ফ্যাশন জগতে ঝড় তুলছে রেশম পদ্মের শাড়ি! কতটা সূক্ষ্ম কাজ জানলে অবাক হবেন

Lotus Silk: সাধারণ সিল্কের থেকে এর দাম দশ গুণ বেশি।

সিল্ক মূলত তৈরি হয় রেশমকীট থেকে, একথা সকলেরই জানা। নরম এই কাপড় বহু মানুষের অত্যন্ত পছন্দের। তাই আসল সিল্কের দামও বেশ ভালই। তবে দামে এই সিল্ককে গুণে গুণে দশ গোল দিতে পারে লোটাস সিল্ক। সেটা আবার কেমন সিল্ক? এর সঙ্গে কি আদৌ পদ্মের সম্পর্ক রয়েছে? নাকি স্রেফ একটা নাম! নাহ, কেবল নাম নয়। লোটাস সিল্ক সত্যিই তৈরি হয় পদ্মফুলের ডাঁটা থেকে পাওয়া আঁশ দিয়ে, যা খুবই নরম। ডাঁটি থেকে সুতো বের করাও একটা শিল্প। এই সুতোর তৈরি পোশাক পরলে শরীরে অদ্ভুত আরাম অনুভব হবে। তবে আরাম পেতে গেলে দাম তো দিতেই হবে। হ্যাঁ, সাধারণ সিল্কের থেকে এর দাম দশ গুণ বেশি।

ভারতের জাতীয় ফুল পদ্ম তার সৌন্দর্যের জন্যই ইখ্যাত (ইদানিং অবশ্য বিশেষ রাজনৈতিক খ্যাতিও জুটেছে)। কিন্তু পদ্মের মহিমা শুধু রূপেই নয়। পদ্ম থেকেই তৈরি হয় বিশ্বের সবচেয়ে দামি সিল্কও! পদ্মফুলের ডাঁটা থেকে সিল্ক তৈরি প্রথম মায়ানমারে (বার্মা) উদ্ভূত হয়েছিল এবং এখন ভিয়েতনামের ছোট আকারের কুটির শিল্প হিসেবে মহিলারা লোটাস সিল্ক বোনার কাজ করে। লোটাস শিল্পের বুনন আর পাঁচটা সাধারণ শাড়ির মতো নয়। সূক্ষ্মতার কারণে  কিছু বিশেষজ্ঞ শিল্পী দ্বারাই এই কাজ সম্ভব, তাই পদ্ম সিল্ক বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল কাপড়গুলির মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচিত হয়।

মায়ানমারে দেখা যায় লোটাস সিল্ক তৈরির ক্ষেত্রে ‘padonma kya’ নামক একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির পদ্মফুল ব্যবহার হচ্ছে। যা তুলনামূলকভাবে হাল্কা গোলাপি, বড় এবং সুগন্ধযুক্ত। এই পদ্মফুলের ডাঁটা সংগ্রহ করা হয় প্রধানত মায়ানমারের শান রাজ্যের ইনলে হ্রদ, মান্দালয় অঞ্চলের (সিন্টকায়িং টাউনশিপের) সুনিয়ে লেক, বাগো অঞ্চলের (থেগন টাউনশিপের) ইনমা লেক, ম্যাগওয়ে অঞ্চলের (সালিন টাউনশিপের) ওয়েথ এবং স্যালিন প্রাকৃতিক হ্রদ, সাগাইং অঞ্চলের ( তাজে টাউনশিপের) কান্দাউংগি হ্রদ থেকে। ভারতে, মণিপুরের বিষ্ণুপুর জেলায় অবস্থিত থাঙ্গা টংব্রাম গ্রামের বিজয়শান্তি টংব্রাম (২৮) লোকটাক হ্রদ থেকে সংগ্রহ করা পদ্মের কাণ্ড থেকে তন্তু তৈরি করে।

