আর অন্ধা নয় কানুন! কেন বদলে দেওয়া হলো ভারতের বিচারের মূর্তিটি?

Lady Justice Statue: যে 'লেডি জাস্টিস'-এর মূর্তি আমরা দেখে এসেছি, সে আসলে জাস্টিটিয়া। রোমান পুরাণে ন্যায়ের দেবী হচ্ছেন জাস্টিটিয়া।

লোকে বলত অন্ধা কানুন! অ্যাংরি ইয়ং ম্যান অমিতাভ প্রতিবাদে চিৎকার করতেন, 'ইয়ে অন্ধা কানুন হ্যায়'। চোখে কালো কাপড় বাঁধা, হাতে দাঁড়িপাল্লার সেই প্রাচীন বিচারের প্রতীকটি বদলে গেল ভারতবর্ষে, খানিক নিঃশব্দেই। ভারতের প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে বিচারের নতুন মূর্তির উন্মোচন করেছেন। এই মহিলার চোখে কালো কাপড় নেই। শাড়ি পরিহিতা মহিলার গায়ে অজস্র গহনা। এক হাতে দাঁড়িপাল্লা এবং অন্য হাতে ভারতের সংবিধান। আগের মূর্তিটি কেনই বা সরানো হলো, কেন খুলে ফেলা হলো চোখের কালো পট্টি?

যে 'লেডি জাস্টিস'-এর মূর্তি আমরা দেখে এসেছি, সে আসলে জাস্টিটিয়া। রোমান পুরাণে ন্যায়ের দেবী হচ্ছেন জাস্টিটিয়া। 'লেডি জাস্টিস'-এর চোখ কালো কাপড়ে বাঁধা, একহাতে দাঁড়িপাল্লা এবং অন্য হাতে ধরা তলোয়ার। তবে শুরু থেকেই কিন্তু ন্যায়ের দেবীর চোখটি বাঁধা ছিল না। রেনেসাঁসের সময়কালে অর্থাৎ ১৪ শতক থেকে চোখ বাঁধা মূর্তি দেখা যেতে থাকে। সম্ভবত আইনি ব্যবস্থার দুর্নীতিগ্রস্ত অবস্থাকে বোঝাতেই এই প্রতীক ব্যবহৃত হতো। বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যায় দেখেও চোখ বন্ধ করে রেখেছিল, এই অভিযোগে ব্যঙ্গ করেই জাস্টিটিয়ার চোখ বাঁধা হয়। ১৭-১৮ শতকে এই চোখ বাঁধা ন্যায়ের মূর্তিকে নিরপেক্ষতার প্রতিনিধি হিসাবে তুলে ধরা হয়। চোখ বেঁধে আছে অর্থাৎ, বিচার ব্যবস্থা সম্পদ, ক্ষমতা এবং সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে পক্ষপাতিত্ব ছাড়াই ন্যায়বিচার দেবে মানুষকে। দাঁড়িপাল্লার অর্থ ভারসাম্য। অর্থাৎ আদালতকে কোনও রায় দেওয়ার আগে যুক্তির দুই পক্ষকেই মেপে দেখতে হবে। আর তলোয়ারটি আইনের ক্ষমতা এবং কর্তৃত্বের প্রতীক। তলোয়ার আইন রক্ষাও করতে পারে এবং শাস্তিও দিতে পারে। এই এতখানি ইতিহাসকে রাতারাতি বদলে কেন দেওয়া হলো ভারতে?

