বিষয়ভাবনায় অভিন্ন হয়েও যেভাবে হাইনের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ

Rabindranath Tagore: রবীন্দ্রনাথ হাইনে থেকে নিয়েছেন,যেমন নিয়েছেন আরও অন্য ভাষার লেখকদের থেকেও, কিন্তু এই গ্রহণ ছিল উৎসের রচনাটিকে অন্য এক বিস্তার ও তাৎপর্যে নিয়ে যাওয়ার সৃষ্টিশীল উপায়।

লেখালেখির মকশো করার বয়সেই যে রবীন্দ্রনাথ বহির্বিশ্বের সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তা-ই নয়, রীতিমত আদাজল খেয়ে নেমে পড়েছিলেন অনুবাদের অনুশীলনেও। তবে এই অনুশীলন ছিল কেবলমাত্র কবিতাতেই সীমাবদ্ধ। ইংরেজি, ফরাসি, ইতালীয় এবং জার্মান ভাষার কবিরাই ছিলেন তাঁর চর্চার কেন্দ্রে। আর ইংরেজি ভিন্ন অন্য যে-দু'টি ইউরোপীয় ভাষাকে তিনি আয়ত্তের চেষ্টা করেছিলেন, সে-দু'টি ছিল ফরাসি ও জার্মান। বিধিবদ্ধভাবে শুরু করলেও ইংরেজির মতো স্বাচ্ছন্দ্য তাতে অর্জিত হয়নি বটে। তবে বিশেষজ্ঞ আর ইংরেজি অনুবাদের সহযোগিতায় তিনি এই দুই ভাষা থেকেই বেশ কিছু অনুবাদ করেছিলেন। জার্মান ভাষার মাত্র দু'জন কবির কবিতা অনুবাদ করেছিলেন তিনি। একজন গ্যোটে আর অন্যজন হাইনে। তার মধ্যে গ্যোটের মাত্র দু'টি কবিতা। সবচেয়ে বেশি অনুবাদ করেছিলেন হাইনের কবিতাই; মোট ন'টি। এই সংখ্যাধিক্য এক অর্থে হাইনের প্রতি তার পক্ষপাতকেই কেবল নির্দেশ করে না,একই সঙ্গে তাঁর প্রভাবেরও সংকেত হয়ে ওঠে। পক্ষপাত ও প্রভাবের য বিস্তৃত বলয় রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে, বুদ্ধদেব বসুর ভাষায়—

“তার বড় একটি অংশ য়োরোপের অন্তর্ভূত।”

(বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধ সমগ্র-৩, বুদ্ধদেব বসু, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০১০, পৃ ২৪৯)

রবীন্দ্রনাথ কেবল বিপুল পরিমাণ রচনারই স্রষ্টা ছিলেন না, ছিলেন বহু বিষয়ের এক গোগ্রাসী পাঠকও। তাঁর এই পাঠের প্রভাব রয়েছে তাঁর সৃষ্টিতে, নানা ধরনের রচনায়। তবে “অন্য এক রকমের প্রভাব আছে যা গোপন বা লুক্কায়িত, যার বিষয়ে কবি নিজেও স্পষ্টত সচেতন নন; যা সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার অর্ধালোক থেকে বাইরে ভেসে ওঠে না কখনো,” ( প্রাগুক্ত, পৃ ২৪৯) অর্থাৎ এমন এক ধরনের প্রভাব যা প্রচ্ছন্ন রূপে লেখার নিহিত পাতালে অস্পর্শযোগ্য ছায়ার মতো ইষৎ অগোচরে থেকে যায়। রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিতভাবেই এই দু'রকম ধারণা সম্পর্কেই সচেতন ছিলেন। কেবল সচেতনতাই নয়,প্রভাব সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণাও ছিল আশ্চর্য্য রকমের স্বচ্ছ। তার ‘কালান্তর’ প্রবন্ধে ১৯৩৪ সালে প্রভাব সম্পর্কে বলেছিলেন—

