রবিশঙ্কর থেকে জাকির-মহাদেবন, গ্র্যামির মঞ্চে ভারতের ম্যাজিক

Year of India at Grammy Awards 2024: আজ থেকে নয়। গ্র্যামির মঞ্চে বছরের পর বছর ধরে ভারতীয় জাদু চলেছে। একের পর এক ভারতীয় প্রতিভা জয় করেছে ওই মঞ্চ। এবার সেই তালিকাতেই নয়া সংযোজন ফিউশন ব্যান্ড 'শক্তি'।

বিশ্ব সঙ্গীতের ভুবনে সবচেয়ে বড় পুরস্কার গ্র্যামি। আর সেই মঞ্চে এ বার আলো ছড়িয়েছে একদল ভারতীয়। তাঁরা প্রত্যেকেই কম বেশি পরিচিত মুখ ভারতীয় সঙ্গীত জগতের। তবে তাঁদের এই মিলিয়ে দিয়েছে একটি বিশেষ কাজ। ফিউশন ব্যান্ড 'শক্তি'-র হাত ধরে যেন একসঙ্গে হয়েছিল একগুচ্ছ গুণী মানুষজন। আর সেই ফিউশন ব্যান্ডের গ্লোবাল অ্যালবামই এনে দিয়েছে অনোন্য সম্মান। 'দিস মোমেন্ট' বলে সেই গ্লোবাল মিউজিক অ্যালবামের জন্য ৬৬তম গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডস জিতে নিয়েছেন বিখ্যাত তবলিয়া উস্তাদ জাকির হুসেন ও জনপ্রিয় সঙ্গীতকার-গায়ক শঙ্কর মহাদেবন। না, তাঁরা একা নন। জন ম্যাকলাফলিন, জাকির হুসেন, শঙ্কর মহাদেবন, ভি সেলভাগণেশ এবং গণেশ রাজাগোপালন— এই পাঁচ মাথা নিয়েই গড়ে উঠেছিল ফিউশন ব্যান্ড 'শক্তি'।

আজ থেকে নয়। গ্র্যামির মঞ্চে বছরের পর বছর ধরে ভারতীয় জাদু চলেছে। একের পর এক ভারতীয় প্রতিভা জয় করেছে ওই মঞ্চ। এবার সেই তালিকাতেই নয়া সংযোজন ফিউশন ব্যান্ড 'শক্তি'। 'দিস মোমেন্ট' নামে অ্যালবামটি বিশ্বমঞ্চে মুক্তি পেয়েছিল ২০২৩ সালের ৩০ জুন। যেখানে তবলাবাদকের ভূমিকায় ছিলেন উস্তাদ জাকির হুসেন, বেহালায় গণেশ রাজাগোপালন এবং অন্যান্য তালবাদ্যে ভি সেলভাগণেশ। গিটারে ছিলেন জন ম্যাকলাফলিন। আর এই ব্যান্ডের সবকটি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন অ্যালবামটিতে জনপ্রিয় সুরকার ও গায়ক শঙ্কর মহাদেবন। মোট আটটি গান রয়েছে এই অ্যালবামে। বেস্ট গ্লোবাল অ্যালবাম হিসেবে শিরোপাটি জিতে নিয়েছে 'দিস মোমেন্ট'। জানা গিয়েছে, গ্র্যামির মঞ্চে মনোনয়নের তালিকায় ছিলেন সুজ়ানা বাকা, বোকান্তে, ডেভিডো এবং বার্না বয়ের মতো সঙ্গীতশিল্পীরাও। তবে তাদেরকে ছাপিয়ে এই খেতাব জিতে নেন জাকির-শঙ্কররা।

আরও পড়ুন: এই নিয়ে বারো বার গ্র্যামি স্যালুট, ৮১ বছর বয়সে এসেও কীভাবে জনপ্রিয়তার শিখরে পল সাইমন

