ব্রিকসের ফাঁকেই শি জিনপিংয়ের সঙ্গে আলাদা বৈঠক! শুধুই সৌজন্য নাকি দক্ষ কূটনৈতিক চাল মোদির?

BRICS Summit 2024: চিনের সঙ্গে ভারতের সংঘাত লেগেই রয়েছে বেশ কয়েক বছর ধরে। তার মধ্যেই প্রায় পাঁচ বছর পর মুখোমুখি মোদি-শি। কী কথা হল তাঁদের মধ্যে?

বিশ্ব জুড়ে একাধিক যুদ্ধপরিস্থিতির মধ্যেই ব্রিকস সম্মেলন ২০২৪। প্রায় বছর দুয়েক ধরে ইউক্রেনে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। সে জন্য আন্তর্জাতিক বহু ক্ষেত্রেই একঘরে হয়ে গিয়েছে পুতিনের দেশ। তবে সেই আবহেই রাশিয়ার কাজানে আয়োজিত হয়েছে চলতি বছরের ব্রিকস সম্মেলন। দিন কয়েক আগেই রাশিয়ায় গিয়ে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক সেরে এসেছেন মোদি। তবে এবার ব্রিকস সম্মেলনে ৩৬ জন রাষ্ট্রনেতাদের মধ্যে যার সঙ্গে কথাবার্তা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনা ঘনিয়েছিল, তিনি অবশ্যই চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। চিনের সঙ্গে ভারতের সংঘাত লেগেই রয়েছে বেশ কয়েক বছর ধরে। তার মধ্যেই প্রায় পাঁচ বছর পর মুখোমুখি মোদি-শি। কী কথা হল তাঁদের মধ্যে? শুধুই সৌজন্য সারলেন, নাকি দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ব্যপারেও কথা সারলেন দুই রাষ্ট্রনেতা।

ভারতের সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগেই রয়েছে চিনের। প্রায় প্রতিবছরই কোনও কথাবার্তা ছাড়াই চিন-সীমান্ত লাগোয়া ভারতের একাধিক ভূখণ্ডের খানিকটা করে অংশ নিজেদের মানচিত্রে ঢুকিয়ে নেয় চিন। সে সব নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ২০২০ সালে লাদাখে চিনা সেনা-মোতায়েন নিয়ে রীতিমতো সংঘর্ষ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল ড্রাগন সেনার সঙ্গে ভারতের। অরুণাচল প্রদেশ নিয়েও মধ্যিখানে চিনের সঙ্গে কূটনৈতিক সংঘাতে জড়িয়েছে ভারত। সে সবের মধ্যেই এই ব্রিকস সম্মেলন। কার্যত বাণিজ্যিক আদানপ্রদান ও বিনিয়োগের সুযোগ তুলে ধরার জন্যই এই সম্মেলনের আয়োজন করা হয়ে থাকে। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা, এই দেশগুলোর নামের প্রথম অক্ষর নিয়েই তৈরি হয়েছিল ব্রিকস শব্দটি। ২০২৪ সালে মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহীও যোগ দিয়েছে এই সম্মেলনে। গত বছর পনেরোতম ব্রিকস সম্মেলন আয়োজিত হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। ২০২৪ সালে ষোড়শ ব্রিকসের আসর বসেছে রাশিয়ার কাজানে।

আরও পড়ুন: যুদ্ধের প্রস্তুতি শি জিনপিংয়ের, কেন তাইওয়ানের দখল চায় চিন?