“সচল মনের প্রভাব সজীব মন না নিয়ে থাকতেই পারে না— এই দেওয়া-নেওয়ার প্রবাহ সেইখানেই নিয়ত চলেছে যেখানে চিত্ত বেঁচে আছে, চিত্ত জেগে আছে।”

( কালান্তর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী, আশ্বিন ১৪২৫, পৃ ১৪)

সন্দেহ নেই যে তাঁর চিত্ত হাইনের প্রভাবে জেগে উঠেছিল। জেগে ওঠার প্রধান কারণ উভয়ের রোমান্টিক মনোগঠনের অভিন্ন স্বরূপ। হাইনের মাধ্যমে কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাঁর অস্ফূট আত্মার বাকস্ফূর্তি ঘটেছিল, নিজের চেতনার সুনির্দিষ্ট কোনও অংশের সমর্থন তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন এই জার্মান কবির কবিতায়। হাইনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ সংযোগ সম্পর্কে তথ্য আকারে যেটুকু জানা যায়, তা খুব বেশি কিছু নয়। অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যের 'নানা রবীন্দ্রনাথ' (২০২৩) শীর্ষক বই থেকে জানা যায়—

“১৮৯২ সালে রবীন্দ্রনাথ হাইনের কবিতা ...অনুবাদ করেন।” (নানা রবীন্দ্রনাথ, পৃ ৫৬ ) অন্যদিকে,প্রশান্ত পাল লিখেছেন : “আমাদের ধারণা 1890-তে গ্যোটের ফাউস্ট পড়তে চেষ্টা করার আগেই তাঁর হাইনে-চর্চা ও অনুবাদ শেষ হয়ে গিয়েছিল।”

(রবিজীবনী, পৃ ২১৩)

হাইনের প্রভাব রবীন্দ্রনাথের লেখক জীবনের সূচনায় যেমন, পরিণত বয়সেও খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। বুদ্ধদেব বসু সেই প্রভাবের কিছু উদাহরণ তুলে ধরেছিলেন তার এক প্রবন্ধে —

“হাইনের সঙ্গে ‘ক্ষণিকা’র সম্পর্ক হয়তো একেবারে কাল্পনিক নয়, যদিও সেই চপলমতি প্যারিসপ্রেমিক জর্মান ইহুদিকে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন জগতের অধিবাসী বলে মনে হয়।”

(বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধ সমগ্র-৩, বুদ্ধদেব বসু, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০১০, পৃ ২৫৪)

কিন্তু এই ‘ক্ষণিকা’রও আগে রবীন্দ্রনাথের আরও কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল, সেগুলোতে হাইনের ছায়া তেমন একটা দেখা যায় না। বা যদি থাকেও, তা বুদ্ধদেব বসুর ভাষায়, “গোপন বা লুক্কায়িত, যার বিষয়ে কবি নিজেও স্পষ্টত সচেতন নন; যা সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার অর্ধালোক থেকে বাইরে ভেসে ওঠে না কখনো,”

উজ্জ্বলকুমার মজুমদার বাংলা কাব্যে পাশ্চাত্য প্রভাব (২০০৯) শীর্ষক বইটিতে রবীন্দ্রনাথের উপর পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রভাব বিষয়ক দীর্ঘ প্রবন্ধে বুদ্ধদেব বসুর বরাতে হাইনের প্রভাবের কথা উল্লেখ করলেও, কোথায় এবং কোন কোন কবিতায় সে প্রভাব ফলপ্রসূ হয়ে উঠেছে সে সম্পর্কে তিনি আমাদের নতুন কিছুই বলেন না। 'Rabindranath Tagore; A Centenary Volume' গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত তারকনাথ সেন তাঁর 'Western Influence on the Poetry of Tagore' নামক পাণ্ডিত্যপূর্ণ দীর্ঘ প্রবন্ধটিতে গ্যোটের কথা উল্লেখিত হলেও, হাইনের প্রসঙ্গটি পুরোপুরিই অনুপস্থিত। তবে হাইনের প্রসঙ্গটি রবীন্দ্রনাথের নিজের স্মৃতিতে অনুপস্থিত ছিল না। ১৯২৩/২৪ সালে চিন সফরে গিয়ে তিনি তার লেখালেখি, পাঠ ও অনুশীলনের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে হাইনের প্রসঙ্গটি উল্লেখ করতে ভোলেননি, যদিও ততদিনে তার হাইনে অনুবাদের বয়স প্রায় ৩৫ বছর পেরিয়ে গেছে —


