েক আগেই লালচোখ দেখিয়ে এসেছিল ঘূর্ণিঝড় রেমাল। যদিও রেমালের প্রভাব সেভাবে পড়েনি বাংলায়। গত দুই দশকে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বেড়েছে অনেকটাই। একের পর এক ঝড় লেগেই আছে যেন। দিন দিন ঝড়ের গতিও বাড়ছে। আয়লা, ফণী,বুলবুল, আমফান, ইয়াস, রেমালের পর এবার ডানা। অতীতে এই ঝড়গুলির দাপটে রাজ্যের উপকূলবর্তী এলাকায় প্রচুর প্রাণহানি এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কেন এত ঘনঘন ঘূর্ণিঝড়? আসুন, ফিরে দেখা যাক বাংলা কাঁপানো সেই সব ঘূর্ণিঝড়গুলিকে।
এপ্রিল থেকে মে মাস এবং বর্ষার বিদায়ের পর অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যেই বেশিরভাগ ঘূর্ণিঝড় হতে দেখা যায়। সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে বায়ুমন্ডলের স্বাভাবিক পরিচলন প্রক্রিয়ায় বাধা তৈরি করলে জন্ম নেয় ঘূর্ণিঝড়। এই ঘূর্ণিঝড় কিন্তু স্থানভেদে ভিন্ন নামে পরিচিত। মূলত উত্তর আটলান্টিক মহাসাগর ও উত্তর-পূর্ব মহাসাগরে এই ঝড়কে হারিকেন বলে এবং দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর ও ভরত মহাসাগরে এই ঝড়কে সাইক্লোন বলা হয়। এই শব্দবন্ধটির উৎপত্তি 'কাইক্লোস' থেকে। এর অর্থ বৃত্ত বা চাকা। ১৯৪৮ সালে হেনরি পিডিংটন তাঁর 'সেইলর'স হর্ন বুক ফর দ্য ল অব স্টর্মস' বইতে সর্বপ্রথম সাইক্লোন শব্দটির ব্যবহার করেছিলেন। এর পর থেকেই দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগরে ঘূর্ণিঝড়কে সাইক্লোন বলা হয়।
সমুদ্রের উষ্ণ জলের কারণে বায়ুর উত্তাপ বাড়লে এই ধরনের ঝড় তৈরি হয়ে থাকে। সে সময় তুলনামুলক উষ্ণ বায়ু হালকা হয়ে গিয়ে উপরে উঠে আসে এবং উপরের ঠান্ডা বায়ু নীচে নেমে যায়। নীচের বায়ুমন্ডলের বায়ুর চাপ কমে গেলে আশেপাশে বায়ুর মধ্যে তারতম্য তৈরি হয়। এই এলাকার বাতাসের চাপ সমান করতে আশেপাশের বায়ু একত্রিত হয়ে ঘূর্ণিঝড় তৈরি করে। যার ফলাফল হিসেবে তৈরি হয় প্রবল বাতাস আর স্রোত। ঝড় ভূমিতে আঘাত করলে বন্যা, ভূমিধ্বসের মতো ক্ষয়ক্ষতি লেগেই থাকে।
আরও পড়ুন: ‘ডানা ’-র বিপদ এড়াতে ট্রেন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত, দূরপাল্লার পাশাপাশি বাতিল লোকালও
সাধারণত বিশ্ব মানচিত্রের মাঝখান দিয়ে পূর্ব-পশ্চিম বরাবর যে কাল্পনিক রেখা (নিরক্ষ রেখা বা বিষুবরেখা) পৃথিবীকে দুই ভাগ করেছে তার আশেপাশের উষ্ণ সমুদ্রের উপরেই তুলনামুলক বেশি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়ে থাকে। ওই কাল্পনিক রেখার উত্তর দিককে উত্তর গোলার্ধ এবং দক্ষিণ দিককে বলা হয় দক্ষিণ গোলার্ধ। ওই রেখা থেকে ৩০° উত্তর এবং ৩০° দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যবর্তী অঞ্চলকে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল বলা হয়। ভারত এবং বাংলাদেশ এই রেখার উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত। ঘূর্ণিঝড়ের সময় সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা কমপক্ষে ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে। কমপক্ষে ৫০ মিটার পর্যন্ত এই তাপমাত্রা থাকে। বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৮০টি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় হয়। তবে এর মধ্যে কিছু ঘূর্ণিঝড় উপকূলবর্তী অঞ্চলে আঘাত করলেও, কিছু ঘূর্ণিঝড় মহাসাগরে বিলীন হয়ে যায়।
