ক্লাস টু-এর ইংরেজিও পড়তে পারে না গ্রামীণ ভারতের ছেলেমেয়েরা! বিস্ফোরক তথ্য সমীক্ষায়
ASER 2023: প্রতি বছর প্রথম ফাউন্ডেশন এই সমীক্ষা চালিয়ে একটি বিস্তারিত বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ করে। ২০২৩ সালও তার ব্যতিক্রম ছিল না। আর সেখানেই ধরা পড়েছে শিক্ষার এই দুরবস্থার কথা।
দেশে মন্দির তৈরি হচ্ছে। সামনেই তার উদ্বোধন। তার জন্য সাজো সাজো রব দেশে। তার পরেই বাজেট ঘোষণা, তার পরেই ভোট। গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় উৎসব। ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় হাতে হাতে মোবাইল, তাতে দ্রুততম ইন্টারনেট পরিষেবা, তা পৌঁছে গিয়েছে দেশের প্রায় প্রতিটি কোণায়। শহরাঞ্চল থেকে গ্রাম, বাদ যায়নি কিছুই। কিন্তু শিক্ষা। ফাইভ-জি-র মতো আদৌ কি তা পৌঁছেছে দেশের সবজায়গায়? অ্যানুয়াল স্ট্যাটাস অব এডুকেশন রিপোর্ট (ASER) ২০২৩ তো বলছে অন্য কথা। দেখা যাচ্ছে, এ দেশের অধিকাংশ গ্রামীণ এলাকাগুলির ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সের অন্তত ৪২ শতাংশ কিশোর-কিশোরীই ভালো করে ইংরেজি পড়তে জানে না। না, কোনও কঠিন ইংরেজি বিদ্যা নয়। সাধারণ থেকে সাধারণতম বাক্যও পড়তে পারে না তারা ইংরেজিতে।
গত বছরে একটি ভিডিও খুব ভাইরাল হয়েছিল। বিহারের একটি কিশোরকে কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে সে অদ্ভুত সব অভিব্যক্তি করে। প্রিয় বিষয় জিজ্ঞেস করলে বলে বলে পছন্দের সবজির নাম। সেই ভিডিও দেখে হেসে লুটোপুটি হয়েছিল গোটা দেশ। কিন্তু এই ভিডিওর নেপথ্যে নির্মম একটা সত্য রয়েছে। আর সেটা হল এ দেশের অধিকাংশ প্রত্যন্ত অঞ্চলেই শিক্ষার আলো ঠিক মতো পৌঁছতে পারছে না। কোভিডকালীন সময়ে গ্রামীণ এলাকার বহু ছেলেপুলেই পড়াশোনা ছেড়ে জীবিকার খোঁজে বেরিয়ে পড়েছিল। কোভিড কাটলেও স্কুলে কি আদৌ ফেরা হয়েছে তাঁদের। সে খবর রাখে না কেউ।
আরও পড়ুন: জোম্যাটো, সুইগির ডেলিভারি কর্মীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কী? স্তম্ভিত করবে সমীক্ষা…
গত বুধবার ASER-২০২৩-র বাৎসরিক রিপোর্ট। ২৬টি রাজ্যের প্রায় ২৮টি জেলায় চালানো হয় সমীক্ষা। চোদ্দ থেকে আঠেরো বছর বয়সী অন্তত ৩৪,৭৪৫ জন পড়ুয়ার কাছে পৌঁছেছিলেন সমীক্ষকেরা। প্রতিটি রাজ্যের একটি করে প্রত্যান্ত থেকে প্রত্যন্ততর এলাকায় সমীক্ষা চালানো হয়। উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে সমীক্ষকেরা পৌঁছেছিলেন দুটি প্রত্যন্ত এলাকায়।
প্রতি বছর প্রথম ফাউন্ডেশন এই সমীক্ষা চালিয়ে একটি বিস্তারিত বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ করে। ২০২৩ সালও তার ব্যতিক্রম ছিল না। আর সেখানেই ধরা পড়েছে শিক্ষার এই দুরবস্থার কথা। দেখা গিয়েছে, অন্তত ২৫ শতাংশ পড়ুয়াই তাদের আঞ্চলিক ভাষায় দ্বিতীয় শ্রেণির ভাষাই সাবলিল ভাবে পড়তে পারে না। অর্ধেকের বেশি পড়ুয়াই ভাগের অঙ্ক কষতে সমস্যার মুখোমুখি হয়। ১৪-১৮ বছর বয়সীদের মধ্যে ৪৩.৩ শতাংশ এই ধরনের সমস্যাগুলি সমাধান করতে পেরেছে। অথচ এই দক্ষতা তো তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণিতেই হয়ে যাওয়ার কথা।