যেখানে কার্যত রূঢ় ভাষাতেই সন্ত্রাস প্রসঙ্গে তোপ দাগতে দেখা গিয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। বছর খানেক হল কানাডার সঙ্গে খলিস্তান ইস্যু নিয়ে সম্পর্ক খারাপ হয়েছে ভারতের। এই পরিস্থিতিতে স্পষ্টত মোদি জানালেন, ‘‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সদিচ্ছা নির্ধারণের কোনও দ্বৈত মাপকাঠি থাকতে পারে না। দ্বিচারিতা চলতে পারে না।’’ সন্ত্রাসে মদত এবং অর্থসাহায্য বন্ধ করার জন্য ব্রিকসের সদস্য এবং পর্যবেক্ষক দেশগুলির যৌথ পদক্ষেপের পক্ষেও সওয়াল করেন মোদী। বলেন, ‘‘আমাদের যুবসমাজকে সন্ত্রাসের পথ থেকে বিরত রাখতে সক্রিয় পদক্ষেপ করতে হবে।’’ তবে মোদির এই বক্তব্যের নিশানা যে চিন, তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি ওয়াকিবহাল মহলের। দীর্ঘদিন ধরেই পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক চিনের। পাকিস্তানকে নানা ভাবে সাহায্য করে চলে চিন। এদিকে ভারত-পাক সম্পর্ক এখনও সেই তিমিরেই। ভারতের বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর সম্প্রতি পাকিস্তানে গিয়ে এসসিও বৈঠক সেরে এলেও, তা যে গোটাটাই ছিল এসসিও বৈঠকের স্বার্থে, তা গোড়া থেকেই পরিষ্কার করে দিয়েছিল নয়াদিল্লি। পাকিস্তান-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আশাজনক কিছু উঠে আসেনি সেই সফর থেকে। এই পরিস্থিতিতে ব্রিকস আসরে মোদির এই সন্ত্রাসবাদ-মন্তব্যের নিশানা ছিল চিনের দিকেই, তা বলাই যায়। কারণ গত কয়েক বছরে রাষ্ট্রপুঞ্জ নিরাপত্তা পরিষদে বেশ কয়েক জন পাক জঙ্গির বিরুদ্ধে ভারত প্রস্তাব আনলেও চিনের ভেটোর কারণে তা পাশ হতে পারেনি।

তবে সেই সব দূরত্বের ইতিহাস দূরে সরিয়ে রেখেই ব্রিকস সম্মেলনে গিয়ে চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে পার্শ্ববৈঠক সেরেছেন মোদি। প্রায় পাঁচ বছর পর মুখোমুখি হয়েছেন এই দুই দেশের রাষ্ট্রনেতা। তবে সেই বৈঠকের মধ্য়েই চিনের ভারতীয় ভূখণ্ডের উপর আগ্রাসী অবস্থান যে ভালো চোখে দেখছে না নয়াদিল্লি, তা পরিষ্কার করে দিয়েছেন মোদি। পূর্ব লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি) বরাবর চীন ও ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিক যে চুক্তি হয়েছে, তাকে স্বাগত জানিয়ে মোদি জানান, সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা উভয় দেশের জন্যই অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। মোদির কথায়, আমরা বিশ্বাস করি, ভারত-চিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কেবল ভারতীয় জনগণের জন্যই নয়, বিশ্ব শান্তি,স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতির জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিগত চার বছর ধরে যে যে ইস্যু দু'দেশের মধ্যে অশান্তির কারণ হয়েছে, সেগুলি নিয়ে যে শেষপর্যন্ত আমরা ঐক্যমত হতে পেরেছি, তাকে স্বাগত জানাই। সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা দু'দেশেরই অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।" একই সঙ্গে পারস্পরিক বিশ্বাস, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং পারস্পরিক সংবেদনশীলতা দু'দেশের সম্পর্কের ভিত্তি হওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেছেন মোদি।

এদিকে মোদির সুরেই সুর মেলাতে দেখা গিয়েছে শি-কেও। তিনি জানিয়েছেন, উভয় পক্ষের মধ্যেই আরও যোগাযোগ ও সহযোগিতার সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন। মতভেদ সরিয়ে সমস্যাগুলির সমাধান নিয়ে মতানৈক্যে পৌঁছনোর ব্যপারেও জোর দিয়েছেন চিনের প্রেসিডেন্ট। শি জিনপিংয়ের সঙ্গে এই সাক্ষাতের কথা ব্রিকস সম্মেলনের ফাঁকেই নিজের এক্স হ্যান্ডেলে শেয়ার করেন মোদি।

 

একদিকে যখন পড়শি দ্বীপরাষ্ট্র তাইওয়ান দখলের জন্য উঠেপড়ে লাগতে দেখা যাচ্ছে চিনকে, রাজধানী তাইপেই ঘেঁষে যেভাবে সামরিক মহড়া চালিয়ে তাদের উপর চাপ তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চিন, সেখানে দাঁড়িয়ে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজার রাখার যে দাবি শি জিনপিং করেছেন ব্রিকস সম্মেলনে, তা হজম করতে পারছে না ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ। তবে কি সবই কথার কথা। আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজের অবস্থান সাফসুতরো রাখার জন্যই ভারতের সঙ্গে বন্ধুতার ইঙ্গিত দিলেন শি? এর আগে ২০২২ সালে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে এবং ২০২৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে দেখা হয়েছিল দুই রাষ্ট্রনেতার। তবে এ ভাবে পার্শ্ববৈঠক করতে দেখা যায়নি তাঁদের গত পাঁচ বছরে।