ব্রিটিশরা যখন ভারত শাসন শুরু করে তখন তারা তাদের আইনি ব্যবস্থাই এই দেশেও চালু করে। নিম্ন আদালত থেকে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত আদালতের শ্রেণিবিন্যাস ব্রিটিশ ব্যবস্থারই প্রতিফলন। ব্রিটিশ শাসনের সময়ই 'লেডি জাস্টিস' ভারতে একটি বিশিষ্ট প্রতীক হয়ে ওঠে। আদালতের বাইরে রাখা হয়েছিল এই মূর্তি। স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যাচ্ছে, নতুন মূর্তিটি ঔপনিবেশিকতার চিহ্ন মোছার প্রয়াস বই কিছুই নয়। ঔপনিবেশিক প্রতীকগুলিকে বাদ দেওয়ার তাড়নাতেই পাশ্চাত্য পোশাকের বদলে শাড়ি পরানো হয়েছে মূর্তিটিকে। চোখ খোলা রাখা হলো কেন? এতে বোঝানো হচ্ছে, আইন অন্ধ নয় এবং ভারতের আইন সবাইকে সমান চোখে দেখে। দাঁড়িপাল্লাটি রয়েছে আগের মতোই। অর্থাৎ আদালত নিরপেক্ষ রায় দেবে এবং সব উভয় পক্ষের কথা সমানভাবে বিচার করবে। তলোয়ারের বদলে আনা হয়েছে ভারতের সংবিধান। দেশের সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণির মানুষ নরন্তর যে বৈষম্যের মুখোমুখি হচ্ছেন, সেই মানুষদের উন্নতির জন্য সাংবিধানিক বিধানকে গুরুত্ব দিতেই মূর্তির হাতে ধরানো হয়েছে সংবিধান। মূর্তি তো বদল হলো। দেশের বিচারব্যবস্থা কি বদলাল? চিরকালই বিচার নিয়ে সন্দেহ থেকেছে। বিত্তশালী, প্রভাবশালীদের জন্য বিচার আর সাধারণ মানুষের জন্য বিচার যে আলাদা তা এখন শিশুও জানে। গত কয়েক বছরে বিচারব্যবস্থার পক্ষপাতিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বেশিই। ভারতে কি সকলে সমান ন্যায়বিচার পায়?

সুপ্রিম কোর্ট কিছুদিন আগেই একটি জনস্বার্থ মামলা খারিজ করেছে। ওই মামলাতে বলা হয়েছিল, দেশের সমস্ত আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা পাঁচ কোটি! জনস্বার্থ মামলাতে এই বিপুল পরিমাণ মামলা নিষ্পত্তির জন্য তিন বছরের সময়সীমা চাওয়া হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, দাবিটি কাম্য হলেও, বিচারব্যবস্থার বাস্তবতা মাথায় রাখলে এটি কার্যত অসম্ভব। জাস্টিস ডিলেইড ইজ জাস্টিস ডিনায়েড, আদালত কি তাই প্রমাণ করল তবে?

কলেজিয়ামের বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত সংশোধিত মেমোরেন্ডাম অফ প্রসিডিউর গত আট বছর ধরে চূড়ান্ত করা হয়নি। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বিষয়ে সরকার ও বিচার বিভাগের এত দীর্ঘসূত্রিতা কেন তবে? উচ্চতর বিচার বিভাগে অনগ্রসর শ্রেণি, তপশিলি জাতি, তপশিলি উপজাতি এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব ২৫% এরও কম। মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব ১৫%-এর কম। তাহলে ন্যায় সকলের কাছে সমানভাবে পৌঁছবে কীভাবে? কীভাবে সমাজের পিছিয়ে থাকা মানুষটির কথা যথার্থভাবে পৌঁছবে আদালতে? হাইকোর্টগুলিতে চিরকালই ৬০-৭০% শক্তি নিয়ে কাজ করা হয়। যার ফলে বর্তমানে ৬০ লক্ষেরও বেশি মামলার অমীমাংসিত অবস্থায় আছে। নিম্ন আদালতে ৪.৪ কোটি মামলা বিচারাধীন। তাহলে খোলনলচে না বদলে শুধু মূর্তি বদলে কি সুরাহা হবে? দেশের প্রান্তিকতম অঞ্চলের মানুষটি যদি বিচার না পান, যদি তাঁর কথা শোনার মতো কানই না থাকে আদালতের তাহলে কি মূর্তির হাতে ধরা সংবিধান রক্ষা সম্ভব?

More Articles