আঞ্চলিক ভাষা ও অঙ্কের মতো বিষয়েই এই অবস্থা যেখানে, সেখানে ইংরেজির অবস্থাটা যে কী, সেটা বোধহয় আঁচ করা খুব শক্ত নয়। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ৫৭.৩ শতাংশ কষ্ট করে ইংরেজি বাক্য পড়তে পেরেছে। কিন্তু তার তিন চতুর্থাংশই সেই বাক্যের অর্থ বলতে পারেনি। প্রাথমিক পর্যায়ের ইংরেজি সহজ সহজ বাক্যও পড়তে রীতিমতো সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে পড়ুয়ারা।
তবে এত সব নৈরাশ্যের মধ্যেও একটা আশার কথা অবশ্য আছে। এই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ছেলেদের থেকে শিক্ষাঅর্জনের ক্ষমতায় এগিয়ে এসেছে মেয়েরা। দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৭৬ শতাংশ মেয়ে আঞ্চলিক ভাষায় দ্বিতীয় শ্রেণী স্তরের পাঠ্য পড়তে পেরেছে। পুরুষেরা সেখানে ৭০.৯ শতাংশ। তবে তার মধ্যেই এ ব্যাপারে ছেলেদের চেয়ে বেশি দক্ষতা দেখাতে পেয়েছে মেয়েরা। তবে পাটিগণিত এবং ইংরেজি বাক্য পড়ায় বেশি ভালো ফল করেছে ছেলেরা। কোনও বস্তুর স্কেল দিয়ে দৈর্ঘ্য-প্রস্থ মাপার বিষয়েও সফল হয়েছে মাত্র ৮৫ শতাংশ পড়ুয়া। তবে সেটা তখনই, যখন বস্তুটিকে স্কেলের 'শূন্য' চিহ্নতে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। বস্তুটিকে স্কেলের অন্য কোথাও সরিয়ে দিলেই সঠিক উত্তর দিতে পারেনি অন্তত ৪০ শতাংশ পড়ুয়া। এক প্যাকেট ওআরএস সলিউশনের প্যাকেটের উপর লেখা নির্দেশাবলী পড়তে পেরেছে মাত্র ৬৫.১ শতাংশ পড়ুয়া। তেমনটাই জানাচ্ছে রিপোর্ট।
মোটামুটি যা দেখা যাচ্ছে, এ দেশের বহু শিক্ষার্থীই শেখার ক্ষেত্রে পিছনে থেকে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হোঁচট খাচ্ছে ব্যবহারিক জীবনের জন্য জরুরি শিক্ষাতেও। ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি (NEP 2020) অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, সেই সব গ্রামীণ এলাকাদের পিছিয়ে পড়া পড়ুয়াদের শিক্ষায় আরও বেশি করে জোর দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে । কিন্তু বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় সেই সুযোগ কি আদৌ রয়েছে! সবচেয়ে বড় কথা, সেই তৎপরতা কি দেখাবে দেশের সরকার।
আরও পড়ুন: কত শিশু ঘুরছে ভারতের রাস্তায়? পৃথিবীর বৃহত্তম শিক্ষাব্যবস্থায় অবাক করবে যে তথ্য
দেশের প্রতিটা মানুষের হাতে হাতে স্মার্টফোন, ইন্টারনেট তো পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু তার সঠিক ব্য়বহারিক প্রয়োগ হচ্ছে কি! এই সব গ্রামীণ এলাকায় ডিজিটাল সচেতনতা গড়ে তোলা হচ্ছে কি! এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর আদৌ রয়েছে কি সরকারের কাছে। নিম্নবুনিয়াদি শিক্ষার অধিকার তো এ দেশের সমস্ত শিশুর। আর সেই শিক্ষাটুকু পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু মন্দির, ভোট এসবের পরে সেই সময়টুকু কি আদৌ দেশের সরকার বা প্রশাসনের রয়েছে! প্রশ্নটা থেকেই যায়।