সিল্কের সুতোটি পদ্ম ফুলের কাণ্ড থেকে পাওয়া। তাই এই ফাইবার ১০০% 'animal cruelty-free'। এই বিরল টেক্সটাইলগুলি কম্বোডিয়ায় ওয়ার্কশপে বোনা হয়। এই রেওয়াজ কিন্তু ৫০০০ বছরেরও বেশি পুরনো৷ অবশ্য এই বিশেষ বুননের একচেটিয়া দক্ষতা  মূলত মহিলাদের মধ্যেই। অসীম ধৈর্যের সঙ্গে এই মহিলারা সূক্ষ্ম পদ্ধতিতে ফাইবারকে  সিল্কের সুতোতে রূপান্তর করার কাজ চালিয়ে যান।

আরও পড়ুন- পাতলা সুতির শাড়ি বিক্রি করে ৫০ কোটির ব্যবসা! দুই বাঙালি বোনের হাতে গড়া ‘সুতা বোম্বে’ তাক লাগাবে

যেভাবে এল এই শাড়ি

পদ্মফুল হিন্দু ও বৌদ্ধদের কাছে পবিত্র। এই ফুল শরীরের মন, আত্মা, জ্ঞান এবং শুদ্ধিকরণের প্রতীক। পৌরাণিক কাহিনি বলছে, পদ্মমূল রেশমের উৎপত্তি মায়ানমারে। পদ্ম ফুলের শাখা থেকে তন্তু সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯১০ সাল থেকে। মায়ানমার এবং কম্বোডিয়াতে সর্বপ্রথম এই তন্তু উৎপাদন শুরু হয়। মায়ানমারের মুয়াং তাই রাজ্যের কেন্দ্রে অবস্থিত ইনলে লেকে লোটাস ফাইবার প্রথম সংশ্লেষিত হয়।

মায়ানমারের ফান থি থুয়ানের পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রেশম তৈরি করে আসছে, বিলাসবহুল পোশাক তৈরির জন্য নিজেরাই রেশমপোকা থেকে থ্রেড তৈরি করছে এবং সংগ্রহ করছে। কিন্তু পদ্ম সিল্ক তৈরি করা ভিন্ন। লোটাস সিল্ক, ফুলের ফাইবার থেকে আসে; এটি কোনও প্রকার কীটের উপর নির্ভর করে না, এটি সম্পূর্ণ ভাবে হাত দিয়ে বোনা হয়। পদ্ম রেশম বিশ্বের অন্যতম বিরল ফ্যাব্রিক। তবে এই সিল্ক তৈরি করার কাজটি সহজ নয়। একটি স্কার্ফের জন্য পর্যাপ্ত পদ্ম রেশম সংগ্রহ করতে প্রায় দুই মাস সময় লাগে এবং চূড়ান্ত পণ্যটি উৎপাদনের ক্ষেত্রে নিয়মিত রেশমের চেয়ে ১০ গুণ বেশি ব্যয় হয়ে থাকে। ফানথি ফুয়ান নামে ভিয়েতনামের এক মহিলার চেষ্টায় সফল হয়েছে পদ্ম ডাঁটা থেকে সুতো বের করার কাজটি। বর্তমানে সেখানে কাজ করছেন বহু মানুষ। তবে সুতো বের করার কাজটি নেহাত সহজ নয়। অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে দক্ষতার সঙ্গে কাজটি করতে হয়। তা নাহলেই নরম আঁশ ছিঁড়ে যায়। ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়েতেই আর এই লোটাস সিল্কের নাম সীমাবদ্ধ নেই। এর নাম ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে।


সুতো তৈরির প্রক্রিয়া

পদ্মফুল থেকে এই সিল্ক তৈরি করার সবথেকে ভালো সময় হল এপ্রিল থেকে অক্টোবর। বেশ কয়েকটি ধাপে পদ্ম থেকে সুতা সংগ্রহ করে কাপড় প্রস্তুত করা হয়। প্রথমেই পদ্মের অনেকগুলো শাখাকে একত্রিত করা হয়। শাখাগুলোকে একসঙ্গে কেটে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ২০ থেকে ৩০টি ভাগে ভাগ করা হয়। তারপর এই ছোট অংশগুলোকে রোলিং প্রক্রিয়ায় সুতায় পরিণত করা হয়। সুতো আলাদা করার পর সুতোর জটকে বাশের তৈরি ঘূর্ণনযন্ত্রে ঘোরানো হয়।