“I also wanted to know German literature and, by reading Heine in translation, I thought I have caught a glimpse of the beauty there. Fortunately I met a missionary lady from Germany and asked her help. I worked hard for some months, but being rather quick-witted, which is not a good quality, I was not persevering. I had the dangerous facility which helps one to guess the meaning too easily. My teacher thought I had almost mastered the language,-- which was not true. I succeeded, however, in getting through Heine, like a man walking in sleep crossing unknown paths with ease, and I found immense pleasure.”


(Talks in China, The English Writings of Tagore, Volume Two, Sahitya Akademi, 2012, P 588)

এটা খানিকটা আশ্চর্যের যে রবীন্দ্রনাথের হাইনে-চর্চার সময়ে তো নয়ই, এমনকি তার বহু বছর পর, ১৯০০ সালে ‘ক্ষণিকা’য় এসে দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপে হাইনে উপস্থিত হলেন। বলতে গেলে প্রায় এক দশক পর। হাইনের প্রতি তাঁর অনুরাগ কতটা প্রগাঢ় ছিল, তার বড় প্রমাণ এই যে পাশ্চাত্য সাহিত্যের যার কবিতা সর্বাধিক সংখ্যায় অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথ, তিনি জার্মান কবি হাইনে। এই ক্ষেত্রে ইতালিয় দান্তেই কেবল নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গৌরবের অধিকারী হতে পারেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই হাইনে কীভাবে ‘ক্ষণিকা’র আগে পর্যন্ত লুক্কায়িত ছিলেন? আর ‘ক্ষণিকা’রও বহু বছর পর আবার তিনি ফিরে এলেন রবীন্দ্রনাথের শেষপর্বের দু'টো কাব্যগ্রন্থের দু'টো কবিতায়; একটিতে চূর্ণরূপে, অন্যটিতে প্রায় পূর্ণাঙ্গ আদলে।

প্রথমে হাইনের কবিতাটি পড়ে দেখা যাক, তারপর আমরা রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ফিরে আসবো —

Questions

By the sea, by the desert night- cover’d sea
Standeth a youth,
His breast full of sadness, his head full of doubtings,
And with gloomy lips he asks of the billows:
“0 answer me life’s hidden riddle,
“The riddle primeval and painful,
“Over which many a head has been poring,
“Heads in hieroglyphical nightcaps,
“Heads in turbans and swarthy bonnets,
“Heads in perukes. and a thousand other
“Poor and perspiring heads of us mortals--
“Tell me what signifies man?
“From whence doth he come and where doth he go?
“Who dwelleth amongst the golden stars yonder?”
The billows are murmuring their murmur eternal,
The wind is blowing, the clouds are flying,
The stars are twinkling, all-listless and cold,
And a fool is awaiting an answer.

( The Poems of Heine, Trans: Edgar Alfred Bowring, Published by George Bell and Sons, London, 1887, P 260-261)


রবীন্দ্রনাথের কবিতাটি এবার পাশাপাশি রেখে দেখা যাক।

প্রথম দিনের সূর্য

প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নূতন আবির্ভাবে—
কে তুমি,
মেলে নি উত্তর।

বৎসর বৎসর চলে গেল,
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম-সাগরতীরে,
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়--
কে তুমি,
পেল না উত্তর।

(শেষ লেখা, ১৯৪১ সাল)