গত ৫০ বছরের ঝড়ের তথ্য বলছে, ঝড়ে বাতাসের গড় গতিবেগ অনেকটাই বেড়েছে। জলবায়ু বিজ্ঞানীরা একমত যে, বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়ছে। তাঁদের মতে, বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং এল নিনোর নিরপেক্ষতা তথা মহাসাগরে গরম জলের স্রোত কমেছে, এতে সাগরের পরিবেশ অতিরিক্ত উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে সমুদ্রের তাপমাত্রা ১৯৭০ সাল থেকে এক ডিগ্রি বেশি উষ্ণ এখন। এর মধ্যে ভারত মহাসাগরও রয়েছে। এর কারণেই এত ঘনঘন শক্তিশালী ঝড় হচ্ছে বলে যুক্তি দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। আর এখন প্রায় সবকটি সাগর-মহাসাগরই উষ্ণ জলাধার, ফলত ভবিষ্যতে আরও বড় ঝড় হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দিতে পারছেন না জলবায়ু বিজ্ঞানীরা। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে আমাজন, অরিনোকো নদী কীভাবে ঝড়কে আরও শক্তিশালী করে তোলে সেই নিয়ে গবেষণা পত্র লেখা হয়েছে, যেখানে জানানো হয়েছে মিষ্টিজল ঝড়ের শক্তি বাড়ায়। ঝড়ের সময় বৃষ্টি হলে সমুদ্রপৃষ্ঠে মিষ্টি জল জমে। এতে ঝড় আরও শক্তিশালী হয়।
হাওয়ার তীব্রতা এবং ধ্বংসক্ষমতার দিক থেকে বাংলাদেশ এবং ভারতে ঘূর্ণিঝড়কে চারটি নামে চিহ্নিত করা হয়। ঘূর্ণিঝড়ের সময় বাতাসের গতিবেগ যদি ঘন্টায় ৬২ থেকে ৮৮ কিলোমিটার হয়, তখন তাকে ট্রপিকাল সাইক্লোন বলে। গতিবেগ ৮৯-১১৭ কিলোমিটার হলে, তাকে সিভিয়ার সাইক্লোন বলে। গতিবেগ ১১৮-২১৯ কিলোমিটার হলে সেটিকে সিভিয়ার সাইক্লোনিক স্টর্ম বলে এবং গতিবেগ ২২০ কিলোমিটারের বেশি হলে তাকে সুপার সাইক্লোন বলে।
ঘূর্ণিঝড় আয়লা
২০০৯ সালে ২৫ মে সুন্দরবনে ও বাংলাদেশের খুলনা উপকূলে আঘাত হানে আয়লা। এই ঘূর্ণিঝড়ের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার। আয়লার তাণ্ডবে তছনছ হয়ে গিয়েছিল রাজ্যের দক্ষিণপ্রান্ত। এই ঘূর্ণিঝড়ে ভারতের ১৪৯ জন এবং বাংলাদেশের ১৯৩ জনের মৃত্যু হয়।
ঘূর্ণিঝড় তিতলি
২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর, ঘূর্ণিঝড় তিতলির মিনিট দু'য়েকের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিলএ রাজ্যের নন্দীগ্রাম। সে সময় সমুদ্র লাগোয়া বহু গ্রামে জল ঢুকে গিয়েছিল, অনেক কাঁচা বাড়ি ভেঙে পড়ে, উপড়ে যায় বিদ্যুতের খুঁটি। নন্দীগ্রাম-২ ব্লকের খোদমবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় ঝড়ে অন্তত ১০টি মাটির বাড়ি ও পাকা বাড়ি ভেঙে গিয়েছিল। ৬ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে ধুলিয়াপোতা, কপোতিয়া, মাঝিপাড়া, শোভাপুর-সহ বেশ কয়েকটি গ্রামে ক্ষতির পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশি।
ঘূর্ণিঝড় ফণী
২০১৯ সালের ৩ মে বঙ্গোপসাগর উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ফণী। এই ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ১৫০ থেকে ১৭৫ কিলোমিটার। এই ঝড়ের প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গে প্রাণহানি কম হলেও অনেকটাই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল ওড়িশায়। বিভিন্ন এলাকায় বাঁধ, রাস্তা, ব্রিজ, ঘর-বাড়ি, কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে বাংলাদেশে ৯ জনের মৃত্যু হয়।
ঘূর্ণিঝড় আমফান