সুতোগুলো পেঁচিয়ে যাওয়ার ভয় থেকে প্রতি ৪০ মিটার অন্তর বিরতি দেওয়া হয়। আবার নতুন সুতো নিয়ে চরকা কাটার প্রক্রিয়াটি শুরু হয়। পরে এই সুতো দিয়ে হাতে গড়া ‘লুম’ নামে এক ধরনের যন্ত্রে বোনা হয় কাপড়।

প্রতিটি কাপড় চওড়া হয় হয় প্রায় ২৪ ইঞ্চি মতো। একখণ্ড পরিপূর্ণ কাপড় তৈরিতে ১,২০,০০০ পদ্ম ফুলের শাখার প্রয়োজন হয়। পুরো কাজটি হাতে করা হয় বলে অনেক সময় লাগে আবার উৎপাদনের পরিমাও হয় কম। একখণ্ড লোটাস সিল্কের কাপড়কে ধরলে মনে হবে লিনেন এবং সিল্কের মিশ্রণ; হলুদাভ সাদা রঙ।

ফ্যান থি থুয়ানের ২০ জন কর্মীর একটি দল আছে যারা প্রতিদিন এই তন্তু তৈরি করে, যার ফলে তারা প্রতি মাসে ১০ থেকে ২০টি স্কার্ফ উৎপাদন করতে পারে। লাগাতার কাজ করলে ধাপে ধাপে এই আঁশ থেকে স্কার্ফ বানাতে সময় লাগে দুই মাস। একজন দক্ষ কর্মী দিনে দু'শো-আড়াইশো টি ডাঁটা থেকে আঁশ আলাদা করতে পারেন। যে কারণে সামগ্রিক ভাবে কাজটা খরচসাপেক্ষ। একটি পদ্ম সিল্কের স্কার্ফের দাম দুশো ডলারেরও বেশি। ভিয়েতনামে সাধারণভাবে আগাছা হিসাবেই জন্ম নেয় পদ্ম। ফ্যান থি থুয়ান রা ২০১৭ থেকে এই পদ্ম সিল্ক নিয়ে নানা গবেষণা শুরু করেছেন।

আরও পড়ুন- আজীবন সাদা শাড়ি, গলায় আঁচল, কেন এই পোশাক বেছে নিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর

আজকের ফ্যাশনে লোটাস সিল্কের জায়গা কোথায়?

পূর্বে মায়ানমার ও থাইল্যান্ডে বৌদ্ধ ধর্মের সাধুরা লোটাস ফেব্রিক থেকে তৈরি পোশাক পরিধান করতেন। সেই ঐতিহ্য ধরে রেখে এখনও অনেক সাধু ও ধার্মিকরা এই ফেব্রিকের পোশাক ব্যবহার করে থাকেন। এর খরচ বেশি হওয়ায় শুধুমাত্র স্বচ্ছল ব্যক্তিরাই এটি ব্যবহার করেন। ২০১২ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইউনেস্কো হস্তশিল্প প্রোগ্রাম আয়োজিত হয়।সেখানে লোটাস ফেব্রিক থেকে তৈরি পোশাকের নমুনা 'সিল অফ এক্সেলেন্স' পুরস্কার পায়।এর ফলে কারিগররা ঐতিহ্যবাহী দক্ষতা ও প্যাটার্ন ব্যবহার করে নতুন উদ্ভাবনী প্রক্রিয়ায় উৎপাদন বাড়ানোর উৎসাহ পান। পদক প্রাপ্তির পর লোটাস ফেব্রিক সমস্ত বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়।

