ওড়িশায় ডানা-তাণ্ডব! নবীনের ব্যাটন হাতে নিয়ে যেভাবে প্রাণহানি রুখলেন মুখ্যমন্ত্রী মোহন মাঝি
Cyclone Dana in Odisha: ওড়িশা সরকারের তরফে শুক্রবার জানানো হয়েছে, ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার বেগে ওড়িশায় ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’ তাণ্ডব চালালেও কোনও প্রাণহানির খবর মেলেনি।
বঙ্গোপসাগরের বুকে তৈরি হওয়া ঘূর্ণাবর্ত ক্রমে নিম্নচাপ থেকে শক্তি বাড়িয়ে বাড়িয়ে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে তৈরি হয়েছিল। বৃহস্পতিবার রাতেই তা আছড়ে পড়ে ওড়িশার ভিতরকণিকা ও ধামারা সংলগ্ন এলাকায়। তার পরে প্রায় আট ঘণ্টা ধরে চলেছে তার ল্যান্ডফলের প্রক্রিয়া। আবহাওয়া দফতর জানায়, সকাল ৭টার দিকে তীব্র ঘূর্ণিঝড়ের শেষের অংশ বা লেজের অংশ স্থলভাগে ঢুকছে। যা শুক্রবার দুপুরের মধ্যেই ওড়িশা অতিক্রম করে ছত্রিশগড় ও মধ্যপ্রদেশের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কথা। ততক্ষণে অনেকখানিই শক্তি হারিয়ে ফেলেছে ডানা।
গোটা এই ল্যান্ডফলের প্রক্রিয়ায় বৃষ্টিতে ভেসেছে পড়শি রাজ্য ওড়িশা। ওড়িশার কেন্দ্রপাড়া, ভদ্রক এবং জগৎসিংপুর জেলায় প্রবল বৃষ্টি হয়েছে। তার সঙ্গে ছিল ঝোড়ো হাওয়া। সেই প্রবল ঝড়ে বিপর্যস্ত হয়েছে ওড়িশার বিস্তীর্ণ এলাকা। ঝড়ে গাছ উপড়ে বন্ধ হয়েছে বহু রাস্তা। ১১০ কিমি বেগে ঝড় বইছে উপকূলবর্তী এলাকায়।
হাওয়া অফিস সূত্রে খবর, বৃহস্পতিবার রাত ১১টা ১২ মিনিটে ল্যান্ডফলের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পূর্বাভাস মতোই ধামড়া এবং ভিতরকণিকার মাঝামাঝি এলাকায় আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় ডানা। প্রায় ৯ ঘণ্টা ধরে ল্যান্ডফলের প্রক্রিয়া চলেছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া দপ্তর। শুক্রবার সকাল আটটা পর্যন্ত ল্যান্ডফল হয়েছে ‘ডানা’র। আছড়ে পড়ার সময়ে ১১০ কিমি বেগে ঝড় হয়েছে বাংলা এবং ওড়িশার উপকূলবর্তী এলাকাগুলোতে। তবে আশার কথা, তেমন মারাত্মক কোনও ক্ষয়ক্ষতির খবর মেলেনি এখনও পর্যন্ত।
আরও পড়ুন: কখন কমবে ডানার দাপট? কোন জেলায় শনিবারও ভারী বৃষ্টি?
তবে ‘ডানা’র ল্যান্ডফলের জেরে ওড়িশায় প্রচুর গাছ ভেঙে পড়ার খবর মিলেছে। ধামড়ার একাধিক এলাকায় গাছ পড়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছে রাস্তা। তবে ইতিমধ্যেই উপড়ে পড়া গাছ কাটার কাজ শুরু হয়েছে সেখানে। ভুবনেশ্বরে বসে পরিস্থিতির দিকে নজর রেখেছেন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী মোহন চরণ মাঝি। ল্যান্ডফল শেষে বিপর্যয় মোকাবিলা মন্ত্রী এবং মুখ্যসচিবের সঙ্গে বৈঠকেও বসেছেন তিনি। ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ার পর থেকেই প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে ওড়িশার একাধিক জেলায়। যতদূর জানা গিয়েছে, ওড়িশার চাঁদবালিতে বৃষ্টি হয়েছে ১৪৫.৮ মিলিমিটার, ভুবনেশ্বরে ২০.৪ মিলিমিটার, বালেশ্বরে ৪৪.৮ মিলিমিটার ও পারাদ্বীপে সকাল ৭টা অবধি বৃষ্টি হয়েছে ৭৬.৪ মিলিমিটার।
এর আগেও একাধিক বার ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপে পড়েছে ওড়িশা। ১৯৯৯ সালে সুপার সাইক্লোন হানা দিয়েছিল ওড়িশায়। ভয়ঙ্কর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল ওড়িশা জুড়ে। সেই সময় ক্ষমতায় নবীন পট্টনায়ক ক্ষমতায়। বিগত ২৫ বছর ধরে যত ঘূর্ণিঝড়, বিপদ হানা দিয়েছে সৈকতরাজ্যে, তিনি সামলেছেন দক্ষ হাতে। কিন্তু চলতি বছর সরকার বদলেছে ওড়িশায়। এখন ক্ষমতায় বিজেপি সরকার। ওড়িশার নতুন মুখ্যমন্ত্রী মোহন মাঝিও অবশ্য় দক্ষতার সঙ্গেই নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন। কার্যত নবীনের ব্যাটন নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন তিনি।