হাইনের কবিতাটি তার প্রথম পর্বের (১৮১২-১৮৩১) কবিতাগুলোর একটি। আর রবীন্দ্রনাথের কবিতাটি ছিল তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত আগে প্রকাশিত 'শেষ লেখা' গ্রন্থের। হাইনের এই কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ পড়েছিলেন কিনা তার স্পষ্ট কোনও ইঙ্গিত যদিও কোথায় পাওয়া যায় না, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সংগ্রহে মূলে (Poetisch Worke Von H. Heine ,1885) ও অনুবাদে (The Poems of Heine, Edgar Alfred Bowring, 1884) হাইনের যে-দুটি বইয়ের উল্লেখ আমরা দেখতে পাই তাতে এই কবিতাটি রয়েছে। সুতরাং এই অনুমান অমূলক হবে না যে তিনি কবিতাটি সেই অনুবাদচর্চার সময়কালেই পড়েছিলেন। কিন্তু এই কবিতাটি তিনি অনুবাদ করতে প্রলুব্ধ হননি কেন, সেটা এক রহস্য। রহস্য এই জন্য বলছি যে এটি যদি তার মনে যদি কোনও প্রভাব না-ই ফেলতো, তাহলে কয়েক দশক উজিয়ে কীভাবে ফিরে এল তাঁর কাছে সেই কবিতাখানা? অথচ এই কবিতাটি তিনি অনুবাদের কোনও চেষ্টাই করেননি। অনুবাদের জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন মূলত প্রেমের কবিতাগুলোই, ন'টির মধ্যে আটটিই প্রেমের, কেবল একটি (বিশ্বামিত্র, বিচিত্র এই লীলা) কবিতা নিষ্প্রেমের। প্রেমবর্জিত একটি কবিতা তিনি অনুবাদ করলেও উপরোক্ত কবিতাটির প্রতি রবীন্দ্রনাথ যৌবনে হয়তো আকর্ষণ বোধ করেননি, কিন্তু সেটি যে তার মনোজগতের কোথায়ও নিঃশব্দে সুপ্ত হয়ে বহুদিন লুকিয়ে ছিল, তা আজ নিশ্চিত করেই বলা যায়। তা নাহলে প্রায় একই ভঙ্গি ও অভিমুখ নিয়ে ‘প্রথম দিনের সূর্য’ রূপে আবির্ভূত হল কীভাবে? কেবল ‘প্রথম দিনের সূর্য’ কবিতাতেই নয়, হাইনের ওই কবিতার প্রক্ষেপ ঘটেছে খানিকটা চূর্ণ রূপে, আর কিছুটা ভাবনার রূপান্তরের মাধ্যমে 'নবজাতক' কাব্যগ্রন্থ (১৯৪০)-এর ‘প্রশ্ন’ নামক কবিতার আত্মায়ও। অনেকটা ইংরেজি 'গীতাঞ্জলি' কাব্যগ্রন্থের কোনও কোনও কবিতার অবয়ব যেরকমভাবে গড়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথেরই রচিত বাংলা ভাষায় ভিন্ন ভিন্ন কবিতার অংশবিশেষের সম্মেলনে, হাইনের এই কবিতাটির ক্ষেত্রেও অনেকটা এরকমই ঘটেছে অল্প সময়ের ব্যবধানে রচিত রবীন্দ্রনাথের কবিতা দু'টোয়।

হাইনের কবিতাটির আত্মা ও অবয়বের সাথে রবীন্দ্রনাথের যে-কবিতাটির সাজুয্য সবচেয়ে বেশি বলে মনে হবে সেটি হাইনের কবিতার শিরোনামকে অগ্রাহ্য করেছে পুরোপুরি। আর যে-কবিতাটি অবয়বকে এড়িয়ে গেছে বহুলাংশে, সেটিই হাইনের কবিতার শিরোনামটিকে শিরোধার্য করে নিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের দু'টো কবিতাই পরস্পর ভিন্ন শৈলী, ভিন্ন প্রেক্ষাপট, ভিন্ন আবহ আর ভিন্ন আয়োজনে আলাদা হয়ে গিয়েছে, কিন্তু পরস্পর-প্রচ্ছন্ন এক বন্ধনে আবার যুক্তও হয়ে আছে। হাইনের সাথে ওই দু'টো কবিতার সাদৃশ্যগুলো পাশাপাশি বসালেই আমাদের কাছে তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ভাবৈশ্বর্য্যে, বহুমুখিতায় এবং মহাজাগতিক আবহের কারণে ‘প্রশ্ন’ কবিতাটি ‘প্রথম দিনের সূর্য’-এর তুলনায় অনেক বেশি ব্যাপ্ত ও ভাবস্ফূর্তিতে উচ্ছ্বল। যদিও তার অন্তর্গত প্রবাহটি মোটেই তুষ্টিমধুর নয়। হাইনের কবিতাটির মতোই রবীন্দ্রনাথের কাছে অজ্ঞেয় রয়ে গেছে গোটা বিষয়টি।