লোটাস ফেব্রিক দেখতে লিনেন ও সিল্ক কাপড়ের মতো। ইতালিয়ান লাক্সারি ব্র্যান্ড 'লোরো পিয়ানা'-এর মালিক পিয়ের লুইজির নজরে এই ফেব্রিক আসে। এর বৈশিষ্ট্য ও সক্ষমতায় অভিভূত হয়ে তিনি এই ফেব্রিক সম্পর্কে আরও জানোট মায়ানমার যান। এরপর সব পর্যবেক্ষণ করে তিনি তার কোম্পানির জন্য এক মাসে ৫৫ গজ ফেব্রিকের অর্ডার করেন। বর্তমানে 'লোরো পিয়ানা'তে লোটাস ফেব্রিকের তৈরি জ্যাকেট বিক্রি করা হয় যার দাম ৫,৬০০ ডলার এবং জাপান ও ইউরোপের বড় বড় দেশগুলোতে এর খুব ভালো বাজারদর।

মায়ানমারের পাউ খান এলাকায় এখনও প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী প্রথা অনুসরণ করে লোটাস ফেব্রিক উৎপাদন করা হয়। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু পরিবর্তন এসেছে। বিশুদ্ধ লোটাস ফাইবার থেকে ফেব্রিক তৈরি অনেক বেশি ব্যয়বহুল হওয়ায় ফাইবারের সঙ্গে প্রায়শই তুলো অথবা সিল্ক মিশিয়ে ফেব্রিক প্রস্তুত করা হয়। উল্লেখ্য যে, লোটাস ফাইবার ১০০% সিল্কের সঙ্গে মিশে যেতে সক্ষম। অপরদিকে ১৫% লোটাস ফাইবার ও ৮৫% তুলা মিশ্রিত হয়ে নতুন ফাইবার উৎপাদনে সক্ষম। পাউ খান এলাকার মহিলারা ফ্লাইং শাটল লুম ব্যবহারের মাধ্যমে পরিষ্কার সিল্ক ও লোটাস ফাইবারকে একত্রিত করে বিভিন্ন উজ্জ্বল রঙ ও নকশার মাফলার তৈরি করে থাকেন। এসব মাফলার তারা নিজেদের এলাকায় পর্যটকদের কাছে বিক্রি করেন। এছাড়াও লোটাস ফেব্রিকের অন্যান্য উৎপাদনের একটা বড় অংশ জাপানে রপ্তানি করা হয়।

এছাড়াও বর্তমানে অনেক কোম্পানি  অনুসরণের পাশাপাশি লোটাস ফেব্রিককে অন্যান্য ভাবেও কাজে লাগাচ্ছে। যেমন, কম্বোডিয়া সামাতোয়া লোটাস টেক্সটাইলস কোম্পানিতে গবেষণার মাধ্যমে নিত্যনতুন ম্যানুফ্যাকচারিং পদ্ধতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। কারিগররা এখানে নিজস্ব উপায়ে লোটাস ফেব্রিক ব্যবহার করেন এবং নতুন নতুন ইকোফাইবার দ্বারা তা তৈরি করেন। আবার ভারতের হিরোজ ফ্যাশন প্রাইভেট লিমিটেড নামক কোম্পানি লোটাস ফেব্রিকের সঙ্গে হাইড্রোফোবিক ন্যানোপ্রযুক্তি সংযুক্ত করে একটি সাদা শার্ট তৈরি করে। অন্যান্য ধর্ম ব্যতীত উক্ত শার্টের আরেকটি বিশেষত্ব হল এর উপর কফি, কালি, রেড ওয়াইন বা অন্য কোনও তরল পড়লে এটি অন্যান্য পোশাকের মতো নোংরা হবে না। বরং শার্টের উপর দিয়ে তরল গড়িয়ে যাবে কিন্তু তা আগের মতোই পরিষ্কার থাকবে। শার্টটির মোট প্রোডাকশন খরচ ছিল ৫৮.৫০ ইউরো। এর প্রচারের জন্য তখন বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্পেইন করা হয় এবং ৮৫ ইউরো বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয়। সেইসাথে ফ্রি শিপিং এর ব্যবস্থাও করা হয়। বাজারের সঙ্গে সঙ্গে এর পরিবেশবান্ধবতাও একে বর্তমানে আভিজাত্যের এক অনন্য অনুষঙ্গ করে তুলছে বিশ্বজুড়ে।

More Articles