সঙ্গীতের আসলে কোনও দেশ-কাল-সীমানা হয় না। আর সে কথাই ফের একবার মনে করিয়ে দিল ৬৬তম গ্র্যামির মঞ্চ। গত ৪ ফেব্রুয়ারি লস অ্যাঞ্জেলসে বসেছিল গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডসের আসর। যেখানে চতুর্থবারের জন্য সঞ্চালকের ভূমিকায় ছিলেন বিখ্যাত কৌতুকশিল্পী ট্রেভর নোয়া। সেখানে মোট তিনটি গ্র্যামি খেতাব এবার জিতে নিয়েছেন উস্তাদ জাকির হুসেন। একটি শক্তি ব্যান্ডের জন্য তো বটেই, দ্বিতীয়টি নিজের সৃষ্টি 'পাশতো'-র জন্য। একই সঙ্গে গ্র্যামির মঞ্চে এবার খেতাব জিতে নিয়েছেন বিখ্যাত বংশীবাদক রাকেশ চৌরাসিয়া। সম্পর্কে কিংবদন্তী হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার ভাইপো তিনি। এই নিয়ে তিন বার গ্র্যামি জিতলেন জাকির, রাকেশের ঝুলিতে রয়েছে মোট দু'টি গ্র্যামি। তবে এই প্রথম বার গ্র্যামি জিতলেন শঙ্কর মহাদেবন। এ বছর মোট ছ'টি গ্র্যামি এসেছে ভারতবর্ষের ঝুলিতে। এ বছর অবশ্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটি গানও ছিল গ্র্যামির মনোনয়ন তালিকায়। তবে শেষপর্যন্ত লড়াইয়ে ছিটকে গিয়েছে সেই গান।

From Ravishankar to Zakir Hussain, Shankar Mahadevan,  How Indian Talent Won Big at the Grammys

তবে গ্র্যামির মঞ্চে কিন্তু এর আগেও একাধিক বার ম্যাজিক দেখিয়েছে ভারত। যে যাত্রা শুরু হয়েছিল আসলে ১৯৬৮ সালে বিখ্যাত সেতারবাদক রবিশঙ্করের হাত ধরে। সেই বছর 'ওয়েস্ট মিটস ইস্ট' অ্যালবামের জন্য খেতাব জিতে নেন রবিশঙ্কর। ১৯৭৩ সালে ফের অ্যালবাম অব দ্য ইয়ার হয় 'দ্য কনসার্ট অব বাংলাদেশ' নামে রবিশঙ্করের একটি লাইভ অ্যালবাম। এর মাঝখানে অবশ্য বেশ কয়েকবার বেশ কয়েকটি বিভাগে নমিনেশন পেয়েছিলেন বিখ্যাত বিখ্যাত পশ্চিমি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কনডাক্টর জুবিন মেহতা। তবে গ্র্যামির শিকে ছেঁড়েনি কপালে। সেই স্বপ্নপূরণ হল ১৯৮১ সালে। বেস্ট ক্ল্যাসিক্যাল পারফর্মেন্স বিভাগে খেতাব জেতেন জুবিন। শুধু একটি নয়, সে বছর বেস্ট ইঞ্জিনিয়ারড রেকর্ডিং বিভাগেও গ্র্যামি জেতেন তিনি। 'আইস্যাক স্টার্ন সিক্সিটিয়েথ অ্যানিভার্সারি সেলেব্রেশন' অ্যালবামটির জন্যই মিলেছিল দু'টি খেতাব। সে বছর আরও দু'টি বিভাগে নমিনেশন পেয়েছিলেন জুবিন। ১৯৮২ সালে ফের বেস্ট ক্ল্যাসিক্যাল ভোকাল সোলোইস্ট পারফর্মেন্স বিভাগে গ্র্যামি জেতেন জুবিন। ১৯৯০ সালে ফের দুটি বিভাগে গ্র্যামি জিতেছিলেন জুবিন। একটি ছিল বেস্ট ক্ল্যাসিক্যাল পারফর্মেন্স, ইনস্ট্রুমেন্টাল সোলোইস্ট (উইদ অর্কেস্ট্রা) এবং অন্যটি বেস্ট ক্লাসিক্যাল ভোকাল পারফর্মেন্স। সবচেয়ে বেশিবার গ্র্যামির মঞ্চে মনোনয়ন পাওয়া ব্যক্তি বোধহয় জুবিনই।