উভয়ের কবিতা দু'টো পাশাপাশি পড়ে ভাবগত মিল লক্ষ্য করা গেলেও,  দেখবেন উভয়ের গড়ন ও চলন একেবারেই ভিন্ন। ভিন্ন প্রধানত অঙ্গে ও গড়নে, দ্বিতীয়ত অভিব্যক্তি ও নির্মাণের অনাড়ম্বর প্রশমনে। রবীন্দ্রনাথ লেখকজীবনের আদিপর্বে সেই যে প্রেমের কবিতার অছিলায় বলেছিলেন —

“ফেলো গো বসন ফেলো, ঘুচাও অঞ্চল।
পরো শুধু সৌন্দর্যের নগ্ন আবরণ—”

( বিবসনা, সূর্যাবর্ত, বিশ্বভারতী গ্রন্থবিভাগ, ১৯৮৯, পৃ ৯)

রবীন্দ্রনাথ তার শেষ জীবনের কবিতায় এই ‘নগ্ন আবরণ’-এর সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। 'প্রথম দিনের সূর্য' সেই আস্থারই এক ‘নগ্ন’ নমুনা। অলংকারহীনতার প্রতি তার অনুরাগ মূর্ত হয়ে উঠেছিল গানেও: “আমার এ গান ছেড়েছে তার সকল অলংকার।” ক্ষিতিমোহন সেন-এর 'দাদূ' গ্রন্থের ভূমিকা লিখতে গিয়েও এই নগ্ন আবরণ-এর প্রতি তার পক্ষপাত জানিয়ে দিয়েছিলেন অকপটেই —

“কবি সত্যকে যখন উপলব্ধি করেন তখন বুঝতে পারেন সত্যের প্রকাশ সহজেই সুন্দর। এই জন্য তখন তিনি সত্যের রূপটিকে নিয়েই পড়েন তার অলংকারের আড়ম্বরে মন দেন না। বৈষ্ণব-পদে পড়েছি, রাধা যখন কৃষ্ণের মিলন চান, তখন গলার হারগাছির আড়ালটুকুও তাঁর সয় না। তার মানে, কৃষ্ণই তাঁর কাছে একান্ত সত্য; সেই সত্যকে পেতে গেলে অলংকার শুধু যে বাহুল্য, তা নয়, তা বাধা।”

(দাদূ, ক্ষিতিমোহন সেন, বিশ্বভারতী গবেষণা প্রকাশন বিভাগ, বৈশাখ ১৩৯৪, পৃ [১৫])

