ধ্রুব রাঠী, রভীশ কুমাররা পারেন, বাংলার ইউটিউবাররা পারেন না কেন?
Dhruv Rathee Ravish Kumar: ধ্রুব রাঠী বুঝতে পেরেছিলেন, শুধু হিন্দিতে নয় বিভিন্ন ভাষায় তাঁর ভিডিওকে পৌঁছতে হবে। তাই তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের সাহায্য নিয়েছিলেন।
এবারের নির্বাচন শুধু বিজেপির বিরুদ্ধে রায় নয়, প্রচলিত গণমাধ্যমের বিরুদ্ধেও রায়। গত দশ বছরে, যেভাবে সমস্ত মূল ধারার গণমাধ্যম এই আখ্যান তৈরির চেষ্টা করেছে যে নরেন্দ্র মোদির কোনও বিকল্প নেই, বিজেপির কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে অন্য ধারার সাংবাদিকতাও সম্ভব তার বহু উদাহরণ আমরা পেয়েছি কিন্তু এই গত দশ বছরেই। তারই প্রভাবও স্পষ্টভাবেই পড়েছে এবারের নির্বাচনে।
সারা দেশে মূলত হিন্দি ভাষায়, যত ধরনের বিকল্প সাংবাদিকতার চেষ্টা দেখা গেছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। শুধু সাংবাদিকতা নয়, বিভিন্ন ইউটিউবার, বিভিন্ন লোকগায়ক, স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ানরা এই কাজ নিরলসভাবে করেছেন। যেহেতু বিজেপির শক্তি হিন্দি বলয়ে বেশি, সেই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে বিজেপির চিন্তাভাবনার অনুপ্রবেশ অনেকটাই বেশি, তাই মূলত হিন্দি ভাষাতেই গেরুয়া বাহিনীর বিপ্রতীপ মতাদর্শও প্রচারিত হয়েছে। দ্য ওয়ার, নিউজলন্ড্রি, নিউজক্লিক, ই-নিউজরুম, অল্ট নিউজ, নিউজ লঞ্চারের মতো ছোট ছোট সংবাদ সংস্থা যেমন একাধারে ইংরেজিতে অনুষ্ঠান করেছেন, পাশাপাশি তারা হিন্দিতেও অনুষ্ঠান করেছেন, খবর করেছেন। কখনও সেই অনুষ্ঠানগুলোতে ঘটনার বিশ্লেষণ থেকেছে, কখনও সেই অনুষ্ঠানে শুধু খবরও থেকেছে। নির্বাচনের আগে রীতিমতো ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ, ছোট অ্যানিমেশন ভিডিও সবই পাওয়া গেছে। উদ্দেশ্য একটাই, বিজেপির বিরুদ্ধে প্রচারকে শক্তিশালী করা।
এই ধরনের ছোট ছোট সংবাদ মাধ্যমের পাশাপাশি বেশ কিছু ইউটিউবাররা নিজেদের মতো করে তাঁদের বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে প্রচার করেছেন। তার মধ্যে যেমন রয়েছেন বেশ কিছু সাংবাদিক, যাঁরা একসময়ে নানা বড় সংবাদসংস্থায় কাজ করেছেন, আবার রয়েছেন বেশ কিছু সমাজকর্মী, স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান, লোকগায়ক এবং সাধারণ মানুষও। এঁদের মধ্যে একটাই মিল, এঁরা প্রত্যেকেই জানতেন এবং এখনও মনে করেন, বিজেপিকে যদি পরাজিত না করা যায়, নরেন্দ্র মোদিকে যদি একটু হলেও ধাক্কা না দেওয়া যায়, তাহলে ভারতবর্ষের ধারণাটাই ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন- মোদির শপথগ্রহণে কেন ডাক পেলেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?