১৯৯১ সালে কিন্তু প্রথম বার গ্র্যামি জিতেছিলেন উস্তাদ জাকির হুসেন। বেস্ট ওয়ার্ল্ড মিউজিক অ্যালবাম বিভাগে টি এইচ বিনায়াক্রমের সঙ্গে যৌথভাবে ওই অ্যাওয়ার্ডটি জেতেন জাকির। সেটি মিলেছিল 'প্ল্যানেট ড্রাম' অ্যালবামের জন্য। ১৯৯২ সালে ওই একই বিভাগে একই অ্যালবামের জন্য গ্র্যামি জেতেন বিশ্ব মোহন ভাট। এরপর গ্র্যামি মঞ্চে অনেকদিনের খরা ভারতের। ২০০২ সালে সেই খরা কাটল ফের রবিশঙ্করের হাত ধরে। বেস্ট ওয়ার্ল্ড মিউজিক অ্যালবাম বিভাগে জিতে নেন তিনি সেই সম্মান।

From Ravishankar to Zakir Hussain, Shankar Mahadevan,  How Indian Talent Won Big at the Grammys

২০০৮ সালে গ্র্যামির মঞ্চ মাতল রহমান-ম্যাজিকে। 'স্লামডগ মিলিনিয়র' সিনেমার জন্য 'বেস্ট কমপ্লিয়েশন সাউন্ডট্র্যার অ্যালবাম' বিভাগে এইচ শ্রীধর, পিএ দীপকের সঙ্গে গ্র্যামি জেতেন এআর রহমান। ওই বছরই 'বেস্ট সং রিটেন ফর ভিস্যুয়াল মিডিয়া' বিভাগে একই সিনেমার জন্য গুলজার ও তনভি শাহের সঙ্গে ফের খেতাব জেতেন রহমান। সেই বছর বেস্ট কনটেম্পোরারি ওয়ার্ল্ড মিউজিক অ্যারবাম বিভাগে আরও একটি গ্র্যামি জেতেন উস্তাদ জাকির হুসেন তাঁর 'গ্লোবাল ড্রাম প্রজেক্ট'-এর জন্য।

২০১৩ সালে ফের গ্র্যামি জেতেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। সে বছর গ্র্যামির মঞ্চ লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট দেয় তাঁকে। একই সঙ্গে বেস্ট ওয়ার্ল্ড মিউজিক অ্যালবাম বিভাগেও আরও একটি গ্র্যামি জেতেন রবিশঙ্কর তাঁর 'দ্য লিভিং রুং সেশন পার্ট ওয়ান' অ্যালবামের জন্য। ২০১৫ সালে বেস্ট নিউ এজ অ্যালবামের জন্য গ্র্যামি জেতেন ভারতীয় সঙ্গীতকার রিকি কেজ, তাঁর 'উইন্ডস অব সামসেরা' অ্যালবামের জন্য। ওই বছরই বেস্ট চিলড্রেন'স অ্যালবাম বিভাগে নীলা ভাস্বানী। ২০২২ সালে বেস্ট নিউ এজ অ্যালবাম বিভাগে পিএ দীপক, রিকি কেজ ও স্টিওয়ার্ট কোপল্যান্ড তাঁদের 'ডিভাইন টাইডস' অ্যালবামের জন্য খেতাব জেতেন। ২০২২ সালে বেস্ট চিলড্রেনস মিউজিক অ্যালবাম বিভাগে গ্র্যামি জেতেন ফাল্গুনি শাহ।

আরও পড়ুন:মাত্র কয়েক ঘণ্টায় ‘পথের পাঁচালি’-র সুর সৃষ্টি করেছিলেন রবিশঙ্কর!

তবে এর মধ্যে অসংখ্য আরও ভারতীয় সঙ্গীতকারেরা মনোনীত হয়েছেন গ্র্যামির মঞ্চে। তাঁদের কাজ, সঙ্গীত বিশ্বমঞ্চে প্রশংসিত হয়েছে। ২০২২-র পর ফের ২০২৩ সালে গ্র্যামির মঞ্চে জয়জয়কার ভারতের। আর এ বছরের সবচেয়ে বড় পাওয়া বোধহয় শঙ্কর মহাদেবন ও পণ্ডিত জাকির হুসেনের এই সম্মান। নিজস্ব সঙ্গীত ও সংস্কৃতির জন্য বরাবরই বিশ্বমঞ্চে নন্দিত হয়েছে ভারত। আর সেই সম্মানকেই আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিল গ্র্যামির মঞ্চে সাম্প্রতিক এই খেতাব।

 

More Articles