এই কবিতার নির্মাণকলা সেই বাধা পেরিয়ে ‘নগ্ন’ভাষ্যে তুলে ধরেছে উত্তরহীন অমাময় নিস্তব্ধতাকে। হাইনে তাঁর আবেগ, অনুভূতি ও প্রজ্ঞাকে প্রায় সবসময়ই গহন ও গহনাময় করে রেখেছেন। এই কবিতাটিও তার ব্যতিক্রম নয়। হাইনে ঠিক যতটা অনুষঙ্গ বাহুল্যে আর আভরণে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠিক ততটাই নিরাভরণ সারল্যে তাঁর কৌতূহলকে পরিমিতির মধ্যে তুলে ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথের স্বভাবসুলভ বাগাড়ম্বর ও বিস্তারের বাইরে এই কবিতা এক অবিশ্বাস্য সংক্ষিপ্ততার দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। প্রায় যেন কাব্যগুণবর্জিত এক কবিতা। রবীন্দ্রনাথ শেষ জীবনের উক্তির ঐশ্বর্য্য ও শৈলীর সারল্যের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন নিজেরই এক পর্বান্তর নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। তবে দাদূ প্রসঙ্গে যা বলেছিলেন, সে-ও ছিল অন্য এক প্রধান কারণ এই পর্বান্তর দৃশ্যমান হওয়ার নেপথ্যে। সর্বোপরি, সারাজীবনের প্রধান প্রবণতার বাইরে গিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাকসংযমী, কিন্তু তা হয়ে উঠেছিল সংযমের সফল এক শিল্পরূপ, ফলে তা কবিতারই নামান্তর।

হাইনে এই অর্থে রবীন্দ্রনাথের থেকে যোজন যোজন দূরে। কিন্তু তাই বলে হাইনের নৈকট্য থেকে মুক্ত ছিলেন না রবীন্দ্রনাথ। তা যে ছিলেন না সেটা উভয়ের কবিতার মৌল প্রবণতাতেই স্পষ্ট। এমনকি, কিছু কিছু অনুষঙ্গেও রয়েছে এই নৈকট্য। হাইনের By the sea, by the desolate nocturnal sea, রবীন্দ্রনাথে এসে রূপান্তরিত হলো ‘পশ্চিম-সাগরতীরে, নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়—’। রবীন্দ্রনাথের কবিতাটিতে একজনই প্রশ্ন কর্তা, হাইনের কবিতাটিতেও তাই। তবে হাইনে আমাদের এ-ও জানাচ্ছেন, প্রশ্নটি কোনও এক যুবকের হলেও, সেটি যে আরও বহুজনেরও (“Over which many a head has been poring,”)। সেই রকম একটা তালিকাও তিনি দিয়েছেন: পাগড়ি , হ্যাট ইত্যাদি শিরোভূষণের সঙ্গে সঙ্গেই রয়েছে ঘামঝরানো দরিদ্র মানুষও। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এই মৌলিক প্রশ্ন ও উত্তরকে কোনও ব্যক্তিচরিত্র দিয়ে নয়, শঙ্খ ঘোষের ভাষায়— “দুটি প্রবল প্রতিমা দিয়ে”, তা-ও অতি সংক্ষেপে,আমাদের সামনে হাজির করলেন। হাইনে যেখানে আবেগ, দুঃখ, হতাশার এক প্রগাঢ় ও ছন্দোময় রঙে চিত্রিত করেছেন প্রশ্নাকুল আর্তিকে। বিপরীতে রবীন্দ্রনাথ প্রায় নিরাবেগ, নির্বিকার আর নিরাসক্ত ভঙ্গিতে নিখিল বেদনাকে লুকিয়ে রাখলেন সংযমের নিরুচ্ছ্বাসে। যেন কোনও অভিযোগ নেই বেদনাবহ এই উপলব্ধির প্রতি। প্রকৃতির নিজের ভেতরকার সংলাপের মধ্য দিয়ে মানুষের অস্তিত্বের নিরর্থকতাকে বাঙ্ময় করে তুললেন পরোক্ষে কিন্তু স্বল্পভাষে । হাইনের বাক্যবিলাস ও বিস্তারের জৌলুসকে কবিতার শরীর থেকে খুলে ফেলে কেবল এর নগ্ন আত্মাটিকেই গ্রহণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটির এক সুগভীর বিশ্লেষণ করেছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ, সেখানে তিনি বলেছেন —