ওড়িশা সরকারের তরফে শুক্রবার জানানো হয়েছে, ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার বেগে ওড়িশায় ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’ তাণ্ডব চালালেও কোনও প্রাণহানির খবর মেলেনি। মুখ্য়মন্ত্রী মোহন মাঝি জানান, “প্রশাসনিক নজরদারি এবং প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির কারণে কারও মৃত্যু হয়নি। সরকারের লক্ষ্য ছিল, আমরা কাউকে মারা যেত দেব না। আমরা কথা রাখতে পেরেছি।” ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী জানান, ডানার হানায় ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নামে প্রশাসন। ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রাণহানি রুখতে আগেই ৮৩২২টি সাইক্লোন সেন্টার প্রস্তুত রেখেছিল ওড়িশা প্রশাসন। বৃহস্পতিবার রাত ১০টার মধ্যে দুর্গতদের অন্তত ৬০০৮টি সেন্টারে রাখা হয়। সেখানে জল, ওষুধ, খাবার-সহ প্রয়োজনীয় সব জিনিসের ব্যবস্থা করা হয়। শুধুমাত্র বালাসোর থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে আনা হয় প্রায় ১ লক্ষ ৭৩ হানার মানুষকে। ময়ুরভঞ্জ জেলায় এই সংখ্যাটা ছিল প্রায় এক লক্ষ। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আমাদের লক্ষ্য ছিল দুর্যোগপূর্ণ এলাকা থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষকে ত্রাণ শিবিরে নিয়ে আসা। ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসতে আমরা সফল হয়েছে। যার জেরে শুক্রবার পর্যন্ত ডানার দাপটে কোনও প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি। মুখ্যমন্ত্রী এ-ও জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যাতেই ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় তাঁর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার কী কী পদক্ষেপ করেছে, তা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে জানানো হয়।
ডানা-র প্রভাবে ধামারা বন্দর সংলগ্ন গ্রামগুলিতে তো বটেই, ভদ্রক এবং অন্য উপকূলবর্তী এলাকাগুলিতেও গাছ উপড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। শুক্রবার বেলা থেকে গাছ সরিয়ে রাস্তা পরিষ্কারের কাজে নেমেছে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী (এনডিআরএফ)। উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে এখনও উত্তাল রয়েছে সমুদ্র। রয়েছে ঝড়ের প্রভাবও। জোয়ারের সময় জলোচ্ছ্বাস শুরু হলে উপকূলবর্তী নিচু এলাকাগুলি জলমগ্ন হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতির হিসাব সামনে আসতে কিছুটা সময় লাগবে বলে ওড়িশা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে।
আরও পড়ুন: ‘বুলবুল’, ‘হুদহুদ’, ‘ফণি’ পেরিয়ে এবার ‘ডানা’! কেন বারবার ঘূর্ণিঝড়ের হানা জগন্নাথধামে?
এদিকে ওড়িশায় ঘূর্ণিঝড়ের ভয়ঙ্কর তাণ্ডবের মধ্যেই সেখানে ত্রাণশিবিরে ভূমিষ্ঠ হয়েছে ১৬০০ নবজাতক। দুর্যোগের মধ্যেই এই সুখবর প্রকাশ্যে এনেছেন খোদ ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী মোহন চরণ মাঝি। ডানার আছড়ে পড়ার খবর পাওয়ার পরেই ওড়িশা জুড়ে শুরু হয়ে গিয়েছিল প্রস্তুতি। উপকূলবর্তী এলাকা থেকে অন্তত ৬ লক্ষ মানুষকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় নিরাপদ আশ্রয়ে। এই তালিকায় ছিলেন ৪ হাজার ৫০০ গর্ভবতী মহিলাও। যার মধ্যে ১৬০০ জন সন্তান প্রসব করেন। বৃহস্পতিবার যখন বাইরে তাণ্ডব দেখাচ্ছে ডানা, সেসময় আশ্রয়শিবিরে এক প্রসূতির হঠাৎই প্রসববেদনা ওঠে। দুর্যোগ উপেক্ষা করেই রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সদস্যেরা সেই মহিলাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, মহিলার পুত্রসন্তান হয়েছে। মা এবং সন্তান দু’জনেই সুস্থ। যে ভাবে মহিলাকে দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়, সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তাঁর স্বামী এবং পরিবারের অন্য সদস্যেরা। ডেনা’র তাণ্ডবের মধ্যে সন্তানের জন্ম হওয়ায় ওই দম্পতি নবজাতকের নাম রাখেন ‘ডানা’। ধ্বংসের মধ্যেই কীভাবে লুকিয়ে থাকে সৃষ্টির বীজ, সে কথাই যেন আরেকবার মনে করিয়ে দিয়েছে এই ঘটনা।