যদিও লাদাখ সমস্যার পর্যায়ে কূটনৈতিক পর্যায়ে চিনের সঙ্গে সমস্যা মেটানোর একাধিক প্রচেষ্টা চালিয়েই গিয়েছে ভারত। চলেছে ব্যাপক আলোচনা। সম্প্রতি চিনের বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র লিন জিয়েন সাংবাদিক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, সীমান্ত সংঘাত মেটাতে ভারতীয় পক্ষের সঙ্গে কাজ করবে চিন। কূটনৈতিক ও সামরিক চ্যানেলের মাধ্যমে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগেও থাকবে তারা। তবে ভবিষ্য়তে সত্যিই তেমনটা হবে কিনা তা তো সময় বলবে।

আরও পড়ুন: একটা দীর্ঘতম তো অন্যটা সমুদ্রের নিচে, জোড়া টুইন টানেল দিয়ে চিনকে টেক্কা দিতে পারবে কি ভারত?

এদিন ব্রিকস মঞ্চ থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-র অপব্যবহার এবং সাইবার নিরাপত্তার ব্যাপারেও কথা বলেন মোদি। পাশাপাশি গোটা দুনিয়া তাকিয়েছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ঠিক কী অবস্থান নেয় ভারত, সেদিকে। রাশিয়াকে ধন্যবাদ জানালেও মোদি এদিন সাফ জানিয়ে দেন 'আমরা সংলাপ ও কূটনীতিকে সমর্থন করি, যুদ্ধকে নয়।' একই সঙ্গে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘‘আমাদের বৈঠক এমন একটা সময়ে হয়েছে যেখানে বিশ্বকে ঘিরে রেখেছে যুদ্ধ, সংঘাত, আর্থিক অনিশ্চয়তা, আবহাওয়াগত পরিবর্তন ও সন্ত্রাসবাদ। বিশ্বে চর্চা চলছে উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব- পশ্চিম ভাগাভাগি নিয়ে… এবং প্রযুক্তির যুগে, সাইবার নিরাপত্তা, ডিপ ফেক, জিন ইফরমেশন নিয়ে নানান চ্যালেঞ্জ উঠে আসছে। এরকম পরিস্থিতিতে ব্রিকস থেকে বহু আশা রয়েছে।' এরই সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেন,' আমি বিশ্বাস করি যে একটি বৈচিত্র্যময় এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্রিকস সকল বিষয়ে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি জনগণকেন্দ্রিক থাকা উচিত। আমাদের বিশ্বকে এই বার্তা দেওয়া উচিত যে ব্রিকস একটি বিভাজনকারী নয়, বরং একটি জনস্বার্থ গোষ্ঠী।'

কার্যত কূটনীতিক বুদ্ধিমত্তার সঙ্গেই চলতি ব্রিকস সম্মেলেনে হাতের সবকটি তাস খেলে এসেছেন মোদি। একই সঙ্গে সন্ত্রাস প্রসঙ্গে চিনকে কাঠগড়াতেও তুলেছেন। পাশাপাশি চিনের সঙ্গে আলাদা করে বৈঠক সেরে দু'দেশের অস্থিরতাকে খানিকটা প্রশমিত করার চেষ্টা করেছেন। অন্যদিকে, বন্ধুদেশেরা যাতে কোনও ভাবেই ভারতের উপর না চটে যায়, সেদিকেও খেয়াল রেখেছেন। বিদেশ মন্ত্রকের তরফে জানানো হয়েছে, দেশে কিছু জরুরি কাজ থাকায় ব্রিকসের মূল সম্মেলন এবং কয়েকটি পার্শ্ববৈঠকে যোগ দিয়ে রাশিয়া থেকে বুধবারই ফিরে আসার কথা প্রধানমন্ত্রী মোদির। এদিকে বৃহস্পতিবার শীর্ষ সম্মেলনের শেষ দিনেই ব্রিকস ঘোষণাপত্র প্রকাশিত হবে। সব ঠিক থাকলে ভারতের পক্ষ থেকে সেখানে উপস্থিত থাকবেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।

More Articles