“এ জিজ্ঞাসা তখন ব্রহ্মজিজ্ঞাসা থেকে হয়ে ওঠে আত্মজিজ্ঞাসা, নিজেরই প্রতি নিজের প্রশ্ন, সত্তার নূতন আবির্ভাবের প্রতি প্রথম দিনের সূর্যের।” খানিক পরে শঙ্খ ঘোষ অন্য এক বিকল্প ভাবনাও যুক্ত করে বলেন, “আমরা ভাবতেও-বা পারি যে রহস্যময় ব্রহ্ম বিষয়ে এক জিজ্ঞাসা ভরে আছে এই কবিতায়।” ( কবিতা-পরিচয়, অমরেন্দ্র চক্রবর্তী, পৃ ২২)


হাইনের কবিতাটি পড়লেও আমাদের মনে এই দুই ভাবনাই প্রগাঢ় হয়ে ওঠে। এবং এ-ও সত্য যে এটি যেমন আত্মজিজ্ঞাসা, তেমনি তা বহুজনের জিজ্ঞাসারও এক প্রতিনিধিত্বমূলক কবিতা। তবে সন্দেহ নেই যে উভয়ের কাছেই কবিতার শেষ স্তবকে আমরা একই পরিণতি লক্ষ্য করি, অর্থাৎ দু'জনই এই প্রশ্নের কোনো মীমাংসা খুঁজে পাননি: “অস্তিত্বের পরম স্বভাব শেষ পর্যন্ত রহস্যময় থেকে যাচ্ছে তাঁর কাছে,” (কবিতা-পরিচয়, পৃ ২৩), তাঁদের দুজনের কাছেই।

‘প্রশ্ন’ কবিতার দ্বিতীয়ার্ধের শুরুর দিকে বিশ্বপ্রকৃতি ও প্রবহমান কালের স্বভাবের মধ্যে নিজের উপস্থিতি ও বিলয়ের এক মানচিত্রকে কালো অক্ষরে ঘনীভূত করে অচেনা নিজেকে এক অজানায় অদৃশ্য হওয়ার কথা জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলে উঠলেন: “এ অজ্ঞেয় সৃষ্টি আমি অজ্ঞেয় অদৃশ্যে যাবে নাবি।” আর এরপরই, কবিতার শেষ লাইনগুলোতে হাইনের সেই কবিতারই (‘প্রশ্ন’) এক সারাৎসার তিনি সংক্ষিপ্তাকারে প্রতিধ্বনিত করে তুলবেন সামগ্রিক ব্যঞ্জনা-সহ —

বাজিতে থাকিবে শূন্যে প্রশ্নের সুতীব্র আর্তস্বর,
ধ্বনিবে না কোনোই উত্তর।

(প্রশ্ন, নবজাতক)

হাইনেও একই প্রশ্নের ‘সুতীব্র আর্তস্বর’ ছুড়ে দিয়েছিলেন কিন্তু তিনিও নিরাশ হয়েছিলেন একইভাবে। আবু সয়ীদ আইয়ুব এই কবিতাটির দীর্ঘ এক ব্যাখ্যার সূত্রে যা বলেছিলেন তা একই সঙ্গে হাইনের কবিতার ক্ষেত্রেও কি প্রযোজ্য নয়?


“যে উত্তর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ( শুধু ভবিষ্যৎ নয়) প্রত্যেকটি মানবাত্মার সার্থকতার বার্তা শোনা যাবে, এই মহাশূন্যে তেমন উত্তর কোনদিক থেকে উচ্চারিত হবে না।”

  ( কবিতা-পরিচয়, পৃ ৩৯)


“জীবনের গোপন ধাঁধার উত্তর চেয়েছিলেন হাইনে। ‘মেলেনি উত্তর।’ রবীন্দ্রনাথ নিজেও তার প্রিয় কবি হাইনের এই অভিন্ন প্রশ্নের দ্বারা আলোড়িত ছিলেন বহুকাল থেকেই। কিন্তু তা অবশেষে, জীবনের উপান্তে এসে “জ্যামুক্ত হয়ে নিক্ষিপ্ত হল এক নিরন্ত শূন্যতার অন্তঃসারে।”

(কবিতা-পরিচয়, পৃ ২০)