২০২০ সালে তাণ্ডব চালিয়েছিল ঘূর্ণিঝড় আমফান। হাওয়ার গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ২৭০ কিলোমিটার। আমফানের দাপটে উপকূলবর্তী এলাকার পাশাপশি সমগ্র দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ১৯১৯ সালের সুপার সাইক্লোনের পর আমফান সবচেয়ে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় ছিল। প্রবল ঝড় এবং অতি প্রবল বৃষ্টির দাপটে তুমুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এই ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে পশ্চিমবঙ্গে অন্তত ৭২ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াস
২০২১ সালে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস-এর সময় ঘন্টায় ১৫৫ কিলোমিটার বেগে বয়ে গিয়েছিল ঝোড়ো হাওয়া। এই ঝড়ে প্রচুর ক্ষতি হয় দক্ষিণ ২৪ পরগনা, সুন্দরবন উপকূল তীরবর্তী এলাকা-সহ ওড়িশায়। শুধুমাত্র ক্যানিংয়েই ১,৬৯২ জন মৎস্যজীবী ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ ছাড়াও ৫০ হাজার মুরগি, ৩০০ গবাদি পশুর মৃত্যু হয়েছিল এবং প্রায় ২০০ নৌকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সব মিলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন প্রায় ৯০ হাজার মৎস্যজীবী।
ঘূর্ণিঝড় ডানা
এবার উত্তর-পশ্চিমে ঘনীভূত হয়েছে সাইক্লোন ডানা। বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার সকালের মধ্যে ওড়িশার ভিতরকণিকা এবং ধামারার মধ্যবর্তী অংশে আছড়ে পড়ার সম্ভবনা রয়েছে ঘূর্ণিঝড় ডানা-র। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের তথ্য অনুযায়ী, সাগর দ্বীপ থেকে ৩৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থান করছে ঝড়টি। মধ্য বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন এলাকায় ডানা ইতিমধ্যে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে।
আরও পড়ুন:শক্তি বাড়িয়ে আরও ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’! ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কায় কাঁপছে বাংলা-ওড়িশা
প্রতিবারই ঝড়ের পূর্বাভাস এলেই উপকূলবর্তী এলাকায় তড়িঘড়ি শুরু হয় বাঁধ সংস্করণ। প্রশ্ন উঠছে, কেন সময় থাকতে থাকতে বেহাল নদীবাঁধগুলির সংস্কার করা হয় না? আমফান, ইয়াস ঘূর্ণিঝড়ের সময় বহু বেআইনি নির্মাণ ভেঙে গিয়েছিল। তার পরও অভিযোগ উঠেছে, উপকূল জুড়ে বেআইনি নির্মাণ চলছেই। বিজ্ঞানীরা আগেই সতর্ক করেছিলেন, পরিকল্পিত নগরায়ন না হলে বার বার এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হবে। বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে জলস্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন জলবায়ু বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বারবার শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়গুলির জন্য পরিবেশ দূষণকেই দায়ী করেছেন। আগামী দিনে উপকূল এলাকায় বহুতল নির্মাণ বন্ধ করতে না হলে, পরিবেশ দূষণ নিয়ে পদক্ষেপ না করলে বিপদ আরও বাড়বে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই প্রশ্ন থাকছেই, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এত লেখা, এত কথাবার্তা, এত আন্দোলন, তবু কেন কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয় না? জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে প্রতিবেদন, গবেষণাপত্র, বই-এ যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ সংগৃহীত হয়েছে। এখন সময় এইসব তথ্যপ্রমাণগুলিকে হাতেকলমে কাজে লাগানোর। যার জন্য বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনাকে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।