নির্বাচন যত এগিয়েছে, তত বেশি করে এই ধরনের ভিডিও চোখে পড়েছে। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম অবশ্যই ধ্রুব রাঠী, রভীশ
কুমার। রভীশ দেশের বিখ্যাত সাংবাদিক। তিনি সম্প্রতি তাঁর বার্তা পৌঁছে দিতে ইউটিউবকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছেন। একটি বিশেষ কারণে ধ্রুব রাঠীর কাজকে বাহবা দিতেই হয়। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, শুধু হিন্দিতে নয় বিভিন্ন ভাষায় তাঁর ভিডিওকে পৌঁছতে হবে। তাই তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের সাহায্য নিয়েছিলেন। বাংলা থেকে শুরু করে তামিলনাডু এবং কেরলেও তাঁর তৈরি ইউটিউব ভিডিও দেখা হয়েছে। তাঁর দর্শক সংখ্যা এবং তাঁর ভিডিওর ভিউ ক্রমশ বেড়েছে। বাংলার কৃষ্ণনগরের একটি কলেজের বাইরে ছাত্রছাত্রীদের তাঁর বাংলা ভিডিও দেখানো হচ্ছে এমন উদাহরণও দেখা গেছে।
ধ্রুব রাঠী বুঝতে পেরেছিলেন শুধু হিন্দি বলয়ে নয়, নরেন্দ্র মোদি এবং সঙ্ঘ পরিবার বিভিন্ন রাজ্যে তাদের প্রভাব বাড়িয়েছে। তাই যদি তার বিরোধিতা করতেই হয়, তাহলে বিভিন্ন রাজ্যের ভাষাতেই করতে হবে। ধ্রুব রাঠী যেভাবে ভাবতে পেরেছিলেন, বাংলার কেউ কি ভেবেছিলেন এইভাবে? অবশ্যই ভেবেছিলেন এবং বহু বিষয়বস্তু তৈরিও হয়েছে এই বাংলাতেই। তাও একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, বাংলায় তৈরি নানা ভিডিও বা লেখাপত্র কি ততটা মানুষের কাছে পৌঁছেছে, যতটা ধ্রুব রাঠী কিংবা রভীশ কুমার বা অন্যান্যদের ভিডিও পৌঁছেছে?
প্রথমত কিছু কথা মেনে নিতেই হবে। ধ্রুব রাঠী কিংবা রভীশ কুমারের ভিডিও কিন্তু সাধারণভাবে মানুষের কাছে পৌঁছয়নি, তাঁদের দর্শক সংখ্যা এমনি এমনিই বেড়ে যায়নি, তাদের পিছনে আম আদমি পার্টির এবং কংগ্রেসের সচেতন প্রয়াস ছিল। বাইরে থেকে ততটা বোঝা না গেলেও এই প্রয়াস ছিল বেশ তীব্র। এমনটা নয় যে সমস্ত ভিডিও কংগ্রেস কিংবা আপের প্রথম সারির নেতারা নিজেরা নিজেদের এক্স কিংবা সামাজিক মাধ্যমের অন্যান্য জায়গায় শেয়ার করেছেন। তা সত্ত্বেও আম জনতা তা দেখেছে, ভিডিও শেয়ার হয়েছে, তার কারণ অবশ্যই বিষয়বস্তু এবং উপস্থাপনা। ভিডিওতে কখনই কংগ্রেস, আপ কিংবা ইন্ডিয়া জোটের অন্যান্য দলকে ভোট দেওয়ার কথা বলা হয়নি। ভিডিওতে ক্রমাগত বিজেপির বিপদ, ফ্যাসিবাদ এবং আজকের শাসকের মধ্যে মিল কোথায়, বা যে খবর প্রচলিত গণমাধ্যমে দেখানো হয় না, তা দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। নির্বাচনী বন্ডের টাকা কীভাবে শাসকদলকে সাহায্য করেছে এবং তার ফলে সাধারণ মানুষের কোথায় ক্ষতি হয়েছে তা সহজভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সমস্ত ভিডিওগুলোর মধ্যে বিজেপি, নরেন্দ্র মোদি এবং তাদের পেটোয়া গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে কথা বলা হয়েছে।
বিজেপির বিরুদ্ধে 'নেগেটিভ' প্রচারের কাজটাই হয়েছে রভীশ কুমার, ধ্রুব রাঠী এবং অন্যান্যদের ভিডিওগুলোর মধ্যে দিয়ে। ঠিক যেমন করে বাংলায়, ‘নো ভোট টু বিজেপি’-র প্রচার হয়েছিল, খানিক সেইরকম। বাংলার ক্ষেত্রে ২০২১ সালের পরে, এবারও ‘ডিফিট বিজেপি’-র ডাক দেওয়া হয়েছিল এবং বেশ কিছু মঞ্চ গড়ে উঠেছিল, যাঁরা সারা বাংলায় প্রচার করেছিল কিন্তু সেই প্রচার দেখে মনে হয়েছে এই প্রচার বকলমে তৃণমূলের হয়ে প্রচার। ২০২১ সালে ‘নো ভোট টু বিজেপি’-কেও অনেকেই তৃণমূলের স্বপক্ষে প্রচার বলেই মনে করেছিলেন কিন্তু তা দৃশ্যগতভাবে সেইসময় মনে হয়নি। এবারের প্রচার যতটা না নাগরিক সমাজের প্রচার মনে হয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি তৃণমূলের হয়ে প্রচার মনে হয়েছে।
আরও পড়ুন- কৃষক-ক্ষোভের আঁচ! যে যে ভুলে ৩৮টি আসন খোয়াতে হল বিজেপিকে?