রবীন্দ্রনাথ কেন সেসময় অনুবাদ করেননি হাইনের এই কবিতাটি— এমন এক কৌতূহল উত্থাপন করেছিলাম লেখাটির শুরুর দিকেই। যদিও তিনি পড়েছিলেন আর তা ছিল তাঁর হাতেরই নাগালে। এর উত্তর আমরা খুঁজে পাবো না ঠিকই, কারণ যে-কোনো পাঠই এক রহস্যময় স্বভাবে মোড়ানো, কেননা তা গণিতের যৌক্তিক শাসনের শৃঙ্খলে বাঁধা নয়, তার আছে মতিচ্ছন্ন চলনের নিগূঢ় স্বভাব যাকে যুক্তি দিয়ে স্পর্শ করা যায় না। কিন্তু তা কোনও এক সৃষ্টির মাহেন্দ্রক্ষণে আবির্ভূত হতে পারে নতুন এক জন্মের শর্তকে মান্য করেই। সেই নবজাতকের শরীরে পূর্বসূরীর কোনও কোনও কুললক্ষণ থাকলেও সে এক স্বতন্ত্র সত্তা। হিমেনেস, যিনি রবীন্দ্র-রচনার নিকটবর্তী হয়েও, ছিলেন অভাবনীয় রকমের স্বাতন্ত্র্যের সূত্রে বাঁধা, সেই হিমেনেসই বলেছিলেন:

“The true sign of poetry is contagion; this does not mean (take care) imitation.”

(Selected Writings of Juan Ramon Jimenez, trnslated by H. R. Hays, Farrar, Straus and Giroux, 1957, P 258)

হাইনের এই কবিতার ক্ষেত্রেও আমার ধারণা এরকম ঘটে থাকতে পারে। হাইনে দ্বারা তিনি একটা সময় আপ্লুত ও আক্রান্ত ( Contagion) হয়েছিলেন, কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত অনুকরণে (Imitation) না গিয়ে অন্য এক সৃষ্টিতে গিয়ে পর্যবসিত হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ হাইনে থেকে নিয়েছেন,যেমন নিয়েছেন আরও অন্য ভাষার লেখকদের থেকেও, কিন্তু এই গ্রহণ ছিল উৎসের রচনাটিকে অন্য এক বিস্তার ও তাৎপর্যে নিয়ে যাওয়ার সৃষ্টিশীল উপায়। আর ঠিক সেই কারণেই বিষয়ে প্রায় অভিন্ন হলেও রবীন্দ্রনাথ হাইনে থেকে আলাদা হয়ে গেছেন বুননে ও নির্মাণে।

গ্রন্থঋণ:

১. বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধ সমগ্র--৩, বুদ্ধদেব বসু, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০১০
২. কালান্তর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী, ১৪২৫
৩. নানা রবীন্দ্রনাথ, অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য, নৈর্ঋত প্রকাশনী, ২০২৩
৪. রবিজীবনী, তৃতীয় খণ্ড, প্রশান্ত পাল, আনন্দ, ১৩৯৪
৫.বাংলা কাব্যে পাশ্চাত্য প্রভাব , উজ্জ্বলকুমার মজুমদার, দেজ পাবলিশিং, ২০০৯
৬. Rabindranath Tagore; A Centenary Volume, ‍Sahitya Akademi, 2010
৭. The English Writings of Tagore, Volume Two, Sahitya Akademi, 2012, P 588)
৮. The Poems of Heine, Trans: Edgar Alfred Bowring, Published by George Bell and Sons, London, 1887
৯. শেষ লেখা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯৪১
১০. নবজাতক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯৪০
১১. সূর্যাবর্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী গ্রন্থবিভাগ, ১৯৮৯
১২. দাদূ, ক্ষিতিমোহন সেন, বিশ্বভারতী গবেষণা প্রকাশন বিভাগ, বৈশাখ ১৩৯৪
১৩. কবিতা-পরিচয়, অমরেন্দ্র চক্রবর্তী, দেজ পাবলিশিং, ১৯৮১
১৪. Selected Writings of Juan Ramon Jimenez, trnslated by H. R. Hays, Farrar, Straus and Giroux, 1957

More Articles