যদিও তার মধ্যে ব্যতিক্রমী কিছু কাজও হয়েছে। বলতেই হয় বেশ কিছু ছোট ছোট ওয়েবপোর্টালের কথা। অন্যস্বর, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম,
গ্রাউন্ড জিরো, সহমন, ইনস্ক্রিপ্ট, নাগরিক, এককমাত্রা- এরা প্রত্যেকেই নিজের নিজের মতো করে চেষ্টা করেছেন। কেউ শুধুমাত্র লেখা প্রকাশ করেছেন, কেউ ভিডিও আলোচনা করেছেন। যে সময়ে বাংলার মূল ধারার সংবাদমাধ্যমে শুধু সান্ধ্যকালীন বিতর্কের নামে চিল চিৎকার হয়েছে, সেখানে ইনস্ক্রিপ্টের ‘বাংলা যা ভাবছে’ অন্যরকম বিতর্ক উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করেছে, যা অবশ্যই উল্লেখ করার
দাবি রাখে। প্রবীর বিশ্বাসের এনকেডিজিটাল, দীপক ব্যাপারীর বং নিউজ, ইক্রামুল বাগানীর ইনসাফ বাংলা, হঠাৎ যদি উঠল কথা এবং অবশ্যই অনিকেত চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাংলা বাজার’ নজর কেড়েছে। ইনস্ক্রিপ্টের ‘বাংলা যা ভাবছে’ এক অন্যরকম বিতর্কের পরিসর খুলে দিয়েছে। যখন সমস্ত বুথ ফেরত সমীক্ষা, বিজেপিকে বাংলায় বেশি আসন দিয়েছিল, সেখানে এই অনুষ্ঠানের আলোচকরা জোর গলায় বলেছিলেন, নরেন্দ্র মোদির বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। এনকে ডিজিটাল, বং নিউজ এবং অনিকেত চট্টোপাধ্যায়রাও বলেছিলেন, বাংলায় বিজেপির আশানুরূপ ফল হবে না। তবে এত কিছুর পরেও বলতে হয়, বাংলার ইউটিউব চ্যানেলগুলোকে আরও পেশাদারি দক্ষতা দেখাতেই হবে, আরও নিরপেক্ষ হয়ে কথা বলতে হবে। ভুলকে ভুল, ঠিককে ঠিক বলতে হবে। মাথায় রাখতে হবে বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবার কিন্তু শুধু উত্তর ভারত নয়, এই বাংলাতেও যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। শুধু নির্বাচনী অঙ্কে বিজেপির আসন কমে যাওয়া নিয়ে উৎফুল্ল হলে হবে না, বিজেপির ভোট শতাংশ কিন্তু প্রায় কিছুই কমেনি এবং সেটাই ভয়ের কারণ। এই রাজ্যের শাসকদের গণতন্ত্র বিরোধী অবস্থান, নানা দুর্নীতি কিন্তু বিজেপির উত্থানের রাস্তাকেই প্রশস্ত করছে প্রতিদিন। সোহম চক্রবর্তী থেকে শেখ শাজাহানদের বিরোধিতা করতে হবে প্রথমেই, না হলে মানুষ বিশ্বাস করবেন না এই ইউটিউব চ্যানেলগুলিকে।
বাংলার বুদ্ধিজীবিদের ভূমিকারও সমালোচনা করা জরুরি। এখানকার বুদ্ধিজীবি এবং নাগরিক সমাজের একাংশ কিন্তু তৃণমূলের ছত্রছায়ায় চলে গেছেন ফলে নাগরিক স্বরও স্তিমিত হয়েছে, তাঁদেরও গ্রহণযোগ্যতা কমেছে। বিজেপির বিপদ ঘাড়ের ওপর চেপে আছে যেমন, তেমনই তৃণমূলের বেশ কিছু অনিয়মের বিরোধিতা করতেই হবে। তা হলেই ভিন্নস্বর শোনা যাবে যা সরকারের স্বরের সঙ্গে মিশে যাবে না। সেখান থেকেই তৈরি হবে বাংলার কিছু নিজস্ব ইউটিউবার। মনে রাখতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বর আর তাদের পোষা
মিডিয়ার স্বর একই হয়ে গেছে বলেই হিন্দি বলয়ে রভীশ কুমার, ধ্রুব রাঠীদের উত্থান ঘটেছে। এখানেও রাজ্য সরকারের স্বর যদি বাংলার বুদ্ধিজীবি এবং নাগরিক সমাজের স্বর যদি এক হয়ে যায়, তাহলে নতুন নাগরিক সমাজ এবং তার ভিন্নতর স্বর শোনা শুধু সময়ের অপেক্ষা। কোনও ভাতা দিয়ে, অনুদান দিয়ে কিন্তু সেই স্বর বন্ধ